ভিয়েতনাম যাওযার আগেই শুনেছিলাম যে বহু লোকে শুধুমাত্র ফুড সাফারি করতেই ভিয়েতনাম যায়। স্বভাবতই কোথায় যাব, কী দেখব এসবের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলাম খাবার খোঁজার দিকেই। ইউ টিউব ঘেঁটে এবং নানা আর্টিকল পড়ে জানতে পেরেছিলাম ভিয়েতনাম আসলে আমিষ ভোজের স্বর্গ।

প্রথম দিন সকালে সাইগন বা হো চি মিনে পৌঁছনোর পর ঐতিহাসিক কু চি টানেলে যাওয়ার আগে সামনের দোকান থেকে কিনে নেওয়া হল ইয়াব্বড় বড় মোমো, যার নাম বান বাও। বিশালাকার সেই মোমোর প্রত্যেকটির ভেতরে রয়েছে, শুয়োর বা মুর্গির পুর এবং তিনটে করে ছোট্ট ডিম। সকালের জলখাবার হিসেবে একেবারে আদর্শ। এরপর মোটামুটি ঠিক করা ছিল যে কী কী খেতেই হবে। বড় রেস্তোরাঁ নয় বরং চালু রাস্তার দোকানই ছিল আমাদের টার্গেট। বাজারে এসে খানিক কেনাকাটা করে রাস্তার ওপরেই বেঞ্চি পাতা চাঁদোয়া টাঙানো একটি দোকানে বসে পড়লাম। রান্নার জায়গায় গিয়ে খেই হারানোর মত অবস্থা কারণ ভিয়েতনামে ইংরিজি বলা বা বোঝানো বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। সুতরাং ভাঙা ভাঙা শব্দ ও ইশারায় অর্ডার দিলাম। পাশের জনের খাবার দেখে লোভ হওয়ায় ওয়েটারকে সেটা দেখিয়ে বললাম এইটেও চাই। খাওয়াটা হল দারুণ। জ্যান্ত সি ফুড রাখা রয়েছে দোকানের সামনে – ছোট বড় চিংড়ি, স্নেলস, অয়েস্টার, অকটোপাস, আরও কত কী। প্রথম দিনেই বেশি রিস্ক না নিয়ে আমরা গ্রিলড চিংড়ি,পর্ক ফ্রাই, সি ফুড ফ্রায়েড রাইস আর ক্রিসপি প্যানকেক অর্ডার দিলাম। ক্রিসপি প্যানকেকের ভেতরে রয়েছে পর্ক, চিংড়ি আর স্প্রাউটস। আর সব ডিশের সঙ্গেই এখানে এক থালা হার্বস দেওয়া হয়। তাতে দু ধরনের লেটুস পাতা চিনতে পেরেছিলাম, বাকি গুলোর বড্ড বুনো গন্ধ। ক্রিসপি প্যানকেকের বান জিও, সকলের খুব পছন্দ হল তাই সেটার অর্ডার রিপিট হল। সঙ্গে সাইগন বিয়ার দিয়ে আমাদের প্রথম দিনের ডিনারটা ভালোই জমল। রাতে আর এক দফা বেরিয়েছিলাম রাতের শহর ঘুরে দেখতে, তখনই দেখলাম পথের মোড়ে মোড়ে শরবত ও কাঠি কাবাবের দোকান। কাঠি কাবাব মানে ভিয়েতনামি পর্ক সসেজ, পর্ক ফ্রাই বা বিফ ফ্রাই। এছাড়া সাইকেলের মতো একটি বাহনে চেপে একজন কেমন সুতোর মত দেখতে, সাদা রঙের,মিষ্টি বিক্রি করছিল একটা লোক, কিন্তু খেয়ে ওঠা হয়নি আর।

এরপর দিন পৌঁছলাম ভিয়েতনামের রাজধানী হানোই শহরে যা স্ট্রিট ফুডের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। হোটেলে হোয়াইট কফি খেয়ে পরের দিনের Ha Long ক্রুজে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত সেরে রাতে খেতে বেরোলাম। ফুটপাথের ওপরেই চেয়ার টেবিল পেতে, খাবারের দারুণ ব্যবস্থা। গিয়ে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ, কী নেই সেখানে, চিকেন, পর্ক, বিফের হরেক পদ, বেকনে মোড়া নানান খাবার, স্যালমন মাছ, স্কুইড, অকটোপাস, সি হর্স, কাঁকড়া, চিংড়ি, ব্যাঙ, অয়েস্টার ছাড়াও রয়েছে টোফু ও বিভিন্ন সবজি, যেমন অ্যাস্পারাগাস, লেটুস, কর্ন এমনকি ঢেঁড়শ পর্যন্ত। তবে সব খাবারই কাঁচা বা ম্যারিনেটেড, বাজার করার আলুর ঝুড়ির মত একটি করে ঝুড়ি দিয়ে দেবে আপনার হাতে, বেছে তুলে দিয়ে দিন, পাশেই সব গ্রিল হচ্ছে। গরম গরম খাবার এসে যাবে আপনার টেবিলে, সেখানেও বার্নারের উপর গরম থাকবে আপনার খাবার, গল্প করতে করতে ঠান্ডা বিয়ার আর গরম গরম সুখাদ্য,আহা !!! কাঁকড়ার মাংসটা সম্পূর্ণ বের করে নিয়ে রান্না করে আবার খোলার ভেতরে পুরে দেওয়া হয়েছিল, খুবই সুস্বাদু, ব্যাঙ খেয়েও বেশ ভালো লাগলো, সি হর্স বরং একটু শক্ত ও ছিবড়ে লেগেছিল। এরপরের দিন থেকে চব্বিশ ঘন্টা আমাদের কাটে হা লং এর ক্রুজে, সে অভিজ্ঞতা আলাদা করে লিখতে হবে কখনও, জাহাজে নানান সুস্বাদু পদের মধ্যে চিংড়ি ও আখ দিয়ে তৈরি খাবারটির কথা বলতেই হবে, বাঙালিদের জিভে কলা পাতায় মোড়া ভিয়েতনামি পাতুরিও ভালোই লেগেছিল, আর খেয়েছিলাম কোকোনাট ওয়াইন। নারকেল ফুটো করে রাইস ওয়াইন দিয়ে, বহুদিন রেখে তৈরি হয় কোকোনাট ওয়াইন, ঝাঁঝালো স্বাদের ওই ওয়াইন সার্ভ করা হয় ছোট ছোট পাত্রে। ক্রুজ থেকে ফেরার আগে সকালে খেয়েছিল ফো, ফো ভিয়েতনামের আরেক বিখ্যাত খাবার, রাইস নুডলস, পর্ক বা বিফ, স্ক্যালিয়নস দিয়ে তৈরি ফো অনেকটা আমাদের চেনা থুকপার মত। Ha Noi ফিরে রাতের হানোই শহর দেখতে বেরোলাম, রাস্তার ধারে অসংখ্য দোকান, সেখানেই টুল পেতে খাওয়াদাওয়া গানবাজনা চলছে। Bahn Mi এখানকার খুব জনপ্রিয় আর একটা খাবার, খানিকটা হটডগের মতই, বিফ স্টেক, নানা হার্বস আর পেঁয়াজ দিয়ে বানানো।

এরপর বেরিয়ে পড়লাম বিখ্যাত বিয়ার স্ট্রিটের খোঁজে। রাত ১২.৩০টাতেও সেখানে ভিড় ঠাসাঠাসি। অনেক কষ্টে কিছু ফাঁকা চেয়ার পেয়ে বসে অর্ডার দিলাম বাটার গার্লিক অয়েস্টার আর টাইগার ক্রিস্টাল বিয়ার। ভিয়েতনামে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল দা নাং ও হোই আন শহর। থু বন নদীর ধারে হোই আন একটি বুটিক শহর। পর্তুগিজ স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে সর্বত্র। নদীর ধারে বসে অক্টোপাস ভাজার সঙ্গে খেলাম ভিয়েতনামের বিখ্যাত এগ কফি। দা নাং ছেড়ে আসার দিন রাতে এক সি ফুড রেস্তোরাঁয় হাজির হলাম এবং লাইভ সি ফুড দেখতে গিয়ে ১০০০০ টাকার কাঁকড়াও (১পিস ) চাক্ষুষ করলাম। ওই দোকানের সবচেয়ে সস্তার চিংড়ি,হোল ফিশ ও অয়েস্টার দিয়ে ডিনার সারার পর হোটেলের মালিক ভিয়েতনামিজ নারী দিবস উপলক্ষে এক গোছা লিচুর মত ফল উপহার দিলেন, নাম রামবুটান। পরের দিন এইসব ভিয়েতনামি স্বাদের স্মৃতি ঝুলিতে ভরে পাড়ি দিলাম আরেক গন্তব্যের দিকে।
দেবলীনার জন্ম রানাঘাটে এবং কর্মস্থল মুম্বই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নোতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। ভালোবাসেন গান গাইতে এবং পেটপুজো করতে।