কৃষ্ণা সাত সকালে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকেই মেনকাকে জিজ্ঞেস করল, “দিদি কোথায়?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রায় ছুটে গিয়ে ঢুকল কুর্চির ঘরে। চা খেতে খেতে একটা বই নিয়ে বসেছিল কুর্চি। বিস্ফারিত চোখে কৃষ্ণা বলল, “সকালে বসন্তদা ফোন করে খবর দিল আজ ডাক্তারবাবু আসছেন ও বাড়িতে। আমি ভাবছি, এসে করবেন কী? জলটাও তো নিজে নিয়ে খেতে পারবেন না। জানেনই না কোথায় জল থাকে!”

কুর্চি খানিকটা ভাবল, তারপর বলল, “তুমি এক কাজ করো কৃষ্ণাদি। তোমার এখানকার রাজ্যপাট মেনকাদিকে বুঝিয়ে দিয়ে তুমি আজ ও বাড়িতেই থাকো। গিয়ে আগে দেখ বাড়িঘর সব সাফসুতরো আছে কিনা। বসন্তদার চোখ নেই। কোথায় ধুলো, কোথায় নোংরা বুঝতেও পারবে না। বাবা আবার ধুলোবালি সহ্য করতে পারে না। বসন্তদা খামোখা বকুনি খেয়ে মরবে। তুমি সবচেয়ে আগে ঘরদোর ঝকঝকে করে ফেল।”

-ডাক্তারবাবু আমাকে যদি বলেন, না বলে চলে গেলে কেন?

কুর্চি হাসতে হাসতে বলল, “কিচ্ছু বলবে না তোমাকে। বরং জিজ্ঞেস করতে পারে তুমি কে? তোমার নাম কী?”

-ওমা, নাম জিজ্ঞেস করবেন কী! এত বছর ধরে আমাকে দেখছেন! কতবার কৃষ্ণা বলে ডেকেছেন! কী বলো তুমি?

-বাবা ওই রকম। কাকে মনে আছে আর কাকে মনে নেই, কিচ্ছু বলা যবে না। হয়তো দেখলে নাম ধরেই ডাকল, তোমার ছেলেমেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করল। তাও হতে পারে।

কৃষ্ণা চিন্তিত মুখে বলল, “কিন্তু খাওয়াব কী? কিছুই তো নেই ও বাড়িতে।”

কুর্চি বলল, “সেটা তো সমস্যা নয়। টাকা নিয়ে যাও আমার কাছ থেকে। বসন্তদাকে দিয়ে হালকা কিছু বাজার করিয়ে নিও। চা-চিনিও কিনে রেখো। বাড়িতে থাকলে বাবা বারবার চা চাইতে পারে। কথা হল, কখন আসছে, ক’জন আসছে, রাতে থেকে যাবে কিনা, কিছুই তো জানি না। যদি দেখ অনেক লোক, সবাই বাড়িতেই খাবে, গোপালকে বলবে গুছিয়ে খাবার পাঠাতে। কিন্তু আমাকে ফোন করতে যেও না। ফোন করলেও পাবে না।”

-যদি তোমার কাছে আসতে চায়?

কুর্চি আবার হেসে ফেলল। বলল, “ভাবছ তোমাকে সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসতে বলবে? কেন? বাবা এ বাড়ি চেনে না নাকি? তুমি ওসব চিন্তা না করে বেরিয়ে পড়ো তো। দেখ বাবা কখন পৌঁছচ্ছে।”

কৃষ্ণাকে রওনা করিয়ে দিয়েই কুর্চি ছুটল দোতলায়। তার দাদু-দিম্মাকে সব জানিয়ে বলল, “তাহলে ওই কথাই রইল। জরুরি কাজে আমি যাচ্ছি কলকাতায়। কবে ফিরব ঠিক নেই। আমার ফোন বন্ধই থাকবে। যখন যা দরকার দিম্মাকে জানিয়ে আবার ফোন বন্ধ করে দেব। তোমাদের কিছু জানানোর থাকলে মেসেজ পাঠিও। আমি মাঝেমাঝেই ফোন চেক করতে থাকব।”

প্রজ্ঞান জানতে চাইলেন, “কোন ট্রেন ধরছিস?”

-এক্ষুনি বেরোতে পারলে মালদা ইন্টারসিটি পেয়ে যেতে পারি। না পেলে লোকাল ধরে বর্ধমান।

বেলভেডিয়ার নার্সিং হোমে পৌঁছতে পৌঁছতে অবশ্য ভিজিটিং আওয়ার শেষ। তবে ডাক্তার করকে হাসপাতালেই পেয়ে যাওয়ায় অরিত্রর কাছে যেতে কুর্চির অসুবিধে হল না। সকালের ফিজিওথেরাপি সেশন শেষ করে স্নান-টান সেরে ঘরের কোণের সোফায় বসে শরদিন্দু পড়ছিল অরিত্র। কুর্চিকে দেখে খুশি খুশি গলায় বলল, “কদ্দিন পরে এলে। আমাকে তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে!” শুনে এত জোরে হেসে উঠল কুর্চি যে নিজেই লজ্জা পেল। অরিত্রর মুখোমুখি সোফাটায় বসতে বসতে বলল, “সরি। দিন নেই রাত নেই, আমি পাঁইপাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছি, আর আমাকে নিয়েই চিন্তা হাসপাতালে বন্দি গোলকিপারের! শুনি, কিসের এত চিন্তা তোমার?”

-তার আগে তুমি বলো, কতক্ষণ থাকবে আজ?

-তোমার ঘুম না পেলে ঘন্টা দু’তিন তো থাকতেই পারি।

-তাহলে আগে তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করি। বলে নার্স ডাকার সুইচটা টিপল অরিত্র। কুর্চি ভাবছিল, সকাল থেকে তো জলখাবার খাওয়ার সময়টাও হয়নি। ট্রেনে এক ঠোঙা মুড়ি খেয়েছিল, সে কখন হজম হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কি তার মুখে লেখা আছে? অরিত্র বুঝল কী করে? ততক্ষণে অরিত্র নার্সকে বলে একটা গেস্ট মিলের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। কুর্চি বলল, “বাঃ, গোলকিপারের তো সব দিকে নজর! সারা মাঠ দেখতে পাচ্ছে। তাহলে হাসপাতালে আর কদিন? কী বলছেন ডাক্তার কর? কবে ছাড়বেন?”

-ধ্যাৎ! স্পষ্ট করে বলছেই না। রোজই বলছেন আর একটু দেখব, আর একটু দেখব। এদিকে ফোনটাও দিচ্ছে না। একটা মেয়েকে লাগিয়ে রেখেছেন। সে আপদ রোজ আমাকে কাউন্সেলিং করতে আসে। আমি বলছি, বাড়ি গেলে আমি অনেক তাড়াতাড়ি সেরে উঠব, মাঠে নামতে পারব। কিন্তু কে শুনছে আমার কথা?

-বাড়ি গিয়ে কী হবে? অরিত্রকে অবাক করে বলল কুর্চি। তার চেয়ে এখান থেকে বেরিয়ে মাকে নিয়ে তুমি শান্তিনিকেতনে চলো। আমি ভালো দেখে একটা বাড়ি খুঁজে দেব তোমদের জন্যে। খোলামেলা জায়গায় থাকবে। টাটকা শাকসবজি, মাছ, মাংস খাবে। বাগানে এক্সারসাইজ করবে, দৌড়োবে। বোলপুরে জিমে যাবে, চাইলে টাউন ক্লাবে প্র্যাকটিসও শুরু করতে পারবে।

জিম আর প্র্যাকটিসের কথা শুনে অরিত্রর মনে হল, হঠাৎ একটা কথার কথা বলছে না কুর্চি। ভেবেচিন্তে তৈরি হয়েই বলছে। হয়তো কিছু ব্যবস্থাও করে এসেছে। কিন্তু কুর্চির বাবা এসব অ্যালাও করবে নাকি? দেবুদা তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিল, মেরে মালাইচাকি ভেঙে দেবে। মালাইচাকি বেঁচে গেলেও, মাথা তো প্রায় ভেঙেই দিয়েছিল। গলা নামিয়ে কুর্চিকে বলল, “এসব ভেবোই না। তোমাকে কিচ্ছু করতে দেবে না তোমার বাবা।”

কুর্চি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, “কতটা জানো তুমি গোলকিপার? দেবুদা তোমাকে ঠিক কতটা বলেছে?” কিন্তু পরে এসব কথা আলোচনার অনেক সময় পাওয়া যাবে ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তোমার মনে আছে, সেদিন বলেছিলে আমি বাঘের খাঁচায় বন্দি?”

-বলেছিলাম, না? আমারও তাই মনে হচ্ছিল, তোমাকে খানিকটা যেন বলেছি।

-আর আমি কী বলেছিলাম, নিশ্চয়ই মনে নেই তোমার?

-না। একদম না। কী বলেছিলে?

-বলেছিলাম, আমি বাঘের খাঁচা থেকে পালিয়েছি।

-সত্যি! বাঘের নাগালের বাইরে?!

-একদম বাইরে!

“কী করে পারলে?” অরিত্রর চোখে একই সঙ্গে জিজ্ঞাসা আর বিস্ময় গভীর। কুর্চি অবশ্য সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসার আকুল আর্তিই দেখতে পেল। উঠে এসে বসল অরিত্রর সোফার হাতলে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল অরিত্রর গলা। ঠোঁট ডুবিয়ে দিল অরিত্রর ঠোঁটে। অরিত্রও তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ভাসল দিশেহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায়।

মন উজাড় করে কথা বলতে শুরু করল দু’জনে। কুর্চি বলল তার খাঁচা খুলে উড়ান দেওয়ার গল্প। অরিত্র সব শুনে বলল, “তবু তোমাকে নিয়ে আমার ভয়ের শেষ নেই কুর্চি। কখন যে তোমার কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে! মনে হয়, সব সময় যদি তোমার সঙ্গে থাকতে পারতাম।” কুর্চি ঘাড় বেঁকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অরিত্রর মুখের দিকে। উঠে এসে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে উল্টো দিকের সোফায় বসে চোখে একটা হাসির ঝিলিক নিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছেন ডাক্তার কর। চিকিৎসা মোটেই শেষ হয়নি। মাঠে কার কী পজিশন, গোলকিপার তো এখনও পুরোটা দেখতে পাচ্ছে না! কী বলছ, বাবা আমাকে বিপদে ফেলবে? ঠিক উল্টো। বাবা যা কিছুই করছে, আমাকে ভালোবেসে করছে। খুব বড় ভুল করেছে, অন্যায় অনৈতিক কাজ করেছে, কিন্তু আমার ভালোর কথা ভেবেই করেছে। বাবা আমাকে কোনও বিপদে ফেলবে না, বরং সব বিপদ থেকে বাঁচানোর চেষ্টাই করবে। বিপদ আমার নয় গোলকিপার, বিপদ তোমার। এবারের বিপদ কাটিয়ে যদি মাঠে ফিরতে পারো, কে বলতে পারে আর একটা বিপদ অপেক্ষা করছে না? অবস্থাটা পাল্টাতে কাজ শুরু করেছি আমি, কিন্তু তার ফল কী হবে কে জানে!”

-কী শুরু করেছ? নিষ্প্রভ গলায় জিজ্ঞেস করল অরিত্র।

-ভেতরে ভেতরে যে বাঘটাকে বাবা পুষছে এতদিন ধরে, সেটাকে পাল্টে মানুষ করে দেব বলে ঠিক করেছি। সোজা নয়, খুব শক্ত কাজ। কিন্তু আমার সামনে ওই একটা রাস্তাই খোলা।

একটু খুলে বলো, বলতে যাচ্ছিল অরিত্র। কিন্তু ঠিক তখনই ওদের খাবার এসে পৌঁছল ঘরে। অরিত্র ওর কথাটাকে গিলে ফেলল। খেতে খেতে ফোন খুলতেই মধুরার মেসেজ পেল কুর্চি। “মনে হচ্ছে তোর আর সুজাতর মুখোমুখি বসা দরকার।” কুর্চি একবার ভাবল ফোন করে তখুনি জিজ্ঞেস করে, কেন? বাবা কী বলল? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল, তাড়া কিসের? ঠিক সময়েই জেনে নেওয়া যাবে। খাওয়া শেষ করে অরিত্রকে বলতে শুরু করল ওর ছেলেবেলার কথা, অমলতাস আলোয় ঠাম্মার কাছে জাতকের গল্প শোনার কথা, পেয়ারা গাছের ডালে বুলবুলি আর কাঠবিড়ালির যুদ্ধের কথা, শকুন্তলা-দুষ্মন্তকে নিয়ে বাঁশের ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে অজয় পেরোনোর কথা, বুবুদির বাউল গানে ডুব দিয়ে অতল গভীরতায় আলো দেখতে পাওয়ার কথা, নরওয়ের রাজপ্রাসাদে অসলো ফিলহার্মোনিয়েনের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে শোনা বিঠোভেনের নাইন্থ সিম্ফনির কথা, বন্ধুদের ভেটকির পাতুরি খাওয়াতে গিয়ে মাছপোড়া খাওয়ানোর কথা, আরও কত কী! হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে বলল, “আর দেরি করলে বিশ্বভারতী ধরতে পারব না। মাকে বোঝাও, তোমার সবচেয়ে ভালো রিহ্যাব হবে শান্তিনিকেতনে।” বলে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।

ট্রেনে উঠেই মেসেজ করেছিল দাদু-দিম্মাকে। কিন্তু একটু লেট করল ট্রেন। কুর্চির বাড়ি পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। অপেক্ষায় ছিলেন মধুরা-প্রজ্ঞান। তিনজনের খাবার সাজাতে শুরু করল মেনকা। হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসেই কুর্চি জিজ্ঞেস করল, “আমাকে থাকতে দিয়েছ বলে রাগারাগি করেনি তো? খারাপ ব্যবহার করেনি তো তোমাদের সঙ্গে?” টক দই মেখে আলু-পোস্ত খাচ্ছিলেন প্রজ্ঞান রুটি দিয়ে। একটা আওয়াজ করলেন, আআআঃ। সেটা সুখাদ্যের প্রশস্তি, না প্রশ্নটিকে অবান্তর বলে নাকচ করা, ঠিক বুঝতে পারল না কুর্চি। তাকাল মধুরার দিকে। খুব নরম দৃষ্টিতে কুর্চির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “সুজাতও ভালো নেই রে। রাগ কোথায়, বরং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল তোর পাশে থেকেছি বলে। আর বলে গেছে, তোর সঙ্গে দেখা না করে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরবে না।”

-তার মানে কালও আমাকে সাত সকালে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে?

-কাল আবার যাবি কলকাতায়? এত ধকল সইবে তোর শরীরে?

-কেন? কলকাতা ছাড়া দুনিয়ায় যাবার মতো আর কোনও জায়গা নেই নাকি?

হুমমফফ। খেতে খেতে আবার একটা শব্দ করলেন প্রজ্ঞান। কুর্চি এবারও বুঝল না সেটা রায়তার লঙ্কার ঝালে, না কাল তার পালানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতায়।

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *