বিশেষতঃ গত দশ বছরে যখন আপামর দুনিয়ার আদর্শ আর সংস্কৃতি দেউলে হতে বসেছে, যৌবন যখন ডিপ্রেশন আর সেপারেশনের হতাশায় ডুবছে, তখন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের নামটাই ক্রমশ অনিবার্য আলোচ্য হয়ে উঠছে।
আজ তাঁর জন্মদিন। ৭৯ বছরে পা দিলেন তিনি। বরাবরই নিজেকে ‘মার্ক্সবাদী-নারীবাদী-বিনির্মাণবাদী’ বলতেই পছন্দ করেন স্পিভাক। নিম্নবর্গর ইতিহাস চর্চায় (সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ) আজ সারা দুনিয়া তাঁর নাম উচ্চারণ করে একবাক্যে, বাঙালি হিসেবে এ আমাদের গর্ব। একদা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী এই আন্তর্জাতিক বাঙালির কাজকে বিভিন্ন সময়ে সম্মান জানিয়েছেন জাঁক দেরিদা, টেরি ঈগলটন, জুডিথ বাটলার থেকে এডওয়ার্ড সঈদের মত চিন্তক-দার্শনিকরা।

যে সমস্ত ধারণার ভেতর আড়াল হয়ে চুপিচুপি সেঁধিয়ে ছিল ‘পাশ্চাত্য’ নামক কনসেপ্টজনিত হায়ারার্কি, সে সবকেই নানাভাবে প্রশ্ন করতে শেখান স্পিভাক। যাকে ধরেই নেওয়া হয়েছে সংখ্যাগুরুর ‘সত্য’ বলে, তাকেই বারবার প্রশ্ন করতে করতে উচ্চারণ করে ফেলেন ‘ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?’ সারা দুনিয়ার নীপিড়িত শ্রেণিবৈষম্যের শিকার মানুষেরাও সমস্বরে তার প্রতিধ্বনি করে উঠেছিলেন।
এখানেই অবশ্য থেমে থাকলেন না স্পিভাক। ধারাবাহিকভাবে মহাশ্বেতা দেবীকে অনুবাদ করার মধ্যে দিয়ে, পিছিয়ে পড়া ভারতীয় জনগোষ্ঠীর কথা দুনিয়ার সামনে তুলেও ধরলেন। পাশাপাশি তুলে আনলেন, নোয়ম চমস্কির মতোই, আজকের সমাজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে ধারাবাহিক প্রশ্ন। তাতে অস্বস্তিতে পড়ল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী থেকে বামপন্থী-সকলেই। কিন্তু স্পিভাককে থামানো গেল না। তথাকথিত উচ্চ-মধ্যবিত্তের শহুরে শোষণে হারিয়ে যাওয়া গ্রামের বৈষম্যকে বিশ্বমঞ্চে তুলে আনতে থাকলেন তিনি।
যা কিছু ‘জেনারেলাইজড’ ধারণা, তাকে বারবার প্রশ্ন করলেন, জানতে চাইলেন, ‘প্রান্তিক’ শব্দটার আদত মানে কি? ‘জলই কি জলের আদত মানে’? আমাদের যা কিছু সাংস্কৃতিক বোধ ও চেতনা, তাকে যদি পুজো করার বদলে তার জোরের জায়গাগুলোকে অস্ত্রের মতো কাজে লাগানো যায়, কাজে লাগানো যায় ইতিহাসচেতনা, তবে আজকের অন্ধকার দূর হতে পারে। আমাদের বুদ্ধিজীবীতার ভেতর পাশ্চাত্য ছাঁচের মিথ্যা ঢুকে পড়েছে বহুকাল, ঢুকে পড়েছে হিসেব আর ধান্দা, সেখানেই চোখে-আঙুল দিলেন স্পিভাক।

আয়ওয়া, টেক্সাস, পিটসবার্গ, পেনসিলভেনিয়া, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ছাত্রদের গ্রামশি-হাইডেগার-মার্ক্স-কান্ট-হেগেল পড়াতে পড়াতে কখন যে তিনি আমাদের আত্মার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন চলন্ত সময়ের বিবেক, তার খেয়াল থাকে না। আমরা বুঝি, স্পিভাক এভাবেই ‘ব্যক্তিত্ব’ হয়ে ওঠেন, আর একটি নক্ষত্র আসে..
আজ স্পিভাক জীবন্ত ইতিহাস। কিংবদন্তী। একদা কবি বিনয় মজুমদার যে ‘গায়ত্রী’কে উৎসর্গ করেছিলেন ‘ফিরে এসো চাকা’, সেই বিচ্ছেদের প্রেমগাথা দগ্ধ করে আজকের প্রেসিডেন্সির তরুণীকেও। সেদিনের গায়ত্রী আর আজকের স্পিভাক হয়ে ওঠেন মিথ ও সত্যের এক মাঝামাঝি অবস্থান; যাঁকে ইতিহাস নির্ণয় করে এক আশ্চর্য মেধাজীবীতার মুদ্রায়। সেখানে তিনি আজকের ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘সুশীল সমাজ’, ‘বিদ্বজ্জন’ শব্দগুলির খোলনলচে ধরে হ্যাঁচকা টান মারেন।
যে ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতির কারণে আজ সারা দুনিয়ার মানুষ এক চরমপন্থার মুখোমুখি, যে জনপ্রিয় ইতিহাসচর্চার নেপথ্যে হারিয়ে যায় প্রতিদিনের অনেক অনেক অনিবার্য তবু বিকল্প নাম আর ঠিকানা, তাদেরই ‘ডিকনস্ট্রাক্ট’ করেন স্পিভাক।
মনে পড়ছে, ২০১০ সালে এক সংবাদপত্রের হয়ে তাঁর মুখোমুখি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। সেটা নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের উত্তাল সময়। প্রশ্ন করেছিলাম তাঁর কাজের সূত্রেই সময়ের এই গোটা চালচিত্র নিয়ে। সেদিনের সেই অনামী তরুণ সাংবাদিকের প্রশ্নও মন দিয়ে শুনেছিলেন তিনি। উত্তরও দিয়েছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। আজ ভাবলে অবাক লাগে!

সেই কথাবার্তায় অনেক কিছুর ভেতর বেশ কয়েকটি কথা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। গ্রামশিকে স্মরণ করেই তিনি বলেছিলেন, যিনি সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী, তিনি কখনওই নিজেকে ‘ইন্সট্রুমেন্টালাইজ’ করবেন না। বলেছিলেন, ‘শব্দ’ বদলালেই ‘কাজ’ বদলায় না। তাই, ‘চাকর’ বদলে ‘কাজের লোক’ করলেই যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না মানুষটাকে। তাই, স্বামী বহুকাল আগে প্রয়াত হলেও নিজের ‘স্পিভাক’ পদবীটা বাদ দেননি কখনও তিনি। কারণ জীবনের সবকিছুই হয়তো ইতিহাসের প্রাত্যহিক দলিল-দস্তাবেজ। প্রতিটি নুড়িপাথর ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এভাবেই ‘প্রচলিত’ ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে এক চিরন্তন ধ্রুবক সত্যের পথেই আজও অবিচল স্পিভাক, সেদিনের পড়ন্ত বিকেলে ‘না-বুঝেই’ আমি যার প্রতিবেশী হয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য।
ভালো থাকুন স্পিভাক। তাঁকে আমাদের প্রণাম।
*ছবি সৌজন্য: literaturfestival.com, mythosmag.com, italianacademy.columbia.edu
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।