উর্দু সাহিত্য জগতে ইসমত চুঘতাই এবং পাঞ্জাবি সাহিত্য জগতে অমৃতা প্রীতম প্রায় সমকালীন দুই ব্যতিক্রমী নারী সাহিত্যিক, যাদের গ্রহণ করতে স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের ভারতবর্ষকে যথেষ্ট অসুবিধের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। প্রথমত তৎকালীন সাহিত্যসমাজ কোনও প্রতিবাদী নারীকণ্ঠকে আত্মস্থ করে ওঠার মত যথেষ্ট সাবালক ছিল না। ‘নারী সাহিত্যিক’ ভাবনাটাই তখন বেশ খানিকটা ধোঁয়াশায় ভরা। নারী জগতে সাহিত্য বা সাহিত্য জগতে নারী, এ দুইই স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে এক অপরিচিত আঙ্গিক ছিল। ফলত নারীদের সাহিত্য-প্রতিভা মোটামুটি ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ থাকত, বিক্ষিপ্তভাবে খুব সামান্য দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া নারীপ্রতিভার জনমানসে বিচ্ছুরণের উদাহরণ সে সময়ে খুব একটা পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রমের মধ্যে বাঙালি কবি কামিনী রায়ের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এছাড়াও মারাঠি সাহিত্যিক মালতি বেদেকার, গিরিজাবাই কেল্কার, সরোজিনী নাইডু, রশিদ জাহান, মহাদেবী বর্মা, বেগম রোকেয়া, করনেলিয়া সরাবজি- হাতে গোনা এই কয়েকটি নামের মধ্যেই সে যুগের নারী সাহিত্যকে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছিল। এহেন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন ইসমত চুঘতাই (১৯১৫-১৯৯১) তাঁর ব্যতিক্রমী লেখনী নিয়ে ‘লিহাফ’ (১৯৪২) ছোটগল্পটির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন উর্দু সাহিত্যজগতে যে একটি আলোড়ন তৈরি হবে তাতে আর আশ্চর্য কী!

‘লিহাফ’ গল্পটির মূল বিষয় সমকামিতা। সেই সময়ের ভারতীয় সাহিত্যজগত এই বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে এত সুচারু ও বলিষ্ঠ কলমের জন্য প্রস্তুত ছিল না। উপরন্তু গল্পটির রচয়িতা এক নারী। রীতিমতো নড়েচড়ে বসল উর্দু সাহিত্যজগত। অনেকে এ মতামতও পোষণ করলেন যে ইসমত আসলে কোনও পুরুষ লেখকের ছদ্মনাম। কৃষাণ চন্দর লিখেছিলেন, ইসমত একজন নারী জানামাত্রই সাহিত্যমহলে একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এমনকি সাদাত হাসান মান্টো, যিনি পরবর্তীকালে ইসমতের সবচেয়ে বড় সমালোচক-বন্ধু হিসেবে অবতীর্ণ হবেন, তিনিও ইসমতকে প্রথম সাক্ষাতে একজন মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে বেশ সহমর্মিতার চোখেই দেখেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁর সেই ধারণা আমূল বদলে যায়। তাঁর মনে হয়েছিল একজন নারীর চোখে দেখেছেন বলেই ইসমত ‘ভুল ভুলাইয়া’, ‘তিল’, ‘টেরহি লকির’, ‘লিহাফ’ বা ‘গেইন্দা’র মতো সূক্ষ্ম অনুভুতিসম্পন্ন গল্পগুলো লিখতে পেরেছিলেন।

Poet Kamini Roy
ব্যতিক্রমের মধ্যে বাঙালি কবি কামিনী রায়ের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে

ইসমতের জন্ম ১৯১৫ সালের ২১ আগস্ট, উত্তরপ্রদেশের বাদায়ুনে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছয় ভাই এবং চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতামাতার নবম সন্তান। তাঁর দাদা মির্জা আজিম বেগ চুঘতাই ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক এবং উৎসাহদাতা। তিনি ইসমতের কিশোরীবেলাতেই একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে নাম করেছিলেন। ইসমতের বাবা মির্জা কাশিম বেন চুঘতাইকে চাকরিসূত্রে পরিবার নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে থাকতে হত। পরিবারটি রক্ষণশীল হলেও বাবার উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইসমত ছোটবেলা থেকেই তাঁর পরিবারে যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ পেয়েছিলেন।

খুব ছোট থেকেই ইসমত ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। দাদার প্রভাবে এবং নিজের চেষ্টায় ইসমত ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকেন বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে। টমাস হার্ডি থেকে সমারসেট মম, দস্তয়ভস্কি থেকে চেকভ, ও হেনরি, ডিকেনস, টলস্তয়, গান্ধী থেকে মুন্সি প্রেমচন্দ- এই দীর্ঘ সাহিত্যযাত্রা তাঁকে সমৃদ্ধ করে তোলে। কলেজ জীবনের চার বছর ইসমতের সাহিত্যবোধের পরিণতির চার বছর, এই সময়ে তিনি পরিচিত হন গ্রিক ও ইংরাজি নাটকের সাথে। শেক্সপীয়র, ইবসেন আর বার্না্ড শ’র লেখা তাঁর সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। তেইশ বছর বয়সে ইসমত ঠিক করেন যে তিনি লেখালেখির জগতেই থাকবেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘ফাসাদি’ যখন প্রকাশিত হয়, পাঠকেরা বেশ একটু অবাক হয়ে যান। অনেকে ভাবেন এটি তাঁর দাদার ছদ্মনামে লেখা গল্প। এমনকি তাঁর দাদা নিজেও জানতেন না যে তাঁর ছোটবোনের একটি গল্প ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে।

ইসমতের বাবা মির্জা কাশিম বেন চুঘতাইকে চাকরিসূত্রে পরিবার নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে থাকতে হত। পরিবারটি রক্ষণশীল হলেও বাবার উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইসমত ছোটবেলা থেকেই তাঁর পরিবারে যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ পেয়েছিলেন।      

কলেজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর লখনউতে একটি সাহিত্য-সভায় ইসমত রসিদ জাহানের সংস্পর্শে আসেন, যাঁর ব্যক্তিত্য ইসমতের ওপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। পেশায় ডাক্তার রসিদ ছিলেন একজন অত্যন্ত মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা নারী, বেশ কিছু ছোটগল্প ও রেডিও নাটকের প্রণেতা তিনি। ইসমত অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছিলেন যে এই মানুষটির প্রভাব তাঁর জীবনে বর্ণনাতীত। স্নাতক হওয়ার পর খানিকটা বাড়ির অমতেই উচ্চশিক্ষার জন্য  ইসমত আলিগড়ে যান। সেখানে মাস্টার্স ডিগ্রি করার সময় তাঁর পরিচয় হয় যে মানুষটির সঙ্গে তিনিই পরবর্তীকালে ইসমতের জীবনসঙ্গী চিত্রপরিচালক শহিদ লতিফ। ইসমতের দাদা এই বিয়ের তীব্র বিরোধী ছিলেন, যতদূর সম্ভব শহিদের সঙ্গে বিনোদন দুনিয়ার যোগসূত্রের কারণে। কিন্তু এই বিয়ের ঠিক দু মাস আগে ইসমতের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে গেছে। তিনি লিখে ফেলেছেন ‘লিহাফ’ নামক ছোট গল্পটি, যা কিনা উর্দু সাহিত্য জগতে ছোটোখাটো একটি ঝড় তুলে দিয়েছে। ‘লিহাফ’ গল্পটিতে একইসঙ্গে এক নবাব এবং তার পুরুষ প্রেমিকদের সমকামী সম্পর্কের সাথে সাথে তার অসুখী বেগম এবং তার চাকরানীর মধ্যেকার সমকামী সম্পর্কটিকেও  লেখক খোলাখুলি তুলে এনেছেন। পুরোটাই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এক ছোট্ট বালিকার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। এই গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরে বয়ে গেল সমালোচনার ঝড়, লেখিকাকে অভিযুক্ত করা হল অশ্লীলতার দায়ে, লাহোরে যে বিচারালয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হল সেখানে একইসঙ্গে বিচারাধীন সাদাত হাসান মান্টো, তাঁর ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ গল্পটির অশ্লীলতার দায়ে। দুবছর বিচার চলার পর যখন ইসমতের লেখায় কোনও অশ্লীলতার অভিযোগ প্রমাণিত হল না, তখন তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। ইসমত সসম্মানে ফিরে আসেন সাহিত্য জগতে। ‘লিহাফ’ প্রকাশিত হওয়ার প্রায় প্রায় চল্লিশ বছর পর, তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘কাগজি হ্যায় প্যারিহন’তে ইসমত নিজের জীবনের অনেক কথাই খোলাখুলি আলোচনা করেছেন। এই আত্মজীবনীতে যখন তিনি ‘লিহাফ’-এর বিচারসভার বর্ণনা করছেন, তখন তাঁর লঘু বর্ণনাটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় কতখানি হাস্যকর ছিল মান্টো এবং তাঁর ওপর চাপিয়ে দেওয়া অশ্লীলতার অভিযোগগুলি।

Ismat Chughtai
খুব ছোট থেকেই ইসমত ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী

এই আত্মজীবনীটিতে ইসমত তাঁর জীবন, পারিপার্শ্বিক, তাঁর বড় হওয়া এবং লেখিকা হিসেবে তাঁর পরিণত হওয়ার কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইসমতের এই বইটি সে সময়ের মুসলিম সমাজে মহিলাদের স্থান এবং পর্দাপ্রথা নিয়ে আলোচনা করে। পর্দা সেইসময় যে শুধুমাত্র বহির্জগত থেকে মুসলিম মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার মাধ্যম ছিল তাই নয়, দীর্ঘকাল পর্দা পালন করা মুসলিম মহিলারা ধীরে ধীরে মনের কুঠুরিগুলিতেও পর্দা পরিয়ে নিতে বাধ্য হতেন। ইসমত এই প্রথার ভেতরে ঢুকে তাকে বিশ্লেষণ করেছেন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বললে তার পূর্ণ মূল্যায়ন হয় না। অনিতা দেশাইয়ের কথায় এই জগৎটির সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্টে জুড়ে ছিলেন, ফলতঃ এই সামাজিক নিয়মগুলির ত্রুটি বিচ্যুতির দিকগুলো ছাড়াও এর প্রতি তাঁর একটা তীব্র ভালবাসার জায়গাও ছিল। ইসলামি রক্ষণশীল সমাজে পর্দানশীন মহিলারা তখন পুরোটাই গৃহমুখী। ইসমত যখন নিজে যথেষ্ট রক্ষণশীল পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন, তখনই তাঁর মধ্যে এই স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার প্রতিবাদী মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে, অনেকটা তাঁর উপন্যাস ‘টেরহি লকির’-এর নায়িকা শাম্মানের মতোই।

‘লিহাফ’কে কেন্দ্র করে এই বিচারসভাটি লেখক হিসেবে ইসমতের খ্যাতি আরও বিস্তৃত করে তুলল। ‘লিহাফ’-পরবর্তী জীবনে ইসমতের অন্তত আরও সাতটি ছোটোগল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয়, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘টেরহি লকির’ ছাড়াও অন্তত আরও আটটি বড়, ছোট উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। দুটি ছোটদের উপন্যাস, ছয়টি নাটক ও বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। উর্দু সাহিত্য ইসমতের কাছে ঋণী।

ইসলামি রক্ষণশীল সমাজে পর্দানশীন মহিলারা তখন পুরোটাই গৃহমুখী। ইসমত যখন নিজে যথেষ্ট রক্ষণশীল পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন, তখনই তাঁর মধ্যে এই স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়ার প্রতিবাদী মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে, অনেকটা তাঁর উপন্যাস ‘টেরহি লকির’-এর নায়িকা শাম্মানের মতোই।

অন্যদিকে অমৃতা প্রীতম (১৯১৯-২০০৫) মূলত কবি হলেও সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি একাধারে লিখে গেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ-কাহিনী, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। তিনি এমন একজন সাহিত্য প্রতিভা, যাঁর জীবনও তাঁর সাহিত্যের মতোই ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র। পাঞ্জাবি সাহিত্যিক অমৃতার জন্ম ইসমতের ঠিক চার বছর পর, ১৯১৯ সালের ৩১ আগস্ট, অখণ্ডিত ভারতের গুজরানওয়ালা শহরে, যা অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত। অমৃতার বাবা কারতার সিংহ হিতকারি পেশায় ছিলেন শিক্ষক। সাহিত্য ছিল তাঁর ভালবাসার জায়গা। তিনি ব্রজভাষা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, এছাড়াও ছিলেন সে সময়ের একটি নামকরা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। তিনি একজন শিখধর্ম প্রচারক হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই এক ধার্মিক পারিবারিক পরিবেশে অমৃতার বড় হওয়ার শুরু। কিন্তু এই পরিবেশ অমৃতার ওপর খুব বেশি মানসিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

মাত্র এগারো বছর বয়সে অমৃতা মাতৃহারা হলে বাবার সঙ্গে লাহোরে চলে এসে এক নতুন জীবন শুরু করেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গতা এবং একাকিত্ব হয়ে ওঠে তাঁর নিত্যসঙ্গী। এই সময় থেকেই অমৃতা কবিতা লেখা শুরু করেন। তেরো বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘অমৃত লেহরান’। এর তিন বছর পর তাঁর জীবনে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘ঠান্দিয়ান কিরণ’, আর এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় লাহোরের এক ব্যবসায়ী পরিবারে, প্রীতম সিং-এর সঙ্গে। একদিকে যেমন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি তাঁকে লাহোরের সাহিত্যজগতে একটি শক্তপোক্ত জায়গা তৈরি করে দেয়, অন্যদিকে এই অসফল বিয়েটি অমৃতার পরবর্তী জীবনের রূপরেখা গড়ে দেয়, যে ব্যতিক্রমী গতিপথটি ধরে তিনি এরপর থেকে প্রচলিত সমাজের সমস্ত কিছুকেই প্রশ্ন করবেন। কিন্তু সেও এত সহজে হয়নি, তাঁর জন্যও অমৃতাকে পাড়ি দিতে হয়েছে এক দীর্ঘ জটিল পথ। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে গেছে অমৃতার ছটি কবিতা সংকলন, কিন্তু সেই সময়ের অমৃতা মূলত রোমান্টিক কবি। তাঁর লেখায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায় লাহোরের প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে যোগদানের পর। ক্রমশই তাঁর লেখায় রাজনৈতিক ছাপ পরিস্ফুট হতে থাকে। ১৯৪৩ সালে তাঁর ‘লোক পীর’ কাব্যগ্রন্থটিতে তিনি যুদ্ধবিধস্ত ভারতের ভেঙে পড়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন।

saadat hasan manto
মান্টো

এর পরেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে এসে উপস্থিত হয় এক মর্মান্তিক সময়। দেশভাগের সময়ে শুরু হয় চরম সাম্প্রদায়িক হানাহানি, হত্যা, অগণিত নারী-ধর্ষণ। কোটি কোটি মানুষ নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করে তথাকথিত স্বদেশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। এই বেরিয়ে পড়া শুধু পুরনো পরিচয় হারিয়ে নতুন পরিচয় খুঁজে বেরোবার অভিযান নয়, এ যেন মানব জাতির এক চরম অস্তিত্ব সঙ্কটের সময়। অমৃতা নিজেও এই দেশভাগের প্রত্যক্ষ ভাগিদার। একজন পাঞ্জাবি রিফিউজি হিসেবে তিনিও তাঁর পরিবারের সঙ্গে পাড়ি দেন লাহোর থেকে দিল্লি। দেশভাগের রক্তাক্ত সময়টি ধরা আছে তাঁর ‘পিঞ্জর’ উপন্যাসটিতে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এক হিন্দু নারী পুরু, যাকে সারাজীবনই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই লড়ে যেতে হয়। রশিদ নামে এক মুসলিম যুবক তাকে অপহরণ করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। পুরু নিজের হাতে হামিদা নামটি খোদাই করতে বাধ্য হয়, বাধ্য হয় রশিদকে বিয়ে করে তার পূর্বপরিচয় ভুলতে। পুরুর এর পরের জীবনটি এক নতুন পরিচয় খুঁজে বেড়ানোর গল্প।

অমৃতাও একইভাবে ছিন্নমূল। লাহোর থেকে দিল্লি আসার পরের সময়টিতে তিনি কিছুদিনের জন্য দেরাদুনবাসী হয়েছিলেন। কাজের এবং বাসস্থানের সন্ধানে দিল্লি এসে ফেরার পথে দেরাদুনগামী ট্রেনে বসে তিনি ভয়ানক বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকেন। ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তীব্রভাবে এগিয়ে চলা ট্রেনটিতে বসে অমৃতার মন ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য ছটফট করতে থাকে। লাহোর থেকে নিয়ে আসা একটিমাত্র লাল শালকে দু’টুকরো করে তিনি তাঁর দু ছেলেমেয়ের গায়ে বিছিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মাতৃভূমিকেও কেউ যেন পরনের ওই লাল শালটির মতোই দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। এই তীব্র বেদনায় তাঁর মনে পড়ে সুফি কবি ওয়ারিশ শাহ-এর কথা, যিনি হীর রঞ্ঝা প্রেমগাথাটির প্রণেতা। ওয়ারিশ শাহ-এর উদ্দেশ্যে লেখা অমৃতার দীর্ঘ কবিতা ‘আজি আখান ওয়ারিশ শাহ নু’ বা ‘An Ode to Warish Shah’ তখনই রচিত হয়। এই যুগান্তকারী কবিতাটি সীমান্তরেখার দু দিকের পাঞ্জাবি মানুষদেরই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং যিনি অমৃতার বহু লেখার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, তিনি এ কবিতাটি নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন এই একটি কবিতাই কবি অমৃতাকে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট।      

“Speak from the depths of the grave
to Warish Shah I say
and add a new page to your saga of love today,
once wept a daughter of Punjab
your pen unleashed a million cries
a million daughters weep today
to you Warish Shah they turn their eyes.”

অমৃতা নিজেও এই দেশভাগের প্রত্যক্ষ ভাগিদার

দেশভাগ অমৃতার কাছে সারাজীবনই থেকে গেছে দুঃস্বপ্নের মতো। তাঁর লেখাও তাই অবলীলায় অতিক্রম করে দেশকালের সীমান্ত। শেষজীবন অবধি অমৃতার লেখা ভারত-পাকিস্তান দু দেশেই সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল।

১৯৬০ সালে প্রীতম সিং-এর সঙ্গে তাঁর আইনি বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়। এরপর অমৃতার লেখা প্রবাহিত হতে থাকে এক সম্পূর্ণ অন্য খাতে। তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস ছুঁয়ে যেতে থাকে নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়গুলি। বহু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে নির্দ্বিধায় লিখে তিনি নানারকমের সমালোচনার সম্মুখীনও হন, তার মধ্যে ছিল বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান বা নারী পুরুষের সম্পর্কের বহুমাত্রিক বিন্যাস। আজন্ম ভালবাসার সন্ধানী অমৃতা তাঁর লেখায় বারেবারে প্রেম, সম্পর্ক, স্বাধীনতা, মুক্তির সংজ্ঞাকে ভেঙেচুরে এমন এক নতুন রূপ দিয়েছেন, যা ছিল তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। তিনি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির অকুণ্ঠ সমালোচনা করেছেন এবং নিজে এক দীর্ঘ জীবন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না থেকেও কাটিয়ে গেছেন শিল্পী ইমরোজের সঙ্গে। তাঁর জীবন ছিল তাঁর কবিতার মতোই স্বচ্ছ। অমৃতা তাঁর কবিজীবনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন,     

“There was a pain
I smoked it like a cigarette
And a few poems I flicked off
Like ashes from a cigarette”

প্রচলিত সামাজিক অচলায়তনগুলির বিরুদ্ধাচারণের মধ্য দিয়েই মূলত অমৃতা ও ইসমতের লেখনীর বন্ধুত্ব, কিন্তু তা ছাড়া আরও একটি বৃহত্তর ক্ষেত্র আছে। নারীমনের গভীর, গোপন ও সূক্ষ্ম অনুভূতির গলিপথে অনায়াসে বিচরণ করেছেন তাঁরা দুজনেই। যে কথা কখনও বলা হয়নি, সে কথা নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন, যা সাহিত্যে আপাত-নিষিদ্ধ হয়ে ছিল তাকে পাঠক মননে জায়গা করে দিয়েছেন। যেখানে ইসমত ছোট ক্যানভাসে অল্প পরিসরে তুলে ধরেছেন নারীমনের বিভিন্ন আঙ্গিক, সেখানে অমৃতা তাঁর বলিষ্ঠ কাব্যিক ভাষায় নারী জীবনের নানা পাওয়া না-পাওয়া, না বলতে পারা কথা সম্পর্কে অসংকোচে আলোচনা করেছেন তাঁর কবিতায়, তাঁর উপন্যাসে।

আজন্ম ভালবাসার সন্ধানী অমৃতা তাঁর লেখায় বারেবারে প্রেম, সম্পর্ক, স্বাধীনতা, মুক্তির সংজ্ঞাকে ভেঙেচুরে এমন এক নতুন রূপ দিয়েছেন, যা ছিল তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। তিনি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির অকুণ্ঠ সমালোচনা করেছেন এবং নিজে এক দীর্ঘ জীবন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না থেকেও কাটিয়ে গেছেন শিল্পী ইমরোজের সঙ্গে। তাঁর জীবন ছিল তাঁর কবিতার মতোই স্বচ্ছ।

ইসমতের গল্পগুলির মধ্য দিয়ে আমরা ১৯৪০-৭০ সালের ভারতীয় মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থান, তাঁদের প্রতিকূল সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করতে পারি। একজন প্রতিবাদী নারী সাহিত্যিক হিসেবে নারীমুক্তি ও নারী-স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি, নারী পুরুষের সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখেছেন, অকুণ্ঠ সমালোচনা করেছেন পর্দাপ্রথার, নারী মনের অবদমিত কামনা বাসনার কথাও নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন তাঁর গল্পে। এক কথায় উর্দু সাহিত্যকে সাবালক বানিয়েছেন তিনি। ইসমতের যুদ্ধ অবশ্যই সামাজিক প্রেক্ষিতের বিচারে অমৃতার তুলনায় কঠিন, কেননা তিনি উর্দু সাহিত্যজগতে প্রথম প্রতিবাদী মুসলিম নারী। যে সময়ে দাঁড়িয়ে ইসমত সমকামিতা, পর্দাপ্রথা নিয়ে কলম ধরেছেন সে সময়ে কোনও নারীর এত বলিষ্ঠ কলম উর্দু সাহিত্যজগতে অভাবনীয় ছিল। বহু বিতর্ক, বহু সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন ইসমত, কিন্তু মত প্রকাশে কোথাও পিছপা হননি।  

Amrita Pritam
অমৃতার লেখা ভারত-পাকিস্তান দু দেশেই সমানভাবে সমাদৃত হয়েছিল

ইসমতের ছোটগল্প ‘তিল’-এ আমরা রানীর মতো এক গ্রাম্য, লাস্যময়ী নারী চরিত্র পাই যার শরীর নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ নেই, সে যুবতী এবং নির্দ্বিধায় নিজের শারীরিক চাহিদা প্রশমনের জন্য একাধিক সঙ্গীকে আহ্বান করে। স্তন-সংলগ্ন তিলটি তার শরীরী বিভঙ্গে এক নতুন মাত্রা জোড়ে। তিলটি এই গল্পে যৌনতার এক জোরালো প্রতীক। আর একটি গল্প ‘ঘরওয়ালি’ ইসমতের একটি বহুচর্চিত গল্প যেখানে মির্জা তার বাড়ির চাকরানি লাজোর সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হয়। লাজোকে ভালো মেয়ে বানানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা মির্জাকে পাঠকদের চোখে এক হাস্যকর চরিত্রে পরিণত করে। মির্জা সেই পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি যেখানে পুরুষ অবলীলায় বহুগামী হতে পারে, কিন্তু নারীকে মনপ্রাণ দিয়ে তার শরীরের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হয়। বিবাহ এই গল্পে এসেছে আবেগশূন্য এক প্রথা হিসেবে, যা শুধুই পুরুষের শরীরী অধিকার ফলানোর একটি হাতিয়ার।

ইসমতের ‘ভোকেসন’ গল্পটি দেহব্যবসা নিয়ে, তথাকথিত ভালো এবং খারাপ মেয়েদের মধ্যেকার সূক্ষ্ম সীমারেখা নিয়ে। এই সীমারেখা সমাজ তৈরি করে, যে সমাজের একটি বড় অংশ সেইসব নারীরা যারা নিজেরাই পাঁচিল তুলে দেয় তথাকথিত ভালো মেয়ে এবং খারাপ মেয়েদের মধ্যে। ‘চৌথি কা জোড়া’ একজন গরীব বিধবার গল্প যে তার দুই মেয়ে, কুব্রা আর হামিদার মধ্যে অসুন্দর মেয়েটির বিয়ের জন্য বেশি ব্যস্ত হয়। কিন্তু বিভিন্ন আশ্চর্য কার্যকারণে কুব্রার বিয়ে বারেবারে আটকাতে থাকে। তার নিজের চাচাতো ভাই রাহাত যখন তাদের বাড়ি থাকতে আসে, তখন সবাই তাকে কুব্রার সম্ভাব্য স্বামী হিসেবে প্রচুর পরিমাণ যত্নআত্তি করতে থাকে। শেষে রাহাতও যখন তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে কুব্রার মা দুঃখ প্রকাশ করে জানায় সুন্দর মুখ আর ফরসা গায়ের রং না হওয়ার কারণেই সে বারেবারে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। কেননা গায়ের রং আর সৌন্দর্যের মাপকাঠিতেই সমাজে মেয়েদের নারী হিসেবে দর বাড়ে আর কমে। তাই চিরকালীন সত্য। কুব্রা, হামিদাদের সমাজে তাইই অবশ্যম্ভাবী। রাহাত কুব্রাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলেও তার বোন হামিদার সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হয়, সে অধিকারও পুরুষ হিসেবে তার প্রাপ্য। গল্পটি শেষ হয় যখন রাহাত ফিরে যাওয়ার পরে কুব্রাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।সে টিবি রোগে ভুগছিল, আর যেন তাকে সমবেদনা জানানোর জন্যই তার শরীরে জড়ানো ছিল তার চৌথির জোড়াটি।

ইসমতের লেখা একটি অপ্রকাশিত গল্প ‘গরম হাওয়া’ একটি বহু সমাদৃত হিন্দি ছবি যার বিষয় দেশভাগ। এ ছবির গল্প দানা বেঁধেছে এক উত্তর ভারতীয় মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারে, যার প্রধান সেলিম মির্জা দেশভাগের পর, ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর, পরিবার সহ পাকিস্তান চলে যাওয়া নিয়ে মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। এ ছবিটি দেশভাগের ওপর এক প্রামাণ্য চিত্রকথা। দেশভাগের সরাসরি শিকার না হলেও ইসমতের বহু লেখায় উঠে এসেছে দেশভাগের যন্ত্রণার ইতিহাস। ইসমত ও অমৃতা দুজনেই এমন একটা সময়ের প্রতিনিধি যে সময় ভারতবর্ষ এক তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অমৃতা দেশভাগের প্রত্যক্ষ শিকার, ইসমত পরোক্ষ। ইসমতকে নিজের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে হয়নি বটে, কিন্তু দেশভাগের সময় ভিটেমাটিহারা কোটি কোটি মানুষের হাহাকার তিনি নিজের অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করেছিলেন। তাঁর একটি ছোটগল্প ‘জড়ে’ বা শিকড়, যেখানে আমরা এক বৃদ্ধা মহিলাকে পাই যিনি নিজের দেশ ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তান যেতে চান না, কারণ ‘দেশভাগ’ কথাটির অর্থই তাঁর বোধগম্য নয়। এই গল্পের আম্মা সে সময়ের অনেক পরিবারেরই মা বা আম্মা, যারা কাগজে কলমে একটা দেশকে কেটে ফেলে, দু টুকরো করে দুটি দেশ তৈরির সত্যকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে উঠতে অনেক সময় নিয়েছিলেন। কেউ কেউ আদৌ বিশ্বাস করে উঠতেই পারেননি।

Ismat front face
ইসমত ও অমৃতা দুজনেই এমন একটা সময়ের প্রতিনিধি যে সময় ভারতবর্ষ এক তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে

অমৃতার উপন্যাস ‘পিঞ্জর’-এর প্রধান চরিত্র পুরুও তার নিজের অস্তিত্বহীনতার সাথে দেশভাগের শিকার অসংখ্য অসহায় নারীর ছিন্নমূল হওয়ার বেদনাকে এক করে ফেলেছিল। নিজের জীবন বিপন্ন করে সে এক মুসলিম পরিবারের হাতে বন্দি হয়ে থাকা তার ভাইয়ের স্ত্রী লাজোকে উদ্ধার করে এনে লাহোরে পৌঁছে তুলে দেয় তার ভাইয়ের হাতে। গন্তব্যে পৌঁছনো যে কোনও নারীর আত্মাই তার নিজের অন্তরাত্মা। এ কথাটি শুধু পুরুর নয়, অজস্র গন্তব্যে পৌঁছোতে পারা এবং না-পারা নারীর অন্তরের কথা। অমৃতার নিজেরও।

অমৃতার পরিণত বয়সের কবিতা, উপন্যাসগুলি অনেক বেশি বৈপ্লবিক এবং বিতর্কিত। ইংরেজিতে অনূদিত অমৃতার একটি কবিতা ‘ভার্জিন’, এর বিষয়বস্তু নারীসত্ত্বার সংকট। জন্ম থেকেই নারী জীবন যেন কুমারীত্ব হারিয়ে তথাকথিত নারীত্ব লাভের জন্য বলিপ্রদত্ত। নারী আজন্ম এক দ্বৈত পরিচয়ের বাহক।   

“I was not one but two persons
Ones marriage had
consummated and complete
the other had remained a chaste
virgin”

অকপটে নারীর মানসিক ও শারীরিক চাহিদা নিয়ে কথা বলেছেন অমৃতা তাঁর কবিতায়, তাঁর গল্পে। তাঁর আরেকটি কবিতা ‘ফার্স্ট বুক’, যেখানে নারী-পুরুষের শারীরিক চাহিদা সামাজিক বাঁধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে পবিত্র অপবিত্রতার সীমা অতিক্রম করে। তাঁর কবিতা এবং গল্প নিরন্তর সন্ধান করে গেছে নারীত্বের এক নতুন সংজ্ঞার। তাঁর ‘নাইট’ বা ‘রাত’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক…

“Night
Half here
Half there,
In the gaslight, I don’t know
Under which rooftop
You must be waiting
With each and every gulp,
With each and every bill,
With each and every beautiful
Face
You-yes, you! You- 
Oh, the father of  
My unborn child!”

এ কবিতায় বক্তা একজন নারী, কিন্তু তাঁর পূর্ণ পরিচয় আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ, তিনি একজন স্বামী বা প্রেমিক-পরিত্যক্তা সন্তানসম্ভবা নারী, বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত, যিনি তাঁর মদ্যপ প্রেমিকের ফিরে আসার অপেক্ষায় তাঁর পৈতৃক গৃহেরই ছাদের নীচে অপেক্ষারত। এ নারী যে সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন সে সন্তান কাঙ্ক্ষিত না অনাকাঙ্ক্ষিত সে প্রশ্ন আমাদের মনে রয়েই যায়।

অমৃতার প্রথম উপন্যাস ডঃ দেব আবারও একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এ উপন্যাসের নায়িকা যখন তার প্রথম প্রেমিক ও অবৈধ সন্তানের কথা তার স্বামীকে জানায় তখন স্বাভাবিক কারণেই তাকে স্বামীবিচ্ছিন্না হতে হয়। কেননা সমাজ সেটাই গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেবে।

Amrita Pritam Old age
অমৃতার পরিণত বয়সের কবিতা, উপন্যাসগুলি অনেক বেশি বৈপ্লবিক এবং বিতর্কিত

সামাজিক বন্ধনের সঙ্গে অমৃতার এই নিরন্তর যুদ্ধ তাঁর লেখাকে পৌঁছে দেয় এক অন্য মাত্রায়। যদিও বহু যুদ্ধজয়ের পর তিনি জানিয়েছিলেন তিনি যখন সাহিত্য অকাদেমি সম্মান পান তখন দিল্লির এক নামকরা ইংরেজি দৈনিক লিখেছিল তাঁর খ্যাতির পেছনে মূল কারণ তাঁর যৌবন ও সৌন্দর্য্য। দুঃখিত অমৃতা বলেছিলেন, মানুষ নারীর সৌন্দর্য্যকে যেভাবে সম্মান জানাতে পারে, প্রতিভাকে সেভাবে নয়।

১৯ টি কাব্য সংকলনের জন্ম দিয়েছেন অমৃতা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘সুনেহরে’, ‘কাগজ তে ক্যানভাস’, ‘কস্তুরী’, ‘নাগমণি’ ইত্যাদি। দশটি উপন্যাস, তিনটি ছোটগল্প, অন্তত তিনটি আত্মজীবনীমূলক লেখা তিনি লিখেছেন। নিজের কবিজীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে তিনি কোনও তফাত রাখেননি। উর্দু কবি সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে প্রেমের আখ্যান তিনি নিজেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘রশিদি টিকিট’ বইটিতে। এ বইটি অনেকাংশেই তাঁর দিনলিপি, টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা। অনেক জায়গাতেই সুসংবদ্ধ নয়, ঠিক যেন একটি ডাকটিকিটের অ্যালবামের পাতাগুলি অন্যমনে উলটিয়ে চলা। সামান্যর মধ্য দিয়ে তিনি বলে গেছেন এক অসামান্য জীবনকথা।

ইসমত ও অমৃতা দুজনেই সারা জীবন অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁদের গল্প কবিতা। কিন্তু তারপরও তাঁদের শ্রেষ্ঠ সম্মান মানুষের ভালবাসা। যে শক্তপোক্ত জমি পরবর্তী নারী সাহিত্যিকদের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁরা, সে জমির ওপর দাঁড়িয়েই স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত আজ অসংখ্য বলিষ্ঠ নারী লেখনীর সাক্ষী। এই দুই ব্যতিক্রমী নারীর কাছে ভারতীয় সাহিত্য আজীবন ঋণী থেকে যাবে।

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, WikiBio, Firstpost

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *