শেয়ালদা স্টেশনে প্রথম যখন সেই সবুজ ট্রেনটা দেখি, তখন আমার বয়স বছর পাঁচেক। ঠাকুরদা আর বাবার সঙ্গে দাদু, দিদা আর ছোটমামাকে আনতে গিয়েছিলাম। তাঁরা আসছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা থেকে। কু ঝিকঝিক করতে করতে অন্য সব ট্রেনের চেয়ে আলাদা ট্রেনটা এসে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে তার গাঢ় সবুজ রঙটা দেখছিলাম। একগাদা বাক্সপ্যাঁটরা, বড় বড় টিন ইত্যাদি নিয়ে একটা কামরা থেকে দাদু-দিদারা হাসিমুখে নেমে এলেন। আর ছোটমামা নেমেই টপ করে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। আমি ছিলাম তাঁর ভারী প্রিয়।
প্রতি বছরই ওঁরা আসতেন আর মাসখানেক করে থেকে যেতেন কলকাতায় আমাদের বাড়িতে। সে একটা উৎসব শুরু হত তখন – বাড়িতে প্রচুর লোকসমাগম হত। যাঁরা দেশ ছেড়ে এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন, সেইসব জ্ঞাতি ও বন্ধুরা সপরিবার দেখা করতে আসতেন। মধ্যাহ্ন বা নৈশভোজে তাঁদের পাত পড়ত। আমার দাদু পরেশনাথ ছিলেন খুব আমুদে মানুষ। আর দিদা প্রীতিলতা ছিলেন তুখোড় রাঁধুনি। সবুজ ট্রেন থেকে নামানো বাক্স টাক্স থেকে নানারকম সুখাদ্য যেন জাদুমন্ত্রবলে বেরিয়ে আসত।
কুমিল্লায় দেশের বাড়িতে তখনও ক্ষেতের চাল, ডাল, সবজি, পোষা গোরুর টাটকা দুধ…। কলকাতার কবুতরের খোপনিবাসী ছেলেমেয়ে, জামাই, নাতিনাতনিকে সেসব কিছুই খাওয়াতে পারেন না, সেই দুঃখেই বোধহয় প্রীতিলতা আসার আগে কতদিন ধরে নারকেল নাড়ু, চন্দ্রপুলি, তিলের নাড়ু, আমসত্ত্ব, আমসি, রকমারি আচার ইত্যাদি বানাতে শুরু করতেন। বানাবার পর নানা আকারের টিনের কৌটো, কাচের বোতল আর বয়ামে সেগুলো ভরে আনা কি কম ঝকমারি! বেশ মনে পড়ে আমসত্ত্বের বান্ডিলটা গোল করে গোটানো থাকত ফর্সা ন্যাকড়ার পাটে পাটে। টিনের কৌটো থেকে মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া বেরোত। দেশের বাড়িতে যে আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি হত তখনও!
একগাদা বাক্সপ্যাঁটরা, বড় বড় টিন ইত্যাদি নিয়ে একটা কামরা থেকে দাদু-দিদারা হাসিমুখে নেমে এলেন। আর ছোটমামা নেমেই টপ করে আমাকে কোলে তুলে নিলেন।
আমার বিশেষ প্রিয় ছিল দিদার তৈরি ছাঁচে ফেলা ক্ষীরের পাতলা সন্দেশ। এক একটা এক এক রকম আকৃতি। কোনওটা পদ্মফুল, কোনওটা মাছ, কোনওটা আবার গোলাপ। কয়েকটা সন্দেশের গায়ে লেখা থাকত ‘সুখে থাকো’। খাবার আগে বসে বসে সন্দেশের গায়ে ডিজাইন দেখতে ভারী ভাল লাগত। ভেঙে খেতে ইচ্ছেই করত না। আর একটা মিষ্টি ছিল নারকেল আর ক্ষীরের পাকে তৈরি। দিদা তাকে বলতেন ‘সুরসপোয়া’ কিন্তু আমার বাবা বলতেন ‘ইচামুড়া’। দ্বিতীয় নামটাই আমার বেশি পছন্দ ছিল, কারণ মিষ্টিটা অনেকটা ‘ইচা’ বা চিংড়িমাছের মাথার মতো দেখতে। একটু এবড়ো খেবড়ো, লম্বাটে, কিন্তু খেতে দুর্দান্ত। নিজের হাতে সর বেটে ঘি তৈরি করে আনতেন দিদা। সেই অপূর্ব সুগন্ধি সোনালি গাওয়া ঘি আর আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে দিলে আমার ছোটবেলার বিখ্যাত অরুচিও দৌড়ে পালাত।
কিন্তু সবুজ ট্রেনের যাত্রীরা যে শুধু খাবারদাবার আনতেন, তা তো নয়! অদৃশ্য ঝাঁপিভরা গল্পও আসত তাঁদের সঙ্গে। কুমিল্লা টাউনের গল্প, দাদুর আদালতের গল্প, দেশের বাড়ি দৌলতপুরের দুর্গাপুজোর গল্প। সমারোহ কমে এলেও তখনও টিমটিম করে পুজো হত। প্রায় সব গল্পেই চলে আসত সবুজ ধানক্ষেত, এপার ওপার দেখা যায় না এমন নদী, ফলন্ত আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু গাছের বাগান, দীর্ঘ বর্ষাকাল, বড় বড় দিঘি আর তাতে জাল ফেলে তোলা মস্ত মস্ত রুই কাৎলার কথা।
ওঁদের মুখে শুনে শুনে আমি একটা সবুজ সবুজ ক্ষেত আর বনে ঘেরা বৃষ্টিভেজা সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখতাম, যেটা কিনা আমারও দেশ। কিন্তু কেন সেই দেশে যাওয়া হত না, তা কেউ জিজ্ঞেস করলেও বলত না। আমি ভাবতাম সবুজ ক্ষেত আর বনে ডুব দিয়ে এসেছে বলেই ওই ট্রেনটা অমন ঘন সবুজ রঙের!

নির্জন দুপুরে কৌটোয় হাত ডুবিয়ে ইচামুড়া চুরি করে খাবার সময় আমি যেন নারকেল গাছগুলোকে দেখতে পেতাম। অদ্ভুত একটা ভাল গন্ধ পেতাম ট্রেনে করে আনা সেসব খাবারে। সে আমসত্ত্ব হোক বা সোনামুগের ডাল বা ক্ষীরের সন্দেশ, যা-ই হোক। আমার কাছে ওটা ছিল দেশের বাড়ির গন্ধ। বছরে একবারই সবুজ ট্রেন সে গন্ধ বয়ে আনে।
সে বছর সবুজ ট্রেনের যাত্রীরা ছোটমামার কলেজে আর দাদুর কোর্টে গরমের ছুটি হলেই আসবে বলে শোনা যাচ্ছে, আচমকা সীমান্তে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধ। দাদু দিদা আর ছোটমামার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রইল না এপারে চলে আসা মা আর মামাদের। ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরল সবাইকে। অনেক পরে জানা গেল, দাদুকে জেলে ভরে রেখেছিল পাক সরকার। কেন? আমি তো জানতাম দুষ্টু পাজি ডাকাত বদমাশরা জেলে বন্ধ থাকে। আমার দাদু তো ভারী ভালমানুষ, হাসিখুশি মেজাজের দিলদরিয়া লোক! বড়দের কথা থেকে বুঝলাম, দাদু হিন্দু বলে ওঁকে নাকি জেলে নিয়ে গেছে। এই ‘হিন্দু’ শব্দটাও তেমন অর্থবহ ছিল না সে বয়সে, ঝাপসা ঝাপসা বুঝতাম, ওটা নাকি আমাদের ধর্ম। শুনলাম দাদুর সব হিন্দু উকিল, ডাক্তার, মাস্টার বন্ধুরাই জেলে। এঁদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম খুব বেশি শুনতাম। বড় হয়ে জেনেছি দাদুর বড়ভাইয়ের মতো এই মানুষটিই প্রথম ঘোষণা করেছিলেন, যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা।
আর একটা মিষ্টি ছিল নারকেল আর ক্ষীরের পাকে তৈরি। দিদা তাকে বলতেন ‘সুরসপোয়া’ কিন্তু আমার বাবা বলতেন ‘ইচামুড়া’। দ্বিতীয় নামটাই আমার বেশি পছন্দ ছিল, কারণ মিষ্টিটা অনেকটা ‘ইচা’ বা চিংড়িমাছের মাথার মতো দেখতে।
এরপর থেকে সবুজ ট্রেন আসা বন্ধ হয়ে গেল। দাদু যদিও কয়েকমাস পর মুক্তি পেলেন, কিন্তু শুনলাম ওঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নানা দুশ্চিন্তায় দাদুর নাকি শরীর ভেঙে গেছে খুব। দিদার মনখারাপ-করা চিঠি আসত মাঝেসাঝে। এমনকী বড়মামার বিয়েতেও ওঁরা আসার অনুমতি পেলেন না। আমরা তখন থাকি মামাবাড়ির কাছেই যাদবপুরে। সেটা ১৯৬৮ সালের গোড়ার দিক। হঠাৎ খবর এল মামাবাড়িতে এক্ষুনি যেতে হবে, দাদুরা নাকি এসেছেন। ছুট্ ছুট্ তক্ষুনি! গিয়ে দেখি, ওমা! এ কেমন আসা? একগাদা এলোমেলো বাক্সপ্যাঁটরা ঘরে ছড়ানো, বিধ্বস্ত ওঁদের চেহারা, জামাকাপড় আধময়লা, চুল উস্কোখুস্কো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মুখে হাসি নেই কারও। তখন অনেকটাই বুঝতে শিখেছি। শুনলাম সম্পূর্ণ লুকিয়ে পালিয়ে এসেছেন ওঁরা। দাদুর শরীর ক্রমশ এত খারাপ হয়ে যাচ্ছিল যে আর থাকার ভরসা করেননি।
ছোটমামার স্কুল-কলেজের মুসলমান বন্ধুরা গোপনে সাহায্য করেছে। জলাজঙ্গল ভেঙে প্রাণ হাতে করে ত্রিপুরার সোনামুড়া বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকে, আগরতলা থেকে কোনও ক্রমে প্লেনে দমদমে এসে নেমেছেন। বাড়িঘরের তেমন কোনও ব্যবস্থা করে আসতে পারেননি। ক্ষেত, পুকুর, বাগিচার তো প্রশ্নই ওঠে না। তিনজনের দৃষ্টিতেই কেমন একটা সব হারানো অন্ধকার, যা ক্রমশ পরে আরও গাঢ় হতে দেখেছি। দিদা একটা ছোট কৌটো খুলে অল্প খানিকটা আমসত্ত্ব বার করে আমাদের ভাইবোনেদের হাতে দিলেন। আশ্চর্য! সবুজ ট্রেন যে গন্ধ বয়ে আনত, সেটা আর পেলাম না এবার! আমাদের সেই দেশের বাড়িটা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।
*ছবি Pinterest
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
Khub sundor ekta golpo porlam jar moddhe matir gondho ache, ar ache amar des opar Banglar ekta chobi. Jodio ami Bangladesh jai ni, kintu lekhaker lekhani te seta ek dome pore fellam.
ভিটেমাটির স্মৃতিচারণ সবসময়ই উপভোগ্য। বড্ডো বেশি ভালো হয়েছে।
চোখে জল এসে যায় । আমারও পূর্ব পুরুষদের ভিটে পুব বাংলায় ছিল ।