আগের পর্বের লিংক:
[] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]

খুরের চোট সেরে যেতেই বক্সার আগের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করল৷ এ-কথা সত্যি যে, সারা বছরটা জুড়ে জন্তুরা একেবারে ক্রীতদাসের মতো খেটেছে এবার৷ খামারের দৈনন্দিন কাজ বা নতুন করে হাওয়া-কল বানানো তো ছিলই, তার সঙ্গেই মার্চ মাস থেকে শুরু হয়েছে শুয়োরছানাদের জন্য স্কুলবাড়ি তৈরির কাজ। আধপেটা খেয়ে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা কাজ করে চলাটা বাকি জন্তদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে মাঝেমাঝে। কিন্তু বক্সারের কোনও হেলদোল হয় না। তার কাজে-কর্মে বা কথায়-বার্তায় বুঝে ওঠা মুশকিল যে, তার শরীরে এখন সেই আগের শক্তি আর নেই৷ কেবলমাত্র তার চেহারায় খানিক বদল এসেছে৷ তার চামড়ায় আগে যে একটা উজ্জ্বল ভাব ছিল, সেটা এখন অনেক ফিকে লাগে৷ এমনকি তার নিতম্বের বিশাল বিশাল পেশীগুলোও যেন কেমন কুঁচকে গেছে। সবাই বলে, ”বসন্তে নতুন ঘাস গজালেই বক্সারের শরীরে ফের গত্তি লাগবে।” কিন্তু বসন্ত আসার পরেও বক্সারের স্বাস্থ্য ফিরল না। মাঝে মাঝে সে যখন বিশাল আকৃতির কোনও পাথর টানতে টানতে খাদের ঢাল বেয়ে উপর দিকে ওঠে, তখন দেখলেই বোঝা যায় যে পেশীর শক্তিতে নয়, কেবলমাত্র প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরেই সে এখনও তার চার-পায়ে খাড়া রয়েছে৷ সেই সময় তার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে বেশ বোঝা যায় সে বিড়বিড় করছে, “আমি আরও বেশি পরিশ্রম করব৷” কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোয় না৷ ক্লোভার আর বেঞ্জামিন ফের তাকে নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে বলে৷ কিন্তু বক্সার কোনও কথাই কানে তোলে না৷ সামনেই তার বারো বছরের জন্মদিন। অবসর নেওয়ার আগে বক্সার প্রচুর পাথর জমিয়ে রেখে যেতে চায়৷ ওই জন্যই এখন সে মরিয়া হয়ে কাজ করে চলেছে।

Animal farm Boxer
পেশীর শক্তিতে নয়, কেবলমাত্র প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরেই সে এখনও তার চার-পায়ে খাড়া রয়েছে

গ্রীষ্মকালে, এক সন্ধের শেষে হঠাৎই খামারে গুঞ্জন শুরু হল— বক্সারের কিছু একটা বিপদ হয়েছে৷ বক্সার হাওয়া-কলের পাথর বইবার জন্য বেরিয়েছিল৷ একাই। এবং যা মনে হচ্ছে, এ-রটনা হয়তো সত্যি৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুটো পায়রা তির বেগে উড়ে এসে খবর দিল, “বক্সার পড়ে গেছে। আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না৷ সে-ভাবেই কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে৷”

খামারের অর্ধেক জানোয়ার তৎক্ষণাৎ পড়ি-কি-মরি করে ছুটল হাওয়া-কলের টিলার দিকে৷ বক্সার পড়ে রয়েছে পাথর-বোঝাই গাড়িটার দুটো দণ্ডের মাঝে৷ গলা টানটান করে শুয়ে রয়েছে সে, মাথা তোলারও ক্ষমতা নেই। তার চোখ-দুটো জ্বলজ্বল করছে৷ ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়াচ্ছে রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা৷ 

ক্লোভার হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল তার পাশে, “বক্সার! কেমন আছ?” 

বক্সার দুর্বল গলায় উত্তর দিল, “ছাতি ফেটে যাচ্ছে গো! তবে সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আমার মনে হয় আমাকে ছাড়াই তোমরা হাওয়া-কল শেষ করতে পারবে। যথেষ্ট পরিমাণে পাথর জমা হয়েছে৷ আমার তো আর মোটে একটাই মাস বাকি ছিল৷ সত্যি বলতে কি, আমি নিজেও অবসর নিতে চাইছিলাম৷ বেঞ্জামিনও তো ভালোই বুড়িয়েছে৷ হয়তো তাকেও ওরা একই সঙ্গে অবসর দেবে৷ আমি একজন সঙ্গী পাব সে-ক্ষেত্রে।” 

ক্লোভার বলল, “কেউ একজন দৌড়ে যাও, স্কুইলারকে জানাও কী হয়েছে৷ এখ্খুনি সাহায্য পাঠাতে বলো।” 

Animal-Farm
বক্সার পড়ে গেছে। আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না৷

সব জন্তুরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটল খামার-বাড়ির দিকে৷ কেবলমাত্র ক্লোভার রয়ে গেল। আর রইল বেঞ্জামিন৷ সে এক পাশে চুপটি করে বসে তার লম্বা লেজ দিয়ে বক্সারের শরীর থেকে মাছি তাড়াতে লাগল৷ 

মিনিট-পনেরো পরে স্কুইলার এসে পৌঁছোল৷ তার গলায় একরাশ সহানুভূতি আর উদ্বেগ৷ সে বলল যে, খামারের অন্যতম অনুগত এক কর্মীর সঙ্গে এমন দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ঘটেছে তা জানতে পেরে কমরেড নেপোলিয়ন গভীরভাবে মর্মাহত৷ তিনি ইতোমধ্যেই বক্সারকে উইলিংডনের হাসপাতালে চিকিৎসা করাবার সব রকম বন্দোবস্ত করতে শুরু করে দিয়েছেন। এই কথাটায় জন্তুদের একটু অস্বস্তি হতে লাগল৷ মলি আর স্নোবল বাদে অন্য কোনও জানোয়ার কখনও খামার ছেড়ে কোথাও যায়নি। ওদের একজন কমরেডকে অসুস্থ অবস্থায় মানুষের হাতে গিয়ে পড়তে হবে— এ-কথা ভাবতে জন্তুদের একটুও ভালো লাগছিল না। তবে স্কুইলার সবাইকে খুব সহজেই বুঝিয়ে দিল যে, তাদের খামারের চেয়ে উইলিংডনের পশু-চিকিৎসকের কাছে বক্সারের চিকিৎসা অনেক সন্তোষজনক হবে। 

আরও আধঘণ্টা পরে বক্সার কিছুটা সুস্থ বোধ করল। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছিল, তবুও সে কোনওমতে লেংচে লেংচে নিজের আস্তাবলে ফিরে এল৷ সেখানে খড় দিয়ে তার জন্য সুন্দর এক বিছানা বানিয়ে রেখেছিল ক্লোভার আর বেঞ্জামিন।

Horse painting 1
কোনওমতে লেংচে লেংচে নিজের আস্তাবলে ফিরে এল

পরের দু’দিন বক্সার আস্তাবলেই রইল৷ শুয়োরেরা ইতোমধ্যে গোলাপি রঙের ওষুধের একটা বড় বোতল পাঠিয়ে দিয়েছে৷ বোতলটা নাকি চানঘরের ওষুধের বাক্সে পাওয়া গিয়েছিল৷ ক্লোভার খাবার পরে দু’বেলা নিয়ম করে বক্সারকে সেই ওষুধ খাওয়াতে লাগল৷ সন্ধেবেলায় ক্লোভার বক্সারের আস্তাবলে তার পাশে বসে গল্পগাছা করে, আর বেঞ্জামিন বক্সারের গা থেকে মাছি তাড়িয়ে দেয়৷ বক্সার দাবি করে, যা ঘটেছে সে নিয়ে তার মনে কোনও দুঃখ নেই৷ সে যদি এ-যাত্রা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে— তা হলে আশা করা যায় আরও বছর-তিনেক বাঁচবে৷ তখন ওই বিশাল চারণভূমির এক কোণে সে পরম শান্তিতে দিন কাটাবে। সেই সময়েই জীবনে প্রথমবারের জন্য সে পড়াশুনো করার আর নিজের মানসিক উন্নতি ঘটানোর ফুরসত পাবে৷ তার ইচ্ছে, শেষ জীবনটুকু বর্ণমালার বাকি বাইশটা অক্ষর শেখার চেষ্টাতেই কাটিয়ে দেবে৷ 

এখন ঘটনা হচ্ছে, বেঞ্জামিন আর ক্লোভার সারা দিনের কাজকর্ম সেরে কেবলমাত্র সন্ধের দিকেই বক্সারকে সময় দিতে পারে৷ আর সেদিন যখন বক্সারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িটা এল, তখন সবেমাত্র দুপুর৷ জন্তুরা একটা শুয়োরের তদারকিতে শালগমের খেতে আগাছা সাফ করছিল৷ এমন সময় তারা অবাক হয়ে দেখল বেঞ্জামিন তারস্বরে চিৎকার করতে করতে খামার বাড়ির দিক থেকে দৌড়ে আসছে৷ এর আগে জন্তুরা বেঞ্জামিনকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখেনি, এমনকি দৌড়োতেও দেখেনি৷ বেঞ্জামিন চিৎকার করে বলল, “এখ্খুনি এসো! তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি! ওরা বক্সারকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।” 

শুয়োরের নির্দেশের জন্য জন্তুরা আর অপেক্ষা করল না৷ হাতের কাজ ফেলে সবাই একসঙ্গে ছুটল খামারবাড়ির দিকে। সত্যিই তো! খামারের উঠোনে দু’ঘোড়ায়-টানা একটা বিশাল ঢাকা-গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটার গায়ে কী-সব যেন লেখা! মাথায় কালো রঙের গোল টুপি পরা একটা ধূর্তমতো লোক বসে আছে চালকের আসনে৷ ওদিকে আস্তাবলও ফাঁকা, বক্সার নেই। 

জন্তুরা গাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একযোগে বলে উঠল, “বিদায়, বক্সার! বিদায়!”

Horse painting animal farm
সেদিন যখন বক্সারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িটা এল, তখন সবেমাত্র দুপুর

“বোকা! একদম হদ্দ বোকা সব!” বেঞ্জামিন নিজের ছোট ছোট খুরগুলোকে মাটিতে ঠুকে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল জন্তুদের চারপাশে, “মূর্খের দল! তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না গাড়িটার গায়ে কী লেখা আছে?” এই কথা শুনে জন্তুরা খানিক থমকে গেল। সবাই একদম চুপচাপ৷ মুরিয়েল বানান করে শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করছিল, বেঞ্জামিন তাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সেই মৃত্যু-শীতল নীরবতার মাঝেই পড়তে শুরু করল, “‘অ্যালফ্রেড সাইমন্ডস৷ ঘোড়ার কসাই ও শিরিষের আঠা প্রস্তুতকারী, উলিংডন৷ চামড়া ও অস্থিচূর্ণ ব্যবসায়ী৷ কুকুরের খাদ্য সরবরাহকারি৷’ এর মানে কি তোমাদের মগজে ঢুকছে না? ওরা বক্সারকে কসাইখানায় নিয়ে যাচ্ছে কোতল করতে!” 

ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করে উঠল জন্তুরা৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘোড়া-চাবকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল চালক, দেখতে দেখতে দুলকি চালে খামারের উঠোনও পেরিয়ে গেল৷

 জন্তুরা গাড়িটার পিছু ধাওয়া করল৷ গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল৷ ক্লোভার গাড়িটার সামনে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটাও গতি বাড়াতে শুরু করেছে৷ ক্লোভারেরও পায়ের পেশী বেশ শক্তিশালী৷ তার সাহায্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অর্ধ-বল্গ গতিতে দৌড় শুরু করল। দৌড়োতে দৌড়োতেই সে চিৎকার করতে লাগল, “বক্সার! বক্সার! বক্সার!”

 ঠিক সেই সময় বাইরের এই হই-হট্টগোল কানে গেল বক্সারের৷ নাকের নীচে সাদা ছোপওয়ালা বক্সারের মুখটা উঁকি দিল গাড়ির পেছনের ছোট্ট জানলাটা দিয়ে৷ ক্লোভার আর্তনাদ করে উঠল, “বক্সার! বেরিয়ে এসো! শিগগির বেরিয়ে এসো! ওরা তোমাকে মারবে বলে নিয়ে যাচ্ছে!”
(চলবে)

 

*পরের পর্ব ৯ জুন
* ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr, RawpixelWallpaperflare

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *