সদ্যঃ পাতকসংহন্ত্রী সদ্যোদুঃখবিনাশিনী।
সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গঙ্গৈব পরমা গতিঃ।।
–যিনি পাপহরণ করেন, দুঃখ বিনাশ করেন; সুখদাত্রী, মোক্ষদাত্রী গঙ্গা, সেই গঙ্গাই আমার পরম গতি।

গঙ্গার প্রণামমন্ত্র এটি। কলিযুগে অবতার হলেন কল্কি, শাসক হল ধনলোভী এবং বুদ্ধিজীবী শাস্ত্রহীন কিন্তু গঙ্গাই পরম তীর্থ। মহাভারতের বনপর্বে বলা হয়েছে—সত্যযুগে সকল স্থানই তীর্থ, ত্রেতায় পুষ্করের শ্রেষ্ঠত্ব, দ্বাপরের শ্রেষ্ঠ তীর্থ কুরুক্ষেত্র, কলিযুগের শ্রেষ্ঠ তীর্থ হল গঙ্গা।

…সর্ব্বং কৃতযুগে পুণ্যং ত্রেতায়াং পুষ্করং স্মৃতম্।
…দ্বাপরে তু কুরুক্ষেত্রং গঙ্গা কলিযুগে স্মৃতা।
গঙ্গাকে তিন ভাবে দেখা যেতে পারে। এক– আর্য্যাবর্ত্তস্থিত পবিত্র নদীবিশেষ। দুই– দেবীবিশেষ, গঙ্গাদেবী। তিন—হ্লাদিনী-প্রভৃতি সপ্তগঙ্গা। শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণে গঙ্গার কথা আছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৭৫ সূক্তে ঊনিশটি নদীর স্তুতি আছে। স্তুতি করেছেন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি সিন্ধুক্ষিৎ। সিন্ধু নদীর পর গঙ্গার উল্লেখ আছে সেখানে। ঋগ্বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের ৬৫ সূক্তে গঙ্গার কথা পাওয়া যায়। তৃতীয় মণ্ডলের ৫৭ সূক্তে জাহ্নবীর উল্লেখ আছে। জহ্নু মুনির কথা সকলেই জানেন। আচার্য মনু গঙ্গার মাহাত্ম্য কীর্তন করেছেন– শূদ্রদের রাজ্যেও কেউ বাস করতে পারেন যদি সেখানে গঙ্গা প্রবাহিত হয়, সেই দেশে যদি মূর্খরা বাস করেন তবু সেই দেশ পবিত্র বলে পরিগণিত হবে। অত্রিসংহিতাতে গঙ্গার কথা রয়েছে। বামনপুরাণে দেখা যায়, মেনকার তিন কন্যা—রাগিনী, কুটিলা ও কালী। কুটিলাকে শিবের ব্রহ্মতেজ গ্রহণ করতে বললে তিনি তাঁর অক্ষমতার কথা জানান। তখন তিনি অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে বহমান হন। ওই কুটিলা নদীই গঙ্গা। কুটিলা নদী শিবতেজ ধারণ করে শরবনে নিক্ষেপ করেন, তিনিই কার্তিকের মা। তাই কার্তিক হলেন গাঙ্গেয়। মহাভারতে গঙ্গা হলেন দেবব্রত-ভীষ্মের মাতা।

রামায়ণের বালখণ্ডে সগর রাজার কাহিনি আছে। সগরের ৬০ হাজার পুত্র যজ্ঞাশ্ব খুঁজতে গিয়ে পাতালে নিহত হন। সগরের পৌত্র দিলীপ অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। শিবের আদেশে দিলীপের দুই রাণী সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে ভগীরথের জন্ম দেন। ভগে ভগে মিলনের ফলে জন্ম বলে তাঁর এমন নাম। ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গাকে আনলেন, তাই গঙ্গার অন্য নাম ভাগীরথী। 

শ্রীকৃষ্ণ গঙ্গার প্রেমে পড়েছিলেন। তখন রাধা বাক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গাকে পান করতে উদ্যত হন। ভীতা গঙ্গা শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় নেন। পরে কৃষ্ণের নখাগ্র থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি, তাই তাঁর অন্য নাম বিষ্ণুপদী। ব্রহ্মার অনুরোধে কৃষ্ণ পরে গঙ্গাকে বিবাহ করেন। পদ্মাপুরাণ অনুসারে, গঙ্গা সুরূপা, অপরূপা, রূপলাবণ্যময়ী। দেহবর্ণ শঙ্খের মতো বা কুন্দ কুসুমের ন্যায় শ্বেতশুভ্র। শুভ্রবসনা দেবীর কন্ঠে শুভ্র মুক্তার মালা। নানা অলঙ্কারে ও আভরণে দেবী ভূষিতা। তিনি দ্বিভূজা—এক হাতে সুধা ও জ্ঞানের প্রতীক অক্ষসূত্র, অন্য হাতে শ্বেত পদ্ম। সুদণ্ডী, সুবদনী, সুপ্রসন্না ও করুণাময়ী। মস্তকে শ্বেতচ্ছত্র, চন্দ্রপ্রভার ন্যায় জ্যোতির্ময়ী। দেবীর বাহন মকর।

মহাভারতে গঙ্গার অন্য চিত্র পাওয়া যায়। কুরুবংশীয় রাজা প্রতীপ হরিদ্বারে বসে তপস্যা করছিলেন, সেখানে গঙ্গা গিয়ে তাঁকে বিবাহ করতে চান। কিন্তু প্রতীপ সম্মত হন না। জানান, তাঁর পুত্রের সঙ্গে গঙ্গার পরিণয় হবে। গঙ্গা তাঁকে বলেন, প্রতীপের পুত্র তাঁর কোনও কাজে যেন বাধা না দেন। গঙ্গা তার পর চলে যান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অভিশপ্ত অষ্টবসুর গর্ভধারিনী হওয়া। যথাকালে ইক্ষাকু বংশীয় রাজা মহাভীষ পুনর্জন্ম লাভ করেন প্রতীপের ঔরসে। তাঁর নাম শান্তনু। তিনি নষ্টপ্রায় বংশের রক্ষক ছিলেন বলে এমন নামকরণ—শান্ততনু। শান্তনু যুবক হলে প্রতীপ তাঁকে জানান, এক জন দিব্য রমণী আসবেন, কোনও পরিচয় না জানতে চেয়ে শান্তনু যেন তাঁকে বিবাহ করেন। এই কথা বলে প্রতীপ বাণপ্রস্থে চলে গেলেন। শান্তনু হস্তিনার রাজা হলেন। 

যথাকালে গঙ্গা এলেন। দু জন দুজনকে দেখে মুগ্ধ হলেন। শান্তনু তাঁকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। অষ্টবসুর কথা ভাবতে ভাবতে শরীরিণী গঙ্গা প্রতীপপুত্রকে বললেন, 

ভবিষ্যমি মহিপাল মহিষী তে বশানুগা।
যত্তু কুর্য্যামহং রাজন্ শুভং বা যদিবাশুভম্।
ন তদ্বারয়িতব্যাস্মি ন বক্তব্যা তথাপ্রিয়ম্। 
–মহারাজ, আমি যা করব, ভাল হোক বা মন্দ, তুমি বাধা দেবে না এবং আমাকে কোনও অপ্রিয় কথা বলবে না। সে রূপ করলে তখনই তোমাকে ত্যাগ করব। তুমি এই শর্তে সম্মত হলে আমি তোমার মহিষী হতে রাজি আছি। 

একে একে সাত পুত্রের জন্ম দিয়ে গঙ্গা তাদের জলে নিক্ষেপ করে বলতেন, এই তোমার প্রিয় কার্য করলাম। শান্তনু চুক্তিবদ্ধ তাই কিছু বলতেন না কিন্তু দুঃখ-শোকে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। অষ্টম পুত্র জন্মানোর পর শান্তনু গঙ্গাকে বললেন, পুত্রঘাতিনী, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ? হে পুত্রঘ্নি, তোমার পাপের সীমা নেই। গঙ্গা জবাব দিলেন, তুমি পুত্র চাও অতএব এই পুত্রকে বধ করব না, কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি আর থাকব না। আমি বিদায় নিচ্ছি।

অহং গঙ্গা জহ্নুসুতা মহর্ষিগণসেবিতা।
দেবকার্য্যার্থ-সিদ্ধ্যর্থমুষিতাহং ত্বয়া সহ। 
আমি মহর্ষিদের দ্বারা সেবিতা জাহ্নবী গঙ্গা। দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য তোমার সঙ্গে এতকাল বাস করেছি। গঙ্গা নিজের সম্যক পরিচয় দিলেন এবং বসুগণের কাহিনি সবিস্তারে বললেন। বশিষ্ঠের হোমধেনু চুরি করেছিলেন অষ্টবসু। তাই তারা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে এসেছিল। আমি ছিলাম গর্ভধারিনী। আট জনের মধ্যে দ্যু নামক বসুর অপরাধ ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই সে বেশি দিন মর্ত্যে থাকবে। এই পুত্রকে গঙ্গার দান বলে মনে করবে। গঙ্গা নবজাতককে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন। শান্তনু শোকাকুল হয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে গেলেন। 

তার পর অনেক দিন কেটে গিয়েছে। শান্তনুর প্রার্থনায় গঙ্গা যুবক পুত্র দেবব্রতকে সঙ্গে নিয়ে একটি নির্জন স্থানে শান্তনুর সঙ্গে দেখা করলেন। পত্নী ও পুত্রকে দেখে শান্তনু প্রসন্ন হলেন। গঙ্গা বললেন, এই তোমার পুত্র—শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। নিখিল বিশ্বের সব বিদ্যা সে শিখেছে। বশিষ্ঠের কাছে শাস্ত্রজ্ঞান ও পরশুরামের কাছে শস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছে দেবব্রত। একে নিয়ে যাও। যুবরাজ করো। এ হল গঙ্গার দান।

মহেষ্বাসমিমং রাজন্ রাজধর্ম্মার্থকোবিদম্। 
ময়া দত্তং নিজং পুত্রং বীরং বীর গৃহং নয়। 
হে রাজন, মহাধনুর্ধর ও রাজধর্মার্থজ্ঞানী এই পুত্রটিকে তোমার হাতে দিচ্ছি। হে বীর, তোমার এই বীর পুত্রটিকে নিজ গৃহে নিয়ে যাও। এর পর গঙ্গাকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। মহাভারতে তাঁর শেষ সাক্ষাৎ মেলে দেবব্রত-ভীষ্মের মৃত্যুর পরে।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। ভীষ্ম পতিত হয়েছেন। শরশয্যায় শুয়ে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। ওদিকে যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছেন। মাঘ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে ভীষ্ম দেহত্যাগ করেন। তখন জীবিত কৌরব, পাণ্ডব ও যাদবগণ ভীষ্মতর্পণ করতে গঙ্গায় নেমেছেন। সেই সময় গঙ্গা আবার শরীর ধারণ করেন। পুত্রশোকে তিনি বিহ্বলা। মাতৃহৃদয় বাষ্পাচ্ছন্ন। তিনি বিলাপ করতে করতে জল থেকে উঠে এলেন। 

কে আমার মহাবীর পুত্রকে হত্যা করেছে? আমার মহান পুত্র রাজনীতি শিখেছেন মহাত্মা বশিষ্ঠের কাছে। আমার বীর সন্তান শস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন চিরজীবী ধনুর্ধর ব্রাহ্মণ পরশুরামের নিকট। গুরু পরশুরামও তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। অম্বাকে কেন্দ্র করে তাঁদের যুদ্ধ হয়েছিল। আমার সেই পুত্রকে কিনা হত্যা করেছে শিখণ্ডী, যে এক কালে নারী ছিল, লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ হয়েছে। আমি সে সব কথা বিশ্বাস করি না। আমার পুত্রকে অন্যায় ভাবে, ছলপূর্বক হত্যা করা হয়েছে। আমার পুত্র শিখণ্ডীর বাণে নিহত হয়েছেন, এই কথা ভাবতে আমার বুক ফেটে যায়। এই কি সেই শিখণ্ডী যে পূর্বজন্মে অম্বা ছিল! হা ঈশ্বর!  

বিলাপিনী গঙ্গার রূপ পালটাতে শুরু করেছে। শুভ্র পণ্যপ্রবাহ আস্তে আস্তে জ্যোৎস্না থেকে চন্দন, তার পর ধীরে ধীরে বর্ণহীন হতে শুরু করল। কৃষ্ণ ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন এলেন দেবী গঙ্গাকে সান্ত্বনা দিতে।

আপনার পুত্র ছিলেন শাপগ্রস্থ। তিনি বশিষ্ঠের কাছে রাজনীতি ও অন্যান্য বিদ্যা শিখেছেন বটে কিন্তু তিনি বশিষ্ঠ দ্বারা অভিশপ্ত। তিনি শস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন পরশুরামের কাছে সেই ব্রহ্মচারী অপুত্রক গাঙ্গেয় শিখণ্ডীর বাণে নয়, অর্জুনের বাণে শরশয্যা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নিজের মৃত্যুর উপায় তিনি নিজেই যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন। এ হল স্বেচ্ছামৃত্যু। 

কাকে যে শিখণ্ডী করা হল তিনি বুঝতে পারলেন না। ব্যাসদেব ও শ্রীকৃষ্ণের প্রবোধবাক্য শুনে দেবী গঙ্গা অন্তর্হিতা হলেন। 

দেবী তথা নদী গঙ্গার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত শিব। সেই সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের তিনটি ধারাও। সাংখ্য, ন্যায় ও অদ্বৈত। যজ্ঞাশ্ব খুঁজতে গিয়ে কপিল মুনির ধ্যানভঙ্গ করেছিলেন সগর রাজার ৬০ হাজার পুত্র। সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিল মুনি তাঁদের ভস্ম করে দেন। সগর রাজার উত্তরপুরুষ ভগীরথ মর্ত্যে গঙ্গাকে এনে পূর্বপুরুষদের সৎকার করেন। ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম গঙ্গাদ্বারের নিম্নভাগে রচনা করেন কুশাবর্ত তীর্থ। আচার্য শঙ্কর যে অমর গঙ্গাস্তোত্র রচনা করেছিলেন তাতে অদ্বৈত-র মূল তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।       

শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *