কবি, গল্পকার ও জনপ্রিয় সন্দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে তিন দশক যাবত কর্মরত প্রণব মুখোপাধ্যায় খ্যাতি থেকে দূরেই স্বচ্ছন্দ থেকেছেন জীবনভর। তাঁর অনুবাদে বার্নার্ড শ-এর লেখা দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ দ্য ব্ল্যাক গার্ল ইন হার সার্চ ফর গড‘ (শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান) গল্পটিকে, এখনও পর্যন্ত বাংলায় সামগ্রিকভাবে শ’-এর যতগুলো অনুবাদ হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলা যায়।

পরিতাপের বিষয় এই, ব্যক্তিলেখক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো এই বইও কিছুটা প্রচারের আড়ালেই থেকে গেছে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরেও (১ মে, ২০২০) তাঁকে নিয়ে সন্দেশ পত্রিকায় গুটিকয় লেখা ছাড়া বিশেষ কোনও স্মৃতিচারণ চোখে পড়েনি। শ্রী মুখোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। জর্জ বার্নার্ড শ ছাড়াও তিনি লুই ক্যারল ও এডওয়ার্ড লিয়র-এরও অনুবাদ করেছেন।

শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধানবইটির প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০১৮। জর্জ বার্নার্ড শ-এর মূল গল্পটি প্রকাশিত হয় আট দশকেরও বেশি সময় আগে, ১৯৩২ সালে, লন্ডনের একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে। বইয়ের অলংকরণ করেছিলেন শিল্পী জন ফারলেই। ১৯৩১-৩২ নাগাদ জন যখন নিজের কাঠ-খোদাই করা পরীক্ষামূলক শিল্পকর্মগুলিকে নিয়ে প্রকাশনার দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন খুব আকস্মিকভাবে এক সুহৃদ মারফত বার্নার্ড শ’-এর একটি চিঠি এসে পৌঁছয় তাঁর হাতে। শ’ তাঁর গল্পের অলংকরণের জন্য জনকে অনুরোধ জানান। ক্রমশ তাঁদের পত্রালাপ দীর্ঘায়িত হতে থাকে। শ’ এবং জনের এই কথোপকথনগুলির সুনিপুণ উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে অনুবাদ গ্রন্থটিতে। লিখেছেন, সম্পাদক সৌম্যেন পাল।

Black Girl
বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় জন ফারলেই-কৃত এমনই অসামান্য এক কাঠখোদাই ছাপা

সমগ্র বই জুড়ে এক নগ্ন মেয়ের ছবি, কালো মেয়ের ছবি পাঠক দেখতে পান, যার নগ্নতার কথা স্পষ্ট করে গল্পে উল্লিখিত হয় না। হয় কেবল তার ত্বকের বর্ণনা। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, শ’-এর এই কৃষ্ণাঙ্গী, ধর্মসর্বস্ব পোশাকি সভ্যতার গালে একটি নগ্নতার সপাট-থাপ্পড়, যে, সাদা চামড়ার এক ধর্মপ্রচারক নারীর কাছে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে ঈশ্বরের সন্ধানে, কেন না সে পবিত্র বাইবেল থেকে জেনেছে, ‘খোঁজ, আমাকে পাবে।’ অতএব হাতে একটি আত্মরক্ষার লাঠি নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে ঈশ্বরকে খুঁজতে, জায়গা বিশেষে যেটিকে সে ব্যবহার করতেও উদ্যত হয়।

শ্যামাঙ্গীর দেখা হয়ে যায় যিশুর মতো দেখতে এক স্নিগ্ধ যুবকের সঙ্গে, একজন শিল্পীর সঙ্গে, যে ক্রুশের ওপর জীবন্ত ঈশ্বর বানাতে চাইছেদেখা হয় মহম্মদের সাধকের সঙ্গে, এক নাস্তিকের সঙ্গে  যার চরিত্র ইভান পাভলভের আদলে তৈরিএকদল বিজ্ঞানী ও তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে। এঁরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব অবস্থানের যুক্তিতে (নাকি যুক্তিহীনতায়) ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।

মেয়েটি এসবের কিছুই বুঝতে চায় না। সে ঈশ্বরকে খুঁজতে চায়।

Black Girl
শ্যামাঙ্গী ঈশ্বরকে খুঁজতে চায়

এই সন্ধান কি এক প্রান্তিকের আত্মানুসন্ধানও নয়? বর্ণের নিরিখে যে কৃষ্ণাঙ্গ, লিঙ্গের নিরিখে যে নারী, বয়সের নিরিখে যে অনভিজ্ঞ, তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তির নিরিখে যে অ-শিক্ষিত, সে-ই প্রান্তিক, যে কেবল স্বকীয় অস্তিত্বে বিশ্বাস করে উল্টোদিকের সভ্যতাকে নিরন্তর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

১৯৩২-এর খ্রিস্টমাসে বাইবেলের চেয়ে বেশি বিক্রি হয় শ’-এর এই বই। ক্যাথলিকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক সংস্করণ। আব্রাহামিক ধর্মের সর্বশক্তিমান একেশ্বরবাদী তত্ত্বকে শ’ যেমন অস্বীকার করেন, তেমনই, ধর্মগ্রন্থ ব্যাপারটাকেই নাস্তিকদের, নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রবণতাকেও শ্লেষ করতে ছাড়েন না৷ বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যেখানে এই অজ্ঞেয়র অবস্থানে দাঁড়িয়ে শ’ তাঁর বইয়ের পরবর্তী সংস্করণের প্রাককথনে বলেন, বাইবেল কোনও সর্বময়কর্তা‘ (divine authority)-কে নিয়ে লেখা বই নয়, কিন্তু বাইবেল ইতিহাস ও নৈতিকতাকে জানার কারণে অবশ্যপাঠ্য।

‘ব্ল্যাক গার্ল’-এর বাংলা-অনুবাদ কেন শ্যামাঙ্গী, তা নিয়ে শেষকথনে কাবেরী বসু নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তবু মনে হয়, শ্যাম ও শ্যামা বাংলা সংস্কৃতির অনুষঙ্গে অতি সহজেই ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরীর সমনামে ধরা দেয়। শ’-এর কালো নগ্নিকা যে ঈশ্বরের সন্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই স্ব-এর অস্তিত্বানুসন্ধানের দিকে এগিয়ে যায়, শ্যামাঙ্গী শব্দটি তারও ঈঙ্গিতবাহী।

G B Shaw
জর্জ বার্নার্ড শ-এর মূল গল্পটি প্রকাশিত হয় আট দশকেরও বেশি আগে

রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এ শতকেও সমানভাবে আলোচনার দাবি রাখা জর্জ বার্নার্ড শ’-এর এই গল্পের, প্রত্যেকটি অনুপুঙখের অনুবাদ প্রণব মুখোপাধ্যায় এতটাই নৈপুণ্যের সঙ্গে করেছেন যে, মূল রচনার মধ্যেকার বিদ্রুপ, ধন্দ ও নৈরাশ্যের সুর নিখুঁতভাবে বাঙালি পাঠকের কানে ধরা দেয়। শ’-এর এলিট বাঙালি পাঠকেরা ইংরেজি পড়তে জানেন নিশ্চিত। কিন্তু স্বীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে একটি পাঠপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে, তা যেমন পাঠককে ঋদ্ধ করে, তেমনই বাংলাভাষা আর সাহিত্যকেও। 

 

গ্রন্থ: শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান
জর্জ বার্নার্ড শ
অনুবাদ: প্রণব মুখোপাধ্যায়
চিত্রকথা: সৌম্যেন পাল
কথামুখ: কাবেরী বসু
প্রকাশক: বুকফার্ম
বিনিময়: ১৮০ টাকা

*ছবি সৌজন্য: biography.com এবং বুক ফার্মের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

বিহু পেশায় বহুজাতিক সংস্থার কর্মী। আদি নিবাস নদিয়া জেলার শান্তিপুর। কর্মসূত্রে আট বছর যাবৎ দেশের একাধিক শহরে ভ্রাম্যমাণ। সঙ্গী বলতে রঙিন মাফলার আর বেরঙিন ইনহেলার। গরিমা বলতে ঘরজোড়া বইপত্র ও একটি যুক্তাক্ষরবিহীন নাম৷ স্বপ্ন দেখেন একদা চাকরি ছেড়ে গ্লোবট্রটার হওয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *