শূূূন্য দশকের শুরুতে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় একই সময়ে পড়াশোনা করেছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সৃজিত দু’বছরের সিনিয়র হলেও একসঙ্গে ক্যুইজ, নাটক ইত্যাদি অনেক কিছুই করেছিলেন দু’জনে। পেশায় কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রবীরেন্দ্র শেষ সতেরো বছর প্রবাসে কাটালেও খুব আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সৃজিতের লাগাতার উত্থান। হয়তো সেই আগ্রহ থেকেই জমে উঠেছিল অনেক প্রশ্ন। এই বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সেই সব প্রশ্ন নিয়েই প্রবীরেন্দ্র আড্ডা জমিয়েছিলেন সৃজিতের সঙ্গে। ‘ফেলুদা ফেরত’ ওয়েবসিরিজ নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করেছিলেন সৃজিত। সেই আড্ডা ছাপার অক্ষরে রইল বাংলালাইভের পাঠকদের জন্য। বাংলা সিনেমার অন্যতম সফল পরিচালক নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছেন সব প্রশ্নের। অনুপম রায়ের গানের মতোই গভীরে ঢুকে আত্মদর্শন করেছেন। নিজে ভেবেছেন। ভাবিয়েছেন প্রবীরেন্দ্রকেও।
সৃজিতঃ প্রত্যেকটা থিয়োরির কিছু প্রামাণ্য রেফারেন্স আছে। যেমন রাশিয়ান হাইপথেসিস টা নিয়ে কাজ করতে গেলে আমি কিছুতেই পূরবী রায়কে অ্যাভয়েড করতে পারব না। আমাকে ডঃ পূরবী রায় এবং জয়দীপ মুখার্জীর বইকে রেফারেন্স হিসাবে নিতেই হবে। একইভাবে গুমনামি বাবা থিয়োরির সবথেকে বড় প্রবক্তা হলেন অনুজ এবং চন্দ্রচূড়। এনারা ক্লান্তিহীন ভাবে মিশন নেতাজি নিয়ে কাজ করে গেছেন। অনুজ-চন্দ্রচূড়ের অ্যাপ্রোচটা আমার খুব ভালো লেগেছিল, আই লাভড ইট। ‘কনানড্রাম’ বা অন্য বইগুলো পড়লে বোঝা যাবে অ্যাপ্রোচটা কোনও ফ্যানাটিকের নয়, অ্যাপ্রোচটা এক বিজ্ঞানীর। একটা প্রোপোজিশন আছে, নির্দিষ্ট একটা মেথড আছে, পক্ষে-বিপক্ষে সমস্ত যুক্তি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাও জানানো দরকার এলাহাবাদ হাইকোর্ট গুমনামি নিয়ে নিজের ভার্ডিক্টে অনুজের নাম করে প্রশংসা করেছেন।

প্রবীরেন্দ্রঃ তুমি কী বইটা আচমকাই পেয়ে গেছিলে? নাকি কেউ তোমাকে রেফারেন্সটা দিয়েছিলেন?
সৃজিতঃ আমি টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় গুমনামি বাবাকে নিয়ে একটা লেখা পড়তে গিয়ে এই বইটার রেফারেন্স পাই। তারপর আমি অনুজকে যোগাযোগ করি। আমার কাছে একজন গবেষকের রাজনৈতিক মতাদর্শ কোনও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই মতাদর্শ রিসার্চ টেকনিক না মেথডলজিকে প্রভাবিত করছে। অনেক লোক বলছে “আরে, অনুজ তো বিজেপি সাপোর্টার”। অনুজ বিজেপির সমর্থক হতে পারে, মাওয়িস্ট হতে পারে, যা ইচ্ছে হতে পারে।
সুগত বসু নয় কংগ্রেস সিমপ্যাথাইজার, অনেকে তাঁকে ‘কংগ্রেস স্টুজ’-ও বলে। কিন্তু চন্দ্রকুমার বসু তো বিজেপির লোক। ইন ফ্যাক্ট, চন্দ্রকুমার বসু এবং সুগত বসু কিন্তু দু’বছর আগে একই মিছিলে হেঁটেছেন। দে ওয়র ভেরি ক্লোজ টু ইচ আদার। রাজনৈতিক কারণে এখন সেই ঘনিষ্ঠতা চলে গেছে। পরিষ্কার ভাবেই সিনেমা নিয়ে যে বিরোধটা দেখা গেছে সেটা পার্টিভিত্তিক নয়। চন্দ্রকুমার বসু নিজে এখন অনুজের থিয়োরির বিরোধিতা করেছেন কিন্তু দু’তিন বছর আগে অবধিও মিশন নেতাজির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন, তাদের প্রশংসাও করেছেন জনসমক্ষে।
পলিটিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন সবার থাকতে পারে। সেটা ইস্যু নয়। আমাকে থিয়োরিটা অবজেক্টিভলি, ক্লিনিকালি দেখতে হবে। প্রত্যেকটা হাইপথেসিসের স্বপক্ষে-বিপক্ষে যাবতীয় পয়েন্টগুলো আমাকে জানতে হবে। আমি বলছি না প্রত্যেকটা থিয়োরিই ওয়াটারটাইট, প্রত্যেক থিয়োরিতেই কিছু না কিছু ফাঁকফোকর থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্নগুলো তুলতে অসুবিধা কোথায়? স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরেও যদি আমাদের সবথেকে বড় হিরোর অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারি সেটা তো আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা। আমি ডেথ থ্রেট পাচ্ছি, হাইকোর্টে মামলা লড়তে যেতে হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটা তাহলে থাকল কোথায়?
প্রবীরেন্দ্রঃ এইরকম একটাস সমস্যাসঙ্কুল সময়ে ইন্ডাস্ট্রির সাহায্য পেয়েছিলে? কারা তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল?
সৃজিতঃ নো ওয়ন, নট আ সিঙ্গল পার্সন। হ্যাঁ, অনুপম-পরম রা ট্যুইট করেছিল। কিন্তু নাথিং সাবস্ট্যানশিয়াল। আমাকে যুদ্ধটা পুরোপুরি একাই লড়তে হয়েছে।
প্রবীরেন্দ্রঃ টলিউডের এই ঔদাসীন্যর জন্য কি তুমি প্রস্তুত ছিলে? জানতে এরকমটাই ঘটার সম্ভাবনা বেশি?
সৃজিতঃ হ্যাঁ। যুদ্ধটা একা কিরকম লড়েছিলাম সেটা একটু বলি। গত চল্লিশ বছরে যে যে ভারতীয় সিনেমা নিয়ে মামলা হয়েছে তার সমস্ত নথিপত্র আমিই অনলাইনে খুঁজে খুঁজে বার করে তার রেফারেন্স আমার উকিলকে দিয়েছি। “ডার্ক চকোলেট’ সিনেমাটা নিয়ে যে ইনজাংশন দিয়েছিল সেটার কথা তুললাম, বম্বে হাইকোর্ট কী বলেছিল সেটার রেফারেন্স দিচ্ছি। ‘আর্টিকল ১৫’ কে কী বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে সে নিয়ে পড়ছি। সারা সকাল জুড়ে এই রেফারেন্সিং এর কাজ চলছে, আর বিকালে ‘গুমনামি’-র ডাবিং করছি।
প্রবীরেন্দ্রঃ প্রসেনজিৎ কে আই গেস তুমি নিজেই এই মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে ঢুকতে দাওনি? এবিপি আনন্দ-র ইন্টারভিউটা দেখতে দেখতে সেরকমই মনে হচ্ছিল। যেভাবে আগলে রেখেছিলে ওনাকে।
সৃজিতঃ একেবারে তাই। আমি বুম্বাদা কে বলেছিলাম “দিস ইজ মাই ব্যাটল, আমি নিজেই লড়ব। তুমি চিন্তা কোরো না, ইউ স্টে আউট অফ ইট”। সুগত বসু বোঝেন না যে নেতাজিকে নিয়ে গবেষণা করাটা প্রসেনজিৎ এর কাজ নয়। বুম্বাদার কাজ নেতাজির ভিডিও দেখে তিনি কীভাবে হাঁটতেন, কেমন ভাবে কথা বলতেন সেগুলো বোঝা। অভিনেতা হিসাবে তার কাজ আমার স্ক্রিপ্ট ফলো করা, সেটাই তার বাইবেল। গবেষণার কাজটুকু আমার। ‘কৌন বনেগা নেতাজিপতি’ খেলতে হলে আমার সঙ্গে খেলুন, বুম্বাদা কে টেনে আনার তো কোনও মানে হয় না! “নেতাজি কতবার সায়গনে গেছিলেন” এসব প্রশ্ন বুম্বাদাকে করার কোনও অর্থই নেই। আসলে টলিউড খুব ইনফেরিয়র সিনেমা বানায় এরকম একটা মনোভাব নিয়েই সুগত এসেছিলেন। আমাকে বললেন “আমার তো বিদেশি ছবি ছাড়া দেখা হয় না। আপনার শুধু অটোগ্রাফটাই দেখেছি”। আমিও বললাম, “না না তাতে কোনও অসুবিধাই নেই। আমিও খুব সিলেক্টিভলি বই পড়ি”।
প্রবীরেন্দ্রঃ এই কথোপকথন টা কি লাইভ ইন্টারভিউ হয়ে যাওয়ার পর? তখন তাহলে উনি অনেকটাই পোলাইটলি কথা বলছিলেন তোমার সঙ্গে?
সৃজিতঃ হ্যাঁ, ইন্টারভিউ এর পর। এবং তখন সত্যিই পোলাইট ছিলেন। তার কারণ আমি ওনাকে গিয়ে নেমন্তন্ন করলাম, বললাম “আপনি প্রিমিয়ারে আসবেন কিন্তু। আমি তো প্লেন ক্র্যাশ থিয়োরিটাও দেখিয়েছি। ওটা হয়ে গেলে আপনি নয় চলে যাবেন।“ তখনই উনি বললেন উনি বাংলা সিনেমা দেখেন না। ওনার আসলে ধারণা টালিগঞ্জ শুধু অশিক্ষিতে ভরা।
প্রবীরেন্দ্রঃ আগের প্রজন্মের অনেককেই দেখেছি, প্রবাসী হন বা না হন, সত্যজিৎ এর সময় থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেন নি। বাঙালি হয়ে তাঁরা ঋতুপর্ণর সিনেমা দেখলেন না, তাঁদের জন্যই কী দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার!
সৃজিতঃ সৃজিত মুখার্জী নয় ধরে নিলাম অর্ডিনারি স্টোরিটেলার। কিন্তু ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’, ‘সহজ পাঠের গপ্পো’, ‘ফড়িং’, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ এইসব না দেখেই বাংলা সিনেমা নিয়ে জাজমেন্ট দিয়ে দেওয়া যায়?!
প্রবীরেন্দ্রঃ তুমি অবশ্যই অর্ডিনারি স্টোরিটেলার নও। সেটা তোমার অনেক সমালোচককেও স্বীকার করতে হবে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানতে চাইব। তুমি একাধিকবার বলেছ তুমি ইন্টেলেকচুয়ালদের জন্য সিনেমা বানাও না। আবার এটাও সত্যি তুমি ‘রান অফ দ্য মিল’ সিনেমাও বানাও না। তুমি কি নিজেকে তরুণ মজুমদার বা তপন সিনহার সঙ্গে রাখবে? কোয়ালিটির দিক থেকে বলছি না, সিনেমামেকিং স্টাইলের প্রেক্ষিতে।
সৃজিতঃ ওনাদের স্টাইলটাও আলাদা। ঋত্বিক বা মৃণালের তুলনার আনডাউটেডলি আমার ফিল্মমেকিং অ্যাপ্রোচ তরুণ মজুমদার, তপন সিনহা, অজয় করা বা যাত্রিকের অ্যাপ্রোচের কাছাকাছি। কিন্তু ওই রিলেটিভ সেন্সেই।
প্রবীরেন্দ্রঃ আর সত্যজিৎ?
সৃজিতঃ সংলাপ বা চিত্রনাট্যর দিক থেকে আমার ওপর মানিকবাবুর প্রভাব আছে, সে কথা অনস্বীকার্য। ঋতুদার-ও আছে। ইনফ্যাক্ট, কৌশিক গাঙ্গুলি বা অঞ্জন দত্তর-ও আছে। কৌশিকদা’র টিভি ফিল্মগুলোর তো ভালোমতন প্রভাব আছে। কিন্তু হ্যারি পটার বইয়ের ভাষায় আমার ‘পেট্রনাস’ যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি তপন সিনহা। তাঁর ছবিতে সঙ্গীত যেভাবে এসেছে, ডাইভার্সিটি অফ থীমস যেভাবে এসেছে সেটা আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছে। যে মানুষটা ‘গল্প হলেও সত্যি’ বানাচ্ছেন তিনিই বানাচ্ছেন ‘সফেদ হাথি’ বা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ বা ‘এখনই’, ভাবাই যায় না!
প্রবীরেন্দ্রঃ ‘নির্জন সৈকত’’-ও খুব অন্য ধরণের একটা সিনেমা।
সৃজিতঃ হ্যাঁ, বা ‘আদালত ও একটি মেয়ে’।
প্রবীরেন্দ্রঃ তোমার পেট্রনাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কখনো?
সৃজিতঃ না, এবং সেটা আমার জীবনের একটা বড় আক্ষেপ। কিন্তু আমার ডেবিউ ফিল্মে আই পেইড আ ট্রিবিউট টু হিম। অরুণ চ্যাটার্জী যখন আই-ডি কার্ডটা খোলে তখন দেখা যায় অরুণ তপন সিনহা ইন্সটিটিউট অফ ফিল্ম অ্যান্ড টেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট! তপন সিনহার ছেলে সেটা নোটিস করে আমাকে যোগাযোগ করে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। তখন আমি ওনাকে বলেছিলাম, “তপনবাবু সম্ভবত বাংলা সিনেমার সবথেকে আন্ডাররেটেড ডিরেক্টর”। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল নিয়ে কথা বলতে বলতে আমরা তপনবাবুকে নিয়ে কিছুই বলিনি কিন্তু আমার কাছে তিনি ‘D’Artagnan of The Three Musketeers’।
প্রবীরেন্দ্রঃ চমৎকার একটা অ্যানালজি। ইন্সপিরেশন নিয়ে আরেকটু কথা বাড়াই। কনটেম্পোরারিদের মধ্যে কেউ তোমাকে ইনফ্লুয়েন্স করেছেন? সিনেমা জগতের মানুষই হতে হবে এরকম কোনও কথা নেই। ইন ফ্যাক্ট, বিয়ন্ড টলিউড নিয়েই কথা হোক। সত্যজিৎ এর যেমন কফি হাউসের আড্ডা ছিল, রথী-মহারথীরা আসতেন। ঋত্বিকের আই-পি-টি-এ ছিল। ঋতুপর্ণকে রাম রে-র ভার্সাটালিটি কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছিল। কনটেম্পোরারি না হলেও অপর্ণা সেন নিশ্চয় কিছুটা প্রভাবিত হয়েছেন ওনার বাবা চিদানন্দ দাশপগুপ্তর থেকে, অত বড় চলচ্চিত্রবোদ্ধা আর কতজনই বা ছিলেন। তোমার জন্য কারা রয়ে গেলেন?
সৃজিতঃ কবীর সুমন। চলচ্চিত্র পরিচালনার দিক থেকে বলছি না কিন্তু। আমার কথাটা যে আমি আমার মতন করে বলতে পারি, সেটা যে আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে এই সাহসটা সুমনই এনে দিয়েছিলেন ‘তোমাকে চাই’ দিয়ে। আমাদের সবাইকেই সাহস যুগিয়েছিল। আমরা বুঝেছিলাম নিজেদের কথাটা বললে মহাকাল বা সমকাল গর্দান নিয়ে নেবে না। সেই সাহসটা পেয়েই কেউ ছবি এঁকেছিল, কেউ গান লিখেছিল,কেউ কবিতা লিখেছিল, কেউ সিনেমা বানিয়েছিল। বিরানব্বই সালে বেরোনো ঐ ক্যাসেটটা আমার জন্য একটা হিউজ ইন্সপিরেশন।

প্রবীরেন্দ্রঃ সেটা যে সৃজিত মুখোপাধ্যায় ‘সৃজিত মুখোপাধ্যায়’ হয়ে ওঠার আগে থেকেই ঘটেছে সেটা আমরাও টের পেয়েছি। জে-এন-ইউ তে পড়ার সময় তুমি সুমনকে নিয়ে অনেক ইভেন্ট অর্গানাইজ করেছিলে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই সব ইভেন্ট নিয়ে অভূতপূর্ব সাড়াও দেখতে পেয়েছিলাম।
সৃজিতঃ ইয়েস, অনেক কিছুই করেছিলাম, সুমনকে নিয়ে আমার চর্চা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। তোর প্রশ্নটায় ফিরে যাই। পরের যে জন আমার কাছে বিশাল এক ইন্সপিরেশন তিনি কনটেম্পোরারিও নন, এবং তিনি সিনেমা জগতের মানুষ। কিন্তু তাঁর কথা আমাকে বলতেই হবে। তিনি উত্তমকুমার। কন্টিনিউয়াস স্ট্রাগল করে কিভাবে একজন নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করতে পারে সেটা আমি শিখেছি উত্তমবাবুর থেকে। এই স্ট্রাগলটা কেউ সিনেমাতে দেখে বুঝতেই পারবে না। কারণ যে মুহূর্তে উত্তমকুমার ক্যামেরার সামনে আসছেন, তিনি দারুণ ভাবে তৈরি হয়েই আসছেন। উচ্চারণের সমস্যা দূর করার জন্য রোজ মুখে সুপুরি নিয়ে সংস্কৃত শ্লোক প্র্যাকটিস করতেন। ইন টার্মস অফ হার্ড ওয়র্ক, হি ওয়জ আ লেজেন্ড।
কনটেম্পোরারিদের কাছে আবার ফিরে যাই। শ্রীজাতর কবিতা আমাকে খুব ইন্সপায়ার করে। রূপম, অনুপমের গান।
প্রবীরেন্দ্রঃ কিন্তু আমি যে ইন্টেলেকচুয়াল আদানপ্রদানের কথা বলছিলাম সেটা তোমাদের মধ্যে হয়?
সৃজিতঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, সব সময় হয়। সিনেমা নিয়ে হয়, কবিতা নিয়ে হয়, লেখালেখি নিয়ে হয়। সমকালীন রাজনীতি নিয়ে হয়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
টলিউডের মধ্যে কৌশিক গাঙ্গুলি আমাকে সবসময় উদ্বুদ্ধ করেন। কৌশিক দা অবশ্য একজন ফিয়ার্স রাইভ্যাল-ও বটে। আমি কোথাও একটা পড়েছিলাম, “ওয়র্ক টিল ইওর আইডিয়াল বিকামস আ রাইভ্যাল”। তুমি যাদেরকে দেখে বড় হয়েছ, যারা গুরুস্থানীয়, তাঁরা যখন তোমার প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়াবেন তখন বুঝবে কোথাও একটা পৌঁছেছো।
প্রবীরেন্দ্রঃ সেই হিসাবে ঋতুপর্ণ কি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন?
সৃজিতঃ (হাসি) ঋতুদার সঙ্গে খুব কমপ্লিকেটেড একটা রিলেশনশিপ ছিল। গৌতম দা, মানে সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য আমাকে বলেছিলেন একটা সময় হি ওয়জ ভেরি ইনসিকিওরড অ্যাবাউট মী।
প্রবীরেন্দ্রঃ ওনার মনে হয়েছিল তুমি ওনার জায়গাটা নিয়ে নিতে চলেছ?
সৃজিতঃ ‘অটোগ্রাফ’ এর পর যে এক্সপোজারটা পেলাম সেইটার জন্য। আর ঋতুদা তখন ‘চিত্রাঙ্গদা’র ফেজটার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। যতদিন তিনি মিডল ক্লাস বাঙালির জন্য তাদেরই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছিলেন, ততদিন তারা ঋতুদাকে মাথায় তুলে রেখেছিল। কিন্তু যেই ঋতুপর্ণ ঘোষ অন্যধরণের সিনেমা বানাতে শুরু করলেন, সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন বাঙালি কিন্তু তখন একটু হলেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল, “এটা ঋতু কী করল” ইত্যাদি! সেই ইনসিকিউরিটিটা ছিল, আর এদিকে একটা ডেঁপো ছেলে ‘অটোগ্রাফ’ আর ‘বাইশে শ্রাবণ’ নিয়ে ঢুকে পড়েছে।
প্রবীরেন্দ্রঃ বাকি পরিচালকরাও কি এরকমই কিছু ভাবছিলেন?
সৃজিতঃ হতে পারে। কিন্তু আমার এখানে দায় নেই। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এর পর আনন্দবাজার ‘একাল সেকাল’ বলে একটা ক্রোড়পত্র বার করেছিল । বর্তমান আর বিগত প্রজন্মের ছবি মর্ফ করে বড় বড় হোর্ডিং করেছিল। যেমন সপ্তপদীর উত্তমকুমার বাইক চালাচ্ছে, উত্তমের পেছনে বসে আছে কোয়েল। ওই সিরিজেই আর একটা হোর্ডিং-এ ছিল সত্যজিৎ রায় ড্রইংরুমে বসে আমার সঙ্গে গল্প করছেন। কী কুক্ষণেই যে বানিয়েছিল হোর্ডিং টা (হাসি)। ব্যাস, ওই হোর্ডিং বেরোতেই আমি শেষ। আমি গৌতম দা কে বলেওছিলাম, “তোমরা যে আমার কী সর্বনাশ করলে!”।
প্রবীরেন্দ্রঃ টলিউড এতটাই ইনসিকিওরড?! একটা হোর্ডিং দেখেই সবার পিলে চমকে গেল?
সৃজিতঃ দেখ, একটা খারাপ লাগা তো থাকবেই। তুই একটা মানুষকে এতটা অ্যাটেনশন দিচ্ছিস! পরে ঋতুদার সঙ্গে আমার এই নিয়ে কথাও হয়েছে। ঋতুদার থেকে গল্প শুনে মনে হয়েছে এটা শুধু টলিউড নয়, বলিউডেও হয়। নিউ কিড অন দ্য ব্লক যদি যে কোনও নিরিখে সফল হয় আর লোকে তাকে প্রডিজি বলে, রেইনিং মাস্টাররা অস্বস্তি অনুভব করেই। শুনেছিলাম রিনাদি, ঋতুদার উত্থানের সময়েও হয়েছিল। লোকে বলে অঞ্জন দা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। এটা চিরন্তন একটা প্রথা, চলেই আসছে। আই জাস্ট হোপ আই উডন্ট বিকাম দ্যাট পার্সন। কাজের চাপে এমনিতেই আমার রাতের ঘুম কম হয়, তার ওপর নিজেকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করলে আর ঘুমই আসবে না। পাগল হয়ে যেতে হবে। এত নতুন ছেলে এত ব্রিলিয়ান্ট সব কাজ করছে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় অন্য কিছু করি। ছবিই যে বানাতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে! ‘সহজ পাঠের গপ্পো’র যে ইনোসেন্স আমি একশবার জন্মালেও সেটা ধরতে পারব না। অথচ মানসমুকুল পাল সেটা করেছে তার প্রথম ছবিতেই। ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’র যে ভাষা, ওই সিনেমাটিক ভাষায় যে গল্প বলা যায় সেটা ভাবতেই পারি না। ব্রিলিয়ান্ট! তাই বলছিলাম, যতদিন আমার হিংসে হচ্ছে, হিংসা হচ্ছে না ততদিন আমি ঠিক আছি। (হাসি) ও, তুমি ‘শব্দ’ বানিয়েছ? বেশ, আমিও দিচ্ছি। ‘জাতিস্মর’এল। আবার কী এল? ‘সিনেমাওয়ালা’! চলো, আমিও আসছি ‘রাজকাহিনী’ নিয়ে। এইরকম হিংসে আর কী।
প্রবীরেন্দ্রঃ তুমি হেলদি কম্পিটিশনের কথা বলছ। কিন্তু উল্টোদিকে এটাও সত্যি যে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ বানানোর পরেও তাঁর শেষ সিনেমা হলই পেল না। মানসমুকুল পাল দুর্দান্ত ভালো কাজ করলেও আমবাঙালির মধ্যে তাঁর সিনেমা সেভাবে পৌঁছচ্ছে কোথায়? সেই অর্থে তাঁরা কী সত্যিই তোমার প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারছেন? তোমাকে যথেষ্ট পুশ করতে পারছেন? তুমি হয়ত জানো বক্স-অফিসে তোমার জায়গাটা এখনো অটুট। কোনও নিউ কিড শেষ দশ বছরে সেই জায়গাটা থেকে তোমাকে নড়াতে পারছে না।
সৃজিতঃ না রে। তারা পারছে, পুশ করতে পারছে। কারণ সব প্রতিযোগিতা বক্স অফিসে হয় না। ওরাও জানে। আমি সিওর ওরা জানে। ওরা বুদ্ধিমান ছেলে। কিছু যুদ্ধ লড়া হবে আজ থেকে পনেরো বছর পর কোনও ড্রইংরুমে। সেখানে ‘এক যে ছিল রাজা’র লড়াই হবে ‘রেনবো জেলি’র সঙ্গে। বক্স-অফিসের ব্যাপারে আমি সত্যিই লাকি। কিন্তু সেটা শুধু পরবর্তী সিনেমা বানানোর রাস্তাটা তৈরি করে দিচ্ছে।
প্রবীরেন্দ্রঃ সে কথা অবশ্যই। আমি কিন্তু প্রদীপ্ত বা মানসমুকুল পালের দিক থেকেই ভাবছিলাম। ভালো কাজ করেও যে মাল্টিপ্লেক্স জায়গা দিচ্ছে না সেটাও তো দুর্ভাগ্যজনক।
সৃজিতঃ কমার্শিয়াল আর্ট ফর্মে কাজ করতে গিয়ে মাল্টিপ্লেক্সের ওপর রাগ করে লাভ নেই। কারণ তারা অকুপেন্সিটাই শুধু বোঝে। ‘শাহজাহান রিজেন্সি’র কথাই ধর না। সৃজিত মুখার্জি ইত্যাদির সিনেমা, আর ওইরকম স্টারকাস্ট। কে নেই? আবীর – পরম – স্বস্তিকা – ঋতুপর্ণা – অনির্বাণ – মমতাশঙ্কর – অঞ্জন দত্ত – কাঞ্চন মল্লিক, ভাবা যায়! সেকন্ড উইকে দুম করে শো-টাইম কমে গেল। আমি কিন্তু ফোন করে জিজ্ঞাসাও করিনি কারণ আমি জানি, যে খেলার যে নিয়ম।

প্রবীরেন্দ্রঃ কিন্তু সবই কি নিয়ম মেনে চলে? তুমি বলছিলে পনেরো বছর পর ‘এক যে ছিল রাজা’র সঙ্গে ‘রেনবো জেলি’র লড়াই হবে। কিন্তু তুমি নিমাই ঘোষের বানানো ‘ছিন্নমূল’ সিনেমাটার কথা ভাবো, বা রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’। অনবদ্য সব কাজ। কিন্তু মানুষ তো জানলই না। শৌকর্যর ‘রেনবো জেলি’ যে সেরকমই একটা সিনেমা হয়ে রয়ে যাবে না, সেটার কী গ্যারান্টি? আমি ‘রেনবো জেলি’ ধরেই বলছি না। ওখানে প্রদীপ্ত, মানসমুকুল, আদিত্যবিক্রম যে কারওর সিনেমা ধরে নাও।
সৃজিতঃ ‘রেনবো জেলি’ বললাম কারণ শৌকর্য তো দাগ কেটে গেছে। ইউ ক্যাননট ডিনাই দ্যাট। দাগ কেটেছে বলেই ‘রক্তরহস্য’ করতে পারল। আর দাগ অনেক রকমের হয়। আজকে সাফল্যটা বক্স অফিসে না এসে ফেস্টিভ্যালে এলেও সেটা তো সাফল্যই। ভালো ছবি বক্স-অফিসে ভালো করলে ভালো, কিন্তু না করলেও ক্ষতি নেই।আমাদের কী সত্যি মনে আছে চারুলতা বক্স-অফিসে কেমন করেছিল? আর ওই যে বললাম যে খেলার যে নিয়ম। আমি ‘নির্বাক’ বানিয়ে ভাবতেই পারব না দু’তিন সপ্তাহ ধরে সিনেমাটা রমরম করে চলবে।
প্রবীরেন্দ্রঃ তাহলে বরং খেলার নিয়মগুলো যারা সেট করছে তাদের নিয়ে প্রশ্ন করি। যেমন, এস-ভি-এফ, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
সৃজিতঃ এক মিনিট, ভেঙ্কটেশ কিন্তু রুলস গুলো সেট করছে না।
প্রবীরেন্দ্রঃ ঠিকই, বাজার করছে। কিন্তু ভেঙ্কটেশের একটা বিশাল মনোপলিস্টিক পাওয়া আছে। একজন মনোপলিস্ট কিন্তু নিজেই তার প্রাইসটা ঠিক করে, সেই ক্ষমতাটুকু তার আছে। তো এই বিশাল মনোপলিস্টিক পাওয়ারের কোনও কুপ্রভাব বাংলা সিনেমার জন্য তুমি দেখতে পাচ্ছ? ভেঙ্কটেশ অনেক ভালো সিনেমা প্রোডিউস করেছে, কিন্তু মনোপলিস্টিক পাওয়ার টা তো অস্বীকার করা যায় না। প্রোডাকশন বলো বা ডিস্ট্রিবিউশন, বাংলায় প্রতিযোগিতা তো প্রায় নেই-ই।
সৃজিতঃ অ্যাবসলিউট মনোপলিস্ট তো নয়। ডুয়োপলিস্টিক সিচুয়েশন। ভেঙ্কটেশ আর উইন্ডোজ। কিন্তু এটা তো একদিনে হয়নি। ভেঙ্কটেশকেও কিন্তু অনেক খেটে এই জায়গাটায় পৌঁছতে হয়েছে। লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোসলের জন্য যে সুমন কল্যাণপুর বা বাণী জয়রাম উঠতে পারল না, এতে কি ভারতীয় সঙ্গীত জগতের প্রচন্ড ক্ষতি হল? তাতে কি ভালো গানের সংখ্যা কমে গেল? ভেঙ্কটেশের মনোপলিস্টিক বা ডুয়োপলিস্টিক পাওয়ার যাই বলিস, তার জন্য কি ভালো সিনেমার সংখ্যা কমে গেল? মাই গেস ইস অ্যাজ গুড অ্যাজ ইওরস। এস-ভিফ-এফ তো অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক গাঙ্গুলি প্রত্যেকের তিন চারটে করে সিনেমা করেছে। কমলেশ্বর দা’র ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আর ‘চাঁদের পাহাড়’ করেছে, ‘এক যে ছিল রাজা’-‘উমা’-‘ভিঞ্চি দা’- ‘গুমনামি’ করেছে। তার মানে ভেঙ্কটেশ প্রায় সব ধরণের সিনেমাই বানাচ্ছে।
প্রবীরেন্দ্রঃ তাহলে একটু ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন বোধহয়। কেন তোমার মনে হয় এই ডুয়োপলিস্টিক সেটআপ টাই দাঁড়িয়ে গেল? চিটফান্ড যেমন একটা বিশাল সমস্যা ছিল। বহু প্রোডিউসার চিটফান্ডের টাকায় তাঁদের প্রোডাকশন হাউসগুলো তৈরি করেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো টিঁকে থাকতে পারেনি।
সৃজিতঃ চিটফান্ড তো আছেই। সেটা বাদ দিয়েও ভুল সিনেমা এবং ভুল পরিচালককে পছন্দ করে অনেকে ডুবেছেন। এবং স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট দরকার। ভালো সিনেমা, ভালো পরিচালক এবং স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট এই তিনটে নিয়েই একটা প্রোডাকশন হাউসের পোর্টফোলিওটা তৈরি হয়। যদি পিওর কোয়ালিটির জায়গা থেকে দেখা যায়, তাহলে কোয়ালিটি এবং কোয়ান্টিটি দুটোই পোর্টফোলিওতে রাখতে হবে কোয়ালিটিকে বাঁচানোর জন্য। শুধু ‘পাগলু’ বা ‘আওয়ারা’ বানিয়ে গেলেও চলবে না, শুধু ‘সিনেমাওয়ালা বা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ বানিয়ে গেলেও চলবে না। এস-ভি-এফ কিন্তু এই জায়গায় খুব সাকসেসফুলি কাজটা করেছে। উইন্ডোজ-ও ঠিক একই কাজ করছে। যদিও ওদের মডেলটা আলাদা। খুব লো বাজেট এবং সোশ্যালি রেলেভান্ট সিনেমা বানিয়ে চলেছে। যেগুলো মূলত মা-মাসিদের টেনে নিয়ে আসে। টিভি যারা দেখেন তাদের টানে। এই জায়গাটা শিবু আর নন্দিতা দি খুব সফলভাবে ধরতে পেরেছেন। বিশাল অ্যাচিভমেন্ট। আমার নিজের মা আমার থেকে শিবুর ছবির খবর বেশি রাখে।
এদের বাদ দিয়ে এখনো কিছু ছোট প্রোডাকশন হাউস আছে। যেমন সুরিন্দর ফিল্মস। যদিও ওদের রিলিজ রেটটা একটু স্লো। বানিয়ে রাখে কিন্তু ঘনঘন রিলিজ করে না। যেটা কিছু সিনেমার জন্য খারাপ খবর হয়ে দাঁড়ায়, কোল্ড স্টোরেজে চলে যায়।
প্রবীরেন্দ্রঃ শিবপ্রসাদ আর নন্দিতার সিনেমা নিয়ে তোমার কী বক্তব্য? তুমি কী ওনাদের সিনেমার গুণগ্রাহী?
সৃজিতঃ আই ডোন্ট এগ্রী উইথ দেয়ার পিচ অফ স্টোরিটেলিং। কিন্তু আমি ওনাদের বিষয়গুলো নিয়ে ফ্যাসিনেটেড। চয়েস অফ সাবজেক্টস। খুব ইন্টারেস্টিং চয়েস।
প্রবীরেন্দ্রঃ কিন্তু ট্রীটমেন্টটা?
সৃজিতঃ হ্যাঁ, আমি অন্যভাবে করতাম। তবে হ্যাটস অফ্, টু দেয়ার টার্গেটিং অফ অডিয়েন্স। ওনারা জানেন সংলাপটা…… আবহ আর অভিনয়ের মাত্রা ঠিক কতটা থাকলে মানুষে অঝোরে কাঁদবে এবং পিলপিল করে হল ভরাবে। (হাসি) বাণিজ্যিক দিকটা ওনারা যেভাবে সামলেছেন তাদের আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
প্রবীরেন্দ্রঃ টিভির প্রসঙ্গ উঠল বলে চট করে একটা প্রশ্ন করে নিই। বাংলায় অদূর ভবিষ্যৎ-এ একটা শার্লক বা একটা গেম অফ থ্রোনস জাতীয় কোনও কাজ হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? আমি একজ্যাক্টলি ওই জাতীয় কাজই বলছি না। আমাদের জন্য রেলেভান্ট কিন্তু স্মার্ট, এবং সমসাময়িক গোত্রের ট্রীটমেন্ট যেখানে থাকবে।
সৃজিতঃ ইনোভেটিভ কাজ তো হচ্ছে…
প্রবীরেন্দ্রঃ টেলিভিশনের কথা বলছি কিন্তু।
সৃজিতঃ ওহ হো, টেলিভিশন! না, সম্ভব নয়। শুধু বাংলা নয়, আমাদের দেশেই টেলিভিশনের কাজগুলো এতটাই পুরাণ আর সাংসারিক ড্রামায় ঢুকে গেছে ওখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
প্রবীরেন্দ্রঃ লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ?
সৃজিতঃ এক্কেবারে তাই। ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল ওয়েব-এ যাওয়া। ওয়েব ইজ দ্য ফিউচার। আমি সেটা বুঝেই ওয়েবে ঢুকে পড়েছি। এবার যা যা ইনোভেশনের ইচ্ছা আছে, সব এক এক করে মেটাব। নেটফ্লিক্সে যেমন কোনও সেন্সর নেই। যা স্ক্রিপ্টে আছে সেটাই শুট করতে পারব। এই ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমটা আছে। তাই জন্যই ওয়েব ফিউচার। ওয়েবে সব কাজই যে ভালো হবে তা নয়, হচ্ছেও না, কিন্তু আমি খুব আশাবাদী।
প্রবীরেন্দ্রঃ অদূর ভবিষ্যৎ-এ তোমার অনেক কাজই তাহলে ওয়েবে দেখতে পাব আমরা?
সৃজিতঃ হ্যাঁ। আমার ধারণা আমার পোস্টারবোর্ডে যেটুকু জায়গা বাকি আছে তার অনেকটাই ভরবে ওয়েবের কাজ দিয়ে, ফিল্ম দিয়ে নয়।
প্রবীরেন্দ্রঃ কিন্তু নেটফ্লিক্স লেভেলের কাজ কি বাংলায় হবে?
সৃজিতঃ সেটা করতে গেলে তো বিনিয়োগ দরকার। ‘সেক্রেড গেমস’ এর বাজেট ছিল চল্লিশ কোটি। চল্লিশ কোটি মানে কুড়িটা বাংলা সিনেমার বাজেট। না, তার বেশি। বাংলা সিনেমার অ্যাভারেজ বাজেট দেড় কোটি। অন্যভাবে দেখলে চল্লিশ কোটি হল এক বছরের বাংলা ফিল্মের বাজেট। তবে বাংলায় আমরা এত টাইট বাজেটে কাজ করি, ইনোভেশন ব্যাপারটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। চাইলে উই ক্যান সার্টেনলি বি ভেরি ইনোভেটিভ। আমার ‘দ্বিতীয় পুরুষ’ সিনেমাটা বারো দিনে শুট করা। বম্বে পাগল হয়ে গেছে শুনে। এক কোটি তিরিশ লাখ দিয়ে বানানো, পাঁচ কোটির বেশি ব্যবসা করেছে।
সঞ্জয় লীলা বনশালী আমার ‘চতুষ্কোণ’ এর বাজেট শুনে বলেছিল “মেরা এক অ্যাসিস্টান্ট ডিরেক্টর কো ভেজতা হুঁ কলকত্তা। জারা ট্রেইন কর দিজিয়ে। ক্যায়সে করতে হো ইয়ার?”। সঞ্জয় তখন ‘বাজিরাও মস্তানি’ বানাচ্ছে। সেটে গেছি। সকাল ন’টা থেকে লাঞ্চটাইম অবধি জাস্ট একটাই শট হল – প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ঘুম থেকে উঠবে। কোনও ডায়ালগ-ও নেই। একই শট বার বার নিচ্ছে। কোনও কারণ নেই কিন্তু, আগের শট গুলো অপূর্ব হয়েছে। তো এই লাক্সারিটা বম্বে দেখাতে পারে।
প্রবীরেন্দ্রঃ তার মানে ডিজিটালি কাজ-ও যখন করছ একটা মেজারড অ্যাপ্রোচ রাখতেই হচ্ছে? সেলুলয়েডের যুগ চলে গেছে মানেই যে অবাধ স্বাধীনতা পাওয়া গেছে তা নয়। সত্যজিৎ রায়েরও যেরকম কনস্ট্রেন্ট ছিল, তোমাদেরও আছে।
সৃজিতঃ পুরোপুরি। স্বাধীনতা খুব কম। ইন ফ্যাক্ট, সত্যজিৎ এর সময়ে তিন চার মাসের শিডিউল থাকত। আমরা পনেরো-কুড়ি দিন ও পাই না। মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম ঘটে। যেমন গুমনামি শুট করতে সময় লেগেছিল চব্বিশ দিন। ভাস্ট ক্যানভাসে করতে হয়েছে। লখনৌ, ফৈজাবাদ, উত্তরবঙ্গ, কলকাতা, অনেক জায়গা যেতে হয়েছিল। ব্যাক ক্যালকুলেশন করলে দেখা যাবে মার্কেট সাইজ আর ইন্ডাস্ট্রি সাইজ ঠিক করে দেয় কতটা সময় আর কতটা টাকা পাব কাজটা করার জন্য। অ্যানালগ এই বাজেটের কারণেই তো উঠে গেল। কে কতটা মেপেজুপে কাজ করছে সে তো এই বাজেটের ওপরেই ডিপেন্ড করে। সঞ্জয় লীলা বনশালী-ও ডিজিটালে কাজ করছে, আমিও ডিজিটালে কাজ করছি। কিন্তু ওনার একটা গানের বাজেট-ই পাঁচ কোটি। সময় সময় দশ কোটি।
প্রবীরেন্দ্রঃ আর যদি বাকি আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো ধরো? যেমন মারাঠি? সেখানেও কি এতটা ডিসপ্যারিটি?
সৃজিতঃ আরেকটু বেটার অবস্থা। বাংলায় যদি গড় বাজেট হয় দেড় কোটি, মারাঠি সিনেমায় সেটা তিন বা সাড়ে তিন কোটি।
প্রবীরেন্দ্রঃ মারাঠি ইন্ডাস্ট্রির জন্য অবশ্য বলিউডের স্পিল ওভার এফেক্ট-ও একটা আছে বোধ হয়।
সৃজিতঃ হ্যাঁ, তা আছে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হল প্রচুর সিনেমা হল আছে। কেরালায় এগারশ, তামিলনাড়ুতে বারোশ-র মতন। পশ্চিমবঙ্গে সেই সংখ্যাটা হল আশি! তাই সাউথের টার্নওভারের সঙ্গে যখন আমাদের টার্নওভারের তুলনা হয়, তখন আমার হাসি পায়। আশিটা হল-ও নয়, বহু হল ভাঙাচোরা, এসি কাজ করছে না, দেখাই যায় না সিনেমা। ভালো হল বোধহয় আছে খান চল্লিশ।
প্রবীরেন্দ্রঃ ঘুরেফিরে আমাদের সার্বিক যে দৈন্যদশা, সেই পয়েন্টেই তাহলে এসে পৌঁছচ্ছি।
সৃজিতঃ একবারেই তাই। আর সেই কারণে যখন লোকে বলে “এমনকি রাজামৌলি-ও তো হতে পারলে না”, তখন বলতে ইচ্ছে করে “দাদা, রাজামৌলির বাজেটটা আগে দেখুন। তারপর মার্কেট সাইজটাও দেখুন। হলের নাম্বারটাও দেখুন।”। ভালো কথা, বিনিয়োগের প্রসঙ্গে বলে রাখি পাঞ্জাবি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি খুব ভালো একটা কেসস্টাডি হতে পারে। প্রচুর বিনিয়োগ করেছে বলে দে আর ডুয়িং রিয়ালি ওয়েল নাও।
প্রবীরেন্দ্রঃ তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে একটা প্রত্যাশা সবসময়েই থাকে তোমাদের? এই জাতীয় বিনিয়োগ প্রসঙ্গে?
সৃজিতঃ অবশ্যই। ট্যাক্স-ইনসেনন্টিভ হতে পারে, একটা রিয়াল এস্টেট ডেভলপমেন্টের টপ ফ্লোরটাকে মাল্টিপ্লেক্স বানাতেই হবে এরকম নিয়ম করা যেতে পারে, প্রাইম টাইমে বাংলা সিনেমার কয়েকটা শো রাখতেই হবে এরকম কিছু ল পাস করা যেতে পারে। হলের সংখ্যাটা অবিলম্বে বাড়া দরকার। এটা একটা ভিশাস সাইকল। মানুষ ওয়েব আর মোবাইলে সিনেমা বেশি দেখছে বলেও কিন্তু সিনেমা হলের সংখ্যা কমে গেছে। সাউথে যেমন সিনেমা দেখতে যাওয়াটা একটা রিচুয়াল। কী সিনেমা চলছে না জেনেও মানুষ চলে যায় দেখতে। একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসটা এসে গেলে সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়বে, আবার সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়লে সিনেমা দেখার অভ্যাসটাও বাড়বে।
কলকাতাতেই সিনেমা হলের কথা ভাবলে দুঃখ হয়। পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল, ভারতী ভেঙ্গে শপিং কমপ্লেক্স তৈরি হল।
প্রবীরেন্দ্রঃ সিঙ্গল স্ক্রীন সিনেমাহল গুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াটা আলাদা করে কতটা ক্ষতিকর?
সৃজিতঃ খুবই। ডেভাস্টেটিং বলা যায়। সিঙ্গল স্ক্রীন হল গুলোকে তো মাল্টিপ্লেক্সে-ও কনভার্ট করা যায়। জয়া যেমন, মাল্টিপ্লেক্স হয়ে রমরম করে চলছে। মিত্রা হতে পারল না, বন্ধ হয়ে গেল। প্রিয়া, দারুণ ভালো চলছে। আসলে ভিশন দরকার, প্যাশন দরকার। লোকজনেরও কতটা অসুবিধা। আমাকে তো লোকে লেখে, “দাদা, বর্ধমান থেকে এলাম আপনার সিনেমা দেখার জন্য”। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও আসে। দুর্গাপুরের মতন বড় শহরেই অতি সম্প্রতি একটা মাল্টিপ্লেক্স খুলেছে, তার আগে কিছুই ছিল না।
প্রবীরেন্দ্রঃ বাংলাদেশে টলিউডের সিনেমা আদৌ যায়?
সৃজিতঃ স্পেশ্যাল স্ক্রীনিং বা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ছাড়া যায় না। হলে দেখানো হয় না। হলেও লিমিটেড রিলিজ পায় যৌথ প্রযোজনায়। অবশ্য বাংলাদেশে হলের সংখ্যাও খুব কম। তাই জন্যই তো বাংলাদেশ থেকে মানুষ সিনেমা দেখতে আসছেন। কিন্তু নিজের রাজ্যর কথা ধরলেও তো দেখি আজকের দিনেও প্রত্যন্ত জায়গার লোকের সিনেমা দেখার সুবিধাটুকু নেই। মহারাষ্ট্রর প্রত্যেকটা গ্রামে সিনেমাহল আছে। তাইজন্যই ‘সয়রাত’ চার কোটি টাকায় বানিয়ে একশ কোটির বিজনেস করেছে। তাই ইনফ্রাস্ট্রাকচারটা বাড়ানো দরকার। এই বিনিয়োগটুকু করতে পারলে লোকে বেশি করে সিনেমা দেখতে আসবে, সিনেমাহলগুলো চলবে, আমারা-ও বেটার সিনেমা বানাতে পারব। আরো বিনিয়োগ আসবে। আমরা কল্পবিজ্ঞান বা ফ্যান্টাসি ফিকশন নিয়ে কাজ করতে পারব।
প্রবীরেন্দ্রঃ অডাসিটিটাও আসতে পারে। মিউজিক্যাল করলে একটা ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ করি। স্কেলটার কথা বলছি, গল্প নয়।
সৃজিতঃ রাইট। প্রফেসর শঙ্কু উইল লুক গ্র্যান্ডার। তাছাড়া বেটার ভি-এফ-এক্স পাব, যেমন ‘চাঁদের পাহাড়’ এর বুনিপ।
প্রবীরেন্দ্রঃ ধৃতিমানবাবুকে শঙ্কুর ভূমিকায় দেখে অনেকেই খুশি নন। তুমি পরিচালক থাকলে কাকে রাখতে?
সৃজিতঃ অঞ্জন দত্ত। ইন্টেলিজেন্স, চার্ম, এবং ওই মিষ্টি আত্মভোলা যে ব্যাপারটা সেগুলো অঞ্জন দত্ত নিয়ে আসতে পারতেন।
প্রবীরেন্দ্রঃ আরও কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনা করা যাক। তুমি সামান্য আগেই বলছিলেন উত্তমকুমার তোমাকে খুব ইন্সপায়ার করেছেন। কিন্তু উত্তমকে নিয়ে তোমার অনুরাগ তুমি পরিচালক হওয়ার অনেক আগে থেকেই ছিল। অর্কুটের জমানায় তোমাকে অনেকবার উত্তম-সৌমিত্র বিতর্কে অংশও নিতে দেখেছি। উত্তমকুমার আর নেই, সৌমিত্র এখনও আছেন। বাঙালির শেষ আইকন, এই মূহূর্তে দাঁড়িয়ে। ওনাকে তোমার সিনেমায় আমরা দেখতে পাব?
সৃজিতঃ সৌমিত্র তো এসেছেন আমার সিনেমায়। ‘হেমলক সোসাইটি’। এই ক’দিন আগেই একটা ঘরোয়া আড্ডা হচ্ছিল। আমাকে বললেন “কী, নতুন কিছু ভাবো। একসঙ্গে কাজ করা যাক”। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য যা কিছু একটা ভেবে ফেললেই তো হল না। সময় দরকার, বিস্তর ভাবনাচিন্তা দরকার। সে কথা বললাম-ও ওনাকে।
প্রবীরেন্দ্রঃ আগের মতনই ছটফট করছেন কাজ করার জন্য?
সৃজিতঃ সে কথা আর বলতে। উনি তো কতজনের সঙ্গে কত রকমের কাজ করেছেন। এখনও করে চলেছেন। কিন্তু কাজের ক্ষুধাটা দেখার মতন। ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। শুনেছি দারুণ ভালো কাজ করেছেন সিনেমাটায়।
প্রবীরেন্দ্রঃ অপর্ণা সেনের সঙ্গে তোমার তো খুবই ভালো সম্পর্ক, ব্যক্তিগত স্তরেই। অপর্ণার অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হয়ে কাজ করেছ, তোমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, উনি তোমার সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। এটা ঘটনা যে পরিচালক অপর্ণা যতটা খ্যাতি পেয়েছেন, অভিনেত্রী অপর্ণা ততটা নন। তুমি কী ওনাকে অভিনেত্রী হিসাবে পুনরাবিষ্কার করতে চাইছ বা চাইবে?
সৃজিতঃ (হাসি) রিনাদি অভিনেত্রী হিসাবে লুকস নিয়ে বেশ কনশাস থাকেন। হয়ত মেইনস্ট্রীম প্রথম সারির অভিনেত্রী হওয়ার সাইডএফেক্ট। ‘এক যে ছিল রাজা’ করতে গিয়ে কতবার আমাকে বলতে হয়েছে “রিনাদি, তোমাকে খুব ভালো দেখতে লাগছে। প্লীজ এটা নিয়ে আর ভেবো না”। রিনাদি সে কথা শুনলে তো! “একেই তুই সমস্ত লাইন অঞ্জনকে দিয়ে রেখেছিস, আমাকে অন্তত ভালো দেখতে দে” ইত্যাদি (হাসি)। কিন্তু ওই অবসেশন উইথ দ্য প্রেটিনেস মাঝে মাঝে পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। অত বড় একজন পরিচালক, রিনাদি তো আগে বুঝবেন চুলটা একটু অগোছালো থাকা বা গলার কাছের চামড়াটা সামান্য ঝুলে থাকাটা কোনও সমস্যাই নয়। লুক অ্যাট মেরিল স্ট্রীপ। মেরিল বলিরেখা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করলে তো আর সিনেমাই হবে না।

রিনাদির অভিনয়ের ব্যাপারে আমি এটা বলতে চাই যে ওনাকে একটু বেশিই আন্ডারঅ্যাপ্রিশিয়েট করেছি আমরা। আমাদের যা পারসেপশন তার তুলনায় উনি অনেক ভালো অভিনেত্রী। তবে রি-ইনভেন্ট বোধহয় করা যাবে না। মূলত ওই অবসেশনটার জন্য।
প্রবীরেন্দ্রঃ বাংলার বাইরে এমন কেউ আছেন যার সঙ্গে কাজ করার জন্য তুমি মুখিয়ে আছ? যার জন্য স্পেসিফিয়ালি তুমি একটা চরিত্র লিখবে? যাকে পুরোপুরি রি-ইনভেন্ট করতে চাইবে? তুমি অমিতাভ বচ্চন এবং শাহরুখ খান দু’জনেরই ভক্ত, সেটা মাথায় রেখেই জিজ্ঞাসা করছি। শাহরুখ বিশেষত। এমন একটা গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছেন উনি!
সৃজিতঃ সুযোগ এলে দু’জনের সঙ্গে নিশ্চয় কাজ করব। মিস্টার বচ্চনকে দিয়ে অবশ্য ‘বেগমজান’-এ ভয়েসওভারের কাজটা করিয়ে ফেলেছি। ওটা আমার উইশলিস্টে ছিল, যেমন ছিল আশাজি কে দিয়ে আমার সিনেমায় গান গাওয়ানো। তবে যার সঙ্গে কাজ করার জন্য আমি মুখিয়ে আছি তিনি হলেন ইরফান খান। খুব ইচ্ছা ওনার সঙ্গে কাজ করার।
শাহরুখের ব্যাপারটা ডাউটফুল। শাহরুখ খান কেন শাহরুখ খান হল? রিস্ক নিয়েছিল বলেই তো। নিজেকে ভেঙেছিল, এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। অন্যদের রিজেক্ট করা রোল করেছিল। ‘বাজিগর’ এর রোলটা অফার করা হয়েছিল সলমন কে। ‘ডর’ এর রোলটা আমির কে। ওনারা নেন নি, কিন্তু শাহরুখ নিয়েছিলেন। কিন্তু শাহরুখ খান হয়ে যাওয়ার পর যেই দু’একটা এক্সপেরিমেন্ট কাজ করল না, উনি ভয় পেয়ে গেলেন। জানি না এই পরিস্থিতিতে আমার মতন পরিচালকের সঙ্গে আদৌ কাজ করতে চাইবেন কিনা।
(চলবে)
আগের পর্বের লিঙ্ক https://banglalive.today/first-person-part-two/
শেষ পর্বের লিঙ্ক https://banglalive.today/first-person-last-part/
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক। অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন সংবাপত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবীরেন্দ্র। এছাড়াও লিখেছেন একাধিক কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যকাহিনী। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হল 'বাইট বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়', 'আবার ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ', এবং 'চার'।
Parer parbo prakashito hate deri hachhe keno ?