ফেলুদার রিভিউ – এ যে কি বিষম বিড়ম্বনা, তা ত্রিশোর্দ্ধ বাঙালি মাত্রেই বুঝবেন। ফেলুদা দেখতে বসলেই আমরা সেই স্কুলের শীতের ছুটিতে, দুপুরে মাংস ভাত খেয়ে, লেপ মুড়ি দিয়ে ফেলুদার বই পড়ার দিনগুলোতে চলে যাই। তার মধ্যে কোথায় সিনেম্যাটোগ্রাফি ঝুলল, কোন কোটের কাটিং লাগসই হল না, এসব দিকে নজর রাখতে হলে মনটা তো বিদ্রোহ করে উঠবেই। সেই রাগটাই বোধহয় গিয়ে পড়ে পরিচালকদের উপর। হয়তো সেই কারণেই ফেলুদার চলচ্চিত্রায়ণের ব্যাপারে বাঙালি মাত্রেই এমন উন্নাসিক।
যাই হোক, প্রথমেই বলে রাখি, আমিও ফেলুদার অন্ধ ভক্ত এবং ফেলুদা দেখার সময়ে বই নিয়ে বসে পাতা মিলিয়ে সংলাপ হিসাব করার অপরাধে আমিও দাগী আসামী। সচেতন ভাবে সেই পক্ষপাতের ফাঁদে পা না দেবার চেষ্টাই করব, তবে কতটা সফল হব জানি না।
এই কাক্কেশ্বরসুলভ ভূমিকাটা দিলুম, কারণ ওই যে বললুম, ফেলুদার ব্যাপারে বাঙালির ঘোর শুচিবাই। জনমতের বিরুদ্ধে গেলে একটা ট্রোলও বাইরে পড়বে না। সুখের বিষয়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও সম্ভবত কট্টর ফেলুবাদী। সেটা শুধু ওঁর সাক্ষাৎকার শুনে বলছি না, সিরিজটার পরতে পরতে পরিচালকের একটা গভীর মায়া আর আদরের আশ্লেষ আছে। তাই পরীক্ষা নীরিক্ষা তিনি যাই করে থাকুন, আর সেটা আমার যেমনই লাগুক, সদিচ্ছার অভাব কোথাও মনে হয়নি।
প্রথমে বলি সিরিজের থিম মিউজিকটার ব্যাপারে। খুবই সাহসের পরিচয় দিয়েছেন সৃজিত আর জয় সরকার, ফেলুদার মত আইকনিক থিম সম্পূর্ণ পালটে ফেলে। তবে জয় সরকার সম্ভবত আগের থিমের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই এটি বানিয়েছেন। এই থিমের মধ্যেও আগের থিমের মত বেড়াতে যাবার বা পিকনিকের মেজাজটা আছে, যদিও সেটাতে যে গতি আর রহস্যের বুনোট ছিল, সেটা এখানে একটু কম। তাছাড়া ফেলুদা থিমের একটা সারল্য ছিল, সেই তুলনায় এটা বেশ জটিল। কথা-টথা নিয়ে পুরোদস্তুর গান একটা। হয়তো সেটা প্রমোশনের জন্য। তবে মোটের উপর সুরটা মনে বেশ গুনগুন করে। সাধুবাদ জানাই। তবে রূপঙ্করের গলায় গানটা মোটেই মানায়নি। সৃজিত নচিকেতাকে নিলে হয়তো ভাল করতেন।
বরং সিরিজের আবহসঙ্গীতগুলোর প্রভাব অনেক স্বল্পস্থায়ী। মানে মন্দ নয় হয়তো, তবে স্মরণীয় কিছু না। এই দাবিটা সঙ্গত কি না জানি না, তবে ফেলুদার আবহে হাত দিলে এই তুলনাটুকু তো এড়ানো যাবে না।
সিরিজের অন্য ক্লাইম্যাক্সে কিন্তু সৃজিত মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন। এর আগে চতুষ্কোণেও সৃজিত প্রমাণ করেছেন, যে রোমাঞ্চকর, স্মার্ট, রাউন্ড টেবিল ক্লাইম্যাক্স তৈরি করতে তিনি এই মুহূর্তে বাংলায় প্রায় অপ্রতিদ্বন্দী। সেটা আবারও প্রমাণ করলেন এখানে। গোটা সিরিজটার স্ক্রিপ্ট ভীষণ টানটান। দারুণ গতি, এক নিঃশ্বাসে দেখে ফেলা যায়। কিন্তু এই ক্লাইম্যাক্সে তা পৌঁছেছে শিখরে।
চিত্রগ্রহণ আর শিল্পনির্দেশনার প্রসঙ্গে বলা যায়, এককথায় অভূতপূর্ব কাজ করেছেন চিত্রগ্রাহক সুপ্রিয় দত্ত আর শিল্পনির্দেশক তন্ময় চক্রবর্ত্তী। গোড়াতে বিষয়টার প্রতি পরিচালকের যে মায়ার কথা বলছিলাম, সেটা সবথেকে বেশি পরিস্ফুট হয়েছে এই দুটি বিভাগের কর্মপটুতায়। ক্যামেরার টোন, আলোকসজ্জা এবং পারিপার্শ্বিকের খুঁটিনাটি প্রায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে ১৯৭৭ সালের হাজারিবাগ। এখনকার দিনে সেটা নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধার্হ কৃতিত্ব। এবং আরেকটা জিনিস বেশ ভাল করেছেন সৃজিত, বোধহয় ইচ্ছাকৃত ভাবেই। কিছু কিছু জায়গায় সিরিজটা যাতায়াত করে গল্পের সময় ও মহেশবাবুর যৌবনের কিছু দৃশ্যে। সেখানে পরিচালক আলাদা কোনো টোন ব্যবহার করেননি, এবং যাতায়াতগুলো বেশ লাগসই হবার ফলে সেটা মাঝে মাঝে দর্শককে বেশ অনাবিল কিছু চমক দেয়। যেমন দীনদয়ালের মৃতদেহ আবিষ্কারের দৃশ্যটা দেখার সময়ে হঠাৎ করে মনে হয়, ‘কই, গল্পে সুলতান তো মানুষ মারেনি কোনো?’ পরে ভুলটা কাটলে বেশ মজা লাগে।
আরো এক জায়গায় অসাধ্যসাধন করেছেন এই দুই বিভাগ, তবে তার সাথে কস্টিউম ডিজাইনার সাবর্ণী দাস এবং পরিচালকের কাস্টিং-এর লুক টেস্টের প্রশংসা করতেই হয়। ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ুর চেহারা, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, এমনকি পোষাকের কাটিং সবকিছুর পিছনে এতটাই যত্ন, যে একেকটা ফ্রেম হুবহু রায়বাবুর আঁকা ছবির মতো যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসে। ফেলুপাগল ভক্তদের কাছে অন্তত এই তিনটি চরিত্রের ক্ষেত্রে সেই অ্যাসিড টেস্টে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া যে কি বিশাল কৃতিত্ব, তা বলা বাহুল্য।
কিন্তু, কস্টিউম এত প্রশংসনীয় হলেও সীমা ঘোষের হেয়ার স্টাইলিং-এর খুব একটা প্রশংসা করা গেল না। তার প্রধান কারণ, বীরেন্দ্র কারান্ডিকারের ভূমিকায় ঋষি কৌশিকের চুল ও গোঁফ। তাঁর চেহারা চরিত্রে বেশ ভাল মানিয়েছে, এবং বাংলার এই সীমিত বিকল্পের মধ্যে ওরকম একটা চেহারা খুঁজে বার করা বেশ শক্ত। কিন্তু তার চুল আর গোঁফের জন্য তাকে দেখে যাত্রাদলের নবকার্তিক মনে হয়। সেটা তার স্টেজের রূপ হলে তাও মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থাতেও ওরকম চুল-গোঁফ অত্যন্ত বেমানান ও দৃষ্টিকটু লেগেছে।
এবারে আসা যাক অভিনয়ে। মূল তিনজনের কথায় পরে আসব, আগে অন্যদের কথাটা সেরে নিই। মহেশ চৌধুরীর চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় অনবদ্য। ব্যক্তিত্ব, কন্ঠস্বর, অভিনয়ে গ্রামের তারতম্য – সব মিলিয়ে একাধারে দাপুটে, সদাশয়, সাহেবীভাবাপন্ন ডাকসাইটে উকিল আর পরিতপ্ত, তিক্ত অথচ ছেলেমানুষ দাদু/বাবা তিনি দুর্দান্ত ফুটিয়েছেন। বরং তাঁর যুবা বয়সের চরিত্রে অরুণ গুহঠাকুরতার মুখে রাগ ছাড়া অন্যান্য সব অভিব্যক্তিই বেশ কেঠো; অবশ্য তাঁর সুযোগও দু তিনটি দৃশ্যে মাত্র।

প্রীতিন চৌধুরীর চরিত্রে সমদর্শী দত্তকে দেখে খানিকক্ষণ আমার মুখে কথা সরেনি। তবে সেটা ‘ইচ্ছে’-র ওই যিশুসুলভ তরুণের চেহারার এহেন রূপান্তর দেখে। যাই হোক, অভিনয় তিনি মোটামুটি চলনসই করেছেন। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমতে তাঁর দু একটা দৃশ্য অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে একটু, যেমন রাতের অন্ধকারে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর কথোপকথনের দৃশ্য। আসলে গল্পটা এত পরিচিত বলেই হয়তো কিছু কিছু জায়গায় রহস্যসৃষ্টির চেষ্টাটা অতিশয়োক্তি মনে হয়েছে।
অরুণেন্দ্র চৌধুরীর চরিত্রে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় খারাপ করেননি। বিশেষ করে বলতে হয়, ফেলুদাদের বাংলোর সামনে দুজনের কথার তলোয়ারযুদ্ধে এবং শেষে রহস্যমোচনের ক্লাইম্যাক্সে তিনি হাসি, অভিব্যক্তি, ফেলুদাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার সময়ে ব্যঙ্গ – সবেতেই জাত অভিনেতার ছাপ রেখেছেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এঁর চেহারাটা চরিত্রে একেবারেই মানায়নি। অরুণবাবু ভারভার্তিক বটে, তবে একই সাথে একজন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও ক্র্যাকশট শিকারি। সেটা অরিন্দমের চেহারায় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আর শিকারি হিসেবে চেহারা বেমানান হওয়াটা যদি পরিচালকের ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্যে’ শশাঙ্ক স্যান্যালের চরিত্রে দেবেশ রায়চৌধুরীর অনবদ্য অভিনয় ভাল করে স্টাডি করতে পারতেন।
অখিলবন্ধু ঘোষের চরিত্রে কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজীও একটু বেমানান। গল্পে চরিত্রটি মধ্যবিত্ত, আটপৌরে বৃদ্ধের হলেও তার মধ্যে একটা জ্ঞানী, স্থিতধী সত্তা আছে। সেটা এই আধা থুত্থুরে, পাগলাটে বৃদ্ধের সাথে বিশেষ মেলে না।
বীরেন্দ্র কারান্ডিকারের চরিত্রে ঋষি কৌশিক কিন্তু বেশ ভাল। খুব পরিমিত অভিনয় করেছেন। আগে ওঁর অভিনয় দেখে বরাবরই মনে হয়েছে, উনি অভিনয় করার সময়ে হাত আর কাঁধ দুটো নিয়ে কি করবেন ভেবে পান না। কিন্তু এখানে শুধু যে সেই দুর্বলতা নেই তা নয়, চরিত্রের দুর্দমনীয় পৌরুষ এবং বিখ্যাত রিংমাস্টারের চাপা গর্ব শরীরী ভাষায় তিনি খুবই ভাল ফুটিয়েছেন। জঙ্গলে সুলতান ধরার দৃশ্যের রোমাঞ্চ বইয়ের মত শানিত না হলেও ঋষি নিজে ভালই অভিনয় করেছেন দৃশ্যটিতে।
নীলিমা চৌধুরীর ভূমিকায় পৌলমী দাস আর শঙ্করলাল মিশ্রের ভূমিকায় অনিল কুরিয়াকোস – অভিনেতা হিসেবে দুজনেই সহজ সপ্রতিভ, এবং তাঁদের ভূমিকার প্রতি সুবিচারই করেছেন। কিন্তু এই দুটি চরিত্রচিত্রণে পরিচালক সৃজিত আমায় বেশ হতাশ করেছেন। প্রথমত, শঙ্করলাল মিশ্রের মতো এত চিত্তাকর্ষক, ব্যালান্সড চরিত্রকে তিনি এমন একমাত্রিক কেন করে ফেললেন, বুঝতে পারলাম না। গল্পের সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্যগুলির মধ্যে একটা – যখন শঙ্করলাল ফেলুদাকে রাত্রে কেস ছাড়ার অনুরোধ করতে আসেন এবং চরিত্রটার বহু নতুন দিক ফুটে ওঠে। সেই দৃশ্যটাকে একটা মামুলি হুমকির পর্যায়ে নামিয়ে এনে পরিচালকের কোন ইষ্ট সিদ্ধ হল, তা মা গঙ্গাই জানেন। দ্বিতীয়ত, নীলিমা দেবী হলেন একজন বুদ্ধিমতী, সপ্রতিভ, ব্যক্তিত্বময়ী নারীচরিত্র যিনি রহস্য সমাধানে ফেলুদাকে সাহায্য করেন – ফেলুদার গল্পে যা জটায়ুর চুলের থেকেও বিরল। আমি আশা করেছিলাম (হয়তো অহেতুকই), যে সৃজিতের মতো একজন আধুনিক, স্মার্ট ফেলুভক্ত তাঁকে ব্যবহার করার ব্যাপারে কিছু মোচড়, কিছু চমক দেবেন। কিন্তু মুখে এক-দুখানা ওপরচালাক অপ্রাসঙ্গিক সংলাপ ছাড়া সেরকম কিছুই দেখলাম না। হয়তো উনিও বাঙালির ফেলু মিত্তির কেন্দ্রিক শুচিবাই ঘাঁটাতে সাহস করেননি।
এবারে আসি বহুপ্রতীক্ষিত বিষয়টিতে। থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। আগেই বলেছি, চেহারা সবারই মিলেছে খুব ভাল। কিন্তু চরিত্রায়ণে সমস্যা আছে বেশ কিছু জায়গায়। যেমন, তপেশ। কল্পন মিত্র যা পেরেছেন করেছেন, কিন্তু দেখে মনে হল তোপসের চরিত্রটা সম্বন্ধে ওঁর নিজের কোনো ধারণাই নেই। একটা আদ্যন্ত প্রতিক্রিয়াধর্মী আখ্যায়কের চরিত্র করা এমনিতেই বেশ কঠিন। তার উপর অভিনেতার চরিত্রটা সম্বন্ধে মাথায় একটা পরিষ্কার নিজস্ব ধারণা না থাকলে সেটা কনভিকশন পায় না। কল্পনকে দেখে মনে হয়, এই তোপসের কোনো অভিব্যক্তিই নেই। এমনকি বাঘ দেখেও তার দৃষ্টি বিস্ফারিত হয় না। কল্পন এই আড্ডাটাইমসেরই আগের তোপসে ঋদ্ধি সেনের অভিনয় দেখতে পারেন, উপকার পাবার জন্য।
জটায়ুর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তীর সাথে সন্তোষ দত্তের চেহারার মিলটা গায়ে কাঁটা দেবার মতো। অভিনেতা হিসেবেও তিনি হয়তো এমনিতে বেশ ভাল। একেন বাবু দেখে তো অন্তত তাইই মনে হয়। মুশকিল হল, এখানেও তিনি চরিত্রটাকে একেনবাবুর মতোই করে ফেলেছেন। কিন্তু, জটায়ুর যে কৌতুহলী মন, ভয় কাটিয়ে ওঠার মনের জোর, সেগুলো কিছুই তাঁর অভিনয়ে দেখতে পেলাম না। আরেকটা ব্যাপার, ভাঁড়ামি করা, পদে পদে অপদস্থ হওয়া আর ফেলুদার জ্ঞানের বাউন্সিং বোর্ড হওয়া – জটায়ু চরিত্রটার এ হেন মধ্যযুগীয় শিশুসুলভ অতিসরলীকরণ সৃজিতের কাছে অন্তত আশা করিনি। তাছাড়া, আরেকটা জিনিস খুব কানে লাগে – সেটা হল অনির্বাণের সংলাপ পরিবেশনে মডিউলেশনের একান্ত অভাব। ‘শের তো ভাগা, বাট হাউ’ – হেন আইকনিক সংলাপও অনেকটা পাঁচালীর মত শোনাল তার গলায়। ‘উট সম্বন্ধে প্রশ্ন’-এর সারল্য আর কোনোদিন দেখতে পাব কিনা জানি না, তবে অধুনা জটায়ুরা যতদিন না ওই দৃশ্যটি আত্মীকরণ করতে পারবেন, জটায়ু চরিত্রটির ভাঁড় থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
ফেলুদার চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরী নিজে বরং ভালই করেছেন। বিশেষ করে তাঁর চেহারা, হাঁটাচলা, ফিটনেস, কন্ঠস্বর অবিকল ফেলুদার মত। যেসব জায়গায় সংলাপ কম, স্নায়ুযুদ্ধ বা প্রখর দৃষ্টি দিয়ে অভিনয় – এসব জায়গায় টোটা সত্যিই অনবদ্য। কিন্তু দুটো জায়গায় বেশ বড় রকম সমস্যা আছে। প্রথমত, টোটা রায়চৌধুরীর মুখটা খুবই ধারালো ও সুন্দর হলেও মুখের মধ্যে একটা খলনায়কোচিত ব্যাপার আছে। তাই ফেলুদার একপেশে হাসিটার সময়ে সেটা একটা ক্রু্র রূপ নেয়। সেই ভাবটা ফেলুদার মুখে খুবই বেমানান। দ্বিতীয় সমস্যাটা অবশ্য শুধু ফেলুদার নয়, অন্যান্য চরিত্র, এমনকি সৃজিতের বহু ছবিতেই সত্যি। সেটা হল সংলাপের ওপরচালাকি আর প্রশ্নোত্তরে স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে পজ-এর অভাব। বারংবার চরিত্ররা প্রায় প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর শুরু করেন এবং তাতে অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়েও নিজের প্রসঙ্গ-বহির্ভূত জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশের প্রচেষ্টা থাকে বেশি। এই অবিরাম অতি-স্মার্টনেসের ফলে সময়ে সময়ে কথোপকথনটা বড় ক্লান্তিকর হয়ে যায়। আর মূল বিষয়বস্তু ছাড়া জ্ঞান, ফেলুদা গল্পের ছলে তোপসে ও জটায়ুকে দিয়েই থাকে। কিন্তু তার মধ্যে একটা কেমন দিলাম ভাব করে হাততালি কুড়োনোর ইচ্ছা, বা অত্যন্ত রূঢ়ভাবে জটায়ুকে অপদস্থ করা – কোনোটাই থাকে না। সেইটে বড্ড প্রকাশ পেয়েছে এখানে। বন্ধুসুলভ ধমক আর রূঢ়তা কিন্তু এক জিনিস নয়। ফেলুদা জটায়ুকে কতখানি ভালবাসে বা বিশ্বাস করে, সেটার ছাপ সিরিজের কোথাও দেখলাম না, অথচ তিনজনের এই অসমবয়সী নির্ভেজাল বন্ধুত্বটাই ফেলুদার গল্পের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে আমার মনে হয়।
ছবির স্পেশাল এফেক্টে বাজেটের অভাব চোখে পড়ে। সুলতানের পেটের কাছে চামড়া যেভাবে ঝুলে পড়েছে, তাতে তাকে দেখে ভয়ের চেয়ে হাসিই পায় বেশি। হয়তো সেই কারণেই জঙ্গলে বাঘ ধরার মত রোমহর্ষক ক্লাইম্যাক্স পর্দায় খুব একটা দাগ কাটতে পারেনি। তাও মান রয়্যাল বেঙ্গল রহস্যের থেকে অনেকটাই ভাল মনে হল। আশা করা যাক, ভবিষ্য়তে আরো ভাল হবে।
ফেলুদাদের বাংলোর সামনে দুজনের কথার তলোয়ারযুদ্ধে এবং শেষে রহস্যমোচনের ক্লাইম্যাক্সে তিনি হাসি, অভিব্যক্তি, ফেলুদাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার সময়ে ব্যঙ্গ – সবেতেই জাত অভিনেতার ছাপ রেখেছেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এঁর চেহারাটা চরিত্রে একেবারেই মানায়নি।
সিরিজের অন্য ক্লাইম্যাক্সে কিন্তু সৃজিত মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন। এর আগে চতুষ্কোণেও সৃজিত প্রমাণ করেছেন, যে রোমাঞ্চকর, স্মার্ট, রাউন্ড টেবিল ক্লাইম্যাক্স তৈরি করতে তিনি এই মুহূর্তে বাংলায় প্রায় অপ্রতিদ্বন্দী। সেটা আবারও প্রমাণ করলেন এখানে। গোটা সিরিজটার স্ক্রিপ্ট ভীষণ টানটান। দারুণ গতি, এক নিঃশ্বাসে দেখে ফেলা যায়। কিন্তু এই ক্লাইম্যাক্সে তা পৌঁছেছে শিখরে। পুরো সিনটা আমাদের সবার মুখস্থ হওয়া সত্ত্বেও যে সাসপেন্স তৈরি করেছেন সৃজিত, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
দেখুন, শীতে নতুন ফেলুদা দেখবেন কিনা সে তো আপনি আমার এই আড়াই পয়সার রিভিউ পড়ে ঠিক করবেন না, তাই সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখছি না। আমি শুধু ফেলুদা ভক্ত হিসেবে আমার সিরিজের প্রথম পর্বের কাছে প্রত্যাশাগুলো কোথায় কোথায় পূরণ হয়েছে বা হয়নি, সেটুকুই লেখার চেষ্টা করলাম।
দ্বিতীয় পর্ব, মানে ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’ কবে বেরোবে জানি না, তবে ট্রেলারে মগনলালের ভূমিকায় খরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে বেশ উত্তেজনায় আছি। গল্পটাও ছিন্নমস্তার থেকে অনেক অ্যাকশনধর্মী। হয়তো টোটার ফিটনেস ও কুং-ফুর কেরামতি কাজে লাগবে সেখানে।
আশায় রইলাম তাও। গত বছর আরো বহু সম্পদের সাথে আদত ফেলুদাকেও হারিয়েছে বাঙালি। শেষ পর্যন্ত আশা রাখব, যাতে এই বছর মনে রাখার মতো এক নতুন ফেলুদা দিয়ে যায় আমাদের।
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তিতিবিরক্ত হতে হতেও আইটি শিল্পতালুকে মজদুরি করতে বাধ্য হন। কিন্তু সবচেয়ে পছন্দের কাজ হাতে মোবাইলটি নিয়ে আলসেমি করে শুয়ে থাকা। চেহারাছবি নিরীহ হলেও হেব্বি ভালোবাসেন অ্যাকশন ফিলিম, সুপারহিরো আর সাই ফাই। সঙ্গে চাই সুরেশের রাবড়ি, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা-পান্তুয়া, কেষ্টনগরের সরভাজা ইত্যাদি নানাবিধ মিষ্টান্ন।