ক্লোভার ছাড়াও এখন খামারে আরও তিনটি ঘোড়া রয়েছে৷ তাদের চেহারা বলিষ্ঠ, কাজের ব্যাপারে নিবেদিত প্রাণ, এমনকি কমরেড হিসেবেও তারা বেশ ভালো। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাদের ঘটে বুদ্ধি বলে বস্তুটি মোটেই নেই, যাকে বলে একেবারে হদ্দ বোকা৷ তিনজনের মধ্যে কারও পক্ষেই বর্ণমালার ‘B’ অক্ষরের বেশি শেখার সাধ্যি হয়নি৷ বিপ্লব বা পশুবাদের নীতি বিষয়ে যা–কিছু ওদের বলা হয় তার সবটাই ওরা বিশ্বাস করে৷ বিশেষ করে ক্লোভার কিছু বললে তো কথাই নেই, ক্লোভারকে ওরা মায়ের মতোই ভক্তি–শ্রদ্ধা করে৷ কিন্তু ওদের যা–যা বলা হয় তার কিছুমাত্রও ওরা বুঝতে পারে কি না সে–বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷
অ্যানিম্যাল ফার্ম এখন আগের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ আর সংগঠিত৷ মিস্টার পিলকিংটনের কাছ থেকে দুটো জমি কেনা হয়েছে। ফলে খামারের আকারও খানিক বেড়েছে। হাওয়া–কলের কাজটাও অবশেষে সফলভাবে সম্পূর্ণ করা গেছে৷ একটা শস্য মাড়াই কল আর একটা খড় তোলার যন্ত্র কেনা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বেশ কিছু নতুন নতুন ঘরবাড়ি। হুইম্পার একটা দু–চাকার এক্কা গাড়ি কিনেছে৷ হাওয়া–কলটাকে কিন্তু বিদ্যুৎ তৈরির কাজে লাগানো হয়নি, তার বদলে শস্য পেষাই করার কাজ হচ্ছে সেটা দিয়ে। এতে বেশ দু–পয়সা লাভও হচ্ছে। জন্তুরা খেটে–খুটে আবার একটা হাওয়া কল বানাচ্ছে৷ বলা হয়েছে, এই নতুন হাওয়া কলটা শেষ হলে পরে এর সাহায্যে ডায়ানামো চালানো হবে৷ কিন্তু জন্তুদের থাকার জায়গায় বিজলি বাতি, ঠান্ডা–গরম জল বা সপ্তাহে তিন দিন কাজ–এর মতো যে–সব স্বপ্ন স্নোবল দেখতে শিখিয়েছিল তার কথা এখন আর কেউ মুখেও আনে না৷ নেপোলিয়ন সে–সব পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছে৷ ও–সব নাকি পশুবাদের আদর্শের পরিপন্থী৷ তার কথায় কঠোর পরিশ্রম আর মিতব্যয়ী জীবন যাপনেই রয়েছে আসল আনন্দ!

আজকাল খামারের ধন–সম্পদ বেড়েছে বেশ, কিন্তু তাতে জন্তুদের হতদরিদ্র অবস্থার বিশেষ কোনও হেরফের হয়নি৷ তারা যে–তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে৷ এই কথাটা অবশ্য শুয়োর বা কুকুরদের বেলায় খাটে না৷ হয়তো–বা শুয়োর–কুকুরেরা সংখ্যায় এত বেশি বলেই তাদের অবস্থাটা ভালো৷ এমন নয় যে ওরা কাজ করে না। ওরা ওদের মতো করে কাজ করে বই কী৷ খামারের তদারকি আর সংগঠনের কাজই নাকি অনেক৷ স্কুইলার অক্লান্তভাবে সে–সব কাজের বিবরণ দিয়ে যায়৷ এর বেশিরভাগই এমন ধরনের কাজ যেগুলো বোঝার ব্যাপারে বাকি জন্তুদের কোনও উৎসাহ দেখা যায় না৷ স্কুইলার বলে যে, শুয়োরদের সারাটা দিনই ‘নথি‘, ‘বিবরণী‘, ‘স্মারকলিপি‘, ‘চুক্তিপত্র‘— এইসব রহস্যময় জিনিসপত্র নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এগুলো আর কিছুই নয়, লেখায় ঠাসা বড় বড় কাগজ৷ কাগজগুলো যখন লেখায়–লেখায় একেবারে ভর্তি হয়ে যায় তখন সেগুলোকে চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ স্কুইলারের কথায়, এটাই না কি খামারের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ তবুও এ–কথা তো মানতেই হবে যে, শুয়োর হোক বা কুকুর— কেউই খাদ্য উৎপাদনের জন্য পরিশ্রম করে না। অথচ ওরা সংখ্যায় যথেষ্ট এবং বলতে নেই, পেটপুজোটাও তারা সবসময় বেশ ভালো মতোই সারে৷

বাকি পশুদের জ্ঞান–মতে তাদের জীবন অবশ্য সেই আগের মতোই চলছে। এখনও তাদের পেটে খিদে লেগেই থাকে, তারা খড়ের উপর শোয়, পুকুর থেকে জল খায়, চাষের মাঠে পরিশ্রম করে। এখনও তারা শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায় আর গরমকালে মাছির অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে থাকে৷ খামারের কিছু বুড়ো জন্তু, যাদের মগজে পুরনো দিনের কিছু স্মৃতি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তারা জোন্সকে তাড়াবার ঠিক পরের দিনগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করে৷ সেই দিনগুলো কি আজকের চেয়ে ভালো ছিল, না খারাপ? কিন্তু তাদের যে কিছুই মনে পড়ে না! বর্তমান সময়ের সঙ্গে যেন কোনও কিছুই তুলনা করা যায় না৷ স্কুইলারের দেওয়া পরিসংখ্যান ছাড়া এখন তাদের হাতে আর কিছুই নেই৷ আর সেই পরিসংখ্যান–মতে দিনে–দিনে দুরন্ত উন্নয়ন হয়ে চলেছে এই খামারে৷ জন্তুরা তাদের সমস্যার কোনও সমাধান খুঁজে পায় না৷ সত্যি বলতে কি, সে–সব বিষয়ে মাথা ঘামাবার সময়ও মেলে না তেমন। একমাত্র বুড়ো বেঞ্জামিন হল মূর্তিমান ব্যতিক্রম৷ এই দীর্ঘ জীবনের খুঁটিনাটি সবই না কি তার মনে রয়েছে৷ তার কথায় জীবন এতদিন যেমনভাবে চলে এসেছে, ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনভাবেই চলবে৷ খুব–একটা ভালো যেমন হবে না, তেমনই খুব–একটা খারাপও কিছু হবে না৷ খিদে, কষ্ট, হতাশা— এ–সব তো জীবনের অপরিবর্তনীয় নিয়ম৷
তবু কথায় আছে না আশায় বাঁচে চাষা, জন্তুরাও তাই হাল ছাড়ে না৷ সবচেয়ে বড় কথা, অ্যানিম্যাল ফার্মের সদস্য হিসেবে তাদের গভীর সম্মানবোধ ও প্রাধিকারের অনুভূতি কিন্তু এক বিন্দুও মলিন হয় না৷ তারাই ইংল্যান্ডের একমাত্র খামারের বাসিন্দা যার মালিকানা ও পরিচালনার ভার দুটোই রয়েছে জন্তুদের হাতে৷ ভাবা যায়! শুধু খামারের পুরনো বাসিন্দারাই নয়, সবচেয়ে ছোট জন্তুটা, কথাগুলো চিন্তা করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে৷ আর যখন তারা বন্দুকের ধ্বনি শোনে, দণ্ডের মাথায় পতপত করে সবুজ পতাকা উড়তে দেখে, তখন তাদের বুক এক অপরিসীম গর্বে ভরে ওঠে। এরপএমনকি যে–সব জানোয়ারদের দশ–কুড়ি মাইল দূরের খামার থেকে কিনে আনা হয়েছে তারাও এইর কথা ঘুরে যায় পুরনো দিনের বীরগাথার দিকে— জোন্সের বিতাড়ন, সাত বিধান লেখার কথা, মহাযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী মানব–সেনাকে পর্যুদস্ত করার গল্প৷ পুরনো স্বপ্নগুলোর কোনওটাই এখনও তাদের মন থেকে মুছে যায়নি৷ বুড়ো মেজর এক কালে যে পশু প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিল, তাতে ওরা এখনও বিশ্বাস রাখে৷ একটা দিন আসবে যখন ইংল্যান্ডের সবুজ মাটি থেকে মানুষের পদচিহ্ন মুছে যাবে৷ একদিন–না–একদিন এমন সময় আসবেই৷ হয়তো খুব শিগগিরই সে–দিন আসবে, হয়তো–বা খামারের এখনকার বাসিন্দারা নিজেদের জীবদ্দশায় সে–দিন দেখে যেতে পারবে না৷ কিন্তু সে–দিন আসবেই আসবে৷

খামারের ইতি–উতি এখনও লুকিয়ে–চুরিয়ে ‘ইংল্যান্ডের পশুরা‘ গাওয়া হয়৷ এই গানটা খামারের সবাই মোটামুটি জানে, তবুও কেউ প্রকাশ্যে গলা ছেড়ে গাইতে সাহস পায় না৷ যদিও খামারের সাধারণ জন্তুরা বেশ কষ্ট করেই দিন কাটায়, তাদের সব আশা পূর্ণ হয় না, তবুও তারা যে বাকি জন্তুদের চেয়ে আলাদা সে–ব্যাপারে তারা বেশ সচেতন৷ তারা যদি খিদের জ্বালায় কষ্ট পায় তা হলেও সান্ত্বনা এটাই যে, অভাবটা অত্যাচারী মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য হয়নি৷ তারা যদি হাড়–ভাঙা খাটনিও খাটে, সেটাও তারা খাটে নিজেদের জন্য৷ তাদের মধ্যে কোনও দু–পেয়ে নেই৷ কেউ অন্য কোনও জন্তুকে প্রভু বলে না৷ এখানে সব জন্তুই সমান৷
গ্রীষ্মের শুরুতে হঠাৎই একদিন ভেড়ার পালকে তার সঙ্গে আসার নির্দেশ দিল স্কুইলার৷ তার পিছু–পিছু ভেড়ার পাল গিয়ে পৌঁছল খামারের একদম শেষ প্রান্তে৷ সেখানে একটা পোড়ো জমিতে প্রচুর বার্চ গাছের চারা গজিয়েছে৷ সারাটা দিন ভেড়ার দল স্কুইলারের তদারকিতে ঘুরে–ঘুরে পাতা খেয়ে কাটালো৷ সন্ধে হলে স্কুইলার নিজে খামারবাড়িতে ফিরে এল আর ভেড়ার পাল-কে বলে এল যে, বড্ড গরম, তোমরা বরং এখানেই থাকো৷ এমনভাবে ভেড়ার দল একটা পুরো সপ্তাহই সেখানে কাটিয়ে দিল৷ এই সময়টা খামারের বাকি জন্তুরা ভেড়াদের টিকিরও দেখা পেল না৷ দিনের সিংহভাগ সময় স্কুইলার ভেড়াদের সঙ্গেই কাটায়৷ জিজ্ঞেস করলে বলে, সে নাকি ভেড়াদের একটা নতুন গান শেখাচ্ছে, তাই খানিক নিরালায় থাকা প্রয়োজন।
ভেড়ার দল ফিরে আসার কিছুদিন পরের কথা৷ এক মনোরম সন্ধে৷ জন্তুরা নিজেদের কাজ শেষ করে খামারবাড়ির দিকে ফিরে আসছে, এমন সময় খামারবাড়ির উঠোন থেকে এক ভয়ার্ত ঘোড়ার ডাক শোনা গেল৷ জন্তুরা থমকে দাঁড়াল সবাই৷ এ তো ক্লোভারের গলা! দ্বিতীয়বার সেই চিৎকার কানে আসতেই জন্তুরা পড়ি–কি–মরি করে উঠোনের দিকে ছুটল৷ ক্লোভার যা দেখে চিৎকার করছিল, সেটা ওরাও এবার দেখতে পেল৷
একটা শুয়োর পিছনের দু–পায়ে ভর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে!
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।