“ডাক্তার কর রোজই তো বলছেন, আর দু-একটা দিন দেখি। এই করতে করতে সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। আইসিইউ থেকে ছোটুকে কবে বার করবে বলুন তো?” সকালের ভিজিটিং আওয়ার্সে অরিত্রর বেডের পাশে বসে দেবদীপকে জিজ্ঞেস করলেন অধৈর্য সুমিত্রা। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় অরিত্র বলে উঠল, “বাড়ি যাব। ভালো লাগে না এখানে।” দেবদীপ এগিয়ে এসে অরিত্রর হাত ধরল। বলল, “যখন কেবিনে থাকবি, তখন এত খারাপ লাগবে না। মাসিমা অনেকক্ষণ থাকতে পারবেন, ভিজিটিং আওয়ার্সে তোর বন্ধুরা আসবে, ক্লাবের লোকজন আসবে, রোজ মাঠের খবর পাবি, হৈ হৈ করে দিন কেটে যাবে।”
সুমিত্রা দেবদীপকে জিজ্ঞেস করলেন, “সেই মেয়েটা? তাকে তো আর একদিনও দেখলাম না?”
দেবদীপ হাত উল্টিয়ে বলল, “কী জানি কুর্চির কী হয়েছে! আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই। তুই কিছু জানিস নাকি, অরিত্র?”
অরিত্র দেবদীপের কথার কোনও উত্তর দিল না। মায়ের দিকেই তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রোজ সকাল বিকেল এখানে এসে বসে থাকো! তোমার স্কুল নেই?”
সুমিত্রা হাসতে হাসতে বললেন, “স্কুল থেকে বলেছে চব্বিশ বছর আগে যেমন করতে, বাড়ি বসে ছেলে সামলাতে, এখন ক’দিন আবার সে রকম করো। ছেলে খেলতে শুরু করলে আবার স্কুলে এসো।”
সুমিত্রার কথা শেষ হওয়ার আগেই নার্স ছুটে এসে খবর দিলেন, ডাক্তার কর আসছেন। অরিত্র শুনেই আকুল হয়ে বলল, “বলো আমাকে ছেড়ে দিতে।”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাজির ডাক্তার কর। এসেই অরিত্রর চিকিৎসার ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, “অনেকটাই তো সেরে উঠেছ এখন। প্রেসার খুব নেমে গিয়েছিল, এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এবার হাঁটা-চলা শুরু করা যাক, নাকি ফুটবলারশ্রী? আজই তোমার আইসিইউ-মুক্তি। আমি সব বলে দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে ছ’তলার কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনারা থাকুন, ওর সঙ্গেই ছ’তলায় যান। ওর ভালো লাগবে। কাল থেকে ওর ফিজিওথেরাপি শুরু হবে। তার কয়েক দিন পরে কাউন্সেলিং। ফরোয়ার্ডদের পা থেকে বাজপাখির মতো বল তুলে নেওয়ার অভ্যেসটা ফিরে আসা চাই তো?”
অরিত্র শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়ি ফিরব কত দিনে?”
ডাক্তার কর এগিয়ে এসে একটা হাত রাখলেন অরিত্রর কাঁধে। বললেন, “মাথায় আঘাত তো? আঘাতটা যতটা সিরিয়াস, তার তুলনায় বেশ তাড়াতাড়িই সেরে উঠছ তুমি। কিন্তু আমাদের এখনও কয়েকটা জিনিসে নজর রাখতে হবে। আর, অপেক্ষা করতে হবে তোমার হাঁটা-চলা স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত। তাতে খুব বেশি দিন তো লাগার কথা নয়।”
“কেবিনে গিয়ে আমি কি ফোনটা ফিরে পাব?” জানতে চাইল অরিত্র।
“পাবে, তবে কেবিনে গিয়েই নয়। আরও ক’দিন দেখি আমরা। যখন বুঝব রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ট্রান্সমিশনে তোমার কোনও বাড়তি ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তখনই ফোন ফিরিয়ে দেওয়া হবে তোমাকে। কেমন?” বলেই ডাক্তার কর অরিত্রর চিকিৎসার পদ্ধতি আর প্রগতি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন তাঁর সহযোগীদের কাছে। কথা বলতে বলতেই তাঁরা বাইরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অরিত্রকে কেবিনে পৌঁছে দিয়ে অবশ্য বেশিক্ষণ থাকা হল না সুমিত্রার। দেবদীপ বলতে শুরু করল, “আপনি নিজে চান-খাওয়া ভুললে চলবে কেন? এখন আমাকে অফিসে নামিয়ে আপনি বাড়িতে যান। রোজকার মতো গাড়ি আপনার কাছেই থাকবে। বিকেলে আবার এখানে আসবেন। আজ সন্ধেবেলা আমার একটা কাজ আছে। আজ যদি না আসতে পারি, কাল সকালেই আবার আসব রে অরি। এখন চলি, একটু পরেই তোর খাবার আসবে।”
নার্স বলছিলেন শুয়ে পড়তে। কিন্তু একটানা এতদিন শুয়ে আছে অরিত্র যে, মাথায় একটু ঝিম ধরা সত্ত্বেও খাবার পরেই আবার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করল না তার। ঘরের কোণের সিঙ্গল সোফাটায় বসে জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অরিত্র ভাবছিল, মা বিকেলে এলে বলতে হবে এখানে কয়েকটা বই দিয়ে যেতে। ভাবছিল, এখানে চাইলে কি একটা খবরের কাগজ পাওয়া যাবে না? ঠিক তখনই দরজা খুলে কারুর ঢোকার আওয়াজ পেল অরিত্র। সোফায় বসে থাকলে দরজাটা দেখা যায় না। দেখার দরকারই বা কী? অরিত্র জানে, কোনও নার্সই এসেছেন আবার। ওষুধ খাওয়াতে বা প্রেসার-টেম্পারেচার চেক করতে। কিন্তু না, একদম অন্যরকম একটা গন্ধ ঢুকল তার নাকে, যেটা এই গন্ধবিধুর হাসপাতালের সব রকম গন্ধের চেয়ে আলাদা!
মুখ ঘুরিয়ে অরিত্র দেখল, কুর্চি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকা চেনা হাসিটা উধাও, কপালে ভাঁজ, চোখের তারায় ঝিকিমিকি নেই, জিজ্ঞাসা গভীর। অরিত্র দেখছে, কিন্তু কোনও কথাই আসছে না তার মুখে। আর, কুর্চিও যেন ভুলে গেছে কী করতে তার এখানে আসা।
কুর্চিই মুখ খুলল আগে। বলল, “আমাকে বলল তুমি শুয়ে আছ। যদি ঘুমিয়ে পড়ে থাকো, যেন ডিস্টার্ব না করি।”
অরিত্র জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখন কী করে এলে? এখানে সব সময় আসা যায় বুঝি?”
কুর্চি বলল, “যাঃ। তাই কখনও যায়! আমি ডক্টর করের স্পেশাল পারমিশন নিয়ে আসতে পেরেছি। তুমি ভালো আছ?”
– এখন ভালো আছি। কিন্তু আমার ফোনটা দিচ্ছে না। ফোন দিলে… তুমি ভালো আছ? আর, শকুন্তলা-দুষ্মন্ত? ভালো আছে ওরা?
– সবাই ভালো। শকুন্তলা তোমাকে গেট ওয়েল সুন বলতে বলেছে। আর দুষ্মন্ত বলেছে, ও তোমাকে খুব মিস করছে।
অরিত্র হাসল, কী যেন ভাবল, তারপর চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, “ডক্টর কর তোমার বাবার বন্ধু?”
– জানি না তো। কিন্তু সেটা জানতে চাইছ কেন?
– বললে না, তোমাকে এখানে আসার স্পেশাল পারমিশন দিয়েছেন?
– ও, সেই জন্যে! দ্যুর, তিনি জানেনই না আমার বাবা কে। আমাকে ডক্টর করের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এক স্পোর্টস জার্নালিস্ট।
– কে?
– নির্মল সাহা। উনি তোমাদের কলিশন নিয়ে নিজের মতো করে ইনভেস্টিগেট করছেন।
‘নির্মলদা!’ বলে চুপ করে গেল অরিত্র। চেষ্টা করছে গুছিয়ে ভাবার, কিন্তু এত ওষুধ ঢুকেছে ওর মাথায় আর শরীরে, বেশি ভাবতে গেলেই ক্লান্ত লাগছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কোনোমতে জিজ্ঞেস করল, “নির্মলদা সব জানে?”
– কী জানে!
প্রশ্নটা শুনে চোখ বড় করে কুর্চির দিকে তাকাল অরিত্র। তাকিয়েই রইল বেশ কিছুক্ষণ। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ওর মাথার ভেতর। বলল, “আমি এবার বেডে ফিরে যাই?”
অরিত্র সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতেই কুর্চি এগিয়ে এসে কনুইয়ের ওপরটা ধরল ওকে সাহায্য করবে বলে। কুর্চির প্রথম ইচ্ছুক স্পর্শ, অরিত্রর পা দুটো যেন আটকে গেছে মাটিতে। সপ্তাহ খানেক আগেও কলকাতা ময়দানের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান গোলকিপার অরিত্র মিত্রের বেশ কিছুটা সময় লাগল পা ঘষটে ঘষটে ঠিক চার পা দূরে তার বেডে ফিরে যেতে। বেডে গেল, কিন্তু শুয়ে পড়ল না, বসেই রইল চোখ বন্ধ করে।
চিন্তায় পড়ে গেল কুর্চি। অরিত্রর কি শরীর খারাপ হচ্ছে? এখনই কি নার্সকে খবর দেওয়া উচিত? ঠিক তখনই চোখ খুলল অরিত্র। ডান হাত দিয়ে ধরল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুর্চির বাঁ-হাতের কব্জি। ঘাড় উঁচু করে তাকাল কুর্চির মুখের দিকে। বলল, “সাবধান কুর্চি। তুমি বাঘের খাঁচায় বন্দি। তোমার কাছে যে আসবে, বাঘের যদি তাকে পছন্দ না হয়…”
কথাটা শেষ করার আগেই ধপ করে শুয়ে পড়ল অরিত্র। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কুর্চি বুঝল, সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
মুখটা অরিত্রর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসিফিসিয়ে বলল, “আমি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছি গোলকিপার। বাঘের নাগালের বাইরে। সে কথা জানাতে এসেছিলাম তোমাকে। আজ হল না, আরেক দিন হবে।”
কেবিনের দরজা টেনে বেরিয়ে এসে সোজা গেল নার্সিং স্টেশন। মেট্রনকে ডেকে বলল, “ঘুমোচ্ছে, কিন্তু একবার চেক করে নেবেন সব ঠিক আছে কিনা?”
লিফটে ঢুকে নিচে নামার বোতাম টিপেই কুর্চির মনে হল, তাহলে অরিত্রও জানে কুর্চির অতীত? দেবুদা গোলকিপারকে এসব কথা বলতে গিয়েছিল কেন? সাবধান করে দিতে চেয়েছিল? কেন? কিন্তু ভুল তো করেনি, দেবুদার আশঙ্কাই তো সত্যি হল!
লিফট থামতেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে জনহীন ক্লান্ত লবি, তার পেছনেই দুপুরের আলো-ঝলসানো রাস্তা।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
In spite of doing FB every day,why do I miss episodes? Very tight knit story line…mebbe you will give me a specially bound version after…all is well that endeth well,ha ha!!