ভাইয়ের জন্মদিন ছিল মাসের শেষদিনে । মা দুঃখ করে বলতেন – “ছেলেটা এমন দিনে জন্মাল, একটু ভালো মন্দ রান্না করব, তার উপায় নেই।“
আমরা অনেকেই নানা সময়ে অনেকের মুখে এমন আক্ষেপ শুনেছি – সোজা ভাষায় বললে আমার হাতে যদি আর-একটু টাকা-পয়সা থাকত, তাহলে ইচ্ছে মতো খরচ করতে পারতাম। আর একেই অর্থনীতির খটমট ভাষায় বলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
এই আর্থিক সঙ্গতি থাকাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার – শুধু একজন মানুষের জন্য নয়, একটা রাজ্যের বা দেশের জন্যেও বটে। কেন, সেটা বোঝার জন্য একটু দেখা যাক টাকা নিয়ে মানুষ কী করে। একজন মানুষ রোজগার করুক বা না করুক বেঁচে থাকতে গেলে তাকে কিছু খরচ করতে হয়। তাকে তো খেতে হবেই, সেই সঙ্গে জামা-কাপড় আর মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তার চাই, যাকে আমরা বলি – রোটি-কাপড়া আউর মকান। আয় যদি না থাকে, সঞ্চয় ভাঙিয়ে বা ধার করেও এই খরচা চালাতে হবে। যাকগে। আপাততঃ সেদিকে না গিয়ে আমরা যারা রোজগারপাতি করেন, তাদের নিয়েই আলোচনা শুরু করি।
আয় করলে মানুষ প্রথমেই দেখে তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য সে কতটা খরচ করতে পারে। তারপর যেটা উদ্বৃত্ত থাকে, সে তাই দিয়ে অন্য কিছু শখ-সাধ মেটায়, তারপরেও যদি কিছু বাকি থাকে, তাহলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। অর্থনীতির পরিভাষায় প্রথমটাকে বলে ভোগব্যয়। তা এই ভোগব্যয় এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-একরকম। কেউ দু-টাকা কিলো দামের চাল খায়, কেউ একশ টাকার। কেউ সাতমহলা প্রাসাদে থাকে আবার কেউ ঝুপড়িতে। কারও শুধু লজ্জানিবারণের বস্ত্র থাকে, কারও অপর্যাপ্ত বসনভূষণ। এর পুরোটা যে বর্তমান আয়ের কারণে তা নাও হতে পারে। কারও আগেকার সঞ্চয় কিংবা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত সম্পত্তি থাকতে পারে।
আজকের ভারত খাদ্যে স্বয়ম্ভর, সেবাক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান। বিশ্বের নানা জায়গায় ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা যে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন, তার পেছনে অবশ্যই ভারতের উন্নয়নের প্রকৃতি বিশেষতঃ শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অবদান আছে।
অনেকদিন আগে আর্ন্সট এঞ্জেল নামের এক অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছিলেন, যার আয় যত কম সে শতকরা হিসেবে তত বেশি খরচ করবে খাদ্যদ্রব্যের ওপর। আয় যত বাড়বে এই খরচ সমানুপাতিক ভাবে কমবে। তখন প্রয়োজনের বাইরে অন্য আরামের বা বিলাসদ্রব্যের ওপর খরচ বাড়বে, খাবার জিনিসও আরএকটু উৎকৃষ্ট হবে। এবার আসি আয়ের অন্য অংশে – যে টাকা খরচ হল না, আপনি সে টাকা রাখলেন ব্যাঙ্কে, তার বদলে সুদ পেলেন। ব্যাঙ্ক সেই টাকা অন্যদের ঋণ হিসেবে দিয়ে সুদ আয় করল আর আপনার সঞ্চয় রূপান্তরিত হল বিনিয়োগে। আপনিও আপনার রোজগারের অতিরিক্ত কিছু আয় করলেন। এটা ভবিষ্যতে আপনার ভোগব্যয় বাড়াবে – অনেকদিন ধরে বেড়াতে যাবেন ভাবছিলেন, সেটা এবার করা যাবে। অর্থাৎ এখন ভোগব্যয় কম করলে, পরে তা বাড়ানো যেতে পারে।
মানুষের জীবনে ভোগব্যয় এভাবেই পালটায়। জীবনের প্রথমদিকে আয় কম থাকে, একেবারে প্রয়োজনীয় জিনিসের সংস্থান করতেই আয়ের অনেকটা চলে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আয় বাড়ে, তাই ব্যয় বাড়লেও সঞ্চয়ও বাড়ে। আবার যখন কর্মজীবন শেষ হয়, আয় কমে যায়, পূর্বসঞ্চয়ের ওপরে নির্ভর করে ভোগব্যয়ের পরিমাণ কেমন হবে। অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা যে কোনও তত্ত্ব শুরু করার আগেই ধরে নেন যে মানুষ স্বভাবত যুক্তি মেনে চলেন। তাই বড়লোক বাপের কুপুত্তুর যারা জীবনের শুরুতে পৈত্রিক সম্পত্তি উড়িয়ে-পুড়িয়ে খেয়ে শেষদিকে খুব কষ্টে দিন কাটায়, তারা এই হিসেবের মধ্যে আসে না – দেবদাস টাইপের লোকেরাও না। তাই আর্থিক সঙ্গতি মানে শুধু আজকে খরচ করার স্বাধীনতা নয়, ভবিষ্যতের কথাও ভাবা।

আরও একটা কথা এখানে মনে রাখা প্রয়োজন। একজন মানুষ সাধারণতঃ থাকেন পরিবারের মধ্যে। তাই এযুগে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত কেমন হবে, সেটা অনেক সময়ই হয় পরিবারগত সিদ্ধান্ত। আগেকার দিনে অবশ্য একজন কমল মিত্রের প্রোটোটাইপ বাবা থাকতেন। তাই সকলের মত অনুযায়ী খরচ করলে মাসে বা বছরে খরচাপাতি ঠিক সরলরেখাতে চলে না।
একজন মানুষের জন্য যা সত্যি, তা কিন্তু বৃহত্তর অর্থে একটি অর্থনৈতিক এককের জন্য সত্যি। একটি দেশেরও যা আয়, তাকে দুভাবে ভাগ করা হয় – ভোগব্যয় আর সঞ্চয় (বিনিয়োগ)। অবশ্যই দেশের আয় যত বাড়বে, শুধু যে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে তা নয়, বিশ্বের দরবারেও দেশের আসন শক্তপোক্ত হবে। ভারতের কথাই ধরা যাক। যখন দু’শো বছরের পরাধীনতার নাগপাশ কাটিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করল, তখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সে ছিল অত্যন্ত দুর্বল। দারিদ্র্যে নিমজ্জিত দেশের সত্তর শতাংশের বেশি মানুষ নির্ভর করে থাকত একটি পশ্চাদপদ কৃষিক্ষেত্রের ওপর। শিল্পক্ষেত্র ছিল নেহাতই ছোট, ঔপনিবেশিক প্রয়োজন মেটাতে তৈরি। বৈদেশিক ঋণের আশায় তখন দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। খাদ্যের অভাব মেটাতে পিএল ৪৮০র মত অসম্মানজনক চুক্তি মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু ভারতের তখনকার রাষ্ট্রনেতাদের উদ্দেশ্য ছিল এক স্বয়ম্ভর দেশ নির্মাণ। তাই তখন ভোগব্যয় কমিয়ে বিনিয়োগ করা হয় ভারী শিল্পে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পরিকাঠামোতে। অনেক সময় লেগেছে। সব নির্ভুল হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু তাতে দেশের সার্বিক আয় বেড়েছে। অবশ্য ব্যক্তিমানুষ সঞ্চয় করলে যে উপকার হয়, দেশের ক্ষেত্রে ঠিক উলটো। দেশের সঞ্চয় বাড়া মানে চাহিদা কমে যাওয়া, তাতে উৎপাদনও কমে যায়। যাই হোক, যেটা উল্লেখ করার, সেটা হল নব্বইয়ের দশক থেকে টানা পঁচিশ বছর ভারতের জাতীয় আয়ের যে উর্দ্ধগতি, তাতে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সে জায়গা করে নিয়েছে। আজকের ভারত খাদ্যে স্বয়ম্ভর, সেবাক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান। বিশ্বের নানা জায়গায় ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা যে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন, তার পেছনে অবশ্যই ভারতের উন্নয়নের প্রকৃতি বিশেষতঃ শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অবদান আছে। যারা স্বাধীন ভারতের প্রথম চল্লিশ বছরের কৃচ্ছসাধনেরর কথা জানেন, তারাই বুঝবেন আজকের দেশ-বিদেশে বেড়ানো, মল-মাল্টিপ্লেক্সে অভ্যস্ত প্রজন্মের বাবা-মায়েদের হিসেব করে চলা ত্যাগস্বীকারের কথা।
অনেকদিন আগে আর্ন্সট এঞ্জেল নামের এক অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছিলেন, যার আয় যত কম সে শতকরা হিসেবে তত বেশি খরচ করবে খাদ্যদ্রব্যের ওপর। আয় যত বাড়বে এই খরচ সমানুপাতিক ভাবে কমবে।
উন্নয়নের তত্ত্বও বলে একটা পশ্চাদপদ কৃষিনির্ভর দেশে আর্থিক সংগতি কম থাকলে মানুষ যে শুধু খরচ করবে কম তাই নয়, খরচ করা সামগ্রীও হবে সীমিত, ভোগ্যবস্তুর সম্ভার খুবই কম থাকে তখন। দেশের আয়বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের ফল যে শুধু ভোগ্যবস্তুর যোগান বাড়া তাই নয়, সেগুলি জনগণের কাছে সহজলভ্য হওয়াও বটে। তাই আজ সামান্য আয়ের মানুষও নানারকম পোষাকের মধ্যে থেকে বেছে কিনতে পারেন আর অনেকের হাতেই থাকে সেলফোন।
তাই আর্থিক সঙ্গতিও আরেক মুক্তি – তা ব্যক্তির জন্যেও সমষ্টির জন্যেও। এটা প্রথমেই বাড়িয়ে দেয় পছন্দের স্বাধীনতা। আমি কাল কী খাব –সেই ভাবনা থেকে মুক্তি পেলে আমি চিন্তা করতে পারি আমি কী পোষাক কিনব, কটা কিনব, কোথায় বেড়াতে যাব, মাসে একটা সিনেমা দেখব, না গান শুনতে যাব।
এখনকার মধ্যবিত্ত মা অনেক আগেই ভেবে ঠিক করে রাখতে পারেন, মাসের শেষদিনে ছেলের জন্মদিনের মেনু কী হবে!
মহালয়া চট্টোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক। নগর অর্থনীতি, মহিলা শ্রম এবং লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে ওঁর লেখা একাধিক দেশি বিদেশি জার্নালে প্রকাশ পেয়েছে। মূলত ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। ইকোনমিকস অফ আরবান ল্যান্ড ইউজ, এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ওঁর লেখা গবেষণামূলক কিছু বই।
খুব সহজবোধ্য ভাষায় বুঝিয়ে বললে।এই মুহূর্তে অধিকাংশ মানুষই টিঁকে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে ।
খুব চমৎকার ঝড়ঝড়ে লেখা। পড়ে আনন্দ পেলাম। এক সরল সন্গ্ধি অনুভূতি।
চমৎকার লেখা, ডঃ মহালয়া। আরো লিখুন।
Wonderful writting in a very lucid way. Enjoyed reading.
কমল মিত্রের মতো বাবার ছবি কিন্তু আজকের সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেছে। আবার এটাও সত্যি, মাসের শেষ বলতে মায়ের মুখের যে অসহায়তার ছবি ফুটে উঠত, যে পারিবারিক কৃচ্ছ্রসাধনার কথা মনে হত, সেই পরিস্থিতিরও বোধহয় কিছু উন্নতি হয়েছে। লেখাটি খুব সহজ, সুন্দর। কেতাবি অর্থনীতির কচকচি বিহীন।