বাংলালাইভের পাক্ষিক পত্রিকার এবারের প্রচ্ছদ কাহিনি নাটক নিয়ে। সেই জন্যেই বোধহয় ওঁরা আমাকে বলেছিলেন কিছু লিখতে। কারণ আমি নাটকের বাড়ির মেয়ে এবং নিজে নাট্যকার। ফলে ওঁদের অনুরোধ একেবারে ফেলে দিতে পারলাম না। কিন্তু কথা হচ্ছে, নাটক নিয়ে গভীর কিছু আলোচনার জন্যে আমি এখন প্রস্তুত নই। এ সময়টাই এমন, চারিপাশের পরিস্থিতি এমন, এ সময় বড় কিছু, গভীর কিছু লিখতে আমার ইচ্ছে করছে না। মনও চাইছে না। তাই ভাবলাম, এক কাজ করা যাক। নাট্যাভিনয়ের নেপথ্যের মজার কিছু ঘটনার কথা বলি, যা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। পেশাদার মঞ্চে অভিনয় চলাকালীন অনেক কিছু ঘটে। স্থির করলাম সেগুলোই না হয় লিখি!
আমরা তখন যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে এক কালে থাকতেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি। সে ফ্ল্যাট ছিল বিশ্বরূপা থিয়েটারের একদম পিছনে। আমার বাবা বিধায়ক ভট্টাচার্যের বিখ্যাত নাটক ‘সেতু’ তখন নিয়মিত অভিনীত হচ্ছে বিশ্বরূপায়। সেই নাটকেই তৃপ্তি মিত্র প্রথম পেশাদার থিয়েটারে অভিনয় করতে এসেছিলেন। তাঁর ধারণাই ছিল না পাবলিক থিয়েটারে স্টেজের ওপর নাটক চলাকালীন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কী করেন, না করেন। নাটকের আগে-পরে, তাঁরা কত রকম কথা বলেন, কত মজা করেন, কত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করেন, সেসব ব্যাপারে তৃপ্তি মিত্র কিছুই জানতেন না। উনি গ্রুপ থিয়েটারের মানুষ। আর গ্রুপ থিয়েটারের কেউই এসবে অভ্যস্ত নন। গ্রুপ থিয়েটারের অনুশীলনটাই অন্য রকম। খুব সুসংহত, গোছানো, খুব নিয়ম মেনে, খুব ডিসিপ্লিনড। কিন্তু পেশাদার থিয়েটারে তো তা নয়। ওখানের ধরন ছিল হইহই করতে করতে, মজা করতে করতে, আনন্দ করতে করতে নাটক করা। মহড়া দিতে দিতে দু’চার বার চা খাওয়া হল, আড্ডা মারা হল। তারপর আবার রিহার্সাল হল, এ ভাবেই চলত। আগেই বলেছি এই পদ্ধতির সঙ্গে তৃপ্তি মিত্র পরিচিত ছিলেন না।

তো সেই রকম একদিন শো হচ্ছে। সেদিন আবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা ছিল। বুঝতেই পারছেন, তখনকার দিনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, কী মারাত্মক অবস্থা! এবং আসল কথাটা হচ্ছে, মোহনবাগান জিতেছে। ‘সেতু’তে অভিনয় করতেন অসিতবরণ, তরুণকুমার, তৃপ্তি মিত্র, জয়শ্রী সেন, সুব্রতা সেন প্রমুখ। এখন হয়েছে কী, অসিতবরণ এবং তরুণকুমার কট্টর মোহনবাগান। জয়ের আনন্দটা তো তাঁরা চেপে রাখতে পারছেন না। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছে, এর চেয়ে বড় আনন্দের খবর মোহনবাগান সমর্থকের কাছে কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু তাঁদের তো নাটক আছে! এক জায়গায় নাটক করতে এসেছেন। সেখানে তো আর এই নিয়ে কোনও আনন্দ করতে পারছেন না! কোথাও বেড়াতে যেতে পারছেন না, খেতে যেতেও পারছেন না নাটক আছে বলে।
যাই হোক, যথাসময়ে শো শুরু হয়েছে। তৃপ্তি মিত্র তো জানেনও না, খেয়ালও করেননি যে আদৌ ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা ছিল কি না, বা কে জিতেছে। তিনি তাঁর চরিত্র নিয়ে ভাবছেন, কী ভাবে কী করবেন, কেমন করে সংলাপ বলবেন ইত্যাদি। সিনটা ছিল, তৃপ্তি মিত্র মঞ্চে রয়েছেন। এমন সময়ে তরুণকুমার, অসিতবরণ ঢুকবেন। তখন তৃপ্তি মিত্র তাদের জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমাদের দেরি হল কেন’ বা এই রকম ধরনের কিছু একটা সংলাপ। কিন্তু অসিতবরণ মঞ্চে ঢুকে তৃপ্তিদেবীর জন্য অপেক্ষা না করেই বলে বসলেন, “কী, কেমন দিলাম?”
এটা তো স্ক্রিপ্টে নেই! অতএব তৃপ্তি মিত্র স্তব্ধ। তিনি বুঝতেই পারছেন না পরের সংলাপটা কী বলবেন! তিনি হতভম্ব হয়ে ওঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওঁরা দু’জনে তো ততক্ষণে বুঝেছেন গোলমাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুযোগ যখন পাওয়া গিয়েছে মোহনবাগানের জয়ের ব্যাপারে কথা বলার, ছাড়া যায় কি? তরুণকুমারও বলে বসলেন, “কী? তোমার কথা বন্ধ হয়ে গেল তো! তুমি বাবা ইস্টবেঙ্গল, তোমার তো কথা বন্ধ হবেই।” তৃপ্তি মিত্র তো আরও অবাক! তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না এর পরের সংলাপ কী বলবেন! তিনি তো জানেনই না ওঁরা কেন এ সব বলছেন, এর পরে কী বললে অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে! এটা তো নাটকে নেই! ওঁরা তো বানিয়ে বানিয়ে বলছেন! তিনি কিচ্ছু না বলে, মুখ ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেলেন মঞ্চ থেকে। এবার তরুণকুমার আর অসিতবরণ দু’জনে স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, না পারছেন কথা বলতে, না পারছেন কিছু করতে। ততক্ষণে তো যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! কী করা যায়?

অসিতবরণ তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগলেন, “কী করি বল দেখি, তোর বউদি তো মনে হচ্ছে খুব রেগে গেছে! বুঝলি, মোহনবাগান গোল দিয়েছে ….” মানে যা মনে আসছে বলে যাচ্ছেন। এবং চিন্তাও করছেন যে এর পরে তৃপ্তি মিত্রর মুখোমুখি দাঁড়াবেন কী করে! তৃপ্তিদেবী তো এদিকে সোজা চলে গিয়েছেন মেক-আপ রুমে। সেখানে গিয়ে চুপ করে এক কোণে বসে রয়েছেন। মঞ্চের উপর তখন তরুণকুমার অসিতবাবুকে বললেন, “আচ্ছা দাদা তুমি ঘরে থাকো, আমি দেখছি।” বলে একা অসিতবরণকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে রেখে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। এবার অসিত বরণ কী করেন! তিনি নানা রকম কথা বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগলেন, “আমি তখনই বলেছিলাম, যে তুই এটা করিস না, তুই এটা বলিস না তোর বউদিকে, এসব করিস না, শুনলি না তো! এখন দেখ কী রকম রেগে বসে আছে!” এরকম বলতে বলতে সিনটাকে কোনওক্রমে টেনেটুনে শেষ করে পরের সিনের সংলাপ বলে দিলেন। সেই সিনে অন্য আর্টিস্টের ঢোকার কথা। তিনি ঢুকে পড়লেন। নাটক চলতে লাগল।
এদিকে তরুণকুমার তড়িঘড়ি মেক-আপ রুমে গিয়ে দেখেন, তৃপ্তি মিত্র গম্ভীর হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তরুণবাবু বললেন,
– কী হল বউদি, আপনি চলে এলেন?
– ওটা আপনারা কী বললেন?
– কই কিছু বলিনি তো?
– না না, বলেছেন। আপনারা তো নাটকের সংলাপ বলেননি! তরুণকুমার তো তখন আমতা আমতা শুরু করেছেন। বললেন
– না না, আসলে মোহনবাগান আজকে জিতেছে তো ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে, তাই।
– তাতে নাটকের কী? নাটকের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান কোত্থেকে এল? আপনারা এ রকম করলে আমি অভিনয় করব কী করে? আমি তো জানিই না এর পরে কী বলব! ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বললেন তৃপ্তিদেবী।
তরুণকুমার বুঝলেন এ মাছ আর শাক গিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না। সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। খুব অন্যায় করে ফেলেছেন। তখন কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “বউদি আর কোনও দিন এমন হবে না।” তৃপ্তি মিত্রর রাগ ততক্ষণে একটু পড়েছে। তিনিও আলটিমেটাম দিয়ে বললেন, “খেয়াল রাখবেন আর যেন কোনওদিন আমাকে এই ভাবে বিপদে পড়তে না হয়! আমি এ সবে অভ্যস্ত নই।” এ বার তাহলে আপনারাই বুঝুন, গ্রুপ থিয়েটারের প্যাশন আর নিষ্ঠা কী জিনিস! কী ভাবে এঁরা নিজেদের তৈরি করতেন!

সেতুর কথা যখন উঠলই, তখন ওই নাটকেরই আর একটা ঘটনার কথা বলি। স্টেজের ওপরেই ঘটে যাওয়া ঘটনা এটা। সেতু নাটকে আমার বাবা এক বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তাঁর একমাত্র সন্তান মারা গিয়েছে। শোকে সন্তাপে তিনি একটু অসংলগ্ন কথা বলেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তিনি ছেলের একটা পুরনো চিঠি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ান। তৃপ্তি মিত্র তাঁর প্রতিবেশিনী। বাবা তাঁর কাছে এসে বলেন, “খোকা চিঠি দিয়েছে। বউমা পড়ে দাও তো!” তৃপ্তি মিত্র তখন বানিয়ে বানিয়ে চিঠিটা পড়ে দেন। এখন হঠাৎ একদিন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কাছে একজন বিমার লোক এসেছে, ছেলের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু কথা বলতে। এবং তিনি এসে শুনছেন যে ভদ্রলোক বলছেন, তাঁর ছেলে বেঁচে আছে। বিমাকর্মী তো অপ্রস্তুত! বলছেন, “সে কী কথা! আপনার ছেলে তো মারা গেছে! সব কাগজ পত্র নিয়ে এসেছি।” তাতে ভদ্রলোক খুব উদভ্রান্ত হয়ে সেই চিঠিটা নিয়ে আসছেন প্রতিবেশিনীর কাছে। বলছেন, “বউমা দেখ তো, এ কী বলছেন ভদ্রলোক… যে, খোকা…” এরকম ধরনের একটা সংলাপ। সেই বিমাকর্মীও পেছনে পেছনে আসবেন, সে রকমই স্ক্রিপ্টে রয়েছে।

সেদিন প্রম্পটিং-এ ছিলেন মনু মুখোপাধ্যায়। জয় বাবা ফেলুনাথের “মছলি বাবা!” মনুবাবু অসম্ভব ভাল অভিনেতা। তিনি যদি প্রম্পটে থাকেন তো কারুর কোনও চিন্তাই থাকে না। বাবা তো ঢুকছেন স্টেজে। এইবার বলবেন “বউমা, বউমা দেখ তো এই ভদ্রলোক কী বলছেন..” কিন্তু ঠিক এই কথাটা বলবার আগে মনুবাবু পাশ থেকে বলে দিলেন, “বউমা, বউমা, মণি শ্রীমানি আমার দাঁত খুলে নেবেন বলছেন।” বুঝুন এ বার কী বিপদ! বাবার অবস্থা একবার ভাবুন। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ জানবেন তিনি তখন, আবেগঘন সিন। সেই সময় প্রম্পটার বলছেন, “মণি শ্রীমানি আমার দাঁত খুলে নেবেন বলছেন।” বাবার তো প্রবল হাসি পেয়ে গেছে, এদিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে অভিনয় করে যেতে হচ্ছে। পোজ ধরে না রাখলে তো সব গুবলেট! কোনও রকমে হাসি চেপে সে যাত্রা ম্যানেজ করলেন। মনুবাবু কিন্তু অকুস্থলে আর নেই তখন। পালিয়ে গিয়েছেন। কারণ, জানেন এর পরে কপালে মার আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মাঝে মধ্যেই এমন দুষ্টুমি করতেন। আর মঞ্চের উপর থাকা অভিনেতাদের সে সব ম্যানেজ করে অভিনয় করতে হত। তবে সে যাত্রা তৃপ্তিদেবীর হাতে মনুবাবুর কোনও শাস্তি জুটেছিল কিনা, সে গপ্পো অবশ্য আমার জানা নেই!
বনানী মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪২ সালে বাগবাজারে। বিশিষ্ট নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের কন্যা। আশৈশব নাটকের আবহে মানুষ। বাবার নাট্যগােষ্ঠী ‘একত্রিকা’-তে নিয়মিত অভিনয়। কলেজে পড়াকালীন তৃপ্তি মিত্র ‘বহুরূপী’-তে নিয়ে যান কাঞ্চনরঙ্গ’-তে অভিনয় করার জন্য। তারপর থেকে অসংখ্য পেশাদার নাটকে অভিনয়। নিজেও নাট্যকার। বেতারের দুনিয়ায় শ্রুতিনাট্যকার হিসেবে বিপুল খ্যাতি। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। তবে কলম এখনও চলছে পুরোদমে। তাঁর শ্রুতিনাটকের সংকলন বই হয়েও বেরিয়েছে।
Love it.
দারুন। বিধায়ক-কন্যার কাছ থেকে এরকম আরও অনেক গল্প শুনতে চাই। তবে, অসিতবরণের ছবিটার কোনো দরকার ছিল না। দরকারি ছিল বিধায়ক ভট্টাচার্যের একটা হবি।