ডিরজিও-র নয়া অবতার বুলুবাবু সম্প্রতি অ্যাকচুয়াল ছেড়ে ভার্চুয়াল ছাত্র ঠ্যাঙানো শুরু করেছেন। জয়েন করেছেন বিশ্ববিখ্যাত টিউশন সেন্টার মনোরঞ্জন ভাণ্ডার ডট কম-এ। তাঁর ভাগে পড়েছে আফিন্দি, লোককথা কাহিনি ও ইতিহাস। তাঁর মতে মোল্লার টুকরোগুলো বড়সড় কোলাজের মতো— যা গুলিয়ে যাওয়া, ঠকে যাওয়া বা চূড়ান্ত অবিশ্বাসের। কোলা শব্দটা গ্রিক, মানে আঠা। এর ক্রিয়াপদ কোলার। ফরাসিতে যার মানে আঠা লাগানো। বেঞ্জামিন বলেছিলেন, এক্সপিরিয়েন্স হ্যজ ফলেন ইন ভ্যালু অ্যান্ড ইট লুকস্ অ্যাজ ইফ ইট কন্টিনিউং টু ফল ইনটু বটমলেসনেস। কাজেই বুলুবাবুর মতে এখন জোর দিতে হবে নীতিগল্পের ওপর। কাজেই মোল্লা নয়, বলতে হবে তার বাবা কাজিসাহেবের কথা।

সেভাবেই শুরু হয়েছিল টুকরোগুলো। কিন্তু মোল্লার কথা বলতে এসে শুধু তার বাবার কথা ছাত্ররা মানবে কেন! প্রথম ৩টে গল্প কাজিসাহেবকে নিয়ে লেখার পর একরাতে বাড়ি ফেরার পথে অভিভাবকেরা মুখে কাপড় বেঁধে রবারের রড দিয়ে বুলুবাবুকে বেদম পেটায়। তারপর থেকে শুধু লেখা নয়, বুলুবাবুর জীবনযাপনও অনেকটা বদলে যায়। এরপরের সব টুকরোই বুলুবাবুর লেকচার থেকে নেওয়া। উৎসাহীরা চাইলে গুগলে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।

***

কাজিসাহেবের কাজে খুশি হয়ে ৭ ছালা মোহর পাঠিয়েছেন সুলতান। ধন্যবাদ তো দূরের কথা, এই ব্যাপারে কোনও কথাই বলেননি কাজি। কদিন পর কায়দা করে কথাটা তুলেছেন সুলতান নিজেই। ‘একজন দাতা কি গ্রহীতার কাছ থেকে সামান্য ধন্যবাদের আশাটুকুও করতে পারে না?’

শব্দ না করে হাসেন কাজি। তারপর বলেন, প্রকৃ্ত মুসলমান হলে পারে না, মুনাফিকদের কথা অবশ্য আলাদা। একজন মুসলমান দান করেন আল্লাহ্-র সন্তোষ বিধানের জন্য। নবী বলেছিলেন, দান করা মুসলমানের কর্তব্য। যার কিছু নেই সে শ্রম দান করবে। যদি সে শারীরিকভাবে অক্ষম হয় তখন অভাবী ও দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করবে। যদি তাও না পারে, তাহলে নিজে কোনও অন্যায় করবে না। ওটাই হবে তার দান।

একটু থেমে কাজি বলেন, কাজেই ধন্যবাদের আশা একমাত্র গ্রহীতাই করতে পারে।

Molla Nasiruddin

***

বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছেন কাজি, জব্বর এক প্যাঁচে পড়ে আচমকাই হাজির হয়েছেন সুলতান। অতিথিকে সাদরে বসিয়ে চা ঢালতে শুরু করেন কাজি। সুলতান বলছেন, কাজিও ঢালছেন। একসময় পেয়ালা থেকে উপচে চা পড়তে শুরু করে পিরিচে। চমকে, কথা থামিয়ে সুলতান বলেন, কী করছেন কাজিসাহেব! ভরা পেয়ালায় চা ঢালছেন!

ঢালা থামিয়ে এইবার সুলতানের দিকে তাকান কাজি। সমস্যা আর তার আনুমানিক সমাধানে মাথা তো বোঝাই হয়ে আছে আপনার। এরপর আমি যে কিছু বলব তার জায়গা কোথায়?

***

কাজিসাহেব তখন মাদ্রাসা চালান। হঠাৎই অনুদান বন্ধ করে দিয়েছেন খামখেয়ালি সুলতান। ভাঁড়ার শূন্য। খাওয়া জুটছে না কাজি আর ছাত্রদের। খিদের জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে রাখছেন কাজি আর তাঁর ছাত্ররা। এর মধ্যেই একদিন সুলতানের দরবারে গল্প শোনানোর জন্য ডাক পড়েছে কাজির। তিনি যখন গেছেন তখন ৬৪ রকম বাটি সাজিয়ে খেতে বসেছেন সুলতান।

গল্প শুরু করেন কাজি— সে বড় কঠিন সময়। কোথাও একদানা খাবারও নেই। খিদে ঠেকাতে পেটে পাথর বেঁধে রাখছেন আবু তালহারা। ক্রমাগত প্রার্থনা করছেন আল্লাহ্-র কাছে। তারপর একদিন স্বয়ং  রসুলুল্লাহ এলেন তাঁদের কাছে।

তবে আর কী, ভেড়ার ঠ্যাং-এ পেল্লায় কামড় দিয়ে মুখ খুললেন সুলতান, নিশ্চয়ই খাজানা খুলে দুধ মধু ফল মাংসে ভরে দিলেন তালহাদের ঘরবার।

আজ্ঞে না হুজুর। প্রথমে তিনি ওদের পেটে বেঁধে রাখা পাথর দেখে চোখ মুছলেন। তারপর জামা তুলে নিজের পেটে বেঁধে রাখা পাথর দুটো দেখালেন।

Molla Nasiruddin story

***

শিকারি হওয়ার সাধ হয়েছে মোল্লার। হাফপ্যান্ট, বুটজুতো, হাতকাটা জামা, কাঁধে বন্দুক, মাথায় টুপি পড়ে হাজির হয়েছে জঙ্গলের গভীরে। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, বাঘ তো দূর, কোনও শেয়ালের দেখা পর্যন্ত নেই। বিরক্ত হয়ে যখন চলে যাবে বলে ভাবছে, ঠিক তখনই একটা কেঁদো বাঘ পেছন থেকে জাপটে ধরে কিছু বোঝার আগেই পায়ুমৈথুন করে কানের কাছে মুখ এনে আলতো করে ‘থ্যাংক ইউ’ বলে পলক ফেলার আগেই মিলিয়ে গেল জঙ্গলে।

তারপর একা একা অনেকক্ষণ চোখের জল ফেলল মোল্লা। শেষে কিনা একটা জন্তুর হাতে! লজ্জায় থুতু ফেলে ডুবে মরতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু না, তা করলে তো জিত হবে বাঘেরই। মনের দুঃখ মনেই চেপে তেড়ে প্র্র্যাকটিস শুরু করে মোল্লা। ৩ হপ্তা বাদে হাজির হয় জঙ্গলে। এবার আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ‘ওঃ তুই এসে গেছিস!’— বলে দেরি না করে কাজ শুরু করে বাঘমামা। কাজ সেরে তাকে লম্বা করে চুমু খেয়ে পায়ে পায়ে চলে যায় জঙ্গলের গভীরে।

আরও পড়ুন: পাসওয়ার্ডনামা

এবার আর চোখের জল নয়, নিজের মাথাতেই গুলি করতে গেছিল মোল্লা। তারপর ঠিক করল, নাহ, একে শায়েস্তা না করে আমি কিছুতেই মরব না। আবার শুরু হয় অনুশীলন। এবার ৩ নয়, ৬ হপ্তা বাদে পুরো তৈরি হয়ে হাজির হয় মোল্লা। এবার আর ঝাপট নয়, সামনে এসে থাবা দিয়ে দু’কান ডলতে ডলতে বাঘ বলে, দিব্বি করে বল তো, তুই কি শিকার করতে আসিস, না কি…

*** 

মেট্রো স্টেশনের মুখে এক দিকপাল তাত্ত্বিকের মুখোমুখি হয়েছে আফিন্দি। সরলভাবে জিজ্ঞেস করেছে, কোথায় চললেন?

অন্যমনস্কভাবে তাত্ত্বিক বলেন, রেল যে পথে যায়।

রেল কি আর এক পথে যায়? আর ধরুন যদি ট্রেন বন্ধ থাকে?

তখন বলব, হাওয়া যে পথে বয়।

হাওয়াও কি আর এক পথে বয়, আর ধরুন যদি হাওয়া না-ই থাকে?

ভুরু কুঁচকে তাত্ত্বিক বলেন, তখন বলব পা যে দিকে যায়।

পা কি আর একদিকে যায়? ধরুন, যদি আপনার পা না-ই থাকে?

বিরক্ত তাত্ত্বিক বলেন, তখন বলব চোখ যেদিকে চায়।

চোখও কি আর একদিকে চায়? আর ধরুন যদি আপনার…

যদি আমি অন্ধ হতাম… খিঁচিয়ে ওঠেন তাত্ত্বিক, তখন বলব বাজারে যাচ্ছি।

শান্ত গলায় আফিন্দি বলে, কথাটা শুরুতে বললেই হত।

Molla Nasiruddin2

***

১৭০০ টাকায় বেশ জম্পেশ একটা মাদুর কিনে ফিরছে মোল্লা নাসিরুদ্দিন। পথে খুঁত ধরা গোপালের সঙ্গে দেখা। — কী মোল্লাসাহেব, মাদুর কিনলে বুঝি?

দেখতেই তো পাচ্ছ।

আহা চটছ কেন! তা কত নিল?

মোল্লা ইচ্ছে করে কমিয়ে বলল, হাজার।

পুরো মেরে দিল তো! আমাকে নিয়ে যেতে, ৮০০-র এক পয়সা বেশি লাগত না।

একটু এগোতে না এগোতে চ্যাম্পিয়ন খুঁত ধরিয়ে রাখালের সঙ্গে দেখা। — নতুন মাদুর মনে হচ্ছে! তা কত নিল?

কোনও ঝুঁকি না নিয়ে মোল্লা বলল, বেশি না, এই ৭০০ মতো।

সাতশ! একা পেয়ে পেছনটা গুছিয়ে মেরে দিয়েছে রে! আমাকে একবার বলবি তো!

তিতিবিরক্ত মোল্লা মাথা নামিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছে। এমন সময় পথ আটকে দাঁড়ালেন সবজান্তা মণিদা, —কী রে কোথায় গেছিলি?

বিরক্ত মোল্লা বলে, পেছন মারাতে।

ভালো করেছিস সঙ্গে মাদুর নিয়ে গেছিলি।

***

বন্ধুকে মাংস রেঁধে খাওয়াবে মোল্লা। গিন্নিকে দিয়ে রেসিপিটা লিখিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। যথাকালে বন্ধু হাজির। খোলা উঠোনে তখন একমনে মাংসের গায়ে আচ্ছাসে পেঁপে মাখাচ্ছে মোল্লা। চারদিকে ছড়ানো রয়েছে বাটা পোস্ত, কাঁচা ডিম, কোরা নারকেল।

করেছিস কী! এ তো এলাহি ব্যাপার! বন্ধু বলে।

এ তো কিছুই না, আগে তৈরি হোক— এই বলে রেসিপি দেখতে গেছে মোল্লা। ব্যাস, মুহূর্তে কোত্থেকে কে জানে একটা চিল এসে মাংস নিয়ে হাওয়া। দেখে হায় হায় করে ওঠে বন্ধু। আর মোল্লা ফেটে পড়ে হাসিতে। ঘাবড়ে যায় বন্ধু। মাংসের শোকে শেষটায় কি মাথাই খারাপ হয়ে গেল মোল্লার?

শেষটায় বহু কষ্টে বিষম-টিষম খেয়ে, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে মোল্লা বলে— গাধা কি গাছে ফলে? ব্যাটা মাংস তো নিল, কিন্তু খাবে কী করে? রেসিপি তো আমার কাছে।

 

 

 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia commons, Getarchive

*পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবে ১৭ মে, ২০২৩

Gautam Sengupta

গৌতম সেনগুপ্তের লেখালেখির বয়স প্রায় ৫০ বছর। কবিতা দিয়ে শুরু, এরপর গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ- সাহিত্যের একাধিক শাখাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ।
৫টি স্বতন্ত্র গল্পের বই ছাড়াও রয়েছে গল্প সমগ্র ও উপন্যাস সংগ্রহ।.
অনুবাদ করেছেন ২টি দলিত উপন্যাস ও কলম্বিয় সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ইন্টারভিউ।
তাঁর গল্প অনুবাদ হয়েছে ইংরাজি, তামিল ও হিন্দি ভাষায়।
সম্মাননা: কথা পুরস্কার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার।

One Response

  1. Respected Editor Sahab
    I am a reporter of renowned news paper. As a patrakar, I love your articles. It’s very very unique and interesting . At the same time it’s a diary of modern day with the light of golden age. I pray for you that, Proceed your wonderful job and giving me the great pleasure.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *