পর পর ছ’টা জোরালো ফুঁ আর প্রবল হাতপাখার বাতাসের ঠেলায় উনুনটা ধরেই গেল শেষ পর্যন্ত। ঝট করে তাতে ঘুগনির ডেকচিটা চাপিয়ে দিল নিতাইয়ের মা। চায়ের জল চাপানোই আছে পাশের উনুনটাতে। সামনে কাঠের বেঞ্চিগুলোর ওপর ব্যস্ত হাতে ঝাড়ন বুলোচ্ছে নিতাই আর নিমাই। ঝাড়ন বুলোচ্ছে বললেই ঠিক বলা হয়, কারণ যা হচ্ছে, তাকে ঝাড়ামোছা অন্তত বলা চলে না। ভাগ্যিস এই দোকানের খদ্দেররা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, নইলে নিতাইয়ের মায়ের কপালে দুঃখ ছিল।
ফেরিঘাটের একদম কাছেই নিতাইয়ের মায়ের চায়ের দোকান। দোকানটার কেতাদুরস্ত নাম “সুমিতা ভোজনালয়”, কিন্তু লোকে নিতাইয়ের মায়ের চায়ের দোকান বলেই চেনে। দোকানের নামটা প্রথম থেকেই এখানকার লোকেদের অপছন্দ– বিধবা মানুষ কখনও নিজের নামে দোকানের নাম রাখে নাকি! কেউ অবশ্য মুখে কিছু বলেনি। বরং সদ্য স্বামীহারানো বউটি দু’টো ছোট ছোট ছেলেকে নিয়ে কারুর গলগ্রহ না হয়ে নিজের অন্নসংস্থান নিজেই করে নিচ্ছে দেখে লোকে খুশিই হয়েছিল। শুধু “সুমিতা” নামটি ত্যাগ করতে হয়েছিল। সেই থেকে সে নিতাইয়ের মা- আর তার দোকান তার নতুন নামেই।
ও নিয়ে দুঃখ করে না সুমিতা। বস্তুত এসব সূক্ষ্ম দুঃখ নিয়ে মনখারাপ করার সময়ই নেই তার। সকাল থেকে কাজের চাপে দম ফেলার সময় থাকে না। ভোর না-হতেই দোকানে লোকের ভিড় লেগে যায়। প্রথম দলের লোকেরা কারখানার লেবার। সকাল সকাল চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে বালির ফেরিঘাট থেকে স্টিমারে চেপে ওপারের কারখানায় যাবে সব। জলখাবার ওই কারখানাতেই, কিন্তু সক্কালবেলা নিতাইয়ের মায়ের দোকানের একভাঁড় স্পেশাল চা না খেলে ওদের শরীরের আড় ভাঙে না।
দোকানটার কেতাদুরস্ত নাম “সুমিতা ভোজনালয়”, কিন্তু লোকে নিতাইয়ের মায়ের চায়ের দোকান বলেই চেনে। দোকানের নামটা প্রথম থেকেই এখানকার লোকেদের অপছন্দ– বিধবা মানুষ কখনও নিজের নামে দোকানের নাম রাখে নাকি! কেউ অবশ্য মুখে কিছু বলেনি।
পরের দল আসে একটু বাদে। তাদের জন্যে ওই ঝাল-ঝাল নিরামিষ ঘুগনি আর কোয়াটার পাউন্ডের রুটি– চার ভাগে কেটে উনুনে সেঁকে দেওয়া। রুটির সঙ্গে খাবে বলে ঘুগনিটা একটু বেশি কাই রেখে রাঁধে সুমিতা। পিঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা আলাদা। এই করতে করতেই বেলা হয়ে যায়। ছেলেদু’টো শুকনো মুখ করে এসে দাঁড়ায়। তাদের ইস্কুলে যাবার সময় হয়ে এল। সুমিতা হিসেব করে আগে ভাগেই ভাত বসিয়ে দেয়। গলা ভাত আর আলুসেদ্ধ খেতে বসে যায় ওরা। মাঝে মাঝে এর সঙ্গে ডিমসেদ্ধ দেয় সুমিতা, কখনও বা একচামচ গাওয়া ঘি– ছেলেদের চোখ চকচক করে ওঠে সেদিনগুলোয়।
বেলা বাড়ে। দুপুরের রান্না চাপায় সুমিতা। ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত অথবা কুমড়োর ঘ্যাঁট। কিম্বা আলুপটলের তরকারি, সঙ্গে ঝিরিঝিরি আলুভাজা। এ শুধু কিছু বাঁধা খদ্দেরদের জন্যে, মাসকাবারি অর্ডার সব। এর ফাঁকে রিক্সাওয়ালা মদন এসে বাজারটা নামিয়ে দিয়ে যায়। সুমিতার দোকানের বাজার করার দায়িত্বটা মদন যেচেই নিয়েছে। সকালবেলা সুমিতার দোকানে চা খেয়ে মদন কাজে বেরিয়ে যায়। রিক্সা নিয়ে এদিক সেদিন যাবার ফাঁকে দোকানের বাজারটা সেরে রাখে আর দুপুরে খাবার সময় দিয়ে যায়। মদন মাসকাবারি খদ্দের, তবে ওর খাবারের পয়সা নেয় না সুমিতা।
এসব চুকতে চুকতে বেলা হয়ে যায়। ততক্ষণে সুমিতার আর খিদে থাকে না। তাই বেশিরভাগ দিন সে খায় রাত থেকে ভিজিয়ে রাখা পান্তাভাত। সঙ্গে লেবু আর কাঁচালঙ্কা। ঠান্ডা লাগে তখন সুমিতার– হাওয়াবিহীন পুকুরের জলের মতো শান্ত লাগে তার। এঁটো থালাখানা মেজে রেখে মাদুর পেতে শুয়ে একটুখানি মনখারাপ করার সময় পায় সুমিতা, কিন্তু মনখারাপটা থেবড়ে বসার আগেই ঘুমটা এসে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে নিতাইয়ের মা।
আজও রোজকার মতো খদ্দেরদের দুপুরের খাবারের পালা মিটিয়ে নিতাইয়ের মা টেবিলগুলো মুছে নিচ্ছে অলস হাতে। এমন সময় লোকটা এল। লম্বা দাড়ি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, উলুঝুলু জামাকাপড়। একটু নোংরা, তবে ভিখিরি নয়। স্পষ্ট সহজ তাকানো তার, মুখে চওড়া হাসি। ভারী অনাবিল ভঙ্গিতে বলল:
– একটু খেতে দেবে, নিতাইয়ের মা?” একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল নিতাইয়ের মা। তারপর বলল:
– ভাত তো নেই। আগে থেকে বলেননি তো। আবার হাসল লোকটা। হাসিটা একেবারে চোখের কোল পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
– একেবারেই নেই? আমার যে খিদে পেয়েছে খুব?
কিরকম ঘোর লাগল সুমিতার চোখে। চট করে পান্তাভাতের হাঁড়িটা টেনে এনে থালায় ঢালল সেটা। ওপরে একটু শুকনোলঙ্কা ভেজে দিল, আর দিল একটু পাতিলেবু কচলে। সঙ্গে দিল কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর অনেকটা কচুবাটা। ভারী তৃপ্তি করে খেল লোকটা, একদম হাপুসহুপুস করে শেষ ভাতটুকু অবধি। তারপর গামছায় মুখ মুছে বলল:
– বড় ভাল খেলাম মা। রাজরানি হও।
– আর রাজরানি! ছেলেদুটো মানুষ হলেই হল আমার। রানি হবার সাধ নেই আমার। সব সাধ মিটে গেছে। দুলে দুলে হাসল লোকটা। তারপর বলল:
– না, সে নিয়ে চিন্তা নেই গো। ছেলেদুটো খুব ভাল করবে জীবনে। ডাক্তার হবে গো, ডাক্তার! না না, নাড়ি টেপা ডাক্তার নয়, লেখাপড়ার ডাক্তার। ডক্টরেট। আর তুমি… তোমার দোকান তো খু-উব বড় হবে গো! খুব বড়। চোখ মটকে হাসল লোকটা।
– এই জন্মে কিম্বা আরজন্মে, এই পৃথিবীতে বা অন্য কোথাও, অন্য এক ছায়ার জগতে…
সুমিতার মাথাটা কেমন টলে উঠল। এই জন্ম বা অন্য জন্ম, বা অন্য পৃথিবী বা অন্য জগত থেকে একটি অদৃশ্য হাতের ঠেলা লাগল ওর গায়ে। অনেক পরে ওকে ডেকে তুলল নিমাই। ছাউনির বাঁশে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছিলো নিতাইয়ের মা।
বালিগঞ্জের অভিজাত পাড়ার একটি জনপ্রিয় কফিশপ। সেই কফিশপের মালকিনের নাম “ডেব”– যার সোনালি ফ্রেমের অক্টাগনাল চশমা আর রক্তাম্বরি ঠোঁট থেকে গ্ল্যামার ঝরে পড়ছে অবিরত। তার যে কলেজে পড়া দুই ছেলে আছে, কে বলবে! এত স্টাইলিশ ক্যাফে চালাতে হলে মালকিনের স্টাইল-কোশেন্ট একটু বেশিই থাকতে হয়, নইলে ঠিক চলে না। ওই স্টাইল-কোশেন্টের ধাক্কাতেই তো ওঁকে সাবেকি দেবস্মিতা নামটা ত্যাগ করে “ডেব” হতে হয়েছে।
বেলা বাড়ে। দুপুরের রান্না চাপায় সুমিতা। ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত অথবা কুমড়োর ঘ্যাঁট। কিম্বা আলুপটলের তরকারি, সঙ্গে ঝিরিঝিরি আলুভাজা। এ শুধু কিছু বাঁধা খদ্দেরদের জন্যে, মাসকাবারি অর্ডার সব। এর ফাঁকে রিক্সাওয়ালা মদন এসে বাজারটা নামিয়ে দিয়ে যায়। সুমিতার দোকানের বাজার করার দায়িত্বটা মদন যেচেই নিয়েছে। সকালবেলা সুমিতার দোকানে চা খেয়ে মদন কাজে বেরিয়ে যায়।
ক্যাফেটা একাই চালান ডেব। ছেলেরা কালেভদ্রে একটু সাহায্য করে। ভাল হ্যাম বা বেকন কেনার দায়িত্ব নেয় কখনও সখনও। বাকি সব অনলাইনেই কিনে নেন। একান্ত দরকার পড়লে পাশের বাড়ির “ম্যাডি”কে ধরেন। অ্যাংলো ছেলেটা সেলসম্যান, বাইকে চড়ে সারা শহর চক্কর মারে। কাজেই টুকটাক কিছু কিনে এনে দিতে আপত্তি করে না। বদলে বিকেলে সাওয়ারব্রেডের মধ্যে একচাকা সালামি আর চিজ় দেওয়া একটা স্যান্ডউইচ পেলেই ম্যাডি মহা খুশি।
ক্যাফেটা খোলে বিকেলে, তবে ডেব মোটামুটি তিনটে থেকেই চলে আসেন। ওঁর ক্যাফে ওঁর মতোই ঝকঝকে থাকতে হবে সবসময়। আর সেটা নিজে না দেখলে হয় না। ক্যাফের দুটো ওয়েটার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে এই সময়টায়। আজও এসেছেন নিজেই, আর এসেই চেয়ারের হাতলে আঙুল বুলিয়ে ধুলো দেখতে পেয়ে সে নিয়ে ছেলেদু’টিকে এক হাত নিয়েছেন। এখন মেনুতে স্পেশাল কী কী রাখা যায়, সেটা ভাবছেন।
ভাবনায় ছেদ পড়লো একটি কাস্টমারের আবির্ভাবে। ষাটের দশকে এই হিপিমার্কা চেহারা দেখা যেত একসময়। লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল, সানগ্লাস, ডেনিমের জামা ও প্যান্ট, রুদ্রাক্ষের সরু মালা। আর ভীষণ ঝকঝকে হাসিটা। দরজাটা সামান্য ঠেলে মুখ ঢুকিয়ে জিগ্যেস করল:
– ইজ ইট ওপেন?
– নট ইয়েট, উত্তর দিলেন ডেব।
– আরও দেড় ঘণ্টা বাদে খুলবে।
– ওহো– আমার আসলে খুব খিদে পেয়েছিল। কিছু পাওয়া যাবে না?

‘না’ বলে দিলেই ল্যাটা চুকে যেত। এসব ক্ষেত্রে ডেব তাই বলে থাকেন। আজ কীরকম ঘোর লাগলো যেন চোখে।
– প্লিজ টেক আ সিট। বলে চট করে কিচেনে চলে গেলেন। পেন্নে পাস্তাটা চিকেন ব্রথে হাল্কা সেদ্ধ করতে দিয়ে তাতে মোজারেলা আর চেডার চিজ় মেশানো হোয়াইট সস দিলেন। একটু স্টারফ্রাই করা হ্যামের টুকরোগুলো তাতে মিশিয়ে দিলেন। তারপর কী ভেবে ওপরে একটু পেঁয়াজ আর রেড চিলি ফ্লেক্স দিয়ে দিলেন। সচরাচর এগুলো উনি দেন না, কিন্তু আজ ইচ্ছে হল।
ভারী তৃপ্তি করে খেল লোকটা। একদম শেষ পাস্তার টুকরোটাও। তারপর টিস্যুতে মুখ মুছে বলল:
– খুব ভাল খেলাম। থ্যাঙ্ক ইউ।
ডেব একটু হেসে বলল “কফি?”
– এস্প্রেসো প্লিজ। বলে চোখ মটকে হাসল লোকটা। তারপর বলল:
– দেবস্মিতা, তোমার বড় ছেলে কী নিয়ে ডক্টরেট করছে?
দেবস্মিতার মাথাটা কেমন টলে উঠল। যেন অনেক দূর থেকে, অনেক সময় পেরিয়ে, অন্য কোন ছায়ার জগৎ থেকে কে যেন একটা ধাক্কা দিল ওকে।
অতনু দে পেশায় বিদ্যুৎ প্রযুক্তিবিদ – গুরগাঁওয়ে একটি বিদেশী কোম্পানিতে কাজ করেন। বাংলা ভাষায় লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। মূলত লেখেন ছোটগল্প ও অণুগল্প, যার অনেকগুলিই ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক ওয়েবজিনে। সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওঁর ছোট গল্পের সংকলন – নাম “শহরের সিম্ফনি”।
সুন্দর লাগল। এত সাবলীল টানে বলা। খুব ভালো।
Darun laglo !! Tor sob golpo gulotei ekta adi bhoutik / opar jiboner chap thake. That’s the special attraction of your story. Bravo 👏
হ্যাঁ, একটা অপার্থিব কিছু রাখার চেষ্টা করি
পেশায় বিদ্যুৎ প্রযুক্তিবিদ , নেশায় বিদ্যুতের ঝলকানির মতো চমকপ্রদ সৃষ্টি
খুব ভালো লাগল অতনু
নতুন ধরনের গল্প খুব ভালো লাগলো
Bah, Bere hoyeche, Atanu… aro chai.
খুব ভালো লাগলো। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প। সুন্দর পরিবেশনা।
Analogy in contrast!! good effort Atanu
ভীষণ ভালো হয়েছে অতনু। নিতাইর মায়ের অংশটায় তোর লেখা আরেকটা নতুন ধাপ পেয়েছে, এরকম মেঠো বিবরণ আগের কোনো লেখায় মনে করতে পারছিনা। গল্পের দ্বিতীয় ভাগের মোচড়টা তো তোর signature হয়ে গেছে এখন, প্রত্যেক গল্পের শেষে বিরিয়ানির পর ফিরনীর মত ওটার আশা বেড়েই চলেছে