একটা ফরাসি সুবচন কোনদিনও ভুলতে পারব না। কোনও না কোনও প্রসঙ্গে কথাটা এসে পড়ে এবং আমাকে প্রয়োগ করতে হয়, কারণ কথাটার বাস্তবতা এতটাই সূক্ষ্ম, সরল ও মর্মান্তিক। ১৮৪৯ সালে লিখেছিলেন অ্যালফঁজ কার, যখন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলেন। তাহলে ১৭৮৯-এর বিখ্যাত সেই ফরাসি বিপ্লবের কী হাল হল? কার লিখেছিলেন ‘প্লু সা শঞ্জ, প্লু ইসে লা মেম্ শোজ।’ ইংরেজি করলে : The more things change, the more they are the same. আর বাংলা তর্জমায়: কোনওকিছু যতই বদলায় ততই তা আগের মতোই হয়ে যায়।
১৯৮৯-এ, ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশতবার্ষিকে জ্যঁ পল সার্ত্রের ষাট পাতার ভূমিকা-সহ মার্তিনিকের কৃষ্ণাঙ্গ মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজদার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফানঁ-র দুনিয়া-কাঁপানো বই ‘দ্য রেকেড অফ দ্য আর্থ’ হাতে এল এবং গোগ্রাসে পড়লাম। কৃষ্ণাঙ্গ মানবসমাজের হয়ে এত তীব্র, চাঞ্চল্যকর এবং বিদ্রোহী রচনা তার আগে পড়িনি। সার্ত্র তো বলেই দিলেন এই লেখা থেকে লজ্জাবোধের শিক্ষা নেওয়া দরকার পাশ্চাত্য সমাজের। ফানঁ যেটা করলেন তা হল, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাবৎ উপনিবেশের হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা। বললেন, নিজের বিচারে, নিজের অধিকারে, নিজের শক্তি ও ভাষা নিয়ে তাদের বাঁচা শিখতে হবে। এই বই শেষ করতে না করতেই হাতে এসে গেল ফানঁ-র আরেক মর্মান্তিক চিন্তাভাবনার বই ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’ (কালো চামড়া, সাদা মুখোশ)। আর সেটি পড়ার পর কত যে বিকেল, সন্ধে কেটেছে লেখক-সাংবাদিক বন্ধু বিক্রমন নায়ারের সঙ্গে ফানঁ ও সার্ত্র নিয়ে আলোচনায়। সে সময়ই বিক্রমনদা উস্কোলো একদিন, ‘তোমার বাংলাদেশ কলামে অতি অবশ্য লেখো ফানঁকে নিয়ে। আমাদের দায়িত্ব আছে ফানঁকে চেনানোয়।’

আর আশ্চর্য সেই লেখাই মায়ের কৃপায় ফিরে এল এতকাল পরে, যখন জীবনকথা বিবৃতি করছি। আর কখন? যখন কিনা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জর্জ লয়েডের মৃত্যু ঘটল শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুলিশের হাতে! সারা মার্কিন দেশজুড়ে এবং বিশ্বেরও নানা প্রান্তে শোর উঠেছে ‘Black Lives Matter’। কালো মানুষের জীবনেরও দাম আছে। অতকাল আর্গে ফানঁ এবং কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতি নিয়ে এমনটা ভেবেছিলাম, লিখেছিলাম দেখে একটু গর্বই হচ্ছে। আর কেবলই ভাবছি, সত্যিই কি কিছু বদলায় শেষ অবধি? কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জীবনমূল্যায়ন কি শেষ অবধি এইখানেই এসে দাঁড়াবে? যা কিছু বদলানোর পর সেই আগের মতোই হয়ে যাবে? ফিরে পাওয়া সেই লেখাই পড়তে দিচ্ছি আপনাদের। তারপর কলেজজীবনের যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে যাব। আগুন, বই আর গোলাপের দিনে।
‘আফ্রিকার বিপ্লবে শরিক হতে হলে একটা বৈপ্লবিক গান লেখাই যথেষ্ট নয়; জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমাকে বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে। আর যদি জনতার সঙ্গে মিশে বিপ্লবের চরিত্র নিরূপণ করতে পারো তো ওই সব গান আপনা থেকে, আপন উচ্ছ্বাসে উঠে আসবে। প্রকৃত সংগ্রাম অর্জন করতে হলে তোমাকে আফ্রিকা ও তার চিন্তাধারার জীবন্ত অঙ্গ হতে হবে; তোমাকে হতে হবে সেই গণশক্তির উপাদান, আফ্রিকার মুক্তি, প্রগতি ও সুখের জন্য যার প্রয়োজন অবধারিত। সেই যুদ্ধের বাইরেও একজন শিল্পী বা বুদ্ধিজীবীর কোও জায়গা থাকতে পারে না যদি সে আফ্রিকা ও দুঃস্থ মানবতার মহান যুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণত এক করে না দেখতে পারে।’
এরপর ফানঁ-র বক্তব্য হল যে, প্রতিটি প্রজন্ম তার বিস্মৃতির ভাণ্ডার থেকে এই আদর্শ আবিষ্কার করে, সেই মর্মে সংগ্রাম করে কিংবা সেটির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ১৯৬১ সনেই ফানঁ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ঔপনিবেশিক সমাজের মানুষের আর চলবে না তাদের বাপ-ঠাকুর্দার মতো শ্বেতাঙ্গদের শোষণ, শাসন ও গোলমেলে রাজনীতি না বোঝার ভান করে নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয় থেকে যাওয়া। সেকু তুরে-র মতো ফানঁও বলতে চেয়েছিলেন যে আফ্রিকানদের পক্ষে কেবল দুঃখের বা প্রতিবাদের কবিতা লেখা কি সংগ্রামী গান গাওয়াই যথেষ্ট নয়, সেই কবিতা ও গানকে হতে হবে ঔপনিবেশিক সমাজের মানুষের বিপ্লবের অস্ত্র, তাদের উঠে আসতে হবে বিপ্লবী জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে, কারণ আফ্রিকার মানুষের একমাত্র সংস্কৃতি হল বিপ্লব। এই সংস্কৃতিই ধারণ করে তার অন্য সমস্ত সংস্কৃতিকে।

ফানঁ নিগ্রো সংস্কৃতিকেও (ঠোঁটকাটা, রাগী লেখক অনুগ্রহ দেখিয়ে ‘কালো’ কথাটাও ব্যবহার করেননি) ভাগ করেছেন ‘নিগ্রো’ এবং ‘আফ্রিকান নিগ্রো’ এই দুই বিভাগে। এবং বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সমস্যার মুখোমুখি হন রিচার্ড রাইট বা ল্যাংস্টন হিউজের মতো লেখক-কবিরা, তার সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য আছে লেওপোল্দ সেংঘর বা ইয়োমো কেনিয়াত্তার কপালের কাছে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর। আফ্রিকাতে সংস্কৃতিবান মানুষমাত্রেরই চেষ্টা হল একটা নিগ্রো-আফ্রিকান সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হওয়া, কারণ উপনিবেশকদের একটা মস্ত অবদানই হল আফ্রিকার নিগ্রোদের মাথায় এমন ধারণা গেঁথে দেওয়া, যে নিগ্রো জাতির বস্তুত কোনও সংস্কৃতি নেই। এ হেন কোনও সংস্কৃতি কোনও জাতীয় সংস্কৃতি হয়ে উঠতে চায় না, তার ভৌগোলিক ও মানসিক সীমা আরও বিস্তৃত। ফানঁ-র বইয়ের ভূমিকায় জ্যঁ পল সার্ত্র এই আফ্রিকান নিগ্রোবাদকে বলেছেন ইউরোপের সৃষ্ট কর্ম। অন্তত ইউরোপীয়দের সেটাই ধারণা। যারা এশিয়ার মানুষদের হেলেনাইজড বা গ্রিক প্রভাবান্বিত করার আদর্শ গ্রহণ করেছিল, তারাই তৈরি করেছে এই গ্রিকো-লাতিন নিগ্রো সমাজ ও সভ্যতা। আর এখন, তৃতীয় বিশ্ব ফ্রানজ ফানঁ-র মতো মানুষদের মাধ্যমে কথা বলছে নিজের প্রতি, নিজের সঙ্গে। শ্বেতাঙ্গ প্রথম বিশ্বকে শ্রোতা হিসেবে তার প্রয়োজন নেই।
১৯৬১ সনে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ফানঁ মারা গেলেন। সার্ত্রের ভূমিকা যেমন তাঁর পড়া হয়নি, তিনি দেখে যেতে পারেননি মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের অভিযান। তাতে অবশ্য তাঁর নিগ্রো ও আফ্রিকান নিগ্রো তত্ত্বের হেরফের হত বলে মনে হয় না, কারণ ‘আফ্রিকান নিগ্রো’ ও ‘মার্কিন নিগ্রো’ ততদিনে দুটো স্বাধীন, মৌলিক চেহারা পেয়ে গেছে। কিন্তু তিনি দেখতেন যে, সমস্ত আঞ্চলিক চারিত্র্য সত্ত্বেও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের সংগ্রাম একটু একটু করে তার ভৌগোলিক সীমাবন্ধন হারিয়ে ফেলছে, তাঁদের গান ও কবিতা মার্কিন আঞ্চলিকতায় অধ্যুষিত হলেও তার নিগ্রো নৃতত্ত্বের দাক্ষিণ্যে ক্রমশ আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে। মার্কিন নিগ্রোর স্পিরিচ্যুয়াল সঙ্গীত শুধু খ্রিস্টের নামগান, জয়গান বা ধর্মসঙ্গীত থাকেনি। তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রেম ও পূজার আঙ্গিকের মিলনের মতো ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে ধর্ম ও প্রতিবাদ। ‘অ্যামেরিকাস মিউজিক’ বইয়ে লেখক গিলবার্ট চেজ ‘দ্য নিগ্রো স্পিরিচ্যুয়ালজ’ পরিচ্ছেদে এক সমীক্ষার প্রসঙ্গ তুলে বলছেন, কৃষ্ণাঙ্গরা যখন তাঁদের মনিবদের গির্জায় উপাসনায় যান, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত ‘হিম’ (hymn) বা বন্দনা-সঙ্গীতই গান। কিন্তু নিজেদের সমাবেশে প্রায়শই নিজেদের তৈরি কথা ও সুরে গান করেন তাঁরা। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, তাঁদের নিজেদের এই সব গানে আছে ‘more religion than those in the books.’ এই সমীক্ষা, এখন বলে দেওয়া দরকার, হালফিলের নয়, স্পিরিচ্যুয়ালজের উৎস লগ্নের, ১৮৪১ সনের। সেই স্পিরিচ্যুয়ালজের একটি নমুনা হল—
Oh, Satan he came to my heart
Throw brickbats in de door,
But Master Jesus come wid brush
Make cleaner dan before.
এ অবশ্যই পূজার গান, আবার প্রতিবাদেরও। শুধু সুর এবং তত্ত্বের নিরিখেই নয়, শব্দের জটিল বয়ানে, নিবেদনের ভঙ্গি ও কাঠামোয়, ইম্প্রোভাইজেশনে, পরিবর্তন ও প্রক্ষেপণে। আর এর সমস্ত কিছুর পিছনে প্রধান শক্তি হল, গিলবার্ট চেজের ভাষায়, ‘দ্য কালচারাল হেরিটেজ অফ আফ্রিকা’। বিখ্যাত ইংরেজ অভিনেত্রী ফ্যানি কেম্বল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর স্বামী পিয়ার্স বাটলারের জমিদারি এলাকায় ১৮৩৮-৩৯ বছরটা কাটান এবং সেখানকার কালোদের গান শুনে একইসঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত হন। তাঁর মনে হয়েছিল, যে ওই গান হল ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারিলি ওয়াইল্জ অ্যান্ড আনঅ্যাকাউন্টেবল’। তারপর তার যে বর্ণনা তিনি দেন তা হল আফ্রিকার নিগ্রো সমাজের গানের চরিত্র-বর্ণনা।
নিগ্রো জাতির উত্থানের স্বপ্ন ফানঁ আঁকেননি তাঁর বইয়ে। পেশায় ডাক্তার এই বাস্তববোধসম্পন্ন মানুষটির চেষ্টা ছিল ঔপনিবেশিক সমাজের মানুষের সামনে তাদের কতকগুলো বাস্তব সমস্যা তুলে ধরা। রোগ নির্ণয়ই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। পরে ‘ব্ল্যাক স্কিনজ, হোয়াইট মাসকস্’ (কালো চামড়া, সাদা মুখোশ) নামে প্রকাশিত বইটিতে বর্ণভেদের আরও কঠিন সমস্যাগুলো তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। বর্ণভেদ ও বর্ণবিদ্বেষই যে শেষ অবধি নিগ্রো আন্তর্জাতিকতার কারণ হবে, ফানঁ-র সমকালীন আরও কিছু মনীষীর মতো তাঁরও অনুমানে ছিল। কেন যে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের কণ্ঠে তোলা ‘উই শ্যাল ওভারকাম সামডে’-র মতো একটা ঐকতানে গাইবার ধর্মীয় গান ক্রমে ক্রমে বিশ্বের তাবৎ কৃষ্ণাঙ্গ এবং অবশেষে, সব বর্ণের প্রতিবাদী, সংগ্রামী মানুষের গান হয়ে উঠল সে ইতিহাস ও পরিণতি অনুসরণ করলে ধারণা হয় কীভাবে কীভাবে বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন কৃষ্ণাঙ্গ জগতগুলো কাছাকাছি এসেছে। ১৯০০ সনে অ্যালবার্ট টিন্ডলে ও যাজক এ আর শকলাই যখন তাঁদের ‘নতুন সুসমাচার সঙ্গীত’ বইয়ে গানটিকে রাখেন তখন গানের বাণী ছিল ‘আই শ্যাল ওভারকাম সামডে’। সুর সম্ভবত নেওয়া হয়েছিল ১৭৯৪-এর প্রার্থনা সঙ্গীত ‘ও স্যাংটিসিশ’ বা ‘সিসিলিয়ান’ নাবিকদের প্রার্থনা থেকে। কিন্তু পরের দিকে এতে নতুন নতুন পঙক্তি যোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরও আধুনিক করে তোলা হয়।
বিখ্যাত মার্কিন লোকশিল্পী পিট সিগার যখন গানটি গাইলেন, তখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ‘আই শ্যাল ওভারকাম’-এর জায়গায় কথা দাঁড়িয়ে গেছে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। মার্টিন লুথার কিং কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে ঘোষণা করেছিলেন যে এই গানই কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে ঐক্য এনে দিয়েছে। ওই আন্দোলনের শ্বেতাঙ্গ কর্মী ভায়োলা লুৎসিও যখন আলাবামায় খুন হলেন, তাঁর ঠোঁটেও ছিল ওই গান। জোহানেসবার্গের জেলখানায় ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে গানটি গেয়ে গেছেন জন হ্যারিস। এবং সেই থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় গানটি ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু গানটির এখন আর কোনও স্থানকালপাত্র নেই, এ এখন সমস্ত জেহাদি মানুষের সুসমাচার সঙ্গীত, বিশ্বের নতুন ‘ইন্টারন্যাশনাল’।
কৃষ্ণাঙ্গদের গানকে শান্তি ও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বিশ্বের মঞ্চে এনেছিলেন পল রোবসন। শুধু মার্কিনি কৃষ্ণাঙ্গ নয়, রোবসনের বিষয় ছিল সারা পৃথিবীর সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গদের কান্না। কিন্তু কমিউনিস্টবিরোধী হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত মার্কিন সরকার ও এক বৃহৎ নাগরিক গোষ্ঠীর কাছে আতঙ্কের কারণ হলেন রোবসন। পনেরো বছর ধরে আমেরিকায় জনপ্রিয়তম কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা কোনও কাজে এল না, তাঁর দেশে গান গাওয়া বন্ধ করা হল। বিদেশে যাওয়ার অনুমতি প্রত্যাহার করা হল। এভাবে আট বছর বাতিলের তালিকায় থেকে তিনি ১৯৫৮ সালে যখন পের কার্নেগি হলে অনুষ্ঠান করলেন এবং লিখলেন তাঁর ব্যক্তিগত ইস্তাহার গ্রন্থ ‘হিয়ার আই স্ট্যান্ড’, ততদিনে রোগ দানা বাঁধতে শুরু করেছে শরীরে। তিনি দেহরক্ষা করলেন ১৯৬৩-তে। ফানঁ তাঁর আগেই মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু রোবসনের ধ্বস্ত হওয়ার ইতিহাস তাঁর নিশ্চয়ই জানা ছিল।
এরকম আরেক স্পিরিচ্যুয়ালজ গায়িকা মারিয়ান অ্যান্ডারসন, যিনি ধর্মসঙ্গীত দিয়েই এককাট্টা করেছিলেন প্রতিবাদী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের। রোবসনের আগেই তিনি এক চাঞ্চল্যকর বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন, যখন ১৯৩৯ সনে ওয়াশিংটনের কনস্টিটিউশন হলে তাঁর অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ হয়। এই নিষিদ্ধকরণের উদ্যোগ নিয়েছিল ‘ডটার্স অফ দ্য অ্যামেরিকান রেভোলিউশন’ সংগঠন, যার প্রতিবাদে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন এলিনর রুজভেল্ট। এই এলিনর রুজভেল্টের স্বামী, তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপিত ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট অবশ্য ভিন্ন একরকম প্রতিবাদের বিষয় হয়ে উঠলেন মাত্র চার বছর পর, ১৯৪৩-এ। ডেট্রয়েট দাঙ্গাকে ভিত্তি করে কবি পল মারে লিখলেন তাঁর কবিতা ‘মিঃ রুজভেল্ট দুঃখপ্রকাশ করছেন।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মুকুল গুহ-কৃত সেই কবিতার বাংলা তর্জমা এরকম—
কী তুমি চাও কালো ছেলে— যখন
তোমার সব কটি দাঁত ভেঙে ফেলা হল,
মাথা লাঠির আঘাতে চৌচির
তোমার পেট চিরে দেয় ছুরির আঘাতে—
তারপর
মৃত তোমাকে নর্দমার ভিতরে গুঁজে দেয়—
—তখন
কিংবা পুলিশ যখন পিছন থেকে গুলি করে,
তোমার রক্তের দাগ মুছে ফেলা পর্যন্ত
বেল্ট দিয়ে বিছানায় বেঁধে রাখা হয়—
তুমি কী পাও
সার্থক মানুষজনের কাছে চিৎকার ক’রে
বিচার চাও,
ঈশ্বরের পরই যাঁর শক্তি ভেবে তাঁকে ডাকো
তোমাকে বাঁচাতে বল—
সেই সর্বোচ্চ মানুষটি তোমাকে কী
উত্তর দেয় কালো ছেলে
“মিঃ রুজভেল্ট দুঃখ প্রকাশ করছেন…”

মার্কিন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লেখা এই কবিতাটি কিন্তু শেষ অবধি কোনও দেশীয় রাজনীতির গণ্ডির মধ্যে বাঁধা থাকে না। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ঈশ্বর ক্রমে প্রতীক হয়ে ওঠেন, কিন্তু বাস্তব থেকে বৃহত্তর বাস্তবে ছড়িয়ে পড়ে কালো মানুষের হতাশা ও পরিস্থিতি। আরও বাস্তব হয় তার বুকের রক্ত ও রক্তপাত। কবিতা ও লড়াই দেখতে দেখতে এক হয়ে আসে, কালোদের বিভিন্ন মহাদেশও কাছে আসতে থাকে। সেকু তুরে-র নির্দেশ, ফ্রানজ ফানঁ-র বিশ্লেষণ কাছাকাছি আসে, আমেরিকার সোনিয়া সানচেজের কবিতায় একটা নবজাগ্রত বাস্তব প্রতিভাত হয়। সোনিয়ার সেই কবিতার নাম ‘এখন কবিতা, আমাদের জন্য’।
ওদের মরে যেতে দিও না,
ওই বৃদ্ধ, কালো, লোকজনদের
ওদের দাসত্বের, অস্তিত্বের স্মৃতিটুকু নিয়েই
শুধু চলে যেতে দিও না।
শুধু এটুকু আমাদের
ঐতিহ্য,
তুমি জানো, আংশিক আফ্রিকান,
আংশিক নিগ্রো, আংশিক ভৃত্যশ্রেণীর—
সোনিয়া সানচেজের সঙ্গে একই বছরে (১৯৩৫) জন্ম যাঁর. সেই হেনরি ভুমা আরও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন কালোদের নিগ্রহকারীর নিয়তির কথা তাঁর ‘মহিষ’ কবিতায়—
আমি কেঁদো ষাঁড়টাকে শেষ অবধি
পেড়ে ফেলতে পেরেছিলাম,
ধুলো,
রক্তের ফোঁটার মতন ছিটকে পড়ছিল
বাতাসে।
আর আমি কিনা এত কাল ভেবে
এসেছি যে,
ষাঁড়টা আমাকে তাড়া করলেই মরে যাব।
এ হল সেই মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ধ্বনি, যার সঙ্গে আফ্রিকান নিগ্রোর কণ্ঠধ্বনি মিশে এক হয়ে এসেছে গত তিন দশকে। শক্তি ও মুকুলের অনুবাদে ‘১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা’-বইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আরও চোদ্দোটি দেশের নিগ্রো কবিতা আছে। পটভূমি আলাদা, ভাষারীতি ভিন্ন, সমস্যা ও সংস্কার পৃথক, কিন্তু তারা কোথায় যেন এক এবং অবিভাজ্য। শুধু কৃষ্ণাঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গে মিশে এক তাই নয়, শেষে একসময় এইসব আর্তনাদ ও প্রতিবাদ মিশে গেছে তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত বর্ণের আর্ত মানুষের আর্তির সঙ্গে।

সেজন্যই কি অ্যাংগোলার কবি হোসে অ্যাভিরিনহো-র ভাষার মধ্যে আচমকা আমরা শুনে ফেলি জীবনানন্দ দাশের মতো আমাদের অতি নিজস্ব কারও কণ্ঠধ্বনি? যখন অ্যাংগোলান কবি লেখেন ‘বীজ সম্ভাবনাময়’ কবিতায়—
জীবন এবং মৃত্যুর ওপারে
কোন বীজ রক্তের ভিতরে কাজ করে
চিরন্তন অস্থির শুভ্রতায়, কোন বীজ
হাড়ের শুভ্রতায় স্বস্তিহীন, মেরির মতন
ইনগ্রিডের স্তনের মতন সাদা,
হাড়ে দূর স্কান্ডিনাভিয়া পোলানার দেশে
অথবা জঙ্গলে, আমার দেহাতি গ্রামদেশে,
সকলে অপ্রস্তুত, আমার রক্তের রং অন্য সকলের
রক্তের মতন, শান্তির পরিবর্তে, পরিবর্তে সহজ
এবং নিখাদ জন্মের সহজ এবং নিখাদ মৃত্যুর
জটিলতা তৈরি করে আমাদের হাড়ের শুভ্রতার বীজে
নদী কান্না আর ঘর্মাক্ত পাথরে, সবুজ জলরাশির
আয়োজনে, এই রাত্রি এই রাত্রি
সকলেই ইতস্তত করে, সাদা বীজের জন্য
ক্রোধ এবং জটিলতার যে অসুখ, তৈরি হয় সেইসব,
একদিন দূর দেশের ইনগ্রিড, মেরিরা
কেঁদে উঠবে, উল্লসিত হাসিতে অস্থির, কেউ না চাইলেও
ভালবাসার সেই গান, সেইসব
সঙ্গীতের মূর্চ্ছণায় বলে উঠবে সাদা হাড়ের মর্যাদায়,
“ক্ষমা করো ভাই আমার।”
নেলসন মান্ডেলার জীবন, আন্দোলন ও মুক্তি দাঁড়িয়ে আছে এহেন অগণিত গান ও কবিতার ওপর। সেকু তুরে যে-গান ও কবিতাকে বলবে লড়াই। ফানঁ বলবেন বিপ্লব।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩০ জুলাই
*ছবি সৌজন্য: warwick.ac.uk, WASD, DUBeat
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।