১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর, পুজোর সময় একই দিনে মুক্তি পেল পাঁচটা বাংলা ছবি। ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ‘সুবর্ণরেখা’— অভিনয়ে মাধবী মুখোপাধ্যায়, অভি ভট্টাচার্য্য। পার্থপ্রতিম চৌধুরীর পরিচালনায় ‘দোলনা’— অভিনয়ে তনুজা, নির্মল কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু দে। বিশ্বজিৎ, বসন্ত চৌধুরী ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘গুলমোহর’— পরিচালনা কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। অগ্রদূতের ‘সূর্যতপা’— অভিনয়ে উত্তম কুমার, সন্ধ্যা রায়। আর বিজয় বসুর পরিচালনায় ‘রাজা রামমোহন’। যার নামভূমিকায় বসন্ত চৌধুরী।

প্রেক্ষাগৃহে সেই সময় সবচাইতে বেশি চলেছিল ‘রাজা রামমোহন’, একটানা ১৩ সপ্তাহেরও বেশি। উত্তমকুমারের ছবিকেও বক্সঅফিসে হার মানায় এই ছবি সে বছর। সবার মনে তখন একটাই নাম বসন্ত চৌধুরী। 

বাংলা ছবিতে, ছবি বিশ্বাসের পর, ক্লাস কী জিনিস বুঝিয়ে দিলেন বসন্ত চৌধুরী। তিনি যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছিলেন রাজা রামমোহন রায় রূপে। এমন অবিকল ‘রামমোহন’ আর কেউ হতে পারেননি, হতে পারবেনও না। বসন্ত চৌধুরী যেন রামমোহন রায়ের আরেক নাম। ঐ দৃঢ়চেতা ব্রাহ্ম ব্যক্তিত্ব, সুপুরুষ চেহারা, সঙ্গে আভিজাত্যের মিশেল— এমনটা বসন্ত চৌধুরীই আনতে পেরেছিলেন। আসলে বসন্ত চৌধুরী যতখানি বাঙালি, ততখানি সাহেবও। তাই সবটাই তাঁর হাতের মুঠোয় থাকত। জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চেও ‘রাজা রামমোহন’ সেরা বাংলা ছবির শিরোপা পায় এবং বিএফজেএ-তে সে বছর সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান বসন্ত চৌধুরী।

‘রাজা রামমোহন’ ছবির পরিচালক বিজয় বসুও স্বর্ণপদক পান জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে। কিন্তু বিজয় বসুর মতো সোনার মেডেল পাওয়া পরিচালককে না মনে রেখেছে বাংলা ছবির জগৎ, না মনে রেখেছেন দর্শকরা। প্রাপ্য সম্মান পাননি ‘রাজা রামমোহন’, ‘ভগিনী নিবেদিতা’র ছবির পরিচালক। 

Award ceremony Basanta Chowdhury

উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে চিরকাল বাঙালি দুভাগে বিভক্ত হয়ে তর্কের আসর জুড়লেও উত্তমকুমারের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী শুরুর দিকে ছিলেন কিন্তু বসন্ত চৌধুরী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব তো অনেক পরে। উত্তমকুমার ‘ফ্লপমাস্টার’ তকমা পেয়ে স্ট্রাগল করছেন যখন, ততদিনে বসন্ত চৌধুরীর আধ্যাত্মিক অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছে জনমানসে।

বসন্ত চৌধুরী জমিদার বা মনীষীদের চরিত্রে যে এত ভালো মানিয়ে যেতেন তাঁর আরেকটি কারণ বোধহয় জমিদার বংশের রক্ত তাঁর শরীরে ছিল। আন্দুলের দত্তচৌধুরী বংশের ছেলে তিনি। কিন্তু কখনও সেই পারিবারিক পরিচয়ের কথা তিনি কোথাও প্রচার করেননি। পদবীতেও শুধুই চৌধুরী। তাঁর পূর্বপুরুষরাই দত্ত পদবী ঝেড়ে ফেলে শুধু চৌধুরী হন এবং তাঁরা নাগপুরে বসবাস শুরু করেন। বসন্তর জন্ম নাগপুরে, ৫ মে ১৯২৮। 

মাত্র তেরো বছর বয়সে বসন্ত চৌধুরীর পিতৃবিয়োগ ঘটে। নাগপুরের দীননাথ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হন। কলেজ পাশ করার পর ২২ বছর বয়সে উড়নচণ্ডী হয়েই বসন্ত কলকাতায় অভিনয় করতে আসার তাগিদবোধ করলেন। চাকরি নয়, অভিনয়ই করবেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি। চলে এলেন কলকাতা। অচেনা শহরে স্ট্রাগলের পর স্ট্রাগল। তবে সিনেমার নায়ক হওয়ার মতো সুদর্শন চেহারা ছিল বলে প্রযোজক পরিচালকদের চোখে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। যে ছবি দিয়ে বসন্ত চৌধুরীর রুপোলি পর্দায় আবির্ভাব তা ছিল ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। তাঁর বিপরীতে ছিলেন নবাগতা অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। ছবির পরিচালক কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। বসন্ত ও অরুন্ধতী, দুজনেরই চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ এই ছবি দিয়ে। দেবদূতসম রূপবান নায়ক পর্দা আলো করে এলেন যেন। সালটা ১৯৫২। 

একই সময় রিলিজ করছে উত্তমকুমারের ‘বসু পরিবার’। উত্তমের ছবি হিট হলেও বসন্তর জন্য দর্শক উন্মাদনা তখন অনেক অনেক বেশি।

Mahaprasthaner pothe Cover and back cover

আচার্য দেবকী কুমার বসু চৈতন্যদেবের জীবনী নিয়ে ছবি করছেন ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। চৈতন্যের ভূমিকায় কাকে মানায়, তার খোঁজ চলছে। দেবকী কুমার বসুর সুযোগ্য পুত্র দেব কুমার বসুর বয়স এখন নব্বই ছুঁই ছুঁই, স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি জানালেন “’ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে চৈতন্য চরিত্রের জন্য আমার বাবা (দেবকী কুমার বসু) বেশ কয়েকজন অভিনেতাকেই দেখেছিলেন। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন উত্তমকুমার। উত্তমকুমার তখনও স্টারডম পাননি। চৈতন্য হতে মাথা ন্যাড়া হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল, কিন্তু উত্তমকুমার ন্যাড়া হতে চাননি। বোধহয় ওঁর অন্য ছবির শ্যুটিং ছিল। তাছাড়া তখন উত্তমকুমারের যা চেহারা, সেটা চৈতন্য রোলের জন্য আইডিয়াল ছিল না। তাই তিনি বাদ যান। সবার মধ্যে থেকে বসন্ত চৌধুরীকেই বাবা ‘নিমাই’ রূপে নির্বাচন করলেন কারণ বসন্তর চেহারার মধ্যে সৌম্য অপাপবিদ্ধ ভাব ছিল। বসন্ত ন্যাড়া হয়েছিলেন। তবে বসন্ত চৌধুরী অভিনয় করার সময় একটু বেশি হেলতেন, যা তাঁকে ক্যামেরার ফ্রেম থেকে বের করে দিত। এই ব্যাপারটা প্রমথেশ বড়ুয়ার মধ্যেও ছিল। উনি বেশি হাত তুলে নাটকীয়ভাবে কথা বলছিলেন ‘অপরাধী’ ছবিতে। বাবা প্রমথেশ বড়ুয়ার হাতে একটা ডাণ্ডার বাড়ি মেরেছিলেন। বসন্ত চৌধুরীকে দেবকী বসু বলেন, তোমার চারপাশে পেরেক মেরে রাখব যাতে তুমি হেললেই পেরেক তোমার পায়ে ফোটে। বসন্তবাবুকে বাবা দুটি শর্ত দেন, নিমাই করার সময় তাঁকে সবসময় নিরামিষ খেতে হবে এবং আধ্যাত্মিক বইপত্র পড়ে ভাবের মধ্যে থাকতে হবে। বসন্ত চৌধুরী মেনেছিলেন সেই শর্ত। দেবকী বসু ছিলেন শিক্ষক গুরুর মতো। আমার সবথেকে ভালো লেগেছিল যে দৃশ্যে ‘নিমাই’ বসন্ত চৌধুরীর চোখের জল পড়ছে কৃষ্ণের পাদপদ্মের উপর। গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্য। আর সুচিত্রা সেনকে দেবকী বসুর কাছে নিয়ে এসেছিলেন পাহাড়ি সান্যাল।”

script reading- Basanta Chowdhury, Suchitra Sen
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছবির চিত্রনাট্য পড়ছেন দেবকী বসু শুনছেন বসন্ত ও সুচিত্রা। ছবি - দেবাশিস বসু

‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ যেমন সুপারহিট করল, তেমন আধ্যাত্মিক জগতেও এই ছবি আলোড়ন ফেলল। কিন্তু বসন্ত-সুচিত্রা জুটিকে নিয়ে খুব বেশি পরিচালক আর ভাবলেন না। দেবকী বসুই আবার বসন্ত-সুচিত্রাকে নিয়ে বানালেন ‘ভালোবাসা’ ছবি। সুশীল মজুমদার একই জুটিকে নিয়ে বানালেন ‘শুভরাত্রি’। কিন্তু রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে ততদিনে জনপ্রিয়তার শিখরে উত্তমকুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটির ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’ যেন আধুনিক রোম্যান্টিক যুগের সূচনা করল। বলতে গেলে, বসন্তের থেকে সুচিত্রাকে ছিনিয়েই নিলেন জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা উত্তমকুমার।

কিন্তু বসন্ত ও উত্তমকুমারের বন্ধুত্ব কখনও নষ্ট হয়নি। পরবর্তীকালে সুচিত্রা সেন যখন উত্তমকুমারকে ছাড়া একক গরিমায় ছবি করতে চেয়েছেন তখন তিনি বসন্তর হাত ধরেছেন। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবির দেবাশিস, এক উন্মাদের চরিত্রে চোখের এক্সপ্রেশনে বসন্ত অনবদ্য। আবার ‘মেঘ কালো’ ছবিতে পরিণত বয়সের ডাক্তার ‘কুন্তল’ বসন্ত। দেবী চৌধুরাণী সুচিত্রার ডাকাতগুরু রূপে বসন্ত চৌধুরী যা অভিনয় করেছেন তার তুলনা হবে না। 

কানন দেবীর শ্রীমতী প্রোডাকশনের ব্যানারে কানন দেবীর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে নিয়ে সুপারহিট ছবি করেছেন ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’। এরপর হরিদাস বানালেন ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’। কিন্তু এবার শ্রীকান্ত চরিত্রটি উত্তমকুমার করলেন না। উত্তমকুমারের বক্সঅফিস মাথায় রেখে হরিদাস নায়ক হিসেবে ভাবলেন বম্বের গুরু দত্তকে। এদিকে গুরু দত্ত নিজের স্ত্রী গায়িকা গীতা দত্তকেই ‘অভয়া’র ভূমিকায় চাইলেন। কিন্তু হরিদাস গীতা দত্তকে নায়িকা করতে সম্মত হলেন না। ইতিমধ্যেই গুরু দত্তর অকালপ্রয়াণে ছবির ভাবনা শিকেয় উঠল। শেষমেশ বসন্ত চৌধুরীকে ‘শ্রীকান্ত’ চরিত্রে নির্বাচন করেন হরিদাস। আর অভয়া চরিত্রে বম্বের মালা সিনহা। ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ বসন্ত ও মালার অভিনয়ের সেরা পারফরম্যান্স হয়ে রইল। 

Abhaya Srikanta movie

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতে “বসন্তদা মানুষ হিসেবে তুলনাতীত। অভিনেতা হিসেবেও অনেক বড়। কিন্তু বসন্তদা নিজেকে ভাঙেননি কখনও উত্তমদার মতো। তাই রোম্যান্টিক অভিনয়ে কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন।”

সাবিত্রীর কথা ধরেই মনে পড়ছে ‘মেমসাহেব’ ছবিতে উত্তম-অপর্ণার দৃশ্য। অপর্ণা সেন উত্তমকুমারের ছেলে গৌতমের বয়সী। কিন্তু ‘মেমসাহেব’ দেখে সেটা বোঝার উপায় আছে? অপর্ণা উত্তমকে বলছেন “কোথায় ভোর পাঁচটার সময় উঠে পড়াশোনা করতে বসবে তা না করে বেলা দশটা অবধি ঘুমোচ্ছ! তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না বড় সাংবাদিক হওয়া।”
তখন উত্তম দুষ্টুমির সুরে বলছেন “তাহলে ভোর না হতে উঠে কর্পোরেশনের যে লোকগুলো রাস্তার বাতি নেভায়, তাদের খুব উন্নতি হবে, বলছ?”

এই যে দুষ্টুমিতে রোম্যান্টিকতা মিশিয়ে দেওয়ার ম্যাজিক, এ শুধু উত্তমকুমারই পারতেন। কিন্তু বসন্ত চৌধুরীর মধ্যে এক অন্যরকম রাজকীয় আভিজাত্য ছিল বলেই তিনি উত্তমের পাশে থেকেও বাংলার দর্শকের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালবাসা পেয়েছেন। বসন্তর বসার ভঙ্গি, পাইপ ঠোঁটে রাখার আর্ট কিংবা বই পড়তে পড়তে বন্ধ করলে একটা আঙুল বইয়ের মাঝে পেজ-মার্কার হিসেবে ঢুকিয়ে রাখা, এসব আভিজাত্যের প্রকাশ শুধু তিনিই পেরেছেন। 

নায়ক হতে বম্বে গেছিলেন বসন্ত চৌধুরী। করেওছেন বেশ কিছু হিন্দি ছবি। ওঁর প্রথম ডেবিউ ছবি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘যাত্রিক’ নামে হিন্দি রিলিজ ট্রাভেল ফিল্ম। ‘নবীন যাত্রা’তে উত্তম কুমার আর বসন্ত চৌধুরী একসঙ্গে প্রথম কাজ করলেন। কিন্তু নায়ক বসন্ত-ই। নায়িকা মায়া মুখার্জি। এই ‘নবীন যাত্রা’-র হিন্দি রিমেক হল বলিউডে ‘নয়া সফর’। একই পরিচালক। সেই ছবিতেও নায়ক বসন্ত। অন্যদিকে হিন্দি উচ্চারণ খারাপ বলে হিন্দিতে জায়গা হল না উত্তমের। বিমল রায়ের ‘পরখ’ ছবিতে সাধনার সঙ্গে জুটি বাঁধেন বসন্ত চৌধুরী। হিন্দি ছবি ‘পরখ’-এ  অভিনয় করে বসন্ত চৌধুরীর পারিশ্রমিক টালিগঞ্জ পাড়ায় এক লাফে বেড়ে গেল। কিন্তু বম্বেতে পাকাপাকি না থেকে বাংলা ছবিতেই নিজের সাম্রাজ্য গড়তে ফিরে এলেন বসন্ত চৌধুরী।

বসন্ত চৌধুরীর আরও কিছু উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবি— ‘যদুভট্ট’, ‘আঁধারে আলো’, ‘বসন্ত বাহার’, ‘শ্রেয়সী’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র সত্যবতীর বাবাকে ভুলি কী করে? ঋতুপর্ণ ঘোষ জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে বসন্ত চৌধুরীকে ডিরেকশন দেন তাঁর ‘হীরের আংটি’ ছবিতে। বনেদি বাড়ির কর্তা বসন্তকেই মানায়। 

আরও পড়ুন: এই বসন্তে

বসন্ত চৌধুরীর কণ্ঠে ‘বালিকা বধূ’ ছবি থেকে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’ ১৯৭৬ সালে আকাশবাণীর মহালয়া অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ব্যবহার করেছিলেন। বসন্ত আবৃত্তি করলে তাতে থাকত নাটকীয়তা। রেডিও নাটকেও তিনি অনন্য। 

মঞ্চ নাটকেও তিনি সমান সফল। ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘বিপ্রদাস’,’দেনা পাওনা’— একাধিক নাটক করেছেন। তাঁর অভিনীত ‘কালবৈশাখী’, ‘ক্ষুধা’ ও ‘পরমা’ নাটক ৫০০ রজনী চলেছিল।

‘পরমা’র সময় প্রতি বৃহস্পতি, শনি, রবিবারের আগে পরিচালক সুভাষ বসুর বাড়িতে এসে পুরো নাটকটা একবার রিহার্সাল করে যেতেন বসন্ত চৌধুরী। সে ৫০০ রজনী পার করার পরেও। ‘শ্রেয়সী’ নাটকেও তিনি স্মরণীয়। যাত্রা করেছিলেন দুটো সিজন, সেখানেও সফল। বসন্ত চৌধুরী নিজেকে ফিল্মস্টার বলে জাহির করতেন না। তাঁর দরজা সবার জন্যই খোলা। এমন মুক্তচিন্তার মানুষ বলেই তিনি হতে পেরেছিলেন কলকাতা শহরের জনপ্রিয়তম ‘শেরিফ’।

Basanta Chowdhury black and white image

মানুষ বসন্ত কেমন লোক ছিলেন? 

নব্বই দশকের বরেণ্য পরিচালক অমল রায় ঘটক জানালেন “পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সঙ্গে আমার জীবনের শুরুর দিনগুলো কেটেছে। পার্থপ্রতিমদা আমায় নিয়ে গেলেন একদিন বসন্ত চৌধুরীর বাড়ি। গিয়ে দেখলাম বসন্তদা একটি মঞ্চ নাটকে কীভাবে অভিনয় করবেন সেটা পার্থপ্রতিম চৌধুরীর থেকে শিখছেন, যে বসন্তদার থেকে অনেক জুনিয়র। ভেবে অবাক হলাম, যে মানুষটি ‘যদুভট্ট’, ‘সুশান্ত শা’-র মতো ছবিতে কঠিন কঠিন চরিত্র করেছেন সে এতটাই ছাত্রের মতো বসে পার্থপ্রতিমের কাছে অভিনয় শিখছেন। শিশুর মতো শিখছেন তিনি। 

বসন্তদা বাড়িতে একটা কচ্ছপ পুষেছিলেন। সেই কচ্ছপটা অতিথি কারা এল দেখে আবার ঘরে ঢুকে যেত। বেশ মজার! 

যেটা স্মরণীয় সেটা বলি, তখন আমার ‘কাচের পৃথিবী’ ছবি করছি। ছবিতে বাবার চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ভেবেছি। তখন উত্তমকুমার-পরবর্তী জমানায় সব ছবিতেই প্রায় সৌমিত্রদা একজন বক্স অভিনেতা ছিলেন। আমার ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন অনিল গুপ্ত ও জ্যোতি লাহা, স্বর্ণযুগের ক্যামেরাম্যান জুটি। সুচিত্রা সেনের মুখ সবথেকে সুন্দর হয়ে উঠত যাদের ক্যামেরার জাদুতে। অনিল গুপ্ত আমায় নিয়ে গেলেন সৌমিত্রদার বাড়ি। সৌমিত্রদা বললেন ‘কেন করব না? এখন আমি ভাল ছবি দুএকটা করি। বাদবাকিগুলো রোজগার! চরিত্র কোনও ফ্যাক্টর নয় আমার কাছে। ছ হাজার টাকা পার ডে নিই!’

তখন আমি স্পষ্ট জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে বললাম ‘না সৌমিত্রদা আমার ছবির জন্য আপনাকে দরকার নেই। আপনার কাছে তো চরিত্রটা দরকারি নয়, টাকাটাই ফ্যাক্টর। কিন্তু আমার কাছে চরিত্রটাই ফ্যাক্টর। যার জন্যই আপনার কাছে আসা।’ অনিলদা বেড়িয়ে বললেন ‘ঠিক করেছ, ঠিক করেছ!’ আমি তখন হতাশ কিছুটা। তখন অনিল গুপ্তই বললেন ‘বসন্তরে দিয়া হয় না?’ আমি লাফিয়ে উঠে বললাম ‘হয় তো! প্রযোজককে বলি।’ প্রযোজকও রাজি হলেন। আমি আর অনিলদা গেলাম বসন্ত চৌধুরীর বাড়ি। বসন্তদা বললেন গল্প বল, চরিত্র বল, এসব নিয়ে এক ঘণ্টা আলোচনা করলেন। টাকার কথা তুলতে বসন্তদা বললেন “দেখ, পার ডে কথাটা শুনতে আমার ভালো লাগে না। কেমন লেবার লেবার মনে হয়। শ্রমিক মজুরদের মতো মনে হয়। আমি থোক টাকা নেব। দিন দশেক কাজ হলে হাজার বিশেক টাকা দিস।” বসন্তদাকে ফাইনাল করে আমি মহানন্দে বেরিয়ে এলাম। বসন্তদার ভিতর টাকা-টাকা ব্যাপারটা অতটা ছিল না। ‘কাচের পৃথিবী’র অভিজাত বাবার চরিত্রেও বসন্তদা দারুণ মানিয়ে গেলেন। বহুচর্চিত সৌমিত্রদার থেকে বরং বেশি দর্শকধন্য হলেন বসন্তদা।”

Basanta Chowdhury

বসন্ত চৌধুরী বিরল শাল সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি শাল রাখতেন অতি যত্নে, যা নিজের অভিনয় করার সময়ও খুব নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে বিশেষ ব্যবহার করেননি। এছাড়াও ছিলেন দেশ বিদেশের মুদ্রা সংগ্রাহক ও গণেশ মূর্তি সংগ্রাহক। সংগৃহীত গণেশ মূর্তি তিনি কলকাতা যাদুঘরে দান করে গেছিলেন। শালের কালেকশন তাঁর দুই পুত্রের তত্ত্বাবধানে আছে। 

বসন্ত চৌধুরীর পরিবার নিয়ে বলতে গেলে তাঁর স্ত্রী ছিলেন অতি সুন্দরী, আধুনিকা অলকা চৌধুরী। কিন্তু সুখের সংসার হয়নি। দুই ছেলে হওয়ার কিছুদিন পর অলকা ও বসন্তর ডিভোর্স হয়ে যায়। বসন্ত চৌধুরী একাই নিজ হাতে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমনকী বসন্ত চৌধুরীর জীবনে মহিলাঘটিত কলঙ্কের কালিমা কখনও লাগেনি। বিচ্ছেদের পর আর কখনও কোনও নারীর আঁচলে বাঁধা পড়েননি। একা এক সাহেব যেন তিনি। নিজের বিবিধ চর্চায় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।

Basanta Chowdhury2

মাধবী মুখোপাধ্যায় বললেন “বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করার সময় কখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। বরং উনি আমাকে নিরাপদে রাখতেন। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমকুমার নন, বসন্তবাবুই নায়ক। বসন্ত চৌধুরী আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়, ওঁর স্ত্রী অলকা আমার সমবয়সী। অলকা আমার বন্ধু ছিল। যদিও অলকার ধূমপান করার অভ্যাস আমি পছন্দ করতাম না। পরে ওঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অলকা এক কর্নেলকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন অলকাকে দেখেছিলাম দেখলাম ও যেন অনেক সাদামাটা। সেই ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে আইশ্যাডো নেই, ব্যক্তিত্বেও সেই সাহসী ভাব নেই। অলকা বলেছিল ‘বসন্তবাবুকে ছেড়ে চলে আসার পর একাই ছিলাম। মাদার টেরেজার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সব সাজগোজ ছেড়ে দিই। একলা থাকার খুব কষ্ট। তাই আবার বিয়ে করলাম।’ অলকা ক্যান্সারে মারা যায়।” 

আর কী সমাপতন! বসন্ত চৌধুরীও শেষ জীবনে ক্যান্সারে মারা গেলেন ২০ জুন ২০০০। নিজের একাকীত্ব, দুঃখ, কষ্ট সব হাসি-মজার আড়ালে লুকিয়ে রাখতেন। অলকা একা থাকতে ভয় পেয়েছিলেন, বসন্ত পাননি। তাই মৃত্যু নিয়েও নিজের সঙ্গে নিজে বোঝাপড়া করে গেছেন। বসন্তর নির্দেশ ছিল তাঁর দুই ছেলের প্রতি, তাঁর মৃত্যুর পর যেন সেই খবর কাউকে জানানো না হয়। শেষকৃত্য হয়ে যাবার পর যেন মিডিয়াকে, ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের খবর দেওয়া হয়। দুই ছেলে বাবার সেই নির্দেশ মেনেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। আভিজাত্য আর সৌন্দর্য্য যার ক্লাস, তিনি চাননি তাঁর ব্যাধি, জরা, মৃত শরীর মানুষের সামনে আসুক। রাজার মতোই রাজাধিরাজের মহাপ্রস্থান হল লোকচক্ষুর আড়ালেই। শুধু চিরবসন্তের ফাগটুকু তিনি রেখে গেলেন চলচ্চিত্র দুনিয়াতে। 

তথ্য ঋণ: জ্যোতিপ্রকাশ গুহ ও উইকিপিডিয়া

কৃতজ্ঞতা: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, দেব কুমার বসু অমল রায় ঘটক।

 

ছবি: Amazon Prime,  সঞ্জিত চৌধুরী, 

Subhadip Bandyopadhyay

বর্তমান সময়ে বাংলা ছায়াছবি ও বিনোদন জগতের লেখালিখিতে জনপ্রিয় নাম শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন বাংলা ছবি সংক্রান্ত গবেষণায় ব্রতী রয়েছেন শুভদীপ। তিনি নিয়মিত সাংবাদিকতা করেন। একাধিক সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'সুরের জাদুকর হেমন্ত' এই সময়ের বেস্টসেলার বই। লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গান তৈরির গল্প নিয়ে শুভদীপের লেখা 'গানে গল্পে বাঙালির লতা' বইটি প্রকাশের পথে।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *