একটা চমৎকার আপ্তবাক্য আছে ইতিহাস বিষয়ে ইংরেজিতে। History repeats itself. The first as tragedy; the second as farce. ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়; প্রথমবার ফেরে ট্র্যাজেডি হয়ে, দ্বিতীয়বার প্রহসন। এবারের যে-লেখাটি জীবনকাহিনিতে আনছি সেটি ১৯৮৯-এ লেখা, যখন বিশাল করে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশতবর্ষ পালন হচ্ছে। আমার লিখতে লিখতে মনে পড়ছিল, তার ঠিক কুড়ি বছর আগের প্যারিসের ছাত্র আন্দোলনের কথা। আমি নিজে তখন এমএ-র ছাত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কফি হাউজ, কলেজ স্ট্রিটে জীবন কাটাচ্ছি। কেমন যেন একটা ভাবনা ছড়াচ্ছে, প্যারিসের লড়াই আমাদেরও লড়াই। আর দেখতে দেখতে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল নকশাল আন্দোলন।
নিছক সমাপতন কিনা জানি না, তার ঠিক কুড়ি বছর পর, ১৯৮৯ সালে যখন বাংলাদেশের পত্রিকার জন্য কলাম লিখছি, তখনও বেজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কোয়্যারে চিনের ছাত্ররা, যুবসমাজ সৈন্যদের গোলাবারুদ, ট্যাঙ্কের সামনে বুক পেতে দিচ্ছে। ততদিনে নকশাল আন্দোলনের ঝাঁঝ একেবারেই মিলিয়ে গেছে। অথচ ছাত্রবিপ্লব নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছিল আমার ‘আগুন, বই আর গোলাপ’-এর জীবন যেন নতুন করে ফিরে আসছে। লিখছি আর ভাবছি— জীবনই তো জীবন দেখায়, জীবন চেনায়। ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। এখানকার কবিতা উৎসবে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে। উৎসব শেষে বিশাল দল নিয়ে শীতের সকালে স্টিমারে গঙ্গাভ্রমণে ছিলাম আমরা। একান্তে নদী দেখতে দেখতে কথা হচ্ছিল কবির সঙ্গে। কথার মধ্যে এসে পড়ল আমাদের কলাম নিয়ে কথা। শামসুর সাহেব বললেন, জীবন তো দেখা শুধু চোখ দিয়ে হয় না, দেখতে হয় জীবন দিয়ে। নিন পাঠক, আমার সে-জীবন আপনারা পড়ুন…
সকালে কাগজ পড়ে খুব উত্তেজনা আর আনন্দ হচ্ছিল কিছুদিন যাবৎ। চিনের ছাত্রদের আন্দোলন ক্রমাগত মনে করিয়ে দিচ্ছিল ৬৮’-র প্যারিসে ছাত্রবিক্ষোভ আর তার কিছু পরেই কলকাতার ছাত্রসমাজে নকশাল চিন্তাভাবনা ও আন্দোলনের কথা। নকশাল আন্দোলন নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ, দোষারোপ-প্রতিদোষারোপ, নতুন তথ্য–নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার এখনও চলছে, আরও বহুদিন চলবে। সেই বিতর্কে কোনও সংযোজন করার জন্য এ লেখা নয়। বেজিংয়ের ছাত্র-বিক্ষোভের খবর পড়তে পড়তে মনের পর্দায় সিনেমার মতো বয়ে যাচ্ছে বিশ বছর আগের ঘটনাবলি।
আজ সকালের খবরে বেজিংয়ের তিয়েনানমেন স্কোয়ারে আন্দোলনে শরিক ছাত্রদের মধ্যে আন্দোলন নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে জেনে প্রায় সেইরকম দমে গেলাম, যেরকম দমে গিয়েছিলাম নকশাল আন্দোলনে শরিক ছাত্রদের অহেতুক হিংসাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে দেখে। তখন বুঝিনি, বহু পরে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হল, কীভাবে সুপরিকল্পিত রাস্তায় আন্দোলনের ছাত্রদের বেপথু, দিশেহারা, অকারণ হিংসাত্মক করে তোলা হয়েছিল। এসব তথ্য যখন প্রকট হতে শুরু করেছে, ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, আন্দোলন ভেস্তে গেছে। আমার জ্যেষ্ঠ, সমবয়সী ও কনিষ্ঠ অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জীবন বরাবরের মতো জখম হয়ে গেছে। তাদের অনেকেই পুলিশের গুলি, শত্রুপক্ষের গুলি, আততায়ীর গুলি বা ছুরিতে প্রাণ দিয়েছে। এদের অনেকেই আমার বন্ধু ছিল। যিনি বন্ধু ছিলেন না, সেই অসীম চট্টোপাধ্যায় (কাকা) অনেক পরে বন্ধু হলেন।

এখনকার সফল নেতৃবর্গ, সফল বুদ্ধিজীবী, লেখক, এগজিকিউটিভ, অধ্যাপকেরা হয়তো ওঁকে বেশ করুণার চোখে দেখেন, নীরবে ‘ইস্! ইস্!’ ধ্বনি তোলেন, তুলে শান্তি পান। কিন্তু আমার প্রজন্মের ওই এক বিজয়ী পুরুষ বলে মনে হয় ওঁকে আমার। ভয়ানক সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন, রীতিমতো দারিদ্র্যের মধ্যে, কিন্তু মগজটা স্ফটিকের মতো চকচকে পরিষ্কার। পূর্বের বহু ভুলভ্রান্তি উনি অকপটে স্বীকার করেন। এমনকী তা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ একটা লেখাও লিখেছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়, আর সেজন্য প্রবলভাবে নিন্দিত হয়েছেন সেই সব আর্মচেয়ার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা, যাঁদের আন্দোলন কাগজে-কলমে, কলেজ-ইউনিভার্সিটির জানালার ফাঁক দিয়ে, ঝড় থেমে গেলে কফি হাউসের নিরাপদ আশ্রয়ে।
নিরাপদ দূরত্বে থেকে গা বাঁচিয়েছিলাম বলে আমার নকশাল সমসাময়িকদের সমালোচনা করার কোনও ধৃষ্টতাই হয় না আমার। বরং যত দিন যাচ্ছে আমার বিস্ময় বাড়ছে, যত দেখি তখনকার স্বার্থান্বেষী ছাত্রনেতাদের ফুলে-ফেঁপে রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে ওঠা, তাদের সম্পূর্ণ আদর্শহীনতা। আমার সমবেদনা বাড়ে বিশ বছর আগেকার সেই সব ‘পরাজিত’ যুবকদের জন্য। অরাজনৈতিক ছিলাম বলে যে লজ্জাবোধ ছেয়ে ছিল, ভেতরে ভেতরে সে সব কবেই ধুয়েমুছে গেছে আমার প্রজন্মের রাজনৈতিক চরিত্রদের বিবর্তন দেখে। কেউ টিভি সিরিয়ালে অর্ধ-উদোম হয়ে নায়িকার সঙ্গে সুইমিং পুলে হাবুডুবু খাচ্ছেন, কেউ কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হয়ে অবান্তর বকবক করছেন টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে, কেউ রাজ্যে মন্ত্রী হয়ে অপসংস্কৃতি প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এ তো গেল সেদিনকার ছাত্রসমাজের অবক্ষয় ও ধ্বংসের কথা। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের চেহারাটাই বা কেমন? যা দেখি, তাতে সত্যি বলতে কি, ভয়ানক হতাশ হতে হয়। কোনও আদর্শ, কোনও সূক্ষ্ম দর্শন, কোনও অনুভূতি আছে বলেই মনে হয় না। এরা পার্টি করে, পলিটিক্স করে কোনও চিন্তা, মতাদর্শ, অনুভূতি থেকে নয়। বড় চতুর এরা। আগেভাগেই জেনে গেছে পার্টি লাইনে গিয়ে কীভাবে বৃত্তি, অনুদান, চাকরি, ব্যবসার বরাত হাতানো যায়। রাজনীতি হল সেই লক্ষ্যে আবশ্যিক হাতিয়ার। এরা আমাদের প্রজন্মের ‘ব্যর্থ’ রাজনৈতিক ছাত্রদের অনুকম্পা করে, ভাবে ‘হায় রে! এইভাবে কেউ গোল্লায় যায়?’

ভাবুক তাতে দোষ নেই, কিন্তু নিজেদের একটা দর্শন বা মতাদর্শ তো তৈরি করতে হবে। সেটা কোথায়? এত পাটোয়ারি মনোভাব নিয়ে একটা প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে দেখলে আমাদেরও তো অনুকম্পা হওয়ার কথা। চাকরি, চাকরির উন্নতি, টিভি প্রোগ্রাম, সিরিয়াল তৈরির দাওয়াতের সন্ধানে এদের তৎপরতা দেখলে আমি ট্র্যাজেডি দেখার অনুভূতি, (Schadenfreuda) ‘শাডেনফ্রয়ডা’-র অনুভব পাই। ভাগ্যিস, আমি এদের বেশ কিছুকাল আগে জন্মেছিলাম! আমার মনে পড়ে আমার এক বিবেকবান বন্ধুর কথা যে বলেছিল, যারা ইঁদুর দৌড়ে (rat race) যোগ দেয় তারা আসলে ইঁদুরই। তার বেশি কিছু না। গাছ দৌড়য় না, কারণ সে তার জায়গা খুঁজে পেয়েছে।
এইসব বিভিন্ন কারণে চিনের ছাত্রদের জয়ী হওয়াটা এত প্রয়োজনীয় ছিল আমার কাছে। ওদের সংগ্রামে কীরকম এক যৌবনবোধ অনুভব করছিলাম, স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম, বিদেশের ছাত্রদল ফিরিয়ে আনছিল নতুন প্রজন্মের প্রতি আমার বিশ্বাস, আমার শ্রদ্ধা। যখন বিশ্বজুড়ে ছাত্রসমাজের চিন্তাচরিত্রে নতুন নতুন ধস নামছে, তখন এই এক দেশ (নকশালদের উদ্বুদ্ধ করার পিছনেও ছিল চিনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আংশিক অবদান) যারা ছাত্রদের এক নতুন মুখ দেখাল আমাদের। কিন্তু কিছুদিন আগের ফ্রান্সের বিক্ষোভী ছাত্রদের মতো তারাও এখন পরাজয়ের মুখে। যা ভয়ানক ক্লান্ত, ধ্বস্ত করছে আমাকে। এখনও অবধি শেষ ফলাফল জানা যায়নি, যদিও কট্টরপন্থী লি পেঙ তাঁর ক্ষমতা পাকা করে ফেলছেন বলে শুনছি, পড়ছি। আর ততই অবসন্ন হচ্ছি স্মৃতির আক্রমণে। আর প্রার্থনা করছি নীরবে— যদি ছাত্ররা পরাজিতও হয় তাহলেও যেন তাদের এই চেষ্টা, এই আদর্শ একেবারে মিথ্যে না হয়। হেরে যাওয়ায় আমার দুঃখ নেই, যদি আদর্শ সঞ্জীবিত হয়। (চলবে)
ছবি সৌজন্য: ABC News, The Gueardian
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।