অক্ষরবৃত্ত: এ-ছন্দের আরও অনেকরকম নাম– তানপ্রধান, মিশ্রকলাবৃত্ত, মিশ্রবৃত্ত, অক্ষরমাত্রিক, বর্ণমাত্রিক। অক্ষরবৃত্ত নামটি প্রবোধচন্দ্রের দেওয়া, তানপ্রধান অমূল্যধনের। আরও অনেকে নানারকম নামে ডেকেছেন এই ছন্দটিকে। তবে, অক্ষরবৃত্তটাই চালু হয়ে গেছে বেশি। প্রবোধবাবু লিখেছেন : “অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মূলে একটি ধ্বনিতত্ত্ব আছে। সেই তত্ত্বটি এই যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অন্তর্গত প্রত্যেকটি শব্দ শেষাংশে মাত্রাবৃত্তধর্মী ও অন্যাংশে স্বরবৃত্তধর্মী। সুতরাং অক্ষরবৃত্ত আসলে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের মিশ্রণজাত একটি যৌগিক ছন্দ”। তাঁর নিজের পছন্দ ছিল মিশ্রকলাবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত নাম।
এ-ছন্দে এক-একটি অক্ষর এক-এক মাত্রার, এমনকী যুক্তাক্ষরও। এ-ছন্দের চাল দলবৃত্তের মতোই চার মাত্রার, কিন্তু দলবৃত্তে মাত্রার হিসেব আলাদা। অক্ষরবৃত্তের একটি পঙক্তি, যেমন
“আলোকিত/পৃথিবীতে/অপরূপ/আমাদের/বেঁচে থাকা/টুকু”,
এ-ছন্দে দু-মাত্রা উদ্বৃত্ত রাখতে হয়, তা না-হলে পুরো কবিতা একনিশ্বাসে পড়ে যেতে হয়, সে খুব ঝামেলা। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী উদাহরণ দিয়েছিলেন:
“বাজে লক্ষ ঢাকঢোল/চতুর্দিকে হট্টগোল/আর সহ্য হয় কত/প্রাণ হল ওষ্ঠাগত”।
সত্যিই ‘হুলুস্থুলু’ ব্যাপার। তবে পরীক্ষামূলকভাবে, বা, পাকা কবি কৌশল করে এসব করতেও পারেন।
আমরা অনেকসময় বলি অমুক কবি ৮ মাত্রার করে তিনটি পর্বে কবিতাটি লিখেছেন! আসলে সেক্ষেত্রে দেখা যাবে, চার মাত্রায় পর্বটি ভাঙলেও বেমানান লাগছে না:
“মহাভার/তের কথা/অমৃত স/মান”,
আর, অনেকসময় দেখতে যদি খারাপ লাগে দুটো পর্ব পরই ভাঙব, ৬+২=৮ মাত্রা করে নেব:
“মহাভারতের কথা/অমৃত সমান”।
কিন্তু একটা নিয়ম আছে, ৮-মাত্রার পর্ব করতে গেলে সত্যেন্দ্রনাথের সূত্রটি মাথায় রাখতে হবে:
“বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়”।
উপরের লাইনে যেমন জোড়ে-জোড়ে গেঁথে ৮ মাত্রা হয়েছে, তেমনি তিন-অক্ষরের পর তিন-অক্ষরের শব্দই রাখতে হবে: “অকূল কুন্তল পাশ-মেলে দিয়ে ক্লান্তির সাগরে”– ১+৩ বা ৩+৫ দিয়ে ৪ কিংবা ৮ মাত্রা করা যাবে না। ভাঙা তখন ব্যাকরণবিরুদ্ধ হয়ে যায়।
অক্ষরবৃত্তে একটা অক্ষর এক মাত্রা, যুক্তাক্ষরও একমাত্রা, কিন্তু ছন্দ বিশ্লেষণের সময় কীভাবে দেখাব? অসুবিধে আছে। তাই, বলা যাক, শব্দের মধ্যস্থিত রুদ্ধদল ১-মাত্রা, অন্তে স্থিত রুদ্ধদল ২-মাত্রা; আর মুক্তদল তো সর্বত্রই ১-মাত্রা রইলই। তাহলে ছন্দ বিশ্লেষণে সমস্যা নেই। নীচের লাইনটিকে এভাবে scan করা যেতে পারে:
“দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত”……
১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১ ১
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
দূর দান্ তো পান্ ডিত্ তো পূর্ নো দুস্ সাধ্ ধো সিদ্ ধান্ তো
এবার ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের উক্ত পঙ্ক্তিটির অক্ষর সংখ্যাও ১৪, গুনে দেখা যাচ্ছে। এখানে একটা কথা, কবিতার পঙ্ক্তিবিন্যাস অনুযায়ী কখনো-কখনো উচ্চারণ দিয়ে কোনো শব্দের মধ্যস্থিত রুদ্ধদলও ২-মাত্রা হতে পারে, যেমন:
“তুমি বড়ো বদমাশ সারাদিন দুষ্টবুদ্ধি তোমার মাথায়”–
এখানে ‘বদমাশ’ ৪-মাত্রা। কিন্তু যদি লিখি–
“বদমাশ ছেলেটা আজ চুপচাপ শুয়ে আছে কেন”? —
এখানে নিয়মানুযায়ী তিনমাত্রাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও স্পষ্ট বলেছেন, অক্ষরবৃত্তে মাত্রা টেনে বাড়ানো ঠিক নয়,
“সাত মাত্রাকে গানের মতন টেনে আটমাত্রা পড়ার রীতি এখন নেই”।
অর্থাৎ নীরেন্দ্রনাথের ভাষায়
“কবিতা লিখতে গিয়ে লক্ষ রাখতে হবে, শব্দের উচ্চারণ আর ছন্দের চাল, এ-দুয়ের মধ্যে যেন ঠিকঠাক সমন্বয় ঘটে”।
অক্ষরবৃত্তের প্রচলিত ছন্দগুলি ছিল– একাবলী, পয়ার ও ত্রিপদী। যথাস্থানে এগুলি আলোচিত হবে। এখন শুধু উদাহরণ দিয়ে কাজ করা যাক:
একাবলী (৬+৫): বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে/ দেখা না হইত পরাণ গেলে।
পয়ার (৮+৬): মহাভারতের কথা অমৃত সমান।/ কাশীরাম দাস ভনে শুনে পুণ্য়বাণ।।
ত্রিপদী (৬+৬+৮): বিকচ কমলে যেন কুতূহলে/ ভ্রমর পাঁতির দেখা।
এছাড়া মহাপয়ার, দীর্ঘত্রিপদীও রয়েছে।
ছন্দ না–জেনে যাঁরা গদ্য কবিতা লেখেন, তাঁদের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকে, ভাবে–ভাষায়–প্রকরণে। অক্ষরবৃত্তে নিপুণ হলে কথ্য–চলিত বাক্যেও কবিতা লেখা যায়, ভাবগাম্ভীর্যেও অটুট থাকা যায়। শৈলী হয়ে ওঠে স্মার্ট
একটি প্রশ্ন, ৪-মাত্রা (বা ৮-মাত্রা) করে অক্ষরবৃত্তে কোনো কবিতার লাইনকে কতদূর টেনে নেওয়া যায়? ৮-মাত্রা ধরলে পয়ারে ১পর্ব, মহাপয়ারে ২পর্ব, অন্যান্যক্ষেত্রে আরও বাড়ানো যায়। কিন্তু কতটা? জীবনানন্দ ৫-পর্ব শেষে দু-মাত্রা উদ্বৃত্ত রেখে মোট ৪২-মাত্রার লাইন লিখেছেন:
“অনেক দিনের গন্ধে ভরা ওই ইঁদুরেরা জানে তাহা– জানে তাহা নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল”।
মাত্রাবৃত্তের মতোই অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরও উৎস নিহিত ছিল অপভ্রংশের কিছু ছন্দে। পাদাকুলক ও মরহট্টা ছন্দই বিবর্তনের পথ ধরে অক্ষরবৃত্ত হয়েছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অনেক সম্ভবনা। এ-ছন্দে (এবং অন্যান্য ছন্দেও) ভাল দখল থাকলে গদ্যছন্দে কবিতা লেখায় আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ছন্দ না-জেনে যাঁরা গদ্য কবিতা লেখেন, তাঁদের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থাকে, ভাবে-ভাষায়-প্রকরণে। অক্ষরবৃত্তে নিপুণ হলে কথ্য-চলিত বাক্যেও কবিতা লেখা যায়, ভাবগাম্ভীর্যেও অটুট থাকা যায়। শৈলী হয়ে ওঠে স্মার্ট-ঝকমকে-গতিসম্পন্ন এবং হৃদয়সংবেদী উভয়তই।
অক্ষরসঙ্ঘাত: ‘সমাধি’ বলতে বোঝায় ‘একের ধর্ম অন্যের উপর সম্যক আরোপণ। বিচিত্র আভরণের ন্যায় উক্তপ্রকার গুণ এবং বহুপ্রকার অলংকার কাব্যের শোভাজনক হয় বলিয়া (এইগুলিকে) ভূষণ বলা হয়’।
‘নাটকলক্ষণরত্নকোষ’-এ আরও বলা হচ্ছে, ভূষণের উদাহরণ হিসাবে ‘অক্ষরসঙ্ঘাত’-এর কথা। অক্ষরসঙ্ঘাতের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ‘যেখানে বিভিন্নার্থক অর্থাৎ শ্লিষ্ট পদের দ্বারা কোনও অর্থ বর্ণিত হয়, সেই লক্ষণ অক্ষরসঙ্ঘাত।’ উদাহরণ হিসাবে একটি শ্লোক সেখানে উদ্ধৃত হয়েছে……।
গৌরী কান্তা তবাপ্যস্তি তবাপ্যস্তি বৃষে রতিঃ ।
কামং দাতাসি মহতঃ স্থানে হরসি সদ্গুণৈঃ ।।
অর্থাৎ, আপনারও কান্তা গৌরী (অন্য অর্থ: গৌরবর্ণা), আপনারও প্রিয় বৃষ (অন্য অর্থ: ধর্ম), আপনিই মহতের (অন্য অর্থ: পবিত্র জ্ঞান বা প্রচুর অর্থ) দাতা, ইহা ঠিকই যে আপনি সদ্গুণের দ্বারা স্বয়ং হর (অন্য অর্থে: সকলের মনোহরণ করেন)। দ্র: ভূষণ। বাংলায় শ্লেষ বা শব্দশ্লেষ নামক শব্দালঙ্কারটির সঙ্গে এটি তুলনীয়। যেমন:
১। কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর।/ যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।।
কে বলে ভগবান গোপনে থাকেন, তিনি চরচরে ব্যাপ্ত, তাঁর প্রভাতেই সূর্য প্রভা পেয়ে থাকে। ওদিকে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকাটি যাঁর প্রভায় সমুজ্জ্বল, সেই ঈশ্বরগুপ্তকে কে গুপ্ত বলে, তিনি চরাচরে ব্যাপ্ত।
২। অভঙ্গ শ্লেষ বলেও একটি ব্যাপার আছে:
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।/ কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ অহর্নিশ।।
পাটনী বুঝছে, আমার স্বামী পাঁচমুখে আজেবাজে কথা বলে বেড়ান, গলায় যেন বিষ ঝরে, দিনরাত আমার সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে। আবার অন্নদামঙ্গলের দিক দিয়ে এর অর্থ, আমার স্বামী মহাদেব (পঞ্চমুখ), কু (পৃথিবী-র)কথায় মগ্ন; তিনি নীলকণ্ঠ, আমার সঙ্গে তাঁর নিত্য মিলন (দ্বন্দ)।
অঙ্গকল্প : (রূপকল্প-ও বলা হয়) কোনো অর্থবহ পদাংশের, তা শব্দ ধাতু বা প্রত্যয় যে-কোনো কিছুর হতে পারে, তার মানসিক একটা রূপ। তার একাধিক বিকল্প অঙ্গ প্রত্যক্ষ দেখা যেতে পারে, কিন্তু সেই বিকল্পগুলির মানস বা চিন্তনীয় রূপকে নিয়ন্ত্রণ করে অঙ্গকল্প। ধরা যাক, কবিতায় বলা হল ‘তুমি’ সেটি তখন নিজস্ব হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, দ্বিতীয়ত, তাতে যখন ‘কে’ বা ‘র’ ব্যবহার করে ‘তোমা’ করা হচ্ছে (তোমাকে, তোমার), তৃতীয়ত, শব্দটিকে ‘তোম’ করে নিয়ে ‘রা’ ব্যবহার করে ‘তোমরা’ করা হল। এটাই অঙ্গকল্প।
অচলধৃত: সংস্কৃত ছন্দ। ষোলোটি লঘু অক্ষরে রচিত হয়।
অঞ্জনা: অলংকারশাস্ত্রের শব্দশক্তির একটি ভেদ। শব্দের তিনটি শক্তি: অভিধা, লক্ষণা, ব্যঞ্জনা। ব্যঞ্জনাবৃত্তিকে ‘অঞ্জনা’ হিসাবেও অভিহিত করা হয়।
অট্ঠকথা: সাধারণভাবে ত্রিপিটকের নিকায় কিংবা তার অন্তর্গত সুত্তগুলির ব্যাখ্যা। পালি ভাষায় লেখা কথাগুলি বেশির ভাগই বুদ্ধঘোষের রচনা। সংস্কৃতে ‘অর্থকথা’। ধম্মপাল প্রমুখ কবিদেরও অট্ঠকথা বা অত্থকথা আছে। পালি ভাষার ব্যাকরণের একটি প্রধান অট্ঠকথা কচ্চায়নের লেখা ‘সারত্থবিকাসিনী’।
বহু পণ্ডিত অট্ঠকথার টীকাও লিখে গেছেন। বুদ্ধঘোষ নিজেই লিখেছিলেন সমন্তপাসাদিকা-র টীকা। বুদ্ধঘোষ রচিত কিছু ধ্রুপদী অট্ঠকথা, ‘সমন্তপাসাদিকা’ বিনয়পিটক থেকে, দীর্ঘনিকায়-এর সুমঙ্গলবিলাসিনী, পপঞ্চসূদনী(মজ্ঝিমনিকায়), মনোরথপূরনী(অঙ্গুত্তরনিকায়) সারত্থপকাসিনী(সঞ্ঞুত্তনিকায়), পরমত্থজোতিকা(সুত্তনিপাত) ইত্যাদি।
অণুযতি : মুক্ত বা রুদ্ধ যে-কোনো দলের পর যে সামান্য যতিটুকু থাকে সেটিকেই বলে অণুযতি। প্রবোধচন্দ্র একে দলযতিও বলেছেন। ক-বি-সম্-মে-লন, এই শব্দটিতে রয়েছে চারটি অণুযতি।
অতদ্গুণ: একটি অর্থালংকার। বর্ণনাযোগ্য কোনো বস্তু অন্য কোনো বর্ণনা অযোগ্য বস্তুর সঙ্গে অবস্থান করা সত্ত্বেও তার গুণ বা অবস্থা গ্রহণ করে না, সেটাই অতদ্গুণ।
অতিকথন: বাগ্বাহুল্য। ইংরেজিতে Prolixity, বেশি-বেশি করে বলা। “সাজ সাজ সাজ বলে/ সাজ সাজ সাজ হে/ সাজ সাজ সাজ”। কিংবা, “কোথায় পৌলমী সতী অনন্তযৌবনা দেবেন্দ্র-হৃদয়-সরোবর কমলিনী”।
জন্ম গড়শিমুলা গ্রামে (অধুনা জামতাড়া জেলা)। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ২০০১ সাল থেকে লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ২০০৯ সালে অনুবাদের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার। এ ছাড়াও পেয়েছেন অন্যান্য সম্মান ও পুরষ্কার। রয়েছে বারোটির বেশি প্রকাশিত গ্রন্থ।