‘জামলো মাকদাম’ – ভারতীয় নাম? কী রকম বিজাতীয় শুনতে, তাই না? সেনগুপ্ত না, মুখার্জি না, সুব্রামানিয়াম না, কাপুর না , আহমেদ না, রোজারিও না, মাকদাম | আবার জামলো| জমলো? নামটা? নাহ| ওরও জমেনি, এই লকডাউন…তাই এই দেশ, এই গ্রহ ছেড়ে মাত্র বারো বছর বয়সেই বিদায় নিয়েছে| “শ্রমিক”-এর আগে “শিশু” বসাতে এই উপমহাদেশে আমরা অনেক আগেই শিখে নিয়েছিলাম, ভাইসকল, তাই এতে কোনো চমক নেই| তবে, ” পরিযায়ী” শব্দের পরে সাহিত্যমনস্ক বাঙালি “পাখি” বসাতেই বেশি পছন্দ করে, এমনকী, আমরা যারা অর্থনীতিতে ছোট বয়সে হ্যারিস-টোডারো-র “রুরাল-আরবান মাইগ্রেশন মডেল” পড়েছি, তারাও “মাইগ্র্যান্ট লেবার/লেবারার” বলতে বেশি কম্ফোর্টেবল,”পরিযায়ী শ্রমিক” বলি কোথায় তেমন…সে যাই হোক, জামলো মাকদাম একজন বছর বারোর বালিকা, এক “পরিযায়ী শিশুশ্রমিক”| মানে, ছিল, এখন নেই — তাকে খেয়েছে লকডাউন| যে লকডাউন আমাদের আলস্য, ডিপ্রেশন, ওয়েব সিরিজ, ফেসবুক-পদ্য, ফেসবুক-লাইভ,”উফফ আর পারছি না”- রঙের টিকটক, ব্ল্যাকে সিগারেট-মদ, সুইগি, যে লকডাউন আমাদের ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম-কিন্তু-চাকরি-থাকবে-কিনা-জানি না, যে লকডাউন আমাদের ব্যবসা বন্ধ-রোজগার নেই, সেই ভালমন্দ মেশানো লকডাউন কিন্তু জামলো মাকদামের কাছে, মাকদামদের কাছে মৃত্যু, জাস্ট পয়েন্ট ব্ল্যাংক ট্রিগারপ্রবণতা| যে বয়সে শিশুরা স্কুলে যায়, খেলাধুলো করে, বাসকিন রবিন্সের চকোলেট ফাজ খায় , সেই বয়সেই জামলো মাকদাম ছত্তিশগড়ে নিজের গ্রাম বিজাপুর ছেড়ে ১৫০ কিলোমিটার দূরে তেলেঙ্গানার মরিচক্ষেতে দিনমজুর হতে পাড়ি জমায়, লকডাউনে সব রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মরীয়া হয়ে পায়ে হেঁটে নিজের গ্রাম, বাবা-মা, ঘর-ভিটের কাছে ফিরতে চায়| ৩ দিন, ৭২ ঘণ্টা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটেছিল জামলো ও তার মরিচক্ষেতের খেতে না পাওয়া সঙ্গীরা, জল নেই, খাবার নেই, কিচ্ছু নেই, শুধু ক্লান্ত চোখে ভেসে আছে মায়ের মুখ, ঘরের দরজা|
নিজের গ্রাম থেকে যখন আর ১৪ কিলোমিটার দূরে, তখন জঙ্গলে লুটিয়ে পড়ে জামলো মাকদাম, মরে যায়| জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে, মরিচক্ষেতের ময়লা নোট আর শৈশবের বটগাছতলা-নদীর মধ্যে, জোর করে বড় হয়ে যাওয়া আর শখ করে কেনা মলিন চুলের ফিতের মধ্যে, দূরত্ব, কমরেডস, জানবেন, এক অনন্ত ১৪ কিলোমিটার|
“আহা, ৩ দিন এইভাবে , ওইটুকু মেয়ে…” – ঋত্বিক-মৃণালের ছবির মতো না, ভাইসকল!? নিজের গ্রাম থেকে যখন আর ১৪ কিলোমিটার দূরে, তখন জঙ্গলে লুটিয়ে পড়ে জামলো মাকদাম, মরে যায়| জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে, মরিচক্ষেতের ময়লা নোট আর শৈশবের বটগাছতলা-নদীর মধ্যে, জোর করে বড় হয়ে যাওয়া আর শখ করে কেনা মলিন চুলের ফিতের মধ্যে, দূরত্ব, কমরেডস, জানবেন, এক অনন্ত ১৪ কিলোমিটার| আমরা করোনাকে কীভাবে মারতে হবে জানি না, জামলো মাকদামদের কেন মানুষের মতো করে নিজের ঘরে ফিরিয়ে দেবার নূন্যতম ব্যবস্থা করা যায় না তাও জানি না| তাই আমরা এই নপুংসক সিস্টেমের প্রেক্ষাগৃহে পপকর্ন খেতে খেতে বসে থাকা আর্মচেয়ার রেভোলিউশনারি, আমরা ফেসবুক-বিপ্লবী , কত লাইক পড়ল গুনতে গুনতে আমরা সেয়ানার মতো খোঁজ নিই সিটি মার্ট থেকে মদের হোম ডেলিভারি হচ্ছে, কি না|
জামলো মাকদাম| এক দাম| এক লাখ| এক লাখ — সরকারি ক্ষতিপূরণ|
যতই স্মার্টলি “নিউ নরমাল” বলে গম্ভীর মুখে মুচকি হাসি, আমরা তো জানি এটা “গ্রেটেস্ট এবনরমাল”| একটা মুখোশ পরা পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দিন কোথায় পৌঁছবে কেউ জানে না| কবে আবার রেইনবো ক্যাফেতে বসে মুখোমুখি কফি খাওয়া যাবে, কবে আবার মুসৌরির পাইনউড বাংলোর বারান্দায় বসে রোদ মাখা যাবে, কবে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের বাদামি চুলের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করা যাবে “ইউ হ্যাভ আ লাইটার?”, কেউ জানে না| তবে এগুলো তো অনেক পরের ব্যাপার| প্রথম হচ্ছে প্রাণ থাকবে কি না, কারণ আমাদের করোনা’র সঙ্গে ঘর-সংসার করতে হবে, ওষুধ নেই| তারপর রোজগারপাতি থাকবে কি না , কারণ ব্যবসা বন্ধ, চাকরিবাকরির মা-বাপ নেই, ক্ষুদ্র শিল্প শেষ, আমদানি-রপ্তানি স্থগিত| ওয়ার্ক ফ্রম হোম, এই হোমেই জীবন, এই হোমেই মরণ আমাদের| ট্র্যাভেল এন্ড টুরিজম , পারফর্মিং আর্ট, এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি সবাই মাস্ক পরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে| আর নীচের দিকে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক-মজদুরের হেঁটে যাওয়া লাশ, জামলো মাকদামের হারানো, মলিন চুল কাঁটা| হ্যান্ড শেক করা যায় না , কথাবার্তা মানে অনলাইন মিটিং, আড্ডা| হোম ডেলিভারি, ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং — এই শব্দগুলো ঘুম আর স্বপ্নের মধ্যে বুদ্বুদের মতো ভেসে বেড়ায়| অনেকদিন দেখা হয়নি, আরও অনেকদিন হবে না, জীবন রিয়েল আর ভার্চুয়ালের মধ্যে ছুটে মরবে অনেকদিন, প্রিয় মুখ যেন ঝাপসা বিকেল| মুখে মাস্ক এঁটে দু-তিন পাক ঘুরে এসে কাটা ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি| যাদের ফুটপাথই ঘর, তারা কোথায় গেল কে জানে | ভদ্রলোকেরা মুখে রুমাল ঢেকে যে অভদ্র পাড়াতে এদিক ওদিক দেখে ঢুকে পড়তেন, সেই পাড়ার মুখে রং মাখা দুঃখী গ্ল্যামার কুইনদের কী হবে, কেউ জানে না| ” নিউ নরমাল ” , তুমি– টোকিও এয়ারপোর্টে যে জাপানি ইমিগ্রেশন অফিসার সব ফরম্যালিটি হয়ে যাবার পরেও আমাকে লাগেজ খুলিয়ে হেনস্থা করে তারপর হাসিমুখে ” আরিগাতো গজাইমাস” বলেছিল, শালা তার চেয়েও খারাপ একটা লোক |
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।
চমৎকার। মানবিক প্রতিবেদন। সংক্রমণ জনিত সামাজিক বিপর্যয় নিয়ে অনবদ্য রচনা। লেখককে ধন্যবাদ।
Khub sohoj vabe likhechen kintu ekta chabuk bar bar somajke sporsho kore geche. Valo laglo pore.
খুব অনবদ্য বলিষ্ঠ লেখনী অসম্ভব ভালো লাগলো লক গাউনে পরিযায়ী শ্রমিক এর দুর্দশা অবর্ণনীয় মা আপনি ফুটিয়ে তুলেছেন