‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’– মোক্ষম মন্ত্রটা দিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ! বিবেকানন্দের মতো আহারবিলাসী মানুষ এই বাংলায় খুব কমই জন্মেছেন। আর তিনি এতই খাদ্যরসিক ছিলেন যে বিলেতে বেদান্ত আর বিরিয়ানির প্রচার একসঙ্গে চালিয়ে গিয়েছেন বলে শোনা যায়। তবে বিবেকানন্দের খাদ্যরসিক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। একেই উত্তর কলকাতার বাসিন্দা, তার ওপর সচ্ছল পরিবারের ছেলে। খাদ্যবিলাসী মানুয হওয়ার পিছনে তাঁর পরিবারের অবদান যথেষ্ট। নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত নিজেও ছিলেন খাদ্যরসিক। বাবা জীবিত থাকাকালীন দত্ত পরিবারে রোজ পোলাও হত। ‘মাংসই দত্তবাড়ির প্রধান আহার্য’— এ তথ্য দিয়েছেন অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তাই মাংসের প্রতি একটা অনুরাগ ছিল স্বামীজির।

তবে মাংসই যে শুধুমাত্র স্বামীজির প্রিয় ছিল, এমনটা কিন্ত ভাবার কোনও কারণ নেই। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলছেন, ‘নরেনকে খাওয়ালে লক্ষ ব্রাহ্মণ ভোজন করানোর পুণ্য হয়…।’ হ্যাঁ, নরেন্দ্রনাথ যে সবকিছু খেতেই ভালবাসতেন! তবে এর মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘কচুরি’। ‘বোধহয়’ শব্দটি যোগ করে এ কথা বলার কারণ হল, পরিব্রাজক বিবেকানন্দের একটি সহাস্য মন্তব্য। রামকৃষ্ণ পরমহংস যেহেতু তোতাপুরীর থেকে গোপনে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন, সেহেতু রামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানদের অনেকেই মনে করছেন ‘পুরী’ সম্প্রদায়ভুক্ত। একবার পরিব্রাজক বিবেকানন্দের কাছে এ প্রশ্নটি করে বসেন কয়েকজন। ‘আপনি গিরি না তোতাপুরী?’ তখন স্বামীজির উত্তর ছিল— ‘কচুরি’। হ্যাঁ, সেই ছেলেবেলা থেকেই কচুরি এবং নোনতার প্রতি বড্ড ভালবাসা নরেন্দ্রনাথের। স্বামীজির জীবনের নানা ঘটনা থেকে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। শোনা যায়, একদিন মেসে বসে তিনি কচুরি খাচ্ছিলেন। বন্ধু এসে যাওয়ায় সেখান থেকেই বন্ধুকে ভাগ দিলেন। কিন্তু ভাগ দিয়েও মনে শান্তি হল না। তিনি সেই বন্ধুকে বলে বসলেন, ‘এইটে থেকে আরও একটু দে না!’

Kochuri
কচুরি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের অতিপ্রিয়

আবার একটি তথ্য পাওয়া যায়, ‘পরমহংসের কচুরি’ (ভুল করবেন না ইনি রামকৃষ্ণ নন, ইনি শিমলে পাড়ার বিখ্যাত কচুরি বিক্রেতা) তিনি আনাতেন বন্ধু রাখালের জন্য। পরবর্তীকালে সেই রাখালই হন স্বামী ব্রহ্মানন্দ। কচুরির প্রতি এতটাই ভালবাসা যে অসুস্থ গুরুভাই স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ যখন রোগীর পথ্য হিসেবে আধসের কচুরি খাচ্ছেন, তখন মোটেই চটে যাচ্ছেন না বিবেকানন্দ। বরং বলছেন, ‘…তোর স্টমাকটা দে দেখি— দুনিয়ার চেহারাটা একেবারে বদলে দিই!’ তবে নোনতার মধ্যে যে কচুরিই ছিল তাঁর প্রিয়, এমনটা কিন্তু মোটেই নয়। চানাচুর খেতেও প্রচণ্ড ভালবাসতেন তিনি। একা একা ঘুরতে ফিরতেও চানাচুর খেতেন। শঙ্করীপ্রসাদ লিখছেন, ‘…শিষ্য দেখিল, সাধু আর কেহ নহেন— তারই গুরু, স্বামী শ্রী বিবেকানন্দ। স্বামীজীর বামহস্তে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুরভাজা; বালকের মত খাইতে খাইতে তিনি আনন্দে পথে অগ্রসর হইতেছেন।’

উত্তর কলকাতার বাসিন্দা, তার ওপর সচ্ছল পরিবারের ছেলে। খাদ্যবিলাসী মানুয হওয়ার পিছনে তাঁর পরিবারের অবদান যথেষ্ট। নরেন্দ্রনাথের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত নিজেও ছিলেন খাদ্যরসিক। বাবা জীবিত থাকাকালীন দত্ত পরিবারে রোজ পোলাও হত। ‘মাংসই দত্তবাড়ির প্রধান আহার্য’— এ তথ্য দিয়েছেন অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তাই মাংসের প্রতি একটা অনুরাগ ছিল স্বামীজির।

নোনতা তো হল, মিষ্টির প্রতিও স্বামীজির কিন্তু প্রবল প্রেম লক্ষ করা যায়। যদিও অনেক বিবেকানন্দ গবেষকের মতে, স্বামীজি মোটেই মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন না। তাঁর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তও জানিয়েছিলেন সেই তথ্য। এখানে কয়েকটি ঘটনার কথা তবে উল্লেখ করতেই হচ্ছে— ‘এই নরেন্দ্রনাথের দক্ষিণেশ্বর গমনও নাকি রসগোল্লার আশায়। বলেছিলেন, যদি আমাকে রসগোল্লা খাওয়াতে পারে তো ভাল, নইলে কান মলে দেব।’ আবার ট্রেনের মধ্যে এক থিওজফিস্টকে তিনি বিবরণ দিচ্ছেন, ‘এই তো, মাত্র ক’দিন আগে কুতমিলালেল ভাণ্ডারাতে গিয়েছিলুম। সে কি এলাহি ব্যাপার। হাজার-হাজার সাধু খাচ্ছে— ইয়া ইয়া লাড্ডু।’ আবার তাড়িঘাট রেলস্টেশনে নামার পর মিষ্টি খাইয়ে তাঁর সেবা করছেন এক ব্যক্তি। শঙ্করীপ্রসাদ লিখছেন— ‘অতঃপর স্থানীয় এক মিঠাইওয়ালা উদিত হয়ে স্বামীজীকে প্রচুর খাওয়াল— সে নাকি স্বপ্নে সাধুসেবা করার নির্দেশ পেয়েছিল।’ এই কয়েকটি ঘটনা শোনার পর আর তো ভাবতে কষ্ট নেই যে স্বামীজি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন।

এবার আসা যাক স্বামীজির ঝাল বৃত্তান্তে। তাঁর ছোট ভাই মহেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, স্বামীজির অত্যন্ত প্রিয় ছিল তীব্র ঝাল। কতটা প্রিয়? বিবেকানন্দ গবেষক এবং লেখক শংকর একটি ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘এই লঙ্কাপ্রীতি প্রচণ্ড অভাবের সময় বিবেকানন্দকে শক্তি দিয়েছে। রামকৃষ্ণর মৃত্যুর পরে বরানগরে সাধনভজনের সময় প্রবল অনটন। দারিদ্র এমনই যে মুষ্টিভিক্ষা করে এনে তাই ফুটিয়ে একটা কাপড়ের ওপর ঢেলে দেওয়া হত। একটা বাটিতে থাকত লবণ আর লঙ্কার জল। একটু ঝালজল মুখে দিয়ে এক এক গ্রাস ভাত উদরস্থ করা হত।’ 

স্বামীজি নিজেও বলতেন, লঙ্কা হল তাঁর ‘বন্ধু ও মিত্র।’ একবার এক অবাঙালি সাধুর সঙ্গে তিনি কম্পিটিশন দিয়ে লঙ্কা খেয়েছিলেন। অসুস্থ থাকার সময় আবার তিনি খিচুড়িতে মিষ্টি দেওয়া হয়েছে বলে লঙ্কা চিবিয়ে থাচ্ছেন। শংকরের মতে, বিবেকানন্দের হাত ধরেই বিলেত লঙ্কা খেতে শিখল। আজকের দিনে যা ‘হট’। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন শংকর– ‘লঙ্কার বেজায় অভাব তখন লন্ডনে… এক সহযোগী বহু কষ্টে উইলিয়াম হোয়াইটের দোকান থেকে তিনটি কাঁচালঙ্কা কিনে আনলেন। একশো বছর আগে সেই ১৮৯৬ সালে সায়েবদের দেশে তিনটে কাঁচালঙ্কার দাম তিন শিলিং বা তখনকার তিন টাকার মতো। বিবেকানন্দ লঙ্কার মোহমায়া সামলাতে পারেন না, তিনি সবকটা লঙ্কা খেয়ে ফেললেন।’

Lonka
ঝাল খেতে অসম্ভব ভালোবাসতেন স্বামীজি

আগেই বলা হয়েছে, স্বামীজির মাংসের প্রতি অনুরাগ ছিল। স্বামীজি মোটেই নিরামিষ খাবার পছন্দ করতেন না। সন্ন্যাসী হয়েও বিবেকানন্দ সারাজীবন মাংস খাওয়ার পক্ষেই লড়াই করে গিয়েছেন। তিনি খাওয়ার ব্যাপারে ছুঁতমার্গকে ঘৃণা করতেন। নিরামিষ খাবারের সঙ্গে ‘ধর্মের জড়াজড়ি ভালবাসাকে স্বামীজি ঘুচিয়েছেন বারবার’। স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, ‘সে দিন নরেন বলিল, চল আজ তোদের কুসংস্কার ভাঙিয়া দিই।… সন্ধ্যার সময় কাশীপুর বাগান হইতে পদব্রজে আমরা নরেনের সঙ্গে বিডন স্ট্রিটে বর্তমানে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার, তাহার নিকটে পীরুর দোকানে উপস্থিত হইলাম। নরেন ফাউলকারি অর্ডার দিল।… রাত্রে কাশীপুরে ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় গিয়েছিলি? আমি বলিলাম কলিকাতার বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানে।… জানতে চাইলেন, কী খেলি? আমি বলিলাম মুরগির ডালনা। শেষপর্যন্ত ঠাকুর ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, বেশ করেছিস।’

স্বামীজি বলতেন, ‘ঈশ্বর কি তোমাদের মতো আহাম্মক, তিনি কি ফুলের ঘায়ে এতই মূর্চ্ছা যান যে এক টুকরো মাংসে তাঁর দয়ানদীতে চড়া পড়ে যাবে!’ এ নিয়ে নানা বিদ্রূপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সেসব অবশ্য আমল দিতেন না। তবে সবচেয়ে বড় বিদ্রূপটি হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। অমৃতবাজার পত্রিকা একটি শোকসংবাদের হেডলাইনে লিখেছিল— ‘A Meat Eating Swami’. তবে স্বামীজি যে শুধুমাত্র ভোজনরসিক ছিলেন তা নয়, তিনি খাওয়াতেও বেশ ভালবাসতেন। দারুণ রান্না করতেন তিনি। রান্নার প্রতি এতটাই অনুরাগ যে ছেলেবেলায় বন্ধুরা মিলে গড়ে তোলেন ‘গ্রিডি ক্লাব’। এই ‘গ্রিডি ক্লাবে’ নানারকমের রান্না করা হত। সেখানে একটা দারুণ রেসিপির সন্ধান মিলছে—‘হাঁসের ডিম ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে সেই চাল, কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে খিচুড়ি।’

দত্ত পরিবারের মেজছেলে জানিয়েছেন, রামদাদার পাল্লায় পড়ে শাক্ত পরিবারের ছেলে মহেন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন বৈষ্ণব। মাছ-মাংস খাওয়া তিনি ছাড়লেন। একবার বেড়াতে গিয়ে ছোট ভাই মহেন্দ্রনাথের মুখে মাংস গুঁজে দিলেন তিনি। মহেন্দ্রনাথ সেই মাংস খেয়ে আবার শাক্ত হতে বাধ্য হলেন। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ‘দাদা’-কে ডাকতে গিয়েও মহেন্দ্রনাথকে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করতে হয়েছিল। সেদিন দাদা আর ভাইয়ের মেনু ছিল, জনৈক ফাগুর দোকান থেকে গরম লুচি, গুটকে কচুরি এবং আলু ছেঁচকি। লন্ডনেও ভাইকে কচুরি আর আলু ছেঁচকি করে খাইয়েছিলেন। খাওয়াতে এত ভালবাসতেন যে শিকাগো যাওয়ার আগে মুম্বইয়ে সকলের জন্য রেঁধেছিলেন পোলাও। নিজে খেয়েছিলেন কেবল এক টুকরো মাংস।

Fowl Curry
বিডন স্ট্রিটে পীরুর দোকানের ফাউলকারি ছিল তাঁর প্রিয়

আর বিদেশে! শংকর-এর বই থেকে জানা যাক। তিনি লিখছেন, ‘সর্বত্যাগী পুরুষ, কামিনীকাঞ্চনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, বিশ্বকে বেদান্ত সম্বন্ধে অবহিত করার জন্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতন যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কিন্তু সারাক্ষণ নিজের জোব্বায় রেখেছেন নানা ধরনের ইন্ডিয়ান গুঁড়ো মশলা।’ বিদেশে তিনি রান্না করে খাওয়াতেন সকলকে। তবে তাঁর রান্নায় এত্ত ঝাল যে সাহেবরা তো বাবাগো-মাগো করতে থাকতেন। তবু স্বামীজি রান্না করলে তাঁরা না খেয়েও ছাড়তেন না। এ প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ দত্তের বলা একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক— “…‘বাঁচাও বাঁচাও ভগবান’— পেটে হাত চেপে চেপে ছটফট করছেন স্বামীজির বিদেশী অনুরাগীবৃন্দ। তাঁরা মরিয়া হয়ে স্বামীজির রান্না খেয়েছিলেন, তাঁদের একজনের বক্তব্য…‘যে খাবার স্বামীজি তৈরী করেন তা হয়ত উপাদেয়, কিন্তু মশলায় মশলায় আগুন। কিন্তু মনস্থির করলাম— যদি দম বন্ধ হয়েও যায় তবু খাব— একজন বিবেকানন্দ আমার জন্য রাঁধতে পারেন, আর আমি খেতে পারব না? তাতে প্রাণ যায় যাক…’…”

বেলুড়ে একবার স্বামীজির ফুলুরি বিক্রির শখ হল। সেবার ফুলুরিওয়ালা হয়ে তিনি ফুলুরি বিক্রি করেছিলেন একেবারে পেশাদারদের মতো। আসলে চপে যে তাঁর অত্যন্ত আসক্তি। শংকর লিখছেন— ‘স্বামীজি চপ কাটলেট বানিয়ে খেতেন ও লোককে খাওয়াতেন।… সংঘজননী সারদা বলেছেন, ‘নরেন আমার… আলু চটকে কী সব রাঁধত– তাকে কী বলে?’ তাই স্বামী বিবেকানন্দের রসনা লেখা এত কম কথায় শেষ হওয়ার নয়। বিশ্বপথিক বিবেকানন্দকে অনেকেই চেনেন, তবে আজও অজানা অচেনা বিবেকানন্দের ভোজনপ্রীতি। একটা গোটা বই হয়ে যেতে পারে। নাম হতেই পারে— ভোজনামৃত।

 

*ছবি সৌজন্য: Ramkrishna Vedanta Society, Banglakonnection.com, Bawarchi.com

banglalive logo

মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial

One Response

  1. এখন যারা স্বামী জী কে নিয়ে খুব নাচানাচি করছে, যারা দেশ থেকে আমিষ তাড়াতে উদ্যত, কথায় কথায় ভেগান প্রচার চালাচ্ছে হিন্দুয়ানী ধুয়ো দিয়ে… ‌‌‌তাঁরা জানেন কি এই জীবন যাপন ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *