অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সত্যব্রতবাবুর মনে হল চোখে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে বোধহয়। সবকিছু দেখছেন ঠিকঠাক, কিন্তু কেমন যেন। ভাবলেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। সত্যব্রত চৌধুরী, বয়স একষট্টি বছর। কলকাতার নামী কলেজের অধ্যাপক। পড়াশুনো আর লেখালেখি নিয়েই থাকেন। শরীর-স্বাস্থ্য মন্দ নয়। তবে সুগার, প্রেশার আর কোলেস্টেরলের ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। কিন্তু সবচেয়ে মুশকিল হল ধূমপানের বদভ্যাস। দিনে এক প্যাকেট না হলে চলেই না। কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না।

আজ কলেজের জরুরি মিটিং রয়েছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলেন। অন্যদিনের মতো শ্যামলী প্রাতঃরাশ সাজিয়ে দিয়েছেন পরিপাটি করে। টুকটাক গল্প করতে করতে সবে কফির মগটায় চুমুক দিতে যাবেন, এমন সময় ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। চোখের বাঁদিকে নেমে এল একটা কালো পর্দার আবরণ, সাথে দু’চারটে আলোর ঝলক। হাত দিয়ে পর্দাটা সরাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। মুহূর্তের মধ্যে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। কতটুকুই বা সময়? বড়জোর মিনিট দুয়েক! দেখতে দেখতে সত্যব্রতবাবুর বাঁ চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল।

সত্যব্রতবাবু শক্ত মনের মানুষ। একটু নার্ভাস হলেও ভেঙে পড়লেন না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন করলেন শহরের বিশিষ্ট চোখের ডাক্তার ডা. সান্যালকে। সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাতেই ডা. সান্যাল বললেন, ‘এখুনি চলে আসুন। ব্যাপারটা সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে’।
‘একেবারে অন্ধ হয়ে যাব না তো ডা. সান্যাল’? সত্যব্রতবাবুর গলায় উৎকণ্ঠার রেশ।
‘দেখা যাক’ বলে ফোন রেখে দিলেন স্বল্পভাষী চিকিৎসক।

আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে, স্ত্রী শ্যামলীকে নিয়ে সত্যব্রতবাবু পৌঁছিয়ে গেলেন ডা. সান্যালের সুসজ্জিত ক্লিনিকে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ডা. সান্যাল তাকে ডেকে নিলেন নিজের চেম্বারে। নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পালা মিটিয়ে সত্যব্রতবাবু তাঁর চোখের ব্যাপারটা বিস্তারিতভাবে জানালেন। আগে সামান্য চালশের পাওয়ার ছাড়া সত্যব্রতবাবুর চোখে আর কোনো সমস্যা ছিল না। ডা. সান্যাল সেটা জানতেন। কিন্তু উনি এখন যা বললেন তাতে ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সত্যব্রতবাবু চোখের দৃষ্টি, প্রেশার, রেটিনা ইত্যাদি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডা. সান্যাল গম্ভীর হয়ে গেলেন।

প্রথম দিকে চোখের সামনে মাছির মতো ছোট ছোট বিন্দু ভাসতে দেখা যায়, কেউ কেউ আলোর ঝলক দেখতে পান। এর সঙ্গে চোখে একটু অস্বস্তিভাবও থাকতে পারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি কমতে শুরু করে। সেটা ধীরে ধীরে কিম্বা আচমকাও হতে পারে। চোখের স্ট্রোকে তুলনামূলক ভাবে বয়স্ক পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

মানুষটি এবার ভয় পেয়েছেন। ‘কী হয়েছে ডাক্তারবাবু আমার বাঁ চোখে?’ গলার স্বর কাঁপছে। কথা বলতে পারছেন না যেন।
‘আপনার বাঁ চোখে স্ট্রোক হয়েছে’ — রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিলেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক।
‘স্ট্রোক ? সে তো মাথায় বা হার্টে হয়। চোখেও?’

হ্যাঁ, স্ট্রোক কেবলমাত্র মাথায় বা হার্টেই হয় না চোখেও হতে পারে। আর তার সম্ভাবনাও কম নয়। এটি সাধারণত বয়স্ক মানুষের অসুখ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমস্ত স্ট্রোকের পিছনে থাকে নির্দিষ্ট কিছু কারণ। আমাদের চোখের ভিতরে রেটিনা নামে নার্ভের একটা আবরণ আছে। বাইরের কোনো বস্তুর আলো চোখের কর্নিয়া-পিউপিল-লেন্স ইত্যাদি ভেদ করে রেটিনার উপরে পড়লে তবেই আমারা দেখতে পাই। রেটিনাল আর্টারি (Retinal Artery) নামের রক্তনালিগুলি রেটিনার পুষ্টি এবং অক্সিজেন বহন করে। আর এই অক্সিজেনের উপরেই রেটিনার সুস্থতা নির্ভর করে যা আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চোখ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যেও সত্যব্রতবাবু স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসায় জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা ডা. সান্যাল, রেটিনার সুস্থতার সঙ্গে চোখের স্ট্রোকের সম্পর্কে কী?’

রেটিনাল আর্টারি রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে রেটিনাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। রেটিনাল আর্টারিটি (Central Retinal Artery) চোখের মধ্যে প্রবেশ করে নানা শাখাপ্রশাখায় (Branch Artery) ভাগ হয়ে যায়। যদি কোনো কারণে এই আর্টারি মানে চোখের রক্তনালিগুলি সরু হতে থাকে কিম্বা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে রেটিনাতে যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছতে পারে না। এর ফলে রেটিনা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এখন প্রশ্ন হল রেটিনার আর্টারিগুলি কেন সরু হয়ে যায় আর কেনই বা সেগুলি অবরুদ্ধ হয়ে যায়। পলির আবরণ জমে যেমন নদীর গভীরতা কমতে থাকে, তার স্রোত যেমন বাধাপ্রাপ্ত হয়, তেমনি ফ্যাট বা চর্বির আবরণ জমে জমে রেটিনার রক্তনালিগুলি ধীরে ধীরে সরু হতে থাকে। আবার ছোট ছোট জমাট-বাঁধা রক্তের দলা বা ক্লট, চর্বির টুকরো রক্তনালির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রেটিনাল আর্টারিতে ঢুকে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একেই বলা হয় চোখের স্ট্রোক।

রেটিনার রক্তনালি বন্ধ হয়ে গেলে, অক্সিজেনের অভাবে রেটিনার নার্ভ-স্তরের মধ্যে একধরনের ফ্লুইড বা তরল পদার্থ জমতে শুরু করে। ফলে রেটিনা ফুলে ওঠে আর সারা রেটিনায় ছড়িয়ে পড়ে শিরা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত। এর ফলেই মানুষ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন।

সত্যব্রতবাবু ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করলেন। তারপর একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এই অসুখের Symptom মানে লক্ষণগুলো কী কী? মানে কীভাবে বুঝব যে আমার চোখে স্ট্রোক হয়েছে ?’

প্রচণ্ড বুকে ব্যথা, ঘাম, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখে ব্রেন কিম্বা হার্ট স্ট্রোক সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু চোখের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। ব্যথা- বেদনা, চোখ থেকে জল পড়া ইত্যাদি কোনো উপসর্গ সাধারণত থাকে না। প্রথম দিকে চোখের সামনে মাছির মতো ছোট ছোট বিন্দু ভাসতে দেখা যায়, কেউ কেউ আলোর ঝলক দেখতে পান। এর সঙ্গে চোখে একটু অস্বস্তিভাবও থাকতে পারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি কমতে শুরু করে। সেটা ধীরে ধীরে কিম্বা আচমকাও হতে পারে। চোখের স্ট্রোকে তুলনামূলক ভাবে বয়স্ক পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তবে চোখের স্ট্রোক সাধারণত এক চোখেই হয়ে থাকে, এটাই যা ভরসার।

‘এ তো সবই আমার সঙ্গে একেবারেই মিলে যাচ্ছে। আচ্ছা আপনি তো বললেন রেটিনাল আর্টারির রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়াই স্ট্রোকের আসল কারণ। কিন্তু কাদের এই ধরনের স্ট্রোকের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি?’

‘দেখুন অনেক অসুখ আছে যেগুলি ধমনি বা শিরাতে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। সেইসব রোগে আক্রান্ত মানুষদেরই স্ট্রোকের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যেমন

অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis) : এই রোগে রক্তনালি সঙ্কুচিত হয়ে রক্ত পরিবহণ ক্ষমতা কমে যায়। সাধারণত রক্তনালির ভিতরের দেওয়ালে চর্বি, কোলেস্টেরল ইত্যাদির আবরণ জমে জমে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস রোগের সূত্রপাত হয়।
হাই ব্লাড প্রেশার: যারা বহুদিন ধরে হাই ব্লাড প্রেশারে ভুগছেন তাদের শরীরের রক্তনালিগুলিও শক্ত আর সরু হয়ে যায়, যা স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।
কোলেস্টেরল: রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে তা রক্তনালির ভিতরে পলির মতো আবরণ তৈরি করে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
ডায়াবেটিস: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে রেটিনায় পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং সেখানে ফ্লুইড আর রক্ত জমে যায়।
হার্ট অ্যাটাক: চেস্ট পেন বা হার্টের অন্য কোনো অসুখে আক্রান্ত রোগীদেরও চোখের স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
রক্তের তঞ্চন-ঘটিত সমস্যা (Coagulation Defect) বা কিছু কিছু জটিল অসুখেও চোখের স্ট্রোক হতে দেখা গিয়েছে।
পারিবারিক গ্লকোমার ইতিহাস যাদের রয়েছে তারাও এই সম্ভাবনার আওতায় পড়বেন।
ধূমপান: ধূমপান স্ট্রোকের সম্ভাবনাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের চিকিৎসায় আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় না।

রেটিনার রক্তনালি বন্ধ হয়ে গেলে, অক্সিজেনের অভাবে রেটিনার নার্ভ-স্তরের মধ্যে একধরনের ফ্লুইড বা তরল পদার্থ জমতে শুরু করে। ফলে রেটিনা ফুলে ওঠে আর সারা রেটিনায় ছড়িয়ে পড়ে শিরা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত। এর ফলেই মানুষ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন।

শঙ্কিত গলায় সত্যব্রতবাবু বললেন, ‘আমার তো ডায়াবেটিস প্রেশার কোলেস্টেরল সবই আছে। যদিও আপাতত সবগুলিই কন্ট্রোলে রয়েছে। কিন্তু আমি তো সিগারেট ছাড়া থাকতেই পারি না। আমার কি হবে ডা. সান্যাল ? আবার আগের মতো দেখতে পারব তো ?’

‘এখনই অত ভাববার কিছু নেই। আজকাল চোখের স্ট্রোকের অনেক উন্নত চিকিৎসা আমাদের হাতের নাগালে রয়েছে। আর সুখের কথা যে আপনি একটুও সময় নষ্ট করেননি। তাই হতাশ না হয়ে আমরা প্রথমেই আপনার রোগনির্ণয় বা ডায়াগনোসিসগুলি করে নিতে চাই। এজন্য কী কী করতে হবে জানিয়ে রাখছি।’

ভিশন টেস্ট (Vision Test) অর্থাৎ দু’চোখে আলাদা আলাদা ভাবে দূরে আর কাছে কেমন দেখছেন বা দৃষ্টির পরীক্ষা।
ফাণ্ডোস্কোপি (Fundoscopy) : বিশেষ আইড্রপ দিয়ে চোখের মণি (Pupil) বড় করিয়ে চোখের রেটিনার পরীক্ষা।
রেটিনার ছবি (Fundus Picture) : ফাণ্ডাস ক্যামেরার সাহায্যে তোলা রেটিনার ছবি দেখে চোখের ভিতরে রক্তপাতের পরিমাণ অনুমান করে নাওয়া হয়।
ফ্লুরসেইন অ্যাঞ্জিওগ্রাফি (Fluorescein Angiography): হাতের শিরার মধ্যে একধরনের ডাই (Dye) ইনজেক্ট করে বিশেষ ক্যামেরার সাহায্যে রেটিনায় রক্তচলাচলের ছবি তুলে বিশ্লেষণ করে দেখা হয়।
ইন্ট্রা-অক্যুলার প্রেশার (IOP) বা চোখের আভ্যন্তরীণ চাপ নির্ণয় এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।
ওসিটি (Optical Coherence Tomography) পরীক্ষার সাহায্যে রেটিনায় জমে থাকা ফ্লুইডের পরিমাণ নির্ণয় করে অসুখের তীব্রতা।
রক্ত পরীক্ষা: ব্লাড সুগার, কোলেস্টেরল সহ রক্তের অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা।
ECG , Echocardiogram ইত্যাদির সাহায্যে হার্টের সার্বিক পরীক্ষা।

শেষ পর্ব: ১১ জানুয়ারি, ২০২১, সন্ধ্যে ছটা। 

বিশিষ্ট চক্ষু চিকিত্‍সক ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার সল্টলেক আই কেয়ার ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। চিকিত্‍সার সঙ্গেই চলে লেখালেখির কাজ। লিখেছেন 'চশমার হ্যান্ডবুক', 'গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার', 'চোখের কথা' ইত্যাদি বই। এছাড়াও 'গীতবিতান আর্কাইভ' এবং 'রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ' নামে দুটি মূল্যবান সংকলন তৈরি করেছেন।

2 Responses

  1. No I described about Stroke of the eye. Amaurosis Fugax is not the same, but both have some common similarities.
    When a person experiences amaurosis fugax, their vision may suddenly appear to cloud over. This is typically a temporary effect that can last anywhere from a few seconds to several minutes. Some people have described the occurrence of amaurosis fugax as feeling as if someone has pulled a shade over their eye. In many instances, amaurosis fugax is a symptom of a transient ischemic attack (TIA). A TIA is a precursor to a stroke. TIAs cause stroke-like symptoms that are temporary. In addition to temporary blindness, other symptoms associated with TIAs include difficulty speaking, a facial droop on one side of the face, and sudden weakness on one side of the body.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *