তোপসের বহুদিনের ইচ্ছে বিখ্যাত দাদার একটা বেশ জমজমাট করে জন্মদিন সেলিব্রেট করে। এই সামনের তেরো তারিখেই ফেলুদা চৌষট্টি কমপ্লিট করে পঁয়ষট্টিতে পা দেবে। যদি এবারেই জন্মদিনটা সেলিব্রেট করা যায়। অনুষ্ঠানটা হ’লে তোপসের ইচ্ছে নিজেদের বাড়ি মানে ২১ নম্বর রজনী সেন রোড়ের বাড়িতেই করবে। আর তো বেশি সময়ও নেই। এতসব ভেবে তোপসে মনে মনে বেশ উত্তেজিত হ’য়ে পড়ল। বাড়িতে তো এসব নিয়ে আলোচনাও করা যাবে না, ফেলুদা যদি আপত্তি করে, তাই ঠিক করল শিগগিরই একদিন লালমোহনবাবুর সাথে দেখা করে আইডিয়াটা বলবে করবে আর উনি রাজি থাকলে একটা প্ল্যানও করে ফেলবে।
আজ শনিবার। তোপসের ছুটি। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে তোপসে গড়পারে লালমোহনবাবুর বাড়ি পৌঁছে গেল। লালমোহনবাবু, ওরফে জটায়ু। উনি তো সবটা শুনে ভীষণ উত্তেজিত।
“কী বলছ তপেস ভাই! আবার সেই মন্দার বোস আর মগনলালের সঙ্গে দ্যাখা হবে! দ্যা ডেকোয়েট অফ আরাবল্লি অ্যান্ড দ্যা স্মাগলার অফ বারাণসী! এক্সাইটমেন্টে আমার ভিতরটা যে কেঁপে কেঁপে উঠছে! আমি তো আর অপেক্ষাই করতে পারছি না! তবে হ্যাঁ! আমাদের কিন্তু মন্দার বোস, ভবানন্দ আর মগনলালজিদের সাথে মুকুল আর রুকুকেও নেমন্তন্ন করতে হবে! আর তুমি ঠিকই বলেছ তপেস! প্রদোষবাবুও যেহেতু যোধপুর-জয়শলমির আর বেনারসের ঘটনার কথাই বেশী বলেন তাই আমরাও শুধু যোধপুর-জয়সলমির আর বেনারসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত লোকজনদেরই ডাকব। তবে দেখো তোমার দাদা আবার যেন রাগটাগ না করেন!” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন লালমোহনবাবু।
“না না ওসব নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না। ফেলুদাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আর এমনিতেই যেহেতু ফেলুদা খুব একটা ভিড় পছন্দ করেন না তাই কম লোকজনকে আসতে বলাটাই ভালো!” তোপসে জানালো।
লালমোহনবাবু একটু লাজুক ঢঙে হাত কচলাতে কচলাতে মাথাটা নিচু করে আবদারের স্বরে বললেন-
“আ আ আ র! তোমাদের খুব আপত্তি না থাকলে যদি বিশ্বশ্রী গুনময় বাগচীকেও ব’লো! আসলে ওনার ওই বাইসেপ ট্রাইসেপগুলো এই বয়সে কেমন আছে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করে।”
“তাতে আর অসুবিধা কিসের? নিশ্চই বলব!”
জটায়ু আজকাল আর খুব একটা লেখেন টেখেন না। যাও বা লেখেন সবই ভক্তিমূলক রহস্য উপন্যাস। আর তাছাড়া বাতের ব্যথা আর ব্লাড সুগারে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন। তবে ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।
তোপসে চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে এখন প্রাইস ওয়াটার হাউসে উঁচু পোস্টে চাকরি করে। বছর পাঁচেক আগে বিয়ে করেছে। পাশের পাড়ার মানে প্রতাপাদিত্য রোড়ের মেয়ে মিষ্টু। ভারী মিষ্টি মেয়ে, যোগমায়াদেবী কলেজে ইতিহাস পড়ায়। খুব ভালো গান গায়। একসময় এ টি কাননের কাছে গানও শিখেছে। ফেলুদার ফ্যান। তবে বাড়িতে ফেলুদাকে মাতিয়ে রাখে তোপসের ছেলে স্পার্ক, জটায়ুর দেওয়া নাম। বছর আড়াই বয়স। সারাক্ষণ হাতে রিভলবার নিয়ে চোখে কালো চশমা পরে স্পাইডারম্যান সেজে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই ফেলুজেঠুকে ঠাঁই ঠাঁই করে গুলি করে আর ফেলুদাকে কিছুক্ষণ গুলিবিদ্ধ হওয়ার অভিনয় করতে হয়। ফেলুদা এখন স্পার্ককে চোখে হারায়। নানান বিষয়ে পড়াশোনা আর স্পার্ক এই নিয়েই ফেলুদার জীবন। আর এর সঙ্গে প্রতিদিনকার শরীর চর্চা।
ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির জীবনের সবার সঙ্গেই তোপসের মোটামুটি যোগাযোগ আছে। তবে জাতিস্মর মুকুল ধর আর বেনারসের রুকুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা একটু বেশিই। ওদের দুজনেরই তোপসেদের বাড়িতে যাতায়াত আছে। মুকুলের বাবা সুজিত ধরের কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান প্রায় উঠে যাবার পথে। মুকুলের সোনার কেল্লার ভূতও বহুদিন আগেই ছেড়ে গেছে। এখন সোনার কেল্লার কথা বললে কিছুই মনে করতে পারে না। শুধু বলে “তাই নাকি!” মুকুল ইঞ্জিনিয়ারীং পাশ করে এখন টিসিএসে চাকরি করে। ভবানীপুরে রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে থাকে। আর রুকু, মানে বেনারসের ক্যাপ্টেন স্পার্ক! সে এখন বাংলা টিভি সিরিয়ালের হিরো। বাংলার ঘরে ঘরে ঠাকুরমা দিদিমাদের চোখের মনি। কাছেই থাকে আনোয়ার শাহ রোডে হরিপদ দত্ত লেনে। লালমোহনবাবু আবার রুকুর ফেভারিট ক্যারেক্টার। তোপসেদের বাড়িতে লালমোহনবাবু এলে রুকু আসবেই। রুকুর বক্তব্য, জটায়ুর কাছ থেকে নাকি অভিনয়ের অনেক কিছুই শেখা যায়।
লালমোহনবাবুর সঙ্গে ঠিক হলো আগামীকাল, রবিবার, ওঁর বাড়িতেই মুকুল আর রুকুকে নিয়ে তোপসে চলে আসবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। লালমোহন বলে দিলেন “ শোনো তপেশরঞ্জন, মিষ্টু আর ক্যাপ্টেন স্পার্কেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে ভুলোনা যেন। কতদিন যে ক্যাপ্টেন স্পার্কের গুলি খাইনা। দুপুরের খাওয়াটা সবাই মিলে একসঙ্গে এখানেই সারব। উফ্ ভাবতেই পারছিনা। আমাকে তো আবার আর্মসগুলোকে সব ঠিক করে রাখতে হবে। বুঝলে তপেশ এ আর সাহারায় শিহোরন নয়, এ একেবারে সারা গায় শিহোরন।“
পরদিন সকালে এগারোটা নাগাদ সবাই মিলে গড়পারে লালমোহনবাবুর বাড়িতে হাজির। তোপসের ছেলে স্পার্ক আজকে পুরোদস্তুর অরিজিনাল ক্যাপ্টেন স্পার্ক সেজে এসেছে। কালো মুখোশ পরে হাতে রিভলবার নিয়ে লালমোহনবাবুর ঘরে ঢুকেই ক্যাপ্টেন স্পার্কের মতন ইয়াহাআআ বলে একটা লাফ দিয়ে ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই করে জটায়ুকে গুলি করে অন্য ঘরে চলে গেল। জটায়ু গুলিবিদ্ধ হয়ে কিছুক্ষন উপুর হয়ে শুয়ে থাকার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন দেখলেন ক্যাপ্টেন স্পার্ক আশেপাশে নেই তখন “যাক গুলি খাওয়া কমপ্লিট। বুঝলে তপেস তোমার ছেলেটি একটি স্পার্কিং ফাইটার!” বলতে বলতে উঠে বসলেন।
প্রথমেই ঠিক হলো মিষ্টু ফেলুদাকে জন্মদিনে পায়জামা, পাঞ্জাবি আর একটা শাল দেবে, মুকুল আর রুকু এক বাক্স হাভানা চুরুট আর জটায়ু তার সাম্প্রতিকতম ভক্তিমূলক রহস্য উপন্যাস “কঙ্কালিতে কেলেঙ্কারি” বইয়ের এক কপি দেবেন। নিমন্ত্রিতদের লিস্টে মোটামুটি সবাই থাকছে। মন্দার বোস, ভবানন্দ, ডঃ হাজরা, মগনলাল, বিশ্বশ্রী গুনময় বাগচী। সবার খোঁজই ওদের জানা আছে তবে মন্দার বোস, ভবানন্দ আর মগনলাল এইমুহূর্তে জেলে আছে না বাইরে মুকুল বলল খোঁজ নিয়ে জানাবে।
ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির জীবনের সবার সঙ্গেই তোপসের মোটামুটি যোগাযোগ আছে। তবে জাতিস্মর মুকুল ধর আর বেনারসের রুকুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা একটু বেশিই। ওদের দুজনেরই তোপসেদের বাড়িতে যাতায়াত আছে। মুকুলের বাবা সুজিত ধরের কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান প্রায় উঠে যাবার পথে। মুকুলের সোনার কেল্লার ভূতও বহুদিন আগেই ছেড়ে গেছে। এখন সোনার কেল্লার কথা বললে কিছুই মনে করতে পারে না। শুধু বলে “তাই নাকি!” মুকুল ইঞ্জিনিয়ারীং পাশ করে এখন টিসিএসে চাকরি করে।
ফেলুদার যেহেতু সাধারণ বাঙালি ঘরোয়া মেনুই বেশি পছন্দ তাই ঠিক হলো একটা ভাজা, শুক্তো, দু’রকমের মাছ, কচি পাঁঠার ঝোল, ভাত, ডাল, পটলের ডালনা, চাটনি আর শেষ পাতে দই আর রসগোল্লা থাকবে। লালমোহনবাবু বললেন “মগনলাল হয়তো ভেজ, তাই আরেকটা নিরামিষ আইটেম যোগ করলে ভালো হয় না কি? যেমন ধরো পনির বানারসিয়া। আর গরম তো পড়েই গেলো, তাই বলছিলাম যদি শুরুতে একটা সুস্বাগতম শরবতের ব্যবস্থা করা যায়।”
তোপসে, মিষ্টু আর লালমোহনবাবু, তিনজনে মিলে ফেলুদাকে রাজি করিয়ে ফেলল।
দেখতে দেখতে মার্চের তেরো তারিখ এসে গেল। সকাল থেকেই ২১ নম্বর রজনী সেন রোড়ের বাড়িতে একটা উৎসবের আবহাওয়া। লালমোহনবাবুর একটু ইচ্ছে ছিলো যদি হাল্কা করে একটু শ্যামাসঙ্গীত বাজানো যায়। ফেলুদা এক বাক্যে না করে দিয়েছে। যাইহোক, একে একে সবাই আসতে শুরু করলেন। লালমোহনবাবু সকাল সকাল এসে পড়েছেন। এসেই ডিক্লেয়ার করে দিলেন অতিথি আপ্যায়নের দিকটা উনিই দেখবেন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবির ওপরে একটা হলুদ জহর কোট পরেছেন আর তার উপরে ভোজালিটা একটা লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে কাঁধ থেকে আড়াআড়িভাবে কোমরের একপাশে ঝুলিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর সবাইকে জাপানিজ স্টাইলে বাও করে “ওয়েলকাম প্লিজ! ওয়েলকাম প্লিজ” বলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ লালমোহনবাবু চাপাস্বরে বলে উঠলেন “মগনা আ আ নন্দ আগচ্ছতিইইই!” ধবধবে সাদা চুরিদার পাঞ্জাবি, চোখে সোনালী রঙের ফ্রেমের চশমা, মাথায় গুজরাটি টুপি, পায়ে লাল মোজার উপরে কালো পাম্প সু পরে পাতি হাঁসের মতন দুলতে দুলতে পান চিবোতে চিবোতে মগনলাল দড়জায় এসে দাঁড়াল।
লালমোহনবাবুকে দেখেই মগনলাল চেঁচিয়ে বলে উঠল “আরে মোহনলাল! লালমোহন, মগনলাল হিয়ার! কিমন আছেন আঙ্কেল!”
লালমোহনবাবু প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিয়ে স্মার্টলি বললেন “হ্যালো মগন ডিয়ার! হাউ আর ইউ?”
একটু পরেই মন্দার বোস এসে উপস্থিত। মন্দার বোস বুড়ো হ’লেও দাপট যায়নি। আজকাল গলায় একটা মোটা সোনার চেন আর এক কানে দুল পরে। ডানহাতের কবজিতে অসংখ্য নানান রঙের সুতো বাঁধা আর তার উপরে আজকে আবার গলায় একটা ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের সিল্কের রুমাল বেঁধে এসেছে। তোপসের দেখে তো বেশ ভয় করছিলো, ফেলুদা আবার বারটার না করে দ্যায়। কি আর করবে সামলাতে হবে, হাজার হলেও নিয়ন্ত্রিত তো! মন্দার বোসের সঙ্গে লালমোহনবাবুর বরাবরই একটা অম্লমধুর সম্পর্ক। তবে আজকে লালমোহনবাবু মন্দার বোসকে পুরো ডাউন করে দিলেন। দ্যাখা হতেই বলে উঠলেন “হ্যালো মিস্টার গ্লোবট্রটার! সারপ্রাইজড টু সি ইউ!”
“কেন আপনি কি আমাকে এক্সপেক্ট করেননি নাকি!” মন্দারের প্রশ্ন।
“না না! তা কেন হবে। আসলে আপনি কখন ভিতরে থাকেন আর কখন বাইরে বোঝা যায় না তো তাই।” লালমোহনবাবু উত্তর দিলেন।
“কিন্তু আপনি কি জানেন মাঝে মধ্যে ভিতরে গেলে কত কন্ট্যাক্টস্ বেড়ে যায়!” এই বলে মন্দার বোস যেই নিচু হ’য়ে জটায়ুর ভোজালিটা ধরে বলল “আরে এটা আপনার সেই ড্যাকোয়েটস্’দের হাত থেকে বাঁচার অস্ত্রটা না!” জটায়ু এক লাফে দুপা পেছনে গিয়ে বলে উঠলেন “ না না না! সেটি আর হচ্ছে না স্যার!”
মন্দার বোস আর লালমোহনবাবু নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা মশকরা করেছিলেন, হঠাৎ লালমোহনবাবুর কাঁধে কি একটা দড়াম্ করে পড়াতে লালমোহনবাবু প্রায় হুড়মুড়িয়ে মন্দার বোসের গায়ের ওপর পড়লেন। একটু সামাল দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখেন বৃদ্ধ গুনময় বাগচী ফোকলা দাঁতে হাসিমুখে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন।
“আরে মশাই একটু বলবেন তো আপনি বাইসেপ অ্যাটাক করবেন! আমিও তাহলে আমার ‘সেপ’দের নিয়ে তৈরি থাকতাম। আপনার বাইসেপ ট্রাইসেপরা তো মনে হচ্ছে আরও স্বাস্থবান হ’য়েছে! কেমন আছেন?” নিজের কাঁধটা ডলতে ডলতে বললেন লালমোহনবাবু। হঠাৎ দ্যাখেন ভবানন্দ পাশ থেকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে।
ভবানন্দকে দেখে মগনলাল হঠাৎ বলে উঠলেন “ হ্যালো আঙ্কেল! কিমন আছেন?” ভবানন্দও হাসতে হাসতে গিয়ে মগনলালের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো। লালমোহনবাবু তো অবাক। মন্দার বোসকে জিজ্ঞাসা করলেন “এরা একে অন্যকে চেনে নাকি?” মন্দার বোস জানালেন ভবানন্দ আর মগনলাল নাকি কয়েক মাস আগে আলিপুর জেলে একই সেলে একসঙ্গে ছিলো। তাই আলাপ আছে।
খাওয়াদাওয়ার পরে সবাই যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে একটু ঠাট্টা মশকরা করছে, লালমোহনবাবু হঠাৎ মিষ্টুকে বললেন একটা গান গাইতে। মগনলাল তো শুনে দারুন খুশি।“বিটিয়া, তুমি কার কাছে গানা শিখলে?”
“এ টি কানন!” মিষ্টু জানাল।
“বাঃ বাঃ! বহুত বঢ়িয়া! গানা বাজানা মে গুরুই আসল আছে। হমারা বানারস মে এক কহাবত হ্যায় –
পানি পিও ছান কে!
আউর গুরু চুনো পহচান কে!
তো বিটিয়া, তুমার কোনও হোরি-ঠুংরী জানা আছে? ফাগুন কা মাহিনা আছে! একটা হোরি গাইলে খুব ভালো লাগতো।” মগনলাল মিষ্টুকে অনুরোধ করলো।
“আপনি তো দেখছি বেশ সঙ্গীতরসিক মশায়!” লালমোহনবাবু একটু রসিকতার সুরেই বললেন।
“আঙ্কেল! বানারস মে থাকবেন আউর ঠুংরী, দাদরা, হোরি, চৈতি, কাজরি শুনবেন না জানবেন না, সে কিরকম কোথা! আপনি জানেন, আজ ভি বানারস কে গলিও মেঁ ঠুংরী গুঁঞ্জতি হ্যায়। গাও বিটিয়া গাও, তুম দিল খোলকে গাও।” মগনলাল বলতে বলতে চেয়ারে পা তুলে মুখে এক খিলি পান গুঁজে বাবু হ’য়ে বসল।
মগনলালের অনুরোধ রেখেই মিষ্টু মিশ্র কাফি রাগে রেবা মুহুরীর গাওয়া হোরি ঠুংরী – “আজ খেলো শ্যাম সঙ্গ হোরি….” ধরল। মিষ্টুর গান ফেলুদার বরাবরই পছন্দের। মিষ্টু গান শুরু করলে ফেলুদা বাইরের ঘরে এসে বসল। মিষ্টুর গান শেষ হতেই মগনলাল আরও একটা গানের জন্যে রিকোয়েস্ট করতে যাচ্ছিল, ফেলুদা এককথায় না করে দিল। গান শেষে কেউই আর বেশিক্ষণ বসল না। সবাই আস্তে আস্তে থ্যাঙ্কিউ ট্যাঙ্কিউ বলে চলে গেল।
সবাইকে এতদিন পর দেখে ফেলুদা বেশ খুশি হলেও ফেলুদার প্রিয় মানিকদা না আসাতে মনটা একটু খারাপই হ’য়েছিল। বয়েস হলেও মানিকদা সাধারনত নেমন্তন্ন মিস করেন না। সন্ধ্যেবেলা পাঁচটা নাগাদ ফেলুদা মানিকদাকে ফোন করলো। আজকাল সবাই মোবাইল ব্যবহার করলেও মানিকদা কিন্তু এখনও ল্যান্ডফোনেই স্টিক করে আছেন, তাই ফোন ধরতে একটু সময় লাগে।
“কি ফেলু! জন্মদিন সেলিব্রেশন কেমন হল? আমি তো আসতেই পারলাম না। তা ওই বদমাইশ মগনলাল, ভবানন্দ এরা সবাই এসেছিল?” মানিকদার রাশভারী গলা।
“হ্যাঁ মানিকদা! শুধু ডক্টর হাজরা আসতে পারেননি। আপনারা এলেন না! আপনার আর বৌদির শরীর টরীর ঠিক আছে তো মানিকদা?”
“না না আমরা ঠিকই আছি। আসলে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রফেসর ত্রিলেকেশ্বর শঙ্কু, খুব নামকরা বৈজ্ঞানিক, গিরিডিতে থাকেন, তাকে নিয়েই একটু সমস্যা হয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছি না, মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য লাগবে। আমি আর একটু দেখে নিই, রাতে তোমায় ফোন করব।” এই বলে মানিকদা ফোনটা রেখে দিলেন।
মানিকদা এইরকম ভাবে ফোন কেটে দেওয়াতে ফেলুদা বুঝতে পারল ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস।
প্রফেসর ত্রিলেকেশ্বর শঙ্কুর নাম কেই বা শোনেনি। ইনিই তো সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক যার আবিস্কারের ঝুলিতে মিরাকিউরাল, অ্যানিহিলিন, ওমনিস্কোপ, রিমেমব্রেন, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, মাইক্রোসোনোগ্রাফ ইনভিজিবিলিটি ড্রাগের মতন আবিস্কার আর বিধুশেখর আর রোবুর মত রোবট রয়েছে। শুধু প্রফেসর শঙ্কু কেন, ওঁর পোষা বেড়াল নিউটন আর বাড়ির কাজের লোক প্রহ্লাদের নামও বিশ্ব শুদ্ধ সবাই শুনেছে। অথচ ফেলুদার সঙ্গে মানিকদার এতদিনের পরিচয় থাকা সত্বেও মানিকদা কিন্তু কোনোদিনও বলেননি যে প্রফেসর শঙ্কু ওনঁর এত ঘনিষ্ঠ।
তোপসেকে ডেকে ফেলুদা পুরো ব্যাপারটা জানাল আর বলল রাতে মানিকদা ফোন করার আগে যেন নেট ঘেঁটে প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর সম্বন্ধে একটু বিস্তারিত জেনে রাখে।
রাত্রে কথামতো মানিকদা ফেলুদাকে ফোন করলেন। বললেন “বুঝলে ফেলু ব্যাপারটা একটু বেশিই সিরিয়াস মনে হচ্ছে! সম্ভব হ’লে কাল একবার সকালে এসো, বিস্তারিত জানাব।”
তোপসের অফিস আছে তাই পরদিন সকাল সকাল ফেলুদা একাই ৬ নম্বর বিশপ লেফরয় রোডে মানিকদার বাড়ি পৌঁছে গেল। পুরনো বাড়ি। পুরনো দিনের লিফট আর কাঠের সিঁড়ি। স্বভাবমতো মানিকদা নিজেই দরজা খুললেন। “এসো ফেলু!” বলে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একটু পরেই বৌদি চা নিয়ে এলেন। বৌদিকেও বসতে বলে মানিকদা সবটা খুলে বললেন।
মানিকদার কাছ থেকে সব শুনে যা বোঝা গেল তা এইরকম-
কাল সকালে গিরিডি থেকে প্রহ্লাদ ফোনে জানিয়েছে যে প্রফেসর শঙ্কু নাকি গত কয়েকদিন ধরে একেবারে অন্যরকম ব্যবহার করছেন। কথায় কথায় মন্দ কথা বলছেন, গান করছেন আর পরশু সন্ধ্যেবেলায় নাকি প্রহ্লাদকে দিয়ে মদ আনিয়েও খেয়েছেন। প্রহ্লাদ ভীষণ ভয় পেয়ে মানিকদাকে ফোন করে জানিয়েছে। মানিকদার বক্তব্য ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়। এর মধ্যে কিছু একটা রহস্য আছে। মানিকদা চান ফেলুদা যদি একবার গিরিডি গিয়ে সমস্যাটা নিজের চোখে দেখে বুঝে একটা সমাধান বার করে আসে।
ফেলুদা উঠে আসার আগে মানিকদা ফেলুদাকে প্রফেসর শঙ্কুর সম্বন্ধে বেশ কিছু এমন তথ্য দিলেন যা থেকে ফেলুদা প্রফেসর শঙ্কুকে চাক্ষুষ না করলেও ওঁর স্বভাব আর আবিষ্কার সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা করতে পারলো। আর মানিকদা এও জানালেন যে যদিও তাঁর সঙ্গে বহু বছর প্রফেসর শঙ্কুর দেখা হয়নি তাঁর দৃঢ় ধারণা শঙ্কু, প্রহ্লাদ ও নিউটনের বয়স আর বাড়ছে না, কারণ ওরা সকলেই নিয়মিত শঙ্কুর আবিস্কৃত বয়স ধরে রাখার ট্যাবলেট ‘নেভারোল্ড’ খায়। এরপর মানিকদা ফোনে গিরিডিতে প্রহ্লাদের সঙ্গে ফেলুদার কথাও বলিয়ে দিলেন। এসব ব্যাপারে মানিকদা ভীষণ পার্টিকুলার।
বাড়িতে ফিরেই ফেলুদা তোপসেকে ফোনে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে বলল আগামীকাল থেকে যদি কয়েকদিনের ছুটি নিতে পারে। কালকেই গিরিডি যেতে হতে পারে।
বেনারসের ক্যালকাটা লজের চক্রবর্তীবাবু বলেছিলেন ওঁদের গিরিডিতেও একটা লজ আছে। ফেলুদা নিজেই চক্রবর্তীবাবুকে ফোন করলো। ফেলুদার গলা শুনে চক্রবর্তীবাবু তো বিগলিত। প্রদোষ মিত্র নিজে ফোন করবেন ভাবতেই পারেননি। বললেন লজটা উশ্রি নদীর একদম কাছেই। ফেলুদা যেন চিন্তা না করে, উনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
সন্ধ্যেবেলা তোপসে ফিরলে ঠিক হলো পরদিন সকালে সওয়া আটটা নাগাদ হাওড়া থেকে ওরা গিরিডির ট্রেন ধরে বারোটা নাগাদ গিরিডি পৌঁছুবে। শুধু লালমোহনবাবু যেতে চান কিনা জেনে তোপসে তৎকালে টিকিট কেটে নেবে। লালমোহনবাবু তো শুনেই দারুণ এক্সাইটেড। “কি বলছো তপেস! আবার রহস্য রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার! এরমধ্যে কোনো ক্রিমিন্যাল অ্যাঙ্গেল আছে কি? তাহলে তো আবার আর্মস নিয়ে যেতে হবে। উফ্ আমি যে আর ওয়েইট করতে পারছি না! আচ্ছা তপেস, গিরিডিতে এখন ঠান্ডা কিরকম? মানে আমি আপাদমস্তক শীতের পোষাক নেবো নাকি মাথা আর পা বাদ দিয়ে দেবো?” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন লালমোহনবাবু।
সবটা শুনে তোপসে শুধু বলল “আর যাই করুন আপনার ওই গোলাপি রঙের মাঙ্কি ক্যাপটা নেবেন না প্লিজ।”
লালমোহনবাবুকে নিয়ে তোপসেরা পরদিন দুপুরে গিরিডি পৌঁছুলো। স্টেশন থেকে রিক্সায় কুড়ি মিনিট মত লাগলো লজে পৌঁছুতে। বীণাপাণি লজ। বেশ পরিস্কার। গেট দিয়ে ঢুকেই লজের বারান্দা পর্যন্ত মোরামের পথ। পথের দুপাশে সুন্দর কেয়ারি করা নানান ফুলের বাগান। বাড়ির একপাশে দেওয়াল বেয়ে একটা থোকা থোকা বেগুনি ফুলে ভরা লতাগাছ ওপরে উঠে গেছে। ফেলুদা গাছটাকে দেখিয়ে বলল এটার নাম পেট্রিয়া ভোলুবিলিস যাকে রবীন্দ্রনাথ নীলমণি লতা বলতেন। বাগানের একপাশে একটা দোলনাও আছে। বাগান দিয়ে উঠে লাল মেঝের বারান্দার ওপরে পর পর ঘর। বারান্দার একপ্রান্তে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি আর অন্যপ্রান্তে ডাইনিং হল আর তার পাশেই ম্যানেজারের ঘর। সেখানেই আলাপ হলো ম্যানেজার প্রভাত মাহাতোর সঙ্গে। ফেলুদাকে দেখেই বললেন “আপনিই তো বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র। চক্রবর্তী স্যার আমাকে সবে বলে দিয়েছেন। চলুন আপনাদের ঘর দেখিয়ে দি। বাগান দিয়ে বারান্দায় উঠলে ডানহাতে দ্বিতীয় ঘর। একটু লম্বাটে ঘরটা। দরজা দিয়ে ঢুকে উল্টোদিকের দেওয়ালে দুটো জানালা, জানালার নিচে দুটো খাট, ডানহাতে অ্যাটাচড টয়লেট। বাঁদিকের দেওয়াল জুড়ে বসার জায়গা আর দরজার ঠিক ডান হাতে আরও একটা খাট। জানালা দিয়ে দূরের পরেশনাথ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রভাতবাবু জানালেন ওই পাহাড়ের গা দিয়েই উশ্রী নদী বয়ে গেছে আর একটু দক্ষিণে গেলেই উশ্রী ফলস্, লজ থেকে হেঁটে মিনিট পনেরো। আর প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ি শহরের দিকে হেঁটে মিনিট দশেক। “আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন আমি লাঞ্চ সার্ভ করার ব্যবস্থা করছি।” প্রভাতবাবু বলে বেরিয়ে গেলেন।
প্রভাতবাবু চলে যেতেই ফেলুদা প্রহ্লাদকে ফোন করে নিজেদের পৌঁছানোর সংবাদটা দিল। প্রহ্লাদ জানাল সে বিকেলে বীণাপাণি লজে এসে দ্যাখা করে যাবে।
সবাইকে এতদিন পর দেখে ফেলুদা বেশ খুশি হলেও ফেলুদার প্রিয় মানিকদা না আসাতে মনটা একটু খারাপই হয়েছিল। বয়স হলেও মানিকদা সাধারনত নেমন্তন্ন মিস করেন না। সন্ধ্যেবেলা পাঁচটা নাগাদ ফেলুদা মানিকদাকে ফোন করলো। আজকাল সবাই মোবাইল ব্যবহার করলেও মানিকদা কিন্তু এখনও ল্যান্ডফোনেই স্টিক করে আছেন, তাই ফোন ধরতে একটু সময় লাগে।
বীণাপাণি লজের খাবারদাবার বেশ ভালো। লাঞ্চে দিলো- উচ্ছে-আলু ভাজা, মটরশুটি দিয়ে সোনা মুগের ডাল, বাঁধাকপি মুলো কুমড়ো বেগুন বড়ি দিয়ে একটা পাঁচমিশালি তরকারি, ফুলকপি দিয়ে টাটকা রুই মাছের ঝোল, টমাটোর চাটনি আর সাদা দই। শেষে দুটো করে রসগোল্লা।
বিকেল পাঁচটার আগেই লজে প্রহ্লাদ এসে হাজির। ভীষণ কনফিউজড আর বেশ ভয় পেয়ে রয়েছে। লালমোহনবাবু জলের বোতলটা এগিয়ে দিলেন।
“বলো প্রহ্লাদ, তুমি মন খুলে সব বলো।” ফেলুদা বলল।
“১২তারিখ সক্কাল থেকেই বাবু একটু অইন্যরকম আচরন কইচরছেন যে! যা কোনোদিন ঘটে নাই সেদিন উটাই হ’লো, বাবু সক্কাল এগারোটায় ঘুম থেকে উইঠলেন। কোনো অঘটন ঘইটলে বা সংকটে পইড়লে নিউটন যেমন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বাবুকে দেইখে অমনিই কইরতে লাইগলো। সেইদিন থিকেই বাবু এক্কেবারে অইন্যরকম হয়ে গেলেন। কথাবার্তা বলার ধরন, খাওয়াদাওয়া সবকিছুই অইন্যরকম যা ওঁর বরাবরের স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মিলে না। যে বাবু সারাদিন লাবুটারীতেই সময় কাটান সে আর ওখানে যাইচ্ছেনই না। আর রাইতেরবেলা আমাদের তো ভেতরে ঘরে থাকতেই দেন না, আমরা পাশে অবিনাশ বাবুর বাড়ি চইলে যাই। বাবু যখনই ঘর থেকে বাইর হন ঘরে তালা দিয়ে যান, যা উনি কোনোদিন কইরতেন না! অবিনাশ বাবু বইলছেন বাবুকে ভুতে পাইয়েছে। আমার খুব ডর লাইগছে দাদাবাবু! আমার বাবুকে ঠিক কইরে দ্যান।” এক নিশ্বাসে গোটাটা বলে গেল প্রহ্লাদ।
“আচ্ছা তোমার বাবুর এইরকম হওয়ার আগে দুয়েকদিনের মধ্যে কেউ কি এসেছিলো?” ফেলুদা জানতে চাইলো।
“হ তো! আইসেছিলো তো! সুইল্যান থেকে কে একজন মুলার নামে সাহেব আইসেছিলো।” প্রহ্লাদ জানালো।
“আচ্ছা প্রহ্লাদ আমরা কি কালকে একবার তোমার বাবুর সঙ্গে দ্যাখা করতে যেতে পারি? তবে তুমি কিন্তু আমাদের চেনোনা এমন ভান করবে। অসুবিধা না থাকলে আমরা সকাল এগারোটা নাগাদ আসবো।” ফেলুদা বলল।
“আপনারা বরং বিকালে আসেন দাদাবাবু! উনি কখন ঘুম থেকে উইঠবেন তা তো জানি না, তাই আর কি!”
“ঠিক আছে তাই আসবো।” ফেলুদা সম্মতি জানালো।
প্রহ্লাদ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জটায়ুর প্রশ্ন “আচ্ছা মশাই সুইল্যান দেশটা আফ্রিকার কোন দিকে বলতে পারেন?”
“সুইল্যান বলে কোনো দেশ নেই লালমোহনবাবু! ওটা সুইজারল্যান্ড হবে।” চুরুটে টান দিতে দিতে ফেলুদা জানালো।
এটা শুনে জটায়ুর মুখ থেকে শুধু একটা শব্দ বেরোলো “অ”!
পরদিন সকালবেলা লালমোহনবাবুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে কেমন করে ইংরেজিতে কথা বলবেন তা প্র্যাকটিস করতে দেখে তোপসে জিজ্ঞাসা করলো “ইংরেজি কেন?” লালমোহনবাবু বললেন “কি বলছো তপেস! এত বড় সায়েনটিস্ট! ইংরেজি ছাড়া হয় নাকি? ইংরেজিতে কথা না বললে কোনো স্ট্যাটাসই থাকবে না যে!”
“উনি কিন্তু আদ্যন্ত বাঙালি! তবে আপনার একান্ত ইচ্ছে হ’লে একবার চেষ্টা করে দেখতেই পারেন।” ফেলুদা বলল।
“ধুর মশাই, ওসব সাহেবি ইংরেজি কি আর গড়পারের এই ভেতো বাঙালির পোষায়?”
বিকালে তোপসেরা তিনজনে প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ি গেল। হাঁটা পথ। ভারী সুন্দর জায়গাটা। অনেকটা ক’রে জমি নিয়ে সব আলাদা আলাদা বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সামনে শীতের রঙ বেরঙের মরশুমি ফুলের কেয়ারি করা বাগান। প্রফেসর শঙ্কুর বাড়িও আলাদা কিছু নয়। তবে দোতলা। গেট থেকে মোরামের পথ দিয়ে উঠে বারান্দা। বাড়ির দুপাশে সুন্দর বাগান। বাড়িটা ডানহাতে পাঁচিল ঘেষা হলেও বাঁদিকে অনেকটা জমিতে সুন্দর বাগান করা। একটা রঙিন ছাতার তলায় একটা আরাম কেদারা পাতা। আরাম কেদারার ঠিক পেছনে একটা ফুলে ভরা সাদা গোলোঞ্চ গাছ। বারান্দার দুপাশে দুটো পর্দা দেওয়া দরজা, বোঝাই যাচ্ছে ঘরের দরজা। বারান্দার মাঝখানে সদর দরজা।
তোপসে কলিংবেল টেপার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহ্লাদ এসে দরজা খুলে দিয়ে প্রফেসরকে ডেকে আনলো। ছোট্টখাট্ট মানুষ প্রফেসর শঙ্কু। হাতজোড় করে এসে দাঁড়িয়ে ফেলুদাকে জিজ্ঞাসা করলেন “আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না।” ফেলুদা নিজের আর বাকিদের সঙ্গে প্রফেসরের আলাপ করিয়ে দিলেও মানিকদার কথা একবারও বলল না। শুধু বলল প্রফেসর শঙ্কুকে দেখতে আর ওঁর কাজ সম্পর্কে জানতেই গিরিডিতে আসা। প্রফেসর শঙ্কু ফেলুদাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
সদর দিয়ে ঢুকেই বড় একটা বসার ঘর। বাঁদিকে পর পর দুটো ঘর আর ডানদিকে রান্নাঘর তারপর খাবারঘর পাশে টয়লেট। সদর দিয়ে ঢুকলে মুখোমুখি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। একটা ব্যাপার দেখে ফেলুদারা একটু বিস্মিত হ’লেন যে গোটা ঘরে কোথাও প্রফেসরের কোনো ছবি বা শংসাপত্র টাঙানো নেই। শুধু দুটো বড় ছবি, একটা আইনস্টাইনের আর একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
সদর দরজার দিকে পেছন করা চেয়ারটাতে বসলেন প্রফেসর শঙ্কু। চেহারায় শান্ত ছাপ থাকলেও কথাবার্তার ধরন আর চোখের চাউনি দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল বেশ রূঢ়, অহংকারী স্বভাবের লোক । প্রহ্লাদের কথার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বরং মানিকদার দেওয়া ডেসক্রিপশনের সঙ্গে আদোউ কোনো মিল পেলো না তোপসেরা। কথাবার্তার ফাঁকে প্রহ্লাদ এসে চা দিয়ে গেল। অনেকক্ষণ নানান বিষয়ে গল্প হলো, তার মধ্যে বেশিরভাগই প্রফেসর শঙ্কুর নানান আবিস্কার আর অভিজ্ঞতার কথা। বোঝাই যাচ্ছিল প্রফেসর শঙ্কু ফেলুদার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছেন না, তাই বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়েও গেলেন। উঠে আসার আগে ঠিক হলো পরদিন সকালে তোপসেরা আবার আসবে প্রফেসর শঙ্কুর ল্যাবরেটরি দেখতে। এই প্রস্তাবে খুব একটা খুশি নাহলেও আপত্তিও করলেন না প্রফেসর শঙ্কু।
তোপসেরা হেঁটেই ফিরল লজে। গোটা রাস্তায় ফেলুদা একটাও কথা বলল না। ঘরে ঢুকে সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে শুধু বলল “বুঝলি তোপসে ব্যাপারটা খুব সহজ ঠেকছেনা! কোথাও যেন কিছু একটা মিসিং।”
“কিন্তু ফেলুদা! প্রফেসর শঙ্কু তো বেশ সপ্রতিভ বলেই মনে হলো!”
“তা ঠিক বলেছিস, কিন্তু ওঁর আবিস্কার আর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি যা জানি তার সঙ্গে ওঁর কথার খুব একটা মিল পেলাম না।” সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল ফেলুদা।
“ভেরি ভেরি সাশপিশিয়াস্!” মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
দেখতে দেখতে রাত নটা বেজে গেল। বাইরেটা বেশ নির্জন আর অন্ধকার। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা রিক্সার হর্ন আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সন্ধ্যের পর এখানে সময় কাটানো বেশ কঠিন। তাই জটায়ু নিজের খাটে বসে পরবর্তী উপন্যাসের খসড়া বানাচ্ছেন, টিভিতে তোপসে প্রিমিয়ার লিগের ফুটবল খেলা দেখছে আর ফেলুদা ঘরের মধ্যে চুরুটে টান দিতে দিতে পায়চারি করছে। হঠাৎ ফেলুদা খুব গম্ভীর চিন্তিত স্বরে ধীরে ধীরে বলে উঠলো-
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।”
বোঝাই যাচ্ছে ফেলুদা গভীর চিন্তায় মগ্ন।
“তোপসে! বড় টর্চটা এনেছিস? আমায় একটু দে তো! আমি একটু বেরোবো। আমার রাতের খাবারটা রেখে দিতে বলিস, ফিরে এসে খাবো। তোরা খেয়ে নিস। আমার ফিরতে একটু রাত হতে পারে।” ফেলুদা খুব গম্ভীর স্বরে কথাগুলো বলল। এই অবস্থায় ফেলুদাকে যে কোনো প্রশ্ন করা যায় না সেটা তোপসে খুব ভালো করেই জানে।
কিন্তু লালমোহনবাবুর কৌতুহল কে থামাবে! ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে ফেললেন “একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“পারেন! তবে একটাই।” ফেলুদা উত্তর দিল।
“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?”
ফেলুদা গম্ভীর স্বরে বলল “এখনও না।”
এই বলে ফেলুদা পাঞ্জাবির উপরে চাদরটা জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।
ফেলুদার ফিরতে প্রায় রাত এগারোটা হলো। লালমোহনবাবু ততক্ষণে নাসিকা গর্জনে হামির রাগে আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। কোনো কথা না বলে ফেলুদা হাতমুখ ধুয়ে এসে শুয়ে পড়ল। তোপসে জানতে চাইলে বলল ঘরে আসার আগে ডাইনিং হল থেকে খেয়ে এসেছে।
পরদিন ব্রেকফাস্টের পর ফেলুদা তোপসে আর লালমোহনবাবুকে বলল “তোরা তৈরি হয়ে নিস আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ি যাবো।”
বসার ঘরে নিজের চেয়ারেই বসে কাগজ পড়ছিলেন প্রফেসর শঙ্কু। ফেলুদাদের আসতে দেখে নিজেই উঠে এসে ওদের ঘরে নিয়ে বসালেন প্রফেসর শঙ্কু। প্রহ্লাদ এসে চা দিয়ে গেল। লালমোহনবাবু এদিকে প্রফেসর শঙ্কুর ল্যাবরেটরি দ্যাখবার জন্যে অস্থির হয়ে দুবার সোফা ছেড়ে উঠেও দাঁড়িয়েছেন। বেশিক্ষণ লালমোহনবাবুকে আটকাতে না পেরে ফেলুদা প্রফেসর শঙ্কুকে বলেই ফেললো “তাহলে আমরা যদি একটু আপনার ল্যাবরেটরিটা দেখতে পারি, প্রফেসর!”
“নিশ্চই! তবে আমার শরীরটা কদিন ধরে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, তাই আপনারা যদি নিজেরাই ল্যাবরেটারিটা একটু ঘুরে দেখে নেন। আর আপনাদের মোবাইল ফোনগুলোর কাইন্ডলি বাইরে এখানে রেখে যাবেন।” প্রফেসর শঙ্কু জানালেন।
“না না আপনি ব্যস্ত হবেন না, বিশ্রাম নিন। আমরা নিজেরাই দেখে নেব।” ফেলুদা উত্তর দিল।
প্রফেসর শঙ্কু ফেলুদাদের নিয়ে ল্যাবরেটারির দরজার সামনে এসে প্রহ্লাদকে ডেকে বললেন ভিতরের আলোগুলো জ্বেলে দিতে আর জানালা দুটো খুলে দিতে।
“দানবের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে ওদুটো কি মশায়?” প্রহ্লাদ আলো জ্বালাবার আগেই জটায়ুর প্রশ্ন ফেলুদাকে।
“মনে হচ্ছে ‘রোবট বিধুশেখর’!” ফেলুদা জানালো।
“উরেব্বাস ! অন্ধকারে যন্ত্রমানব!” কথাগুলো লালমোহনবাবু ফিসফিস করে বলেই নোটবুকে লিখে নিলেন।

ল্যাবরেটারিতে ঢুকে ফেলুদারা প্রফেসর শঙ্কুর যুগান্তকারী সব আবিস্কার দেখতে থাকল। ফেলুদার কাছ থেকে প্রতিটি আবিস্কারের বিবরণ শুনে লালমোহনবাবু নানানরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে থাকলেন।
শেষে একটা ছয়ফুট লম্বা , ফুট তিনেক চওড়া চেম্বার দেখে ফেলুদা দাঁড়িয়ে পড়লো। ভালো করে চেম্বারটাকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। কথা বলতে বলতে চেম্বারের কথাটা প্রফেসর শঙ্কুকে জিজ্ঞাসা করলো ফেলুদা। মনে হলো প্রফেসর শঙ্কু প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। এবারে ফেলুদা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো “এটাই কি আপনার নতুন যন্ত্র ‘জেনোক্লোন’? যা দিয়ে জেনেটিক ক্লোনিং করা যেতে পারে!”
জেনোক্লোন শব্দটা শুনে প্রফেসর শঙ্কু একটু অবাক হয়ে ফেলুদাকে বললেন “আপনি তো দেখছি আমার ব্যাপারে অনেক খবর রাখেন।”
“ওই একটু আধটু চেষ্টা করি আর কি! আসলে আপনার ‘সুইজারল্যান্ডের ইকোল পলিতেকনিক ফেদারালে দি লোজানে’ জেনেটিক ক্লোনিংয়ের উপর রিসেন্ট লেকচারটা ডিটেইলে শোনার পর থেকেই মনে অনেক প্রশ্ন জাগে আর সেটার জন্যেই গিরিডিতে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসা। আপনি যদি এই মেশিনটা কিভাবে কাজ করে একটু বুঝিয়ে বলেন! অবশ্যই আপনার যদি অসুবিধা না থাকে।” ফেলুদা বলা শেষ করার প্রায় আগেই প্রফেসর শঙ্কু বলে উঠলেন “সে নাহয় আরেকদিন হবে। আসলে আজকে আমার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না।”
“না না ঠিক আছে। আমরা তো এখন কদিন এখানে আছিই। আচ্ছা আপনি নিশ্চই প্রফেসর ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলারকে চেনেন! সুইজারল্যান্ডের ইকোল পলিতেকনিক ফেদারালে দি লোজানের প্রফেসর! ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলারের কাজের ব্যাপারে আপনার কি ধারণা? উনি জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং নিয়ে যা ক্লেম করছেন তা কি সত্যিই সম্ভব!” ফেলুদা জানতে চাইল।
ফেলুদার মুখে প্রফেসর ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলারের নাম শুনে প্রফেসর শঙ্কু একটু অবাক হয়েই বললেন “কিন্তু আপনি প্রফেসর মূলারের নাম জানলেন কি করে? আমি ওনাকে চিনি মানে ভীষণ ভালোভাবে চিনি। ভীষণ ট্যালেন্টেড আর অনেস্ট।”
“কিন্তু নেটে দেখছিলাম ওনাকে অন্যের রিসার্চওয়ার্ক চুরি করার দায়ে তিনবার জেলে যেতে হয়েছে! ইজ দ্যাট রাইট প্রফেসর?” ফেলুদার প্রশ্ন।
“না না ওগুলো সব ফেক খবর, ওতে কান দেবেন না। বোঝেনই তো, কনটেম্পোরারি রিসার্চ ওয়ার্ল্ডে এইরকম রেষারেষি লেগেই থাকে। আর তার থেকেই এইসব গুজব ছড়ায়।” শঙ্কু কথাগুলো একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন।
“কিন্তু যেসব ইনস্টিটিউটের রিসার্চের কাজ চুরি করার ব্যাপারে ওঁর নাম জড়িয়ে পড়েছে তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও তো এই ইনফরমেশনগুলো পাবলিশ্ড। আর আমি লোজানে আমার এক বন্ধুকে দিয়ে খবর নিইয়েছি অ্যাবাউট হিজ ডিটেনশনস্। সেটাও বলছে সত্যি খবর।” ফেলুদা খুব দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলল।
“ডু ইউ মিন আই অ্যাম লাইং। লিসেন! আই ডোন্ট লাই, ডক্টর ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলার নেভার লাইজ! বাই দ্যা ওয়ে, হু আর অ্যাক্চুয়্যালি ইউ মিস্টার মিত্র? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম মি ?” খুব উত্তেজিত হয়ে প্রশ্নগুলো করলেন প্রফেসর শঙ্কু।
“আই অ্যাম প্রদোষ মিত্র ওনলি! আমি শুধু আপনার আসল পরিচয়টা জানতে এসেছি। তবে আপনি যে নকল প্রফেসর শঙ্কু তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই, কারণ আপনি তো সেটা নিজেই স্বীকার করে নিলেন। অ্যাম আই কারেক্ট মিস্টার মূলার?”
এরপরে যে ঘটনাটা ঘটল সেটা তোপসেরা কেউই এক্সপেক্ট করেনি। মূলার ওরফে নকল প্রফেসর শঙ্কু পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে ফেলুদার দিকে তাক করে বললেন “ইউ জাস্ট গেটআউট অফ হিয়ার!”
“উহু ওই ভুলটা করবেন না মিস্টার ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলার! একবার পিছনে ফিরে দেখুন!” ফেলুদা একটু মিচকি হেসে মূলারকে বলল।
মূলার পিছন ফিরে দ্যাখে সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই দুজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে একজন হাতে একটা রিভলবার নিয়ে মূলারের দিতে তাক করে রয়েছেন।
এদিকে মূলার পেছন ফিরতেই তোপসে মূলারের হাতে একটা জোরে থাপ্পড় মারল আর তাতে মূলারের হাত থেকে রিভলবারটা ছিটকে মাটিতে গিয়ে পড়ল।
“সাবাশ্ তোপসে!” রিভলবারটা তুলতে তুলতে ফেলুদা বললেন, আর ততক্ষণে মূলারের দুটো হাত দরজায় দাঁড়ানো ভদ্রলোক দুজন এসে ধরে ফেলেছেন।
“আলাপ করিয়ে দিই! ইনি তিনবার জেল খাটা ইকোল পলিতেকনিক ফেদারালে দি লোজানের প্রফেসর ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলার। আর ইনি লোকাল থানার ওসি মিস্টার চন্দ্রপ্রতাপ সিং। মনে হচ্ছে জেনোক্লোন আপনার সঙ্গে একটু বিট্রেই করে ফেলেছে! কি বলেন প্রফেসর ভ্যান্ডারমিখ্ট মূলার! গিভ মি এ মিনিট মিস্টার মূলার! আই উইল শো ইউ দ্যা রিয়েল প্রফেসর শঙ্কু।” কথাগুলো বলতে বলতে ফেলুদা সোজা ল্যাবরেটরীর পাশে সামনের দিকের ঘরটায় ঢুকে পড়লেন। কারুর মুখে কোনও শব্দ নেই। লালমোহনবাবু, প্রহ্লাদ, নিউটন সবাই অবাক হয়ে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউ বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। শুধু মূলার সাহেব মিস্টার সিংয়ের থেকে হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেলুদা একজন হুবহু প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। দেখেই বোঝা গেল ফেলুদার সঙ্গে আসা প্রফেসর শঙ্কু ভীষণ ক্লান্ত আর দুর্বল। নিউটন দুর্বল প্রফেসর শঙ্কুর কাছে গিয়ে ল্যাজ তুলে মিঁয়াও মিঁয়াও করতে থাকলে উনি নিউটনকে কোলে তুলে নিলেন।
লালমোহনবাবু তো অবাক, বড় বড় চোখ করে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন “এক্কেবারে সেম সেম!”
ফেলুদা দুর্বল প্রফেসর শঙ্কুকে ধরে চেয়ারে বসাতে বসাতে বললেন “হ্যাঁ লালমোহনবাবু সত্যিই টুইন! তবে মিস্টার সিং যাকে ধরে রেখেছেন তিনি নকল আর আমার সঙ্গে ইনি আসল প্রফেসর শঙ্কু।”
একটু শ্বাস নিয়ে একটু জল খেয়ে দুর্বল প্রফেসর শঙ্কু বললেন “আগে মূলারকে আমার থেকে আনক্লোন করতে হবে। মিস্টার সিং প্লিজ ওকে ওই চেম্বারে ঢোকানোর বন্দোবস্ত করুন।”
মিস্টার সিং আর তার সাগরেদ মূলারকে প্রায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে চেম্বারে ঢোকানোর পর দুর্বল প্রফেসর শঙ্কু আস্তে আস্তে গিয়ে চেম্বারের দরজার উপরে লাগানো কিবোর্ডে কিছু কম্যান্ড টাইপ করে বসার ঘরে এসে ফেলুদাদের সঙ্গে বসলেন।
“ঘন্টাখানেক লাগবে মূলারের নিজের অরিজিনাল স্টেটে ফিরে যেতে।” প্রফেসর শঙ্কু জানালেন।
ফেলুদা প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে লালমোহনবাবু আর তোপসের আলাপ করিয়ে দিলেন। এও জানালেন ফেলুদাদের মানিকদাই পাঠিয়েছেন প্রহ্লাদের কাছ থেকে ফোনে বিস্তারিত সব জানার পরে।
বাবুর অসুস্থতার ব্যাপারটা আঁচ করে প্রহ্লাদ তাড়াতাড়ি বাবুর জন্যে এক গ্লাস গরম দুধ আর খানকয়েক বিস্কুট এনে দিলো। দুধে বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে প্রফেসর শঙ্কু জানতে চাইলেন “কিন্তু মিস্টার মিত্র! আপনি কি করে ব্যাপারটা বুঝলেন?”
“আসলে আমার এই পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারার পেছনে প্রহ্লাদের অনেক অবদান আছে। সুইজারল্যান্ডের প্রফেসর মূলারের কথা এবং আপনার অস্বাভাবিক আচরনের কথা আমি প্রহ্লাদের কাছ থেকেই জানতে পারি। একটু খোঁজ করতেই আপনার রিসেন্ট কাজ ‘জেনোক্লোন’ আর আপনার ইকোল পলিতেকনিক ফেদারালে দি লোজানে দেওয়া জেনেটিক ক্লোনিংয়ের উপর লেকচারটার সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে জানতে পারি। কাল সন্ধ্যায় যখন প্রথম নকল প্রফেসর শঙ্কুর সঙ্গে আলাপ হয় ওঁর কথাবার্তার মধ্যে অনেক অসঙ্গতি দেখতে পাই আর তাতে আমার সন্দেহ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝার জন্যে একটু রিস্ক নিয়েই আমি কাল রাতে আপনার বাড়িতে আসি। আপনার ঘরের বাগানের দিকের জানালা দিয়ে যখন আপনাকে একটা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় বসে থাকতে দেখে আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যায়। রাতেই আমি মিস্টার সিংকে জানাই আর মানিকদাকে বিস্তরিত সব বলি। বাকিটা তো সবটাই আপনি জানেন।” ফেলুদা জানালেন।
এরমধ্যে প্রফেসর শঙ্কু গিয়ে ‘জেনোক্লোন’ চেম্বার শাটডাউন করে মূলারকে বার করে মিস্টার সিংয়ের হাতে তুলে দিলেন। মূলারকে নিয়ে মিস্টার সিং চলে যাওয়ার পর প্রফেসর শঙ্কু বললেন “জেনোক্লোন মেশিনটা আসলে পুরো তৈরি হয়নি আর আমাকে যতক্ষণ চেম্বারে রেখে আমার জেনেটিক প্রোফাইলিং করা দরকার সেটা যেমন মূলার করেননি তেমনি ক্লোন হবার জন্যে নিজের যতক্ষণ চেম্বারে থাকার কথা সেটাও উনি থাকেননি। তাই প্রফেসর মূলার চেষ্টা করেও ১০০% জেনেটিক্যালি আমার ক্লোন হতে পারেননি। সেইজন্যেই ওঁর লুক আমার সঙ্গে মিললেও ফিলটা আদৌ মেলেনি, তাই নিউটন আর প্রহ্লাদ ওনাকে দেখে একটু দিশাহারা হয়ে ভয় পেয়ে যায়।”
প্রফেসর শঙ্কু একটু স্থির হয়ে বসার পর ফেলুদা জিজ্ঞাসা করল “মিস্টার মূলারের আপনার সঙ্গে এরকম করার কারণ কী?”
“আসলে মূলার চাইছিল ওকে আমি জেনোক্লোনের টেক্নোলজিটা বলে দিই। আমি রাজি না হওয়ায় এই বিপত্তি।”
ফেলুদা এবারে প্রফেসরের কাছে জেনোক্লোন যন্ত্রটা সম্পর্কে একটু বিশদে জানতে চাইলো।
দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে প্রফেসর শঙ্কু শুরু করলেন- “আসলে জেনোক্লোন মেশিনটা দেখতে যতটা সিম্পল ব্যাবহার করাটা ততটাই কমপ্লিকেটেড। এটা অপারেট করতে গেলে কতগুলো বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা দরকার। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং আর নিউরোমরফিক কম্পিউটিং। তাছাড়া কি রেঞ্জের ওয়েভ দিয়ে বডি স্ক্যান করতে হবে সেটা সম্পর্কেও ভালো জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তারওপরে এই মেশিনকে অপারেট করতে হলে জিসিসিএল, মানে জেনোক্লোন কম্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, নামে একটা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ জানতে হবে। এই ল্যাঙ্গুয়েজটা এই মেশিনের জন্যে আমারই তৈরি করা। এর মধ্যে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলিং থেকে আরম্ভ করে নিউরোমরফিক কম্পিউটিং, স্ক্যান ফ্রিকোয়েন্সির মতো নানান জটিল অ্যালগোরিদম আর প্যারামিটার ব্যাবহার করা হয়েছে। প্রফেসর মূলার যেহেতু এই সবকিছুর সঙ্গে অবগত ছিলেন না তাই গোলমাল করে ফেলেছেন।”
“আচ্ছা ইফ আই অ্যাম নট রঙ, এই নিউরোমরফিক কম্পিউটিং দিয়েই তো আর্টিফিশিয়াল নিউরনের উপর ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যালের প্রভাব বোঝা হয়। আর এটা তো আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলিংয়েরই অংশ!” ফেলুদা বলল।
প্রফেসর শঙ্কু বেশ অ্যাপ্রিশিয়েটিং টোনেই ফেলুদাকে বলে উঠলেন “ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট মিস্টার মিত্র! আপনি তো দেখছি আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলিং আর নিউরোমরফিক কম্পিউটিং সম্পর্কে বেশ আপ টু ডেট!” এটা শুনে তোপসেরও নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হলো।
“স্যার আপনার এই ক্লোনিক্যাল মেশিনের অপারেশনটা যদি আর একটু ক্লিনিক্যালি সহজ করে বুঝিয়ে দেন!” প্রফেসর শঙ্কুর সব কথোপকথন নোট করতে করতে লালমোহনবাবু বলে উঠলেন।
“মেশিনটার নাম জেনোক্লোন, ক্লোনিক্যাল নয়, লালমোহনবাবু!” ফেলুদা জটায়ুর ভুল ধরিয়ে দেয়।
“নিশ্চই মিস্টার গাঙ্গুলি! হোয়াই নট!” হাসতে হাসতে বলে উঠলেন প্রফেসর শঙ্কু। ততক্ষণে প্রহ্লাদ সবার জন্যে লুচি, ছোট আলুর দম আর দরবেশ নিয়ে এল। সঙ্গে অবশ্যই চা। নিউটনকে প্রফেসর শঙ্কুর কোল থেকে নামানোর জন্যে প্রহ্লাদ নিউটনকে একবাটি দুধ আর মাছভাজা দিয়ে গেল।
নিউটনকে কোল থেকে নামিয়ে লুচী খেতে খেতে প্রফেসর শঙ্কু বলতে শুরু করলেন- “ধরুন আপনার দুই বন্ধু রাম আর শ্যাম। আপনি শ্যামবাবুকে রামবাবুর ক্লোন করতে চান। সেক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে রামকে জেনোক্লোন চেম্বারে ঢুকিয়ে জেনেটিক প্রোফাইল স্ক্যান করতে হবে। স্ক্যানিং কমপ্লিট হলে সেই স্ক্যানড ডেটা স্টোর করে শ্যামকে জেনোক্লোন চেম্বারে ঢুকিয়ে তারও জেনেটিক প্রোফাইল স্ক্যান করে সেই ডেটা স্টোর করে রাখতে হবে। এবারে স্টোর করা রামবাবুর স্ক্যানড ডেটা দিয়ে শ্যামবাবুর শরীরের জেনেটিক প্রোফাইলকে রিপ্লেস করলেই শ্যামবাবু রামবাবু নম্বর-২ হয়ে যাবেন। আবার আপনি যদি রামবাবু নম্বর-২কে শ্যামবাবুতে ফেরত আনতে চান তাহলে রামবাবু নম্বর-২ এর শরীরের জেনেটিক প্রোফাইলকে স্টোর করা শ্যামবাবুর জেনেটিক প্রোফাইল দিয়ে রিপ্লেস করতে হবে।”
এতটা শুনে জটায়ু পুরো কনফিউজড হয়ে রামেতে আর শ্যামেতে হারিয়ে গিয়ে দুহাত কচলে কচলে বলতে থাকলেন “রাম থেকে শ্যাম আর শ্যাম থেকে রাম!”
এসব হয়ে যাওয়ার পর ফেলুদা বলল “প্রফেসর! তাহলে আমরা এবার উঠি। আপনি বিশ্রাম নিন। সাবধানে থাকবেন। আমি কোলকাতায় ফিরে মানিকদাকে সবিস্তারে সব জানাবো।”
ফেলুদাদের বাইরের গেট অবধি এগিয়ে দিতে এসে প্রফেসর শঙ্কু ফেলুদাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে অনেকবার করে ধন্যবাদ জানালেন। বেরিয়ে আসার ঠিক মুখে জটায়ু হঠাৎ নিজের মোবাইলটা তোপসেকে দিয়ে প্রফেসর শঙ্কুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন “ওয়ান স্ন্যাপ প্লিজ। তপেস দেখো ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন গোটা বাড়িটাও আসে।” এই বলে হাসিমুখে ক্লাস ফোরের ফার্স্ট বয়ের পোজে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে প্রফেসর শঙ্কুকে থ্যাঙ্ক ইউ, টাটা এসব বলে এক লাফে এসে ফেলুদার পাশে দাঁড়ালেন।
লজে পৌঁছে ফেলুদা তোপসেকে বলল “দ্যাখ তো তোপসে পাঁঠার মাংস পাওয়া যাবে কিনা? কি লালমোহনবাবু রেড মিট চলবে তো? আপনার আবার কোলেস্টরলের ব্যারাম নেই তো?”
তোপসে খোঁজ নিয়ে জানালো পাঁঠা আজ মেনুতেই আছে আর চাইলে সঙ্গে বড় সাইজের গলদা চিংড়িও করে দিতে পারে।
“ইউ মিন বেঙ্গল লবস্টার উইথ বেঙ্গলি স্টাইল হাঙ্গেরিয়ান মাটন গোলাশ! উফ্ দারুণ হবে।” লালমোহনবাবু বলে উঠলেন।
“লালমোহনবাবু! হাঙ্গেরিয়ান মাটন গোলাশ একধরনের স্টু। বাঙালি পাঁঠার ঝোল স্টুয়ের ধারে কাছে পৌছায় না।” ফেলুদা বুঝিয়ে বলল।
পাঁঠার মাংস আর গলদা চিংড়ি দিয়ে ভাত খেয়ে দুপুরে একটু ভাতঘুমের পর তোপসেরা উশ্রী দেখতে গেল। কাল সকালেই তো আবার কলকাতা ফেরা।
পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।
onekdin por erakom ekta dilkhush kora galpo pore bado bhalo laglo…..garpaare bheto baangaalir baari
Feludar janmodiner onusthaan cholakalin poribesh bornona darun legeche…namoskaar
porer adventurer opekkhaaye roilam ..bhalo thaakun…
Brilliant. To put together so many diverse and famous characters maintaining their individual features and styles in order to build up a solid snd intersting story line is not an easy job. Mission accomplished . The fatless crisp smart to the point writing style just in line with the original literature is amazing.
Fascinating.
Very novel idea. The way you have described the Genoclone machine and it’s operating system, it sounds like a real stuff.
বুদ্ধিদীপ্ত রসদীপ্ত লেখা পড়ার মজা পেলাম। একটা অন্য জগতে বিচরণ করার সুযোগ হয়ে গেল। দারুণ লিখেছ।