জন্তুরা সমস্ত কথাই বিশ্বাস করল। সত্যি বলতে কি, জোন্স বা তার আমলের সমস্ত স্মৃতি এখন আবছা হয়ে এসেছে তাদের মনে৷ ওরা জানে আজকাল বড্ড কষ্টে দিন কাটছে৷ বেশিরভাগ সময় খিদে লেগেই থাকে৷ ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে যায় হাড়ে। এ-ছাড়াও ঘুমোবার সময়টুকু বাদে যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণই ওদের কাজ করতে হয়। তবুও এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আগেকার দিনগুলো আজকের তুলনায় বহুগুণে মন্দ ছিল। তা ছাড়া সে-সময় ওরা ছিল ক্রীতদাস, আর আজ ওরা সবাই স্বাধীন— এটাই যে সবচেয়ে বড় তফাত সেটা স্কুইলার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে ভোলে না।
এখন অবশ্য আরও বেশি জন্তুর মুখে খাবার জোগাতে হয়৷ শরৎকালে চারটি পূর্ণবয়স্ক শূকরী প্রায় একই সঙ্গে বাচ্চা দিয়েছে৷ সব মিলিয়ে একতিরিশটি শুয়োরছানা। ছানাগুলির গায়ে সাদা-কালো ছোপ ছোপ, এবং ফার্মের মধ্যে যেহেতু নেপোলিয়নই একমাত্র পূর্ণবয়স্ক পুরুষ শুয়োর তাই বাচ্চাগুলোর বাবা কে— সেটা সহজেই অনুমান করা যায়৷

কিছুদিনের মধ্যে কিছু ইট আর কাঠ কিনে এনে ঘোষণা করা হল যে, খামারবাড়ির বাগানে একটা স্কুলঘর তৈরি করা হবে। ইতোমধ্যে শুয়োরছানারা খামারবাড়ির রান্নাঘরে নেপোলিয়নের কাছেই পড়াশোনা শিখতে শুরু করেছে৷ তারা ব্যায়াম করে বাগানের চৌহদ্দির মধ্যে৷ অন্য কোনও জন্তুর বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মেলামেশা করা একদম বারণ। এমন সময় নিয়ম করা হল যে, রাস্তায় যদি একটা শুয়োরের সঙ্গে কোনও অন্য জন্তুর দেখা হয়ে যায় তা হলে সেই অন্য জন্তুটি শুয়োরকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়াবে। এ-ছাড়াও বলা হল, যে কোনও শুয়োর— তার মর্যাদা যেমনই হোক না কেন— সে চাইলে প্রতি রবিবার নিজের লেজে সবুজ ফিতে বেঁধে ঘুরতে পারবে।
বছর শেষ হলে বোঝা গেল, ফসল ফলানোর দিক থেকে তারা সফল হলেও হাতের টাকা-কড়ি তেমন নেই৷ এদিকে স্কুলবাড়ি তৈরি করতে ইট, বালি ও চুন কেনার দরকার। অন্যদিকে হাওয়াকলের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য টাকাও জমাতে হবে৷ এ-ছাড়াও বাতির জন্য তেল, খামারবাড়ির মোমবাতি— এসবও কিনতে হবে। নেপোলিয়নের নিজস্ব টেবিলের জন্য চিনিও লাগবে৷ (মোটা হয়ে যাবার ভয় আছে বলে নেপোলিয়ন অবশ্য অন্য শুয়োরদের চিনি খাওয়া নিষেধ করে দিয়েছে।) আর লাগবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র৷ যেমন— টুকটাক যন্ত্রপাতি, পেরেক, দড়ি, কয়লা, তার, ছাঁটাই লোহা আর কুকুরের বিস্কুট৷ তাই বেশ কয়েক আঁটি খড় আর কিছুটা আলু বেচে দিতে হল। ডিম সরবরাহের যে সাপ্তাহিক চুক্তি ছিল সেটাকেও বাড়িয়ে ছ’শো করে দেওয়া হল৷ ফলে মুরগির সংখ্যাও আর আগের মতো রইল না, কারণ তারা ডিম ফুটিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ ছানার জন্মই দিতে পারল না।

ডিসেম্বরে যেমন খাবারের বরাদ্দ কমানো হয়েছিল, তেমনই আবার ফেব্রুয়ারি মাসেও খাবারের বরাদ্দ কমল৷ তেল বাঁচানোর জন্য জন্তুদের থাকার জায়গায় লণ্ঠন জ্বালানো নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল৷ কিন্তু শুয়োরদের উপর এ-সবের কোনও ছাপ পড়েনি৷ দেখলে মনে হয় তারা যেন দিব্যি আরামে আছে৷ গায়ে-গতরেও হচ্ছে বেশ।
ফেব্রুয়ারি শেষ হয় হয়, এমন সময় এক বিকেলে দারুণ উত্তেজক এক গন্ধ পাওয়া গেল৷ এমন লোভনীয় গন্ধ জন্তুরা আগে কখনওই পায়নি। অনেকেরই পেটে খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল সেই গন্ধে। খামারবাড়ির রান্নাঘরের পেছনে একটা ছোট্ট ভাটিখানা আছে। জোন্স চলে যাওয়ার পর থেকেই ঘরটা আর ব্যবহার করা হত না। পড়েই ছিল। গন্ধটা আসছে সেই ঘরটা থেকেই, ছড়িয়ে পড়েছে খামারের উঠোনময়। কে যেন বলল— বার্লি রান্না হচ্ছে। এ তারই সুবাস৷ জন্তুরা বুভুক্ষুর মতো বাতাসে সেই গন্ধ শুঁকতে লাগল। ভাবল, সেই খাবার বুঝি রাতের বেলার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু সে-গুড়ে বালি৷ সেই পানীয় তো মিললই না, বরং পরে রবিবার ঘোষণা করে দেওয়া হল যে, এখন থেকে সমস্ত বার্লি কেবলমাত্র শুয়োরদের জন্যই সংরক্ষিত থাকবে। ইতোমধ্যেই ফল-বাগানের ওপাশের জমিতে বার্লির বীজ বোনা হয়ে গিয়েছে।
শীঘ্রই এক নতুন খবর ফাঁস হল৷ প্রত্যেক শুয়োরের জন্য না কি এখন রোজ এক পাঁইট করে বিয়ার বরাদ্দ হয়েছে, আর নেপোলিয়নের নিজের জন্য আধা গ্যালন৷ নেপোলিয়নের বিয়ার পরিবেশন করা হয় ক্রাউন ডার্বি স্যুপের পাত্রে৷

যদিও আজকাল জন্তুদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তবু সে-সব কষ্ট পুষিয়ে যায় যখন তারা ভেবে দেখে যে তাদের জীবনের মান-মর্যাদা আগের তুলনায় কত বেড়েছে! আজকাল প্রায়ই গান গাওয়া হচ্ছে, প্রচুর বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে, মিছিলও বেরোচ্ছে ঘন ঘন। নেপোলিয়ন নির্দেশ দিয়েছে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে একটি করে—যাকে বলে স্বতঃস্ফূর্ত কার্যক্রম হবে৷ যার উদ্দেশ্য, অ্যানিমেল ফার্মের লড়াই ও বিজয় উদযাপন করা৷ এক নির্দিষ্ট সময়ে জন্তুরা নিজেদের কাজ মুলতুবি রেখে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করতে করতে ফার্মের প্রাঙ্গণে ঘুরবে৷ শুয়োরেরা নেতৃত্ব দেবে, তারপরে থাকবে ঘোড়ারা, তার পিছনে যথাক্রমে থাকবে গোরু, ভেড়া ও হাঁস-মুরগির দল৷ কুকুরেরা এই শোভাযাত্রার পাশে পাশে চলবে। আর সবার সামনে হাঁটবে নেপোলিয়নের সেই কালো মোরগছানা৷ এই শোভাযাত্রায় বক্সার আর ক্লোভারের দায়িত্ব খুর আর শিং আঁকা সেই সবুজ পতাকা বয়ে নিয়ে যাওয়া। পতাকায় লেখা থাকে, ‘কমরেড নেপোলিয়ন দীর্ঘজীবী হোন’। তারপর নেপোলিয়নের সম্মানে কবিতা পাঠ করা হয়৷ খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধির সাম্প্রতিকতম তথ্যাবলী বিস্তারিত জানায় স্কুইলার, এবং এই পুরো কার্যক্রমের মাঝে মাঝে একবার করে বন্দুকধ্বনি করা হয়। এই স্বতঃস্ফূর্ত কার্যক্রমের অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়ল ভেড়াগুলো। কেউ যদি কোনও অভিযোগ করে (শুয়োর বা কুকুরেরা আশেপাশে না থাকলে অনেক সময় কিছু জন্তু অভিযোগ করে যে, তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে বা বেকার বেকার ঠান্ডায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।) তা হলেই ভেড়ার দল ‘চারপেয়েরা ভালো, দুপেয়েরা খারাপ’ বলে শোরগোল তুলে অভিযোগকারীদের চুপ করিয়ে দেয়৷
এক নির্দিষ্ট সময়ে জন্তুরা নিজেদের কাজ মুলতুবি রেখে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করতে করতে ফার্মের প্রাঙ্গণে ঘুরবে৷ শুয়োরেরা নেতৃত্ব দেবে, তারপরে থাকবে ঘোড়ারা, তার পিছনে যথাক্রমে থাকবে গোরু, ভেড়া ও হাঁস-মুরগির দল৷ কুকুরেরা এই শোভাযাত্রার পাশে পাশে চলবে। আর সবার সামনে হাঁটবে নেপোলিয়নের সেই কালো মোরগছানা৷ এই শোভাযাত্রায় বক্সার আর ক্লোভারের দায়িত্ব খুর আর শিং আঁকা সেই সবুজ পতাকা বয়ে নিয়ে যাওয়া। পতাকায় লেখা থাকে, ‘কমরেড নেপোলিয়ন দীর্ঘজীবী হোন’। তারপর নেপোলিয়নের সম্মানে কবিতা পাঠ করা হয়৷ খাদ্যশস্যের ফলন বৃদ্ধির সাম্প্রতিকতম তথ্যাবলী বিস্তারিত জানায় স্কুইলার, এবং এই পুরো কার্যক্রমের মাঝে মাঝে একবার করে বন্দুকধ্বনি করা হয়।
তবে এ-কথাও ঠিক যে, বেশিরভাগ জন্তুরাই এই উদযাপন বেশ উপভোগ করে৷ তারা যে কারও দাস নয়, নিজেদের মর্জির মালিক এবং তারা যে খাটাখাটনি করছে তা কেবলমাত্র নিজেদেরই সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য—এই কথাগুলো বারবার মনে করিয়ে দিলে তাদের বেশ স্বস্তি হয়৷
অতএব এই গান, শোভাযাত্রা, স্কুইলারের পরিসংখ্যান, বন্দুকের গর্জন, মোরগছানার কোঁকর কোঁ বা পতাকা ওড়ানো— এ-সবের মাঝে তাদের পেটের খিদেটা বেশ চাপা পড়ে যায়, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও৷

এপ্রিল মাসে অ্যানিম্যাল ফার্মকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হল৷ এবার কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা দরকার। এ-ক্ষেত্রে একজনই মাত্র প্রার্থী— নেপোলিয়ান৷ এক বাক্যে সবাই তাকে নির্বাচিত করল, সে-দিনই জানা গেল যে, স্নোবলের সঙ্গে জোন্সের আঁতাতের ব্যাপারে আরও কিছু কাগজপত্র হাতে এসেছে৷ এবার পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, স্নোবল শুধু গোয়ালঘরের যুদ্ধে জন্তুদের হারাবারই চেষ্টা করেনি, সে একেবারে সরাসরি জোন্সের পক্ষ নিয়েই লড়াই করেছিল৷ আরও খোলাখুলি বললে স্নোবলই ছিল মানুষদের দলের নেতা৷ ‘মানুষ দীর্ঘজীবী হোক’— এই বলে চিৎকার করতে করতেই সে জন্তুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল৷ অনেক জন্তুরই হয়তো এখনও মনে আছে যে যুদ্ধের সময় স্নোবলের পিঠে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছিল। সেটা আর কিছুই নয়— নেপোলিয়নের দাঁতের কামড়৷
গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় নাগাদ দাঁড়কাক মোজেস কোত্থেকে এসে উদয় হল৷ আজ বহু বছর হল সে ফার্ম ছেড়ে বেপাত্তা। তবে দেখা গেল, এতদিনেও তার স্বভাব-চরিত্র বিশেষ বদলায়নি৷ কাজের সময় তার পাত্তা পাওয়া যায় না এবং এখনও সে চিনি-মিছরির পাহাড়ের সেই ঘ্যানঘেনে গপ্পো বলে৷ সে একটা খুঁটির ওপর বসে ডানা ঝাপটায়, আর তেমন শ্রোতা পেলে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ধরে বকর বকর করে চলে। নিজের বিশাল ঠোঁট উঁচিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলে, “ওই ওপরে কমরেডস৷ ওই কালো মেঘটার উল্টো পিঠেই সেই চিনি-মিছরির পাহাড়। সে-এক মহানন্দের দেশ, বুঝলে! আমাদের মতো কপাল-পোড়া জন্তুরা এই হাড়ভাঙা খাটুনির জীবন থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়ে সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নেবে।” তার দাবি, সে নাকি খুব উঁচু দিয়ে ওড়ার সময় একবার সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। সে দেখেছে, সেখানকার মাঠ কেমন ক্লোভার ঘাসে ছেয়ে রয়েছে। যে-ঘাস কখনও ফুরোবে না। এ-ছাড়াও ঝোপে-ঝাড়ে ফলে রয়েছে তিসির খোল আর চিনির ডেলা। অনেক জন্তুই তাকে বিশ্বাস করে। ওরা ভাবে, সত্যিই তো! তাদের জীবন মানেই তো স্রেফ খিদের জ্বালা আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম। এর চেয়ে আরও ভালো জীবন অন্য কোথাও থাকা তো অবশ্যই সম্ভব। একশো বার সম্ভব। তবে মোজেসের প্রতি শুয়োরদের মনোভাব বোঝা দুষ্কর। একদিকে তারা মোজেসের এই কথাগুলোকে গুলতাপ্পি বলে অবজ্ঞা করে, অন্যদিকে মোজেস কোনও কাজ করে না— তা সত্ত্বেও তাকে ফার্মে থাকতে দিচ্ছে৷ এমনকি রোজ চার আউন্স করে বিয়ারও বরাদ্দ করেছে তার জন্য।
(চলবে)
*পরের পর্ব ২৬ মে
* ছবি সৌজন্য: লেখক, Pixabay, Youtube,
অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।