“তোর মাথায় এরকম আলু হল কী করে রে পাপাই?”
রুমকির প্রশ্নটা শুনে গম্ভীর মুখ করে পাপাই বললো “জাড্য, জাড্য।”
“আবার স্কুলে মার খেয়ে এসেছিস তো?”
“নাহ, মাথা ঠুকে গেছে।”
“ফের বাজে কথা! একটু আগেই তো কার একটা নাম বলছিলি।”
“ওটা কাকাই বলেছে।”
“ধুর, তোকে বলতে হবে না, যা।”
“আরে, স্কুল থেকে ফেরার সময় বাসের কাকু হঠাৎ করে একটা ব্রেক মারল…”
“আর তোর মাথাটা দুম করে সামনের রডে ঠুকে গেল। তাই তো?”
“হুঁ।”
“তাহলে প্রথমে কী বলছিলি?”
“জাড্য। ঐ তো কাকাই এসে গেছে ঘটিগরম নিয়ে। তুই কাকাইকেই জিগ্যেস কর। আমারটায় ঝাল দাওনি তো কাকাই?”
কাকাই ঘাসের ওপর বসে পড়ে বলে, “কম ঝাল। তোদের যে বলেছি আগে দু’পাক দৌড়ে আসতে। তা না করে খালি বকবক করছিস!” পাপাই আর রুমকিও বসে পড়ে হাত বাড়ায়।
“জাড্য কী কাকাই?” ঘটিগরমের ঠোঙাটা হাতে নিতে নিতে রুমকি জানতে চায়।
কাকাই তখন পাল্টা প্রশ্ন করে, “নিউটনের নাম শুনেছিস?”
রুমকির চটজলদি উত্তর “ঐ তো, যার মাথায় আপেল পড়েছিল।”
কাকাই হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে,”না না মাথায় পড়েনি। ঐ গল্পটা অন্যদিন বলবো।”
ঘটিগরম চিবোনোর ফাঁকে পাপাই বিজ্ঞের মত বলে, “আরে, সায়েন্টিস্ট রে।”
“সে আমি জানি। তুমি বল তো কাকাই। গাড়িতে ব্রেক মারলে গাড়ির লোকজন সামনের দিকে হেলে যায় এটা সবাই জানে। তা সেটা নিয়ে এত হেঁয়ালির কী আছে!”
“আচ্ছা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি হঠাৎ করে চলতে শুরু করলে কী হয় বলতো?” কাকাইয়ের প্রশ্ন।
“ঠিক উল্টোটা হয়। সবাই পেছন দিকে হেলে যায়।”
“ঠিক। কিন্তু কেন বলতো।”
“ঝটকা মারে বলে।”
“ঝটকা তো মারলো। কিন্তু তার জন্য আমরা হেলে যাই কেন?”
“জাড্য?”
“ঠিক তাই। বিজ্ঞানীরা বহু যুগ ধরেই এইসব ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলেন। গ্যালিলিও এই ব্যাপারটা নিয়ে লেখালিখি করেন। তবে ব্যাপারটাকে সঠিকভাবে গুছিয়ে সূত্রের আকারে লেখেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। তিনি তিনটি গতিসূত্র লেখেন তাঁর বইতে। আমাদের চারপাশের যেকোন বস্তুর নড়াচড়া এইসব নিয়মগুলো মেনেই হয়। এবার এই তিনটে সূত্রের প্রথমটাকে বলে প্রথম গতিসূত্র বা জাড্যর সূত্র। জাড্যর ইংরিজি হল inertia। কেপলার প্রথম ব্যবহার করেন এই শব্দটা,” একটু থেমে মুখে ঘটিগরম ঢেলে দেয় কাকাই।
“তা কী বলেছে এই সূত্রটায়?”
” বলেছে যে, বাইরে থেকে কোনভাবে বিরক্ত না করলে, মানে কোন জোর না খাটালে যে জিনিসটা স্থির আছে সেটা স্থির থাকবে আর যে জিনিসটা চলছে সেটা একই স্পিডে নাক বরাবর চলতে থাকবে।
“এটা কেমন কথা হল?” পাপাই বলে ওঠে, ” যে জিনিসটা থেমে আছে সেটা নাহয় থেমেই থাকলো, যে জিনিসটা চলছে সেটাও তো একটু বাদে থেমে যাবে। যেমন ধর, এই বলটা গড়িয়ে দিলে একটু বাদে তো থেমেই যাবে। তাহলে?”
“ধর, বলটাকে একই স্পিডে একবার একটা এবড়োখেবড়ো জায়গায় গড়িয়ে দিলাম আর একবার একটা মসৃণ জায়গায় গড়িয়ে দিলাম। কোনক্ষেত্রে বেশী দূর যাবে?”
“মসৃণ জায়গাটায়। কিন্তু দু’বারেই তো থেমে যাবে,” পাপাই বলে।
“হ্যাঁ, তার কারণ হল বলটা গড়ানোর সময় ঘষা খাচ্ছে, যার ওপর দিয়ে গড়াচ্ছে তার সাথে। এই ঘর্ষণের ফলে শক্তিক্ষয় হচ্ছে। দেখ সূত্রয় বলা ছিল বাইরে থেকে কোন বলপ্রয়োগ করা মানে জোর খাটানো না হলে ওরকমটা হবে। এক্ষেত্রে তো জোর খাটানো হচ্ছে, তাই না? মহাশূন্যে যেখানে জোর খাটানোর কিছু নেই সেখানে বলটাকে ছুঁড়ে দিলে ওটা চলতেই থাকবে।”
রুমকি বলে “কিন্তু এখানে জাড্যর কথা কই?”
কাকাই খালি ঠোঙাগুলোকে একসাথে পাকিয়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, ” যে ধর্মের জন্য কোন স্থির জিনিস স্থির থাকতে চায় আর চলতে থাকা বস্তু একইভাবে একই গতিতে চলতে চায় সেটাকেই বলে জাড্য। থেমে থাকা বস্তুর ক্ষেত্রে স্থিতিজাড্য, চলতে থাকা বস্তুর ক্ষেত্রে গতিজাড্য। এই কারণেই গাড়ি ব্রেক কষলে আমাদের শরীরের যে অংশটা গাড়ির সাথে ঠেকে আছে সেটা থেমে যায় কিন্তু শরীরের উপরের অংশটা এগিয়ে যেতে চায় গতিজাড্যর জন্য। সেই জন্যই পাপাইবাবুর মাথায় আলুর চাষ হয়েছে আজ।”
“আর থেমে থাকা গাড়ি চলতে শুরু করলে যে আমরা উল্টোদিকে হেলে যাই সেটা স্থিতিজাড্য?” রুমকি জিগ্যেস করে।
“হ্যাঁ, তখন শরীরের উপরের অংশটা স্থির থাকতে চায়, তলার অংশটা চলতে শুরু করে গাড়ির সাথে। দেখবি যখন ডাস্টার থেকে চকের গুঁড়ো ঝাড়া হয় বা পাপোশ থেকে ধুলো ঝাড়া হয় তখন ডাস্টার বা পাপোশকে পেটানো হয়। ওগুলো নড়ে ওঠে কিন্তু ওতে লেগে থাকা চকের গুঁড়ো বা ধুলো নড়তে চায় না আর ঝরে যায়। স্থিতিজাড্য।”
রুমকি উত্তেজিত গলায় বলে, ” তুমি সেদিন যে খেলাটা দেখালে, ঐ যে, গ্লাসের ওপর একটা কার্ড রেখে তার ওপর একটা পয়সা রেখে কার্ডটায় জোরসে টোকা মারলে, কার্ডটা উড়ে গেল, পয়সাটা গ্লাসের ভেতরে পড়লো, ওটাও তো তাহলে জাড্যর জন্য?”
“সাব্বাশ। একদম ঠিক। আবার চলন্ত গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে গতিজাড্যর কারণে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। অভ্যস্ত লোকেরা উল্টোদিকে হেলে নামে সেটা সামাল দেওয়ার জন্য। তোরা যেন এইটা আবার পরীক্ষা করে দেখতে যাস না। আর গাড়িতে যাতায়াত করার সময় সবসময় শক্ত করে ধরে বসবি। সিটবেল্ট থাকলে বেঁধে নিবি। বুঝলি? নে এবার উঠে পড়। দৌড়োনো বাকি আছে,” বলে কাকাই উঠে দাঁড়ায়। রুমকিও উঠে দাঁড়ায়।
পাপাই বসে থেকেই মুখ তুলে বলে, “এই তো একটা নতুন জিনিস শিখলাম। এখন আবার ছুটতে হবে?”
কাকাই কিছু বলার আগেই রুমকি বলে ওঠে, “তোর জাড্যটা খুব বেশী। বুঝলি?”
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভাটপাড়ায়, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বর্তমানে বোস ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। সিনেমা, গান এবং ফুটবল নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
খুব সুন্দর , কি ভালভাবে বোঝালেন। আমরা যারা বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি ভীষণ ভাবে পুরোনদিনে ফিরে গেলাম