পেলে তাঁর বাবাকে বলেছিলেন… তখন তাঁর বয়স মাত্র নয়, সালটা ১৯৫০, ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজিত, বাবার চোখে জল দেখে বলেছিলেন যে, তিনিই নাকি বিশ্বকাপ জিতে আনবেন! ছোট্ট ছেলে, প্রাক্তন ফুটবলার বাবাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন নাকি অবচেতনের আকাঙ্ক্ষাটা কর্ক উড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল কে জানে! সেবারের কাপ ঘিরে আশা ছিল ব্রাজিল-বাজারে তুরীয়। একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ সালে ফুটবলের সবচেয়ে বড় উৎসবটি কুচ করে কেটে দেওয়া হয়, ১৯৩৮ সালের পর ১৯৫০— বুঝতেই পারছেন এক দীর্ঘ গ্যাপ, তার উপর আয়োজক দেশই যে তারা! কাপ শুরু ইস্তক ফুটবল-কাতর হলুদ জার্সির দেশে সকলেই যেন পায়ে-পায়ে মনে-মনে আনমনে ঘুমিয়েও খেলছে। সাম্বার তালে তালে সারা ব্রাজিল ফুটের নাচে নেচে উঠেছে। দেশের খেলা থাকলে রেডিওয় লাখো লাখো কান আটকাচ্ছে। কিন্তু ফাইনালে হেরে যেতে হল উরুগুয়ের কাছে।

সে সময়ের দেশের রাজধানী রিও ডি জেনেইরো-র মারাকানা স্টেডিয়ামে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে তাদের ফাইনাল ম্যাচটা এখনও ব্রাজিল-বৃদ্ধদের অনেকেরই স্মৃতিতে একটা ব্ল্যাকহোল হয়ে রয়েছে। উরুগুয়ে সেই ম্যাচ জিতে গিয়েছিল ২-১-এ। যদিও দ্বিতীয়ার্ধে ফ্রিয়াকার গোলে ব্রাজিল এগিয়ে যাওয়ার পর ব্রাজিলিয়ানরা ভেবেই নিয়েছিলেন যে, তাঁর জিতে গিয়েছেন। বলা যেতে পারে এমনও, ম্যাচের আগে থেকেই তাঁরা জিতে বসেছিলেন। কিন্তু পরাজয়। উরুগুয়ের পর পর দুটো গোলে ব্রাজিল গুম মেরে গেল। দ্য মারাকানা স্ম্যাশ বা মারাকানাজো বলা হয়ে থাকে সেই ম্যাচকে। প্রায় দু’লক্ষ মানুষ দেখেছিলেন সেই খেলা। সেও এক রেকর্ড বৈ কি! 

Pele on football field

এর পরের ওয়ার্ল্ডকাপ হল সুইটজারল্যান্ডে। ব্রাজিল গ্রুপ এক-এ। সে গ্রুপে এক নম্বরে থাকলেও, ম্যাক্সিকোকে ৫-০ গোলে হারালেও, কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে স্বপ্ন চুরচুর। হাঙ্গেরির কাছে ব্রাজিলকে হেরে যেতে হল ৪-২ গোলে। এই হারের ধারাবাহিকতার আলোয় বুঝে নিতে হবে ১৯৫৮-র বিশ্বকাপকে। পেলের জন্ম ১৯৪০-এর ২৩ অক্টোবর, ত্রেস কোরাসোয়েসে। পেলের ভাল নাম— এডসন অ্যারান্তেস ডো নাসিমেন্তো। ১৯৫৮ ওয়ার্ল্ডকাপে যাঁর অভিষেক ঘটল, বয়স ১৭ বছর ২৪৯ দিন। ওয়ার্ল্ডকাপে সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার হিসেবে ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন।

অনেকেই বলে থাকেন, পেলে নাকি ওভাররেটেড। গ্যারিঞ্চার মতো সতীর্থ না পেলে নজরকাড়া সাফল্যের এতটা তাঁর ঝুলিতে আসত না। কিন্তু ভাবুন একবার ফুটবলপাগল দেশের সে বারের প্রত্যাশার গগনচুম্বিতা। ইউফোরিয়াকে। ‘জিততেই হবে’র ভয়ঙ্কর বীভৎসতাকে। ভাবুন একবার। তবে পেলের কথা উঠলে গ্যারিঞ্চাও ওঠেন। সেই ফাইনাল ম্যাচে সুইডেন চার মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে দিল। অনেকেই ভাবলেন ব্রাজিলের হয়ে গেল। কিন্তু গ্যারিঞ্চা (যিনি পেলের চেয়ে সাত বছরের বড়) রক্ষাকর্তা হয়ে উঠলেন। তাঁর দুটি ক্রসে ভাভা গোল দিয়ে প্রথম অর্ধেই এগিয়ে নিয়ে গেল ব্রাজিলকে। ফলে দ্বিতীয় অর্ধে ব্রাজিলের খেলা ছিল অনেকটা চাপমুক্ত। পেলে সেকেন্ড হাফে দুটি গোল করলেন। ম্যাচের তৃতীয় গোল, এক আশ্চর্য কৌশলী পেলেকে দেখা গেল। ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে ফ্লিক করে বলটাকে এগিয়ে নিয়ে ভলি করে জালে জড়িয়ে দেন পেলে। এটাও বলতে হবে, আরও অসামান্য কয়েকটি শট পেলে সেই ম্যাচে নিয়েছিলেন, কিন্তু জালে জড়িয়ে সেগুলিকে চুমুর চরিতার্থতা দিতে পারেননি।

Pele Garrincha
পেলের কথা উঠলে গ্যারিঞ্চাও ওঠেন

পেলের জীবননির্ভর ছবি ‘পেলে: বার্থ অফ এ লেজেন্ড’-এ (যে ছবির মিউজিক দিয়েছেন এ আর রহমান) একটি ব্যাপার ভারি আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয়েছে। সেটা হল, পেলের হাত ধরে জিনগা স্টাইলের প্রত্যাবর্তন। যে স্টাইলে মাহির পেলে, কিন্তু ব্রাজিল দলের ম্যানেজার ভিনসেন্টে ফেওলা জিনগা স্টাইলের উপর মারাত্মক খাপ্পা। পেলেকে স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিয়েছেন যে, এই ‘আদিম কালের চাঁদিম হিম’ জিনগাকে বিন-এ ফেলে দিতে হবে। পেলের বাকরুদ্ধকর পরিস্থিতি, কারণ জিনগা বিনে তাঁর পায়ের গীত থেমে যাবে যে! এর আগেও তিনি এই অবস্থায় পড়েছিলেন। ক্লাব স্যান্টোস ভুক্ত হওয়ার সময়ে। তখন অভিমানাহত পেলে বল ছেড়ে বরিয়া-বিস্তর বেঁধে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। স্টেশনে পৌঁছে ছিলেন ট্রেন ধরবেন বলে। পিছন পিছন এসেছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার প্রবীণ ডি ব্রিটো। ছবিতে দেখানো হয়েছে— ডি ব্রিটো-র সুপারিশেই তাঁকে স্যান্টোসে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্টেশনে কিশোর পেলের পাশে বসে ডি ব্রিটো বুঝিয়েছিলেন, ১৯৫০-এর পরাজয়ের জন্য কীভাবে জিনগা-কে কাঠগড়ায় তোলা হয়। জিনগা-র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ব’লে ডি ব্রিটো পেলেকে বোঝান এই স্টাইলের অমূল্যপনা। পেলে সেই শুনে ধাতস্থ হন, ট্রেন ছেড়ে ক্লাবে ফেরেন। ফেওলাও জিনগা-ক্রুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তাতেও কিছু করা যায়নি। পেলের পা থেকে জিনগা-কে সরিয়ে দেওয়া যায়নি, তা সম্ভবও ছিল না। কারণ, এই কৌশল তো তাঁর রক্তে লীন। 

জিনগার ইতিহাসের খোঁজ করলে ফিরে যেতে হবে ১৬ শতকে। ব্রাজিলে পর্তুগিজরা এসেছিল যখন, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল আফ্রিকান ক্রীতদাসদের। প্রবল শক্তির সমাহার সেই ক্রীতদাসদের মধ্যে স্বাধীনতার বর্জ্র নির্ঘোষ ছিল। বহু জনই পালিয়ে গিয়েছিলেন জঙ্গলে। তাঁদের জিনগা বলা হত, ক্যাপোয়েরা ছিল তাঁদের লড়াইয়ের ফর্ম। মার্শাল আর্ট আর নৃত্য— দুইয়ের এক অলোকসামান্য যুগলবন্দি। সেই কৌশল চলে এসেছে ফুটবলে। দৃষ্টিনন্দন সেই স্টাইল। যা আফ্রিকার বীজ থেকে উত্থিত পেলের ভিতরেই ছিল। হাওয়া দিয়ে তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা, পেলের জীবনের প্রথম কোচ। ডি ব্রিটোর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত পেলে বুঝে গিয়েছিলেন, কোচেরা যা-ই বলুন না কেন জিনগাতেই তিনি চাঙ্গা, কামাল দেখাবেন ওই কৌশলে। মাঠে সেই কাজটি তিনি যে পদে-পদে করলেন, ইতিহাসই প্রমাণ। 

Pelé Schiphol 1962

যাঁরা বলেন পেলে ওভাররেটেড, তাঁদের এও বুঝে নিতে হবে, পেলে ফুটবলকে অনেক আলোকবর্ষ এগিয়ে দিয়েছেন। তিনি ফুটবলের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। সেটা এমনকি গ্যারিঞ্চার মতো মহান প্লেয়ারের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। কারণ, গ্যারিঞ্চা ছিলেন অন্ধ করে দেওয়ার মতো মদাসক্ত, গ্যারিঞ্চা ছিলেন উওম্যানাইজার, খেলাটাকে খুবই খেলাচ্ছলে নিতেন তিনি। খেলা ছিল একশ শতাংশ বিনোদন তাঁর কাছে। গ্যারিঞ্চা ছিলেন বড় মানুষের দেহে এক শিশু, আমুদে ড্রেসিংরুমের ক্লাউন, তাঁর সতীর্থরাই বলছেন এমন। যদিও ১৯৬২-র ওয়ার্ল্ডকাপে গ্যারিঞ্চাকে লিডার হিসেবে দেখা যায়, পেলে তখন হাঁটু ইনজুরিতে মাঠের বাইরে। গ্যারিঞ্চার একার ক্যারিশমাই ব্রাজিলকে ওয়ার্ল্ডকাপে হলুদ পতাকা পোঁতায়। কিন্তু ক্রমে অসংযত জীবন গ্যারিঞ্চাকে গহ্বরে ঠেলে দেয়, যা পেলের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ফলে তিনি সহজেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কমবয়সীর কাছে নিষ্কণ্টক আইডল হয়ে ওঠেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ইউনেস্কোর গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হন। ১৯৯৫-তে ব্রাজিলের ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি মিনিস্টার অফ স্পোর্টস’ করা হয়েছিল তাঁকে। খেলাধুলো থেকে দুর্নীতিকে দূর করার কথা বলেছিলেন পেলে। একটি আইনের প্রস্তাবও তিনি করেছিলেন। যা ‘পেলে ল’ হিসেবে ব্রাজিলে পরিচিত। ফার্নান্দো কার্ডোসো প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে, দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীর পদটিই অবশ্য তুলে দেন, এবং পেলের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে অভিযোগ উঠল ইউনিসেফ থেকে ৭ লক্ষ ডলার তছরুপে তিনিও জড়িত। অভিযোগটা হল, পেলের সংস্থাকে ওই অর্থ দেওয়া হয়েছিল একটি বেনিফিট ম্যাচের জন্য, যে ম্যাচটি বাতিল হলেও অর্থ নাকি ফেরত দেওয়া হয়নি। যদিও কোনও কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। ইউনিসেফও এই অভিযোগ মানেনি। ছেলে গোলকিপার এডিনহো-কে নিয়েও পেলেকে কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। অর্থ তছরুপ এবং মাদক পাচারের মামলায় এডিনহো গ্রেফতার হন ২০০৫ সালে। গ্যারিঞ্চার মতো নারীতে ডুবে না থাকলেও পেলে তিনটি বিয়ে করেন। প্রথম দুইয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় যথাক্রমে ১৯৮২ এবং ২০০৮ সালে। কিন্তু এইসব পেলের কিংবদন্তির পতাকায় একটুও কালি ছিটোয়নি। ফুটবলের এক মহাপ্রচারকের সততার শিহরণ এতটুকু কমেনি। 

সাদা চামড়ার দুনিয়াদারিতে পেলে এক মুক্তির প্রতীক। নিপীড়িতের তিনি অক্সিজেন, তিনি শোষকের আক্রমণ-রক্ষণে আতঙ্কের হারাকিরি। তাঁর প্রতিটা গোল এক একটা গোলা, ধ্বংসের দুনিয়ায় সৃষ্টির জিনগা-সুর সে সব। কিন্তু তিনি কোনওভাবেই সম্রাট নন, তাঁকে দেওয়া সম্রাট তকমা ডাহা ভুল। তিনি ফুটবলের মানবেশ্বর। তাঁর নামে ফুটবল চলে, তিনি সর্বশক্তিমান বোধের জন্ম দেন, সব ময়দানে পায়ে পায়ে মোজায়, জার্সিতে, বাহুতে-মস্তিষ্কে তাঁর বিচরণ। আমাদের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ, তাই তিনি মধুর, ঐশ্বরিক।… তোমায় আমায় মিলন হলে সকলি যায় খুলে–/ বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে।/ তোমার আলোয় নাই তো ছায়া, আমার মাঝে পায় সে কায়া,/ হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।

ঈশ্বর নেশার মতো, আশার মতো, অপরাধীর ভয়ের মতো, ঈশ্বর আমাদের বাঁচায়, মারে, তাঁর জন্ম নেই মৃত্যুও না।

ছবি সৌজন্য: StoreNorske, Wikimedia

Nilarnab Chakraborty Author

পেশায় সাংবাদিক নীলার্ণব বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গল্প কবিতা ও ফিচার লেখায় সমান আগ্রহ ও দক্ষতা রয়েছে। প্রকাশিত বই রাতের কাহিনী, অসংলগ্ন রিপোর্টাজ, হাওয়ার আওয়াজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *