‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…’ উঁচু গলায় মহিলা কণ্ঠের ডাক পরিষ্কার শুনল অরিত্র।

রাত ন’টা বেজে গেছে। দেবদীপ এখনও টিভিতে ফুটবলে মশগুল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। সন্ধের পর থেকেই আহ্লাদি শীত উত্তুরে হাওয়ায় ফুরফুরে নাচছে। এ সময় বাড়ির বাইরে বেরনোর এতটুকু ইচ্ছেও ছিল না অরিত্রর। কিন্তু একে টটেনহ্যাম-চেলসির এই খেলাটা আগে দু’বার দেখা, তারপর দেবুদার যত অদ্ভূত নিয়ম। বাড়ির ভেতরে তো নয়ই, বারান্দা-বাগানেও সিগারেট নিষিদ্ধ। ধূমপান চলবে না। যদি বারণ না-ই মানো, তো রাস্তায় যাও।

বাড়ির মধ্যে তো হালকা একটা হাতকাটা কার্ডিগানই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে বেশ ঠান্ডাই লাগছে। তার মধ্যেই বারবার উঁচু গলার অদ্ভুত ডাক, ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…।’ ডাকতে ডাকতে গলাটা যেন এগিয়ে আসছে!

দেবদীপের বাড়ির গেটে একটা আলো, তারপর অন্তত পঞ্চাশ ফুট দূরে টিমটিম করছে পরের আলো, অন্য কোনও বাড়িতে। মাঝের জায়গাটা জুড়ে আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। সেই আবছায়া অন্ধকার থেকেই বেরিয়ে এল মেয়েটা ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…’ ডাকতে ডাকতে। না, ভূত-টুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে মাথায় গোলমাল থাকতেই পারে। চাদর জড়িয়েছে ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর। চশমার আড়ালে চোখের দৃষ্টিও কেমন এলোমেলো, একবার এদিক দেখছে, একবার ওদিক দেখছে, কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। অরিত্রকে যেন দেখতেই পেল না। তিন হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আবার ডাকল, ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…’

ব্যাপারটা কী, জানার ইচ্ছে আর দমিয়ে রাখতে পারল না অরিত্র। দুম করে জিগেস করে বসল, “আর, তুমি কি শকুন্তলা?”

দপ করে জ্বলে উঠল মেয়েটার চোখ। ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…’ ডাক পাল্টে এবার হেঁকে উঠল, ‘বসন্ত, বসন্ত…!’ ঠিক একই রকম উঁচু গলায়। তারপরেই দূরে, মেয়েটার পিছনে অন্ধকার ফুঁড়ে একটা লোককে টর্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতেও দেখল অরিত্র। ঠিক তখনই নিজে নিজেই যেন গানটা বেরিয়ে এল অরিত্রর মুখ থেকে, “এক রাশ বিপদের মাঝখানে শুয়ে আছি, কানাঘুষো শোনা যায়, বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে…”

ঠিক ঠিক সুরও লাগল, বেতালাও হয়নি, কিন্তু মেয়েটা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, “ধর তো ওকে বসন্ত! পালাতে দিও না। আমি পুলিশ ডাকছি।”

“দুষ্মন্ত হল, বসন্ত হল, এবার পুলিশ? আমি ডাকব?” বলে উত্তরের অপেক্ষাও না করে অরিত্র ডাকতে শুরু করল, “পুলিশন্ত, পুলিশন্ত…” একটুও হাসল না মেয়েটা, শুধু একটু থমকে গেল। এদিকে ততক্ষণে বসন্তও হাজির অকুস্থলে। তার চেহারা এবং জামাকাপড় বলছে সে ওই মেয়েটির বেতনভোগী। সম্ভবত মালি বা দারোয়ান। মুখে শস্তার মদের কটু গন্ধ।  “কী হয়েছে?” গম্ভীর গলায় জানতে চাইল বসন্ত।

“আরে হয়নি তো কিছুই।” অরিত্র বলল, “আমি শুধু জানতে চেয়েছি দুষ্মন্তকে খুঁজছে, ও কি শকুন্তলা? তার উত্তরই তো পাইনি এখনও।”

– উনি কেন শকুন্তলা হবেন? শকুন্তলা-দুষ্মন্ত দিদির কুকুর। দুষ্মন্ত আমাদের চোখের আড়াল দিয়ে বেরিয়ে গেছে। দিদি তাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন।

– বসন্তদা, তুমি হয় দুষ্মন্তকে খোঁজো, নয় তো যেমন ঘুমোচ্ছিলে, ঘুমোও। এখানে আড্ডা মারতে হবে না। দিদির গলা বিরক্তিতে তীক্ষ্ণ।

‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত…’ ডাকতে ডাকতে অন্ধকারে সামনের দিকে এগিয়ে গেল বসন্ত। আর ঠিক তখনই দরজা খুলে বেরিয়ে এল দেবদীপ। রাস্তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “তুই তখন থেকে বাইরে কী করছিস রে অরি? গোটা প্যাকেটটা কি একবারেই শেষ করছিস নাকি? আরে, ওটা কে? কুর্চি? কী হয়েছে রে? চিনিস নাকি অরিত্রকে?”

– না দেবুদা, মোটেই চিনি না। তোমার গেস্ট বুঝি? রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখন থেকে আবোল-তাবোল বকছে।

– ও দেবুদা, এখানকার পুলিস সুপার, বাজোরিয়া না পাজোরিয়া, তোমার চেনা না? শিগগির খবর দাও, কুর্চি খুঁজছে। গলা তুলে বলল অরিত্র।

– কেন রে? কী হল আবার? চোর-টোর ঘুরছে নাকি? জানতে চাইল দেবদীপ।

– চোর না! কুকুর। কুর্চির কুকুর পালিয়ে গেছে, এসপি যদি ফোর্স পাঠিয়ে খুঁজে দেন…।” কুর্চি কিছু বলার আগেই জুড়ে দিল অরিত্র। অন্ধকার থেকে তখনও বসন্তর ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত’ ডাক শোনা যাচ্ছে।

– শুনলে তো? নিজেই শুনলে আবোল-তাবোল? আমি চললাম দুষ্মন্তকে খুঁজতে। অ্যাত্তো পাজি, রান্নাঘরের জানলা গলে পালিয়ে এসেছে!

– অ্যাঁ! সে কী রে! ওই ছোট্ট দুটোর একটা? রাস্তার কুকুরগুলো দেখতে পেলে তো ছিঁড়ে খাবে। আর তোরা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিসকোর্স দিচ্ছিস! হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকিস না অরি, যা কুর্চির সঙ্গে যা। দেখ কুকুরটা গেল কোথায়?  আমি এখানে আছি, দেখতে পেলেই ডাকব তোদের।

শিরশির করছে ঠান্ডা। রাস্তায় কোনও আলো নেই, দূরে দূরে টিমটিমে আলো জ্বলছে এক একটা বাড়ির গেটে। তার মধ্যে কী খুঁজতে রাস্তায় নেমেছে অরিত্র? না, অদেখা-অচেনা একটা কুকুর! ইস, কেন যে সে মুখ খুলতে গিয়েছিল কুর্চির সামনে! রাগটা প্রথমে হল নিজের ওপর, তারপর গেল কুর্চির দিকে, পরের নিমেষেই পাকা জায়গা করে নিল দেবদীপের ওপর। উফ,  দেবুদার ধরনটাই এই রকম। অপোনেন্টকে ল্যাং মেরে আছাড় খাইয়ে বলটা নিজের পায়ে তুলে নেবে! নিজেই  রেফারি সেজে বসে থাকে, যা খুশি করে। কোনও উপায় নেই অরিত্রর, এই অন্ধকার রাস্তায় কুর্চির ঝুঁটি আর ফটর ফটর চটি দেখতে দেখতে যেতে হবে এখন। আর তার মধ্যেই যখন তখন পেনাল্টির মত ধেয়ে আসতে পারে দেবুদার ‘অরি-ই-ই’ বলে হাঁক।  বসন্ত কোথায় এগিয়ে গেছে কে জানে, তার গলার আওয়াজ ভাসছে অনেক দূরে।

(পরবর্তী পর্ব বৃহস্পতিবার)

 

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *