বিশ্বাস করুন, এ দুনিয়ায় ভয় বলে আসলে আর কিচ্ছু নেই। ঘুচে গ্যাছে জন্মের মতো।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আবার কী বেফালতু কথা! প্রতি দিন যে এত এত ভয় নিয়ে বাঁচছি! চাকরি যাওয়ার ভয় দিয়ে শুরু করে প্রেম হারাবার ভয়। যৌবন চলে যাওয়ার ভয়। কোথাও কিচ্ছু নেই, কোদ্দিয়ে আলটপকা একটা ভিড় এসে হঠাৎ ঘিরে ফেলবে আর যা-হোক একটা অজুহাত দেখিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে এক্কেবারে জানে মেরে দেবে জাস্ট। ব্রিজ ভেঙে পরবার ভয়, গণধর্ষণের ভয়, অ্যাসিড হামলার, ক্যান্সারের, আমেরিকার, চায়নার, ডেঙ্গুর, টলিউডে বিশ্বাস ব্রাদার্সের আর পলিউশনে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়, কী বলছেন, ভাই, ভয় নেই?
আমি বলছি, না, নেই। ওটা আপনার মনের ভুল।
বা, আশায় মরে চাষা সিনড্রোম।
দেখুন, যত ক্ষণ অনিশ্চয়, তত ক্ষণই তো ভয় আসলে। আপনি এখনও ভাবতে ভালবাসেন, যেখানে যাই হয়ে যাক, নিউ ইয়র্ক শেয়ার মার্কেট মায়ের ভোগে যাক, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার পাতালপ্রবেশ করুক, সমস্ত শিল্প সমস্ত ব্যবসা গাধার গাড্ডায় চলে যাক, এমনকি আপনি যে অফিসে বাবু সেজে যান টাইফাই লড়িয়ে রোজ, সেখানেও আর সক্কলকার চাকরি চলে যাক, খালি আপনারটা যাবে না শুধু, কোনও-না-কোনও ভাবে কী করে যেন টিকে যাবে নিশ্চয়ই, হয় মালিকের মানবিকতা উথলে উঠবে, কবে কোন খারাপ সময়ে আপনি কোম্পানির পাশে ছিলেন টানা তিন মাস মাইনে না-পেয়েও, অন্য জায়গায় অনেক বড় অফার ছিল, তবু যাননি, আজও মালিক সে কথা মনে রেখে নিশ্চয়ই বিশেষ দৃষ্টিতে দেখবেন আপনাকে, নয়তো ক্লাইম্যাক্স কালে ভগবান ঠিকই নেমে আসবেন চোঁ করে।
এই অবাস্তব মনোভাবের জন্যেই আপনার ভেতরে একটা দোনামনা দশা তৈরি হয়, মানে আপনার অন্তরাত্মা আসলে খুব ভালো ভাবেই জানে চাকরিটা যাবে, অবশ্যই যাবে, কোনও বাঁচতে পারবে না। কিন্তু আপনি এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে চাইছেন না। আপনি কুস্তি করছেন। কোনও যুক্তি নেই, তবু জোর করে নিজের মনের মধ্যে একটা কল্পজগৎ তৈরি করে সেখানে বাস করতে চাইছেন একা-একা, যেখানে এখনও আশা আছে, ভালোবাসা আছে। আরে, ফি-বার পুজোয় কিশোরকুমার আজও বাজতে থাকেন, “আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল”, হ্যাঁ, ছিল, কিন্তু ওই, ছিল-ই। পরের লাইনেই “আর আশা নেই, ভালোবাসা নেই”। ওনার মতো লোক মেনে নিতে পারলেন আর, আপনি শুধু শুধু পাম্পার দিয়ে বুকে বাতাস ভরে যাচ্ছেন কেন এখনও? এই যে আপনাকে নিয়ম করে সক্কলে মিলে ‘পজিটিভ’ থাকবার ইঞ্জেকশন দিয়ে যাচ্ছে রোজ, যত খারাপই হোক না কেন, তার মধ্যেও আপনাকে পজিটিভ থাকতে বলছে, ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু’ মোডে এক পা বাড়িয়ে রাখতে বলছে সারাক্ষণ, কোন দিকে, তার ঠিক নেই, কিন্তু থাকুন, রোজ নতুন-নতুন করে নিজেকে গ্যাস খাওয়ান, নিজেকে বিশ্বাস করান, সব ধ্বংস হয়ে যায়নি এখনও, খারাপ হয়ে যায়নি, ভালো হবে, ভালো হবে, পজিটিভ থাকুন, নিশ্চয়ই ভালো হবে শেষে, আপনাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে আর আপনিও সেই হানিট্র্যাপে বাঁধা পড়ে দিব্যি একটা মেকি একটা মৌজে গা ভাসিয়ে রয়েছেন ঢালা বিসনায় আধশোয়া, না?
অথচ, এই আশ-ই আপনার বাঁশ। আশাগ্রস্ত আপনি আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দেখা হয় ওই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন সিধে আপনি-টার সঙ্গে আর, ওমনি এই ক্যালাস আপনি-টা নিজেকে দেখে, নিজের আসলিয়তটার মুখোমুখি হয়ে ভয় পায়, কারণ এই আপনি-ও আসলে জানে, ওই আপনি-টাই সত্যি।
আয়নার এই এপার-ওপারটা আপনার নিজের তৈরি করা। এটাই আপনার স্বজারিত মনোরোগ, যাকে আপনি ভয় বলে ভুল করছেন।
দেখুন, অনিশ্চয় বলে দুনিয়ায় কিন্তু আর কিছু সত্যিই বাকি নেই। পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে, নিশ্চিত। সারা পৃথিবীজুড়ে যেখানে যা সম্পদ এখনও ছুটকোছাটকা ছিটিয়ে আছে, সেটুকুও দখল করে নেওয়ার শেষ দৌড়টা যে শুরু হয়ে গ্যাছে এবং সে দৌড় যে আসলে বিশ্বব্যাপী শেষ এবং সীমাহীন ধ্বংসলীলার মধ্যেই সমাপন হবে, কিচ্ছু থাকবে না, কিচ্ছু থাকবে না আর, মানুষ গাছ পশু পাখি নদী নালা কিচ্ছু না, আমরা যে ফাইনালি এক্কেবারে মুছে যেতে চলেছি, তা-ও স্পষ্ট। যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ হবেই, শুরু হয়ে গ্যাছে, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, প্রত্যেকটি মহল্লায় যে তা ঢুকে আসছে, হায়নার দল যে এলাকা দখল নিচ্ছে, কোথাও আর কোনও কায়দাকানুন নীতিনৈতিকতার তোয়াক্কা থাকছে না, ক্রমে যে আরও থাকবে না, এতটুকুনও থাকবে না আর, সত্যি বলুন তো, এইটুকখানি বুঝবার জন্যে কি বিদ্বান হওয়ার দরকার আছে আর? কীসের ভয় তাহলে? সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে চলেছি, শেষ দৃশ্য নির্দিষ্ট হয়ে গ্যাছে, মধ্যেকার পথও মোটামুটি দেখতে পাচ্ছি সক্কলে, আর কীসের ভয়? হ্যাঁ, রাস্তা ঠিক কতটা খারাপ, সে নিয়ে খানিক দোলাচল আছে বড়জোর, এক্কেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আরও ঠিক কতটা ঝেলতে হবে, সঠিক যেন ঠাহর করে উঠতে পারছি না পুরোপুরি, তাই খানিক যেন অস্বস্তি রয়ে যাচ্ছে, তাই তো? কিন্তু আসলে সেটারও উত্তর চোখের সামনেই আছে। যতটা খারাপ ভাবতে পারছি, তারও হাজার গুণ নিষ্ঠুর নৃশংস হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পরের দিন। পরের দুঃসংবাদটা যবে নাগাদ আসবে ভেবেছিলুম, আসলে তার অনেক অনেক আগেই ঘটে যাচ্ছে সব কিছু। এই তো? ভবিষ্যদ্বাণীর চেয়ে অনেক আগেই মাঠ হয়ে যাচ্ছে আমাজন, মেরুর বরফ তড়িৎগতিতে গলছে, পার্লামেন্টের একটা সেশনেই পাশ করে দিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি আইন। এ ক্ষেত্রে আসলে সমস্যাটা হচ্ছে, লেদুশ আপনি এত কিছুর সঙ্গে তাল রাখতে পারছেন না, এই তো? এর বেশি তো কিছু না। আপনার বুঝে উঠবার আগেই গুণিতকে বাড়ছে গতি আর ক্ষতি বাড়ছে খরস্রোতে। এ বার সেই দুর্দমনীয় বিধ্বংসের তীব্রতার সঙ্গে নিজের সিস্টেমটা আবার একটু টিউন করে নিলেই দেখবেন, সব কিছুই আসলে হিসেবমতোই চলছে। ঠিকই আছে। কোথাও কোনও অস্বস্তি আর নেই। ভয় তো বহু দূর।
এমন দিন এসে গ্যাছে, বিশ্বাস করুন, এই রাত্তিরবেলা শুতে গেলুম, সুয্যিমামা কালকে ঠিকই পূর্বদিকেই উঠবে জেনে, এ বার সক্কালবেলা চোখ পিটপিট করেই প্রথমে যেমনি ফোনটা এক বার দেখে নেওয়ার অভ্যেস রোজ, ও মা, নেট কানেকশন নেই, যাচ্চলে, সূর্যটাও তো দেখি দক্ষিণ করে উঠছে, রাত কে রাত আইন পাশ হয়ে গ্যাছে নাকি, ওটাই আসলে দেশের পক্ষে ভালো। আর, এর মধ্যেই, সংখ্যাতীত সশস্ত্রবাহিনী ঘিরে ফেলেছে আপনাকে, অবাক হওয়ার অধিকারটুকুনও আর নেই। এই সহজ বাস্তবটা নিজেকে এ বার বোঝান। আসলে আপনি তো আর অবাকও হন না। গুগল ম্যাপে প্যালেস্তাইন বলে আর কিছু দেখায় না, অবাক হন কি? কাল যদি চায়না চক্ষের পলকে এক লাখ উইগুর হাপিস করে দেয়, অবাক হবেন? সত্যি বলুন তো, এই যে দুম করে কাশ্মীরে যা করা হলো, হতে পারে আপনার হেব্বি লেগেছে, কিম্বা ভেতরে-ভেতরে আপনি টুকরে-টুকরে গ্যাং, কাশ্মীরিদের যনতোন্নায় বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে আপনার, কিন্তু ঠিক করে ভাবুন তো, খুব একেবারে অবাক হয়েছেন কি? হননি। হতে পারেন না। কারণ, আপনি জেনে গ্যাছেন, এটা হতেই পারে। এর’ম যা খুশি যখন তখন যেখানে সেখানে হতে পারে। হবে। হবেই। এবং, এটাই চলবে। এ ভাবেই চলবে। সারা পৃথিবীতেই। এ পথেই নির্বাণ পানে আলোর গতিতে এগিয়ে যাব আমরা। এর মধ্যে কোনও অনিশ্চয় আর নেই। এ আপনিও জানেন, অনেক দিন ধরেই জানেন, তবু মেনে নিতে পারছেন কিছুতেই। ওর’ম হয়। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পরেও অনেক দিন অবধি বিশ্বাস হয় না যে, সত্যিই গ্যাছে। কিন্তু মেনে তো নিতেই হয়। এক বার যেই সত্যকে আত্মস্থ করে নিতে পারেন, মেনে নিতে পারেন সত্যিই আপনি প্রাক্তন হয়ে গ্যাছেন, আর তো চোখে হারাবার ভয় থাকে না, তাই না?
মানুষ প্রাক্তন হয়ে গ্যাছে। বিশ্বাস করুন।
জন্ম কলকাতায়। কর্মও মোটের ওপর এখানেই। কারণ, সম্ভবত এ শহরের প্রতি মাত্রারিক্ত মায়া। যৌবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত পড়াশুনোর প্রতি দায়বদ্ধতা ক্রমক্ষীয়মান, উল্টে সিলেবাস-বহির্ভূত নানা বিষয়ে আগ্রহ, বিশেষ করে রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সিনেমা। কর্মজীবনে শুরুর দিকে, বিভিন্ন বিনোদনমূলক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে বেশ কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিচালক। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সিনেমার দুনিয়ায় সম্মানিত কয়েকটি ফিল্মের সম্পাদক। এরই মধ্যে, প্রথম সারির কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি। বর্তমানে স্বাধীন ভাবে তথ্যচিত্র ও প্রচারমূলক ছবি নির্মাণ, বিভিন্ন অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। আর, ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শদাতা একটি সংস্থার অংশীদার। প্রথম প্রকাশিত গদ্য ২০০৬, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘রোববার’ পত্রিকায় (সংবাদ প্রতিদিন)। পরে, আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময় ও অন্যত্র। প্রবন্ধ বা ফিচারধর্মী লেখার পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পও।