ছোট থেকে বড়, তাঁকে পড়েননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। নির্দোষ কৌতুক, শ্লেষ বা পানিং- বাংলা সাহিত্যে আজও তাঁর জুড়িদার নেই। অথচ স্বীকৃতির উজ্জ্বল মঞ্চ থেকে চিরকালই যেন সরেই থাকলেন তিনি। বাঙালির রসবোধের অন্যতম উৎস হয়েও থেকে গেলেন খানিক অনাদরে, অবহেলায়। মানুষটির নাম শিবরাম চক্রবর্তী, যাঁর জীবনের গল্পগুলোও ছিল ছিল তাঁর কলমের মতোই সরসতায় উজ্জ্বল, যেন এক দীর্ঘস্থায়ী ঠাট্টা।
মালদা জেলার চাঁচোলের রাজপরিবারে জন্ম। শিরায় টগবগে রাজরক্ত। অথচ রাজকীয় বোলচালের ধার ধারেননি কোনওদিন। আজীবন সংসারে সন্ন্যাসী হয়েই কাটিয়ে দিলেন মানুষটা। ঘরপালানোর ব্যামো সেই কৈশোর থেকেই। পকেটে টাকাকড়ি নেই, তবু হুট করে ট্রেনে চেপে বসতেন, নেমে যেতেন অজানা স্টেশনে। কিছুদিন পরে ফিরেও আসতেন। কিশোরবেলা থেকেই এভাবে পালাতে পালাতে সত্যিই গৃহত্যাগী হলেন একদিন। পরাধীন দেশে স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে তখন। দেশমাতৃকার শেকল ছেঁড়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হলেন স্কুলপড়ুয়া শিবরামও। জুটে গেলেন দেশের কাজে৷ হল হাজতবাস। স্কুল থেকেও একরকম বের করে দেওয়া হল তাঁকে। থেমে গেল প্রথাগত পড়াশোনার পথ।
স্বশিক্ষিত মানুষ বলতে যা বোঝায় শিবরাম ছিলেন ঠিক তাই। শুধু কলমে নয়, স্বভাবেও ছিলেন আদ্যন্ত রসিক। নিজের জন্য গোটা জীবনে বিশেষ কিছুই চাওয়ার ছিল না তাঁর, অপার আনন্দ ছাড়া। সেই আপাদমস্তক মজার মানুষ শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে আজও কলকাতার বুকে ভেসে বেড়ায় নানান গল্প, কথকতা।
শিবরাম তখন স্বদেশি বিপ্লবী। পুলিশের নজরে পড়েছেন। একজন পুলিশ অফিসার সারাদিন গোপনে নজরদারি চালাচ্ছেন তাঁর উপরে। কারও উপর ২৪ ঘণ্টা নজরদারি তো নেহাত মুখের কথা নয়, বেশ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। কিন্তু দেখা গেল এই পুলিশ অফিসারটি দিন দিন যেন মুটিয়ে যাচ্ছেন। কাজে গাফিলতির দায়ে তলব করা হল তাঁকে। নিজের স্থূলতার কারণ দর্শাতে গিয়ে অফিসার কিন্তু সরাসরিই দায়ি করে বসলেন শিবরামকে। জানালেন, শিবরামের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়েই নাকি তাঁর এই দশা! খাই খাই বাতিক আছে শিবরামের। দিনভর এ দোকান ও-দোকান ঘুরে ঘুরে রাবড়ি, রসগোল্লা, চপ, কাটলেট এইসব খান। অনুসরণকারী ভদ্রলোকটিকেও দোকানে ঢুকে বেগতিক হয়ে খাবার অর্ডার করতে হয়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে৷ এই পুলিশ অফিসারের কর্তব্যনিষ্ঠা পাঠকদের মজাই দেয়।
শোনা যায়, কলম ধরেছিলেন কাবলিওয়ালার দেনা শোধ করতে। বলতেন,”গায়ের জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না, তার বদলে কলম টানি।” কখনও হকারি, কখনও সাংবাদিকতা, এমনকি কেরানিগিরিও করেছেন একসময়৷ কিন্তু টাকা হাতে থাকত না শিবরামের৷ থাকবে কী করে! মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, “টাকা উড়ে যাওয়ার জন্য। জমাবার জন্য নয়।” তাঁর টাকা অবশ্য বেশি উড়ত কচুরি, রাবড়ি, চপ, কাটলেটে। পকেটে তেমন টান না পড়লে টাকাপয়সা নিয়ে ভাবার মানুষ ছিলেন না শিবরাম। মুক্তারামের তক্তার বাইরে খুব বেশি কিছু ভাবতেও চাননি। মুক্তারাম স্ট্রিটের মেসের দোতলার ঘরটি ততদিনে পাকাপাকিভাবে তাঁর আস্তানা। একদিন এক ভক্ত সেই ঠিকানায় এসে দেখেন, ভেতর থেকে দরজার কড়ায় শেকল দিয়ে তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন শিবরাম। কারণ কী? না, চোরের উপদ্রব। ভক্তের চোখ কপালে উঠেছে ততক্ষণে। বললেন,-‘এভাবে তালা লাগিয়েছেন আপনি! চোর তো চাইলেই ঢুকে পড়তে পারে!’
মুচকি হেসে শিবরাম উত্তর দিলেন, ‘তা পারে। কিন্তু বেরোবে কী করে? ভেতরে ঢোকা যায় ঠিকই, কিন্তু শিব্রাম চাবি দিয়ে তালা খুলে না দিলে বেরোনো যায় না, পাল্লাদুটো গায়ে চেপে বসে।’
সত্যিই একদিন চোর ঢুকল সে ঘরে, ধূপকাঠি বিক্রেতার ভেক ধরে। শিবরাম তখন বাসায় ছিলেন না। ফিরে এসে দেখেন সারা ঘর লণ্ডভণ্ড। বোঝা যায় বহু খোঁজাখুঁজির পরেও হতাশ হয়ে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে বেচারা চোরকে। কিন্তু ফেরার আগে ঘরের মালিকের জন্য সহৃদয় চোর বাবাজি রেখে গেছেন একটা দশ টাকার নোট, একটা ধূপকাঠির প্যাকেট আর একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, ‘ভাই তোমার ঘরে চুরি করতে এসে দেখলাম তোমার অবস্থা আমার থেকেও খারাপ। কাজকম্ম বোধহয় কিছুই করো না। এই দশটা টাকা রেখে গেলাম। এই টাকায় এই কোম্পানির ধূপকাঠি কিনে ফেরি কোরো…’

কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী সেসময় খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন শিবরামের। তাঁর মুখে প্রায়ই শোনা যেত এই গল্পটা। একবার চণ্ডী লাহিড়ীকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার এক ঘুগনিওলার কাছে হাজির শিবরাম। এসেই সটান তিন প্লেট ঘুগনির অর্ডার দিলেন। ঘুগনিওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনারা তো দুজন, আরেকটা কাকে দেব?’’
‘‘আরেকটা তুমি খাবে। কোনওদিন নিজের ঘুগনি খেয়ে দেখেছ? আজ খাও। আমি খাওয়াব।’’
অগত্যা, শিবরামের সামনেই নিজের বানানো ঘুগনি নিজে খেয়ে সেযাত্রা নিস্তার পান ঘুগনিওয়ালা।
খাবারদাবারের প্রতি শিবরামের নিষ্ঠাভক্তি বরাবরই বেশি৷ তাঁর গল্পে-উপন্যাসে খাবার প্রসঙ্গ যে কতভাবে এসেছে, তা পাঠকমাত্রেই জানেন। বিশেষ করে শিবরামের রাবড়িপ্রীতি তো প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তবে মিষ্টি নয়, এই গল্পটা আমিষ খাওয়া নিয়ে।
একবার এক নেমন্তন্ন বাড়িতে হাজির হয়েছেন শিবরাম। সেখানে খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন। শিবরামও বসে গেলেন পাত পেড়ে। কবজি গুটিয়ে যথেচ্ছ খাসির মাংস খাওয়ার পর মনে পড়ল ডাক্তারের সাবধানবাণী। কিন্তু মানুষটা তো শিবরাম। তক্ষুনি আশেপাশের মানুষদের শুনিয়ে বলে উঠলেন, ‘আজ বড্ড মাংস খেয়ে ফেলেছি, ব্লাডপ্রেসারটা বোধহয় হাই হয়ে গেছে।’- এই বলে পকেট থেকে কয়েকটা ওষুধ বার করে টপাটপ মুখে পুরে দিলেন। তারপরেই আবার হেঁকে উঠলেন, ‘এহ! প্রেশারটা বড্ড কমে গেল‚ মানে একেবারে লো প্রেসার হয়ে গেল যে! এখন আবার মাংস না খেলে প্রেসার নর্মাল হবে না।’
এই কথা বলেই আবার সটান ডানহাত গুটিয়ে মাংসের প্লেটের সামনে বসে পড়লেন ‘শিব্রাম’।

নিজেকে নিয়ে মজা করতে শিবরামের জুড়ি মেলা ভার। রেহাই দেননি পিতৃদত্ত নামটাকেও। শিবরাম চক্রবর্তীর বদলে নিজের নাম লিখতেন ‘শিব্রাম চকরবরতি’। ভাবাই যায় না, সিরিয়াস কবিতালেখা দিয়ে সাহিত্যজগতে পা রেখেছিলেন মানুষটা। পরে অবশ্য গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক সবই লিখেছেন। বিষয়বৈচিত্র থাকলেও তাঁর লেখার মূল সুরটি সেই রসবোধ। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রায় স্বয়ম্ভু বলা যায়৷ মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর কোনও সুযোগ্য উত্তরসূরির জন্ম দিতে পারেনি বাংলা সাহিত্য। সাহিত্যিক হিসেবে, এমনকি মানুষ হিসেবেও বাংলা সাহিত্যের উঠোনে তিনি একক। অদ্বিতীয়।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons,
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।