*আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] []

সবটা শুনে ওসি সাইবার সেল সুনীল তলাপাত্র বলেছিলেন,
– মন শক্ত রাখুন। আমাকে খবর দিন, আপনার ব্রেন হ্যাক করা হচ্ছে।
তিনটে কথাই ভদ্রলোক বললেন এক নিঃশ্বাসে। একই সুরে। কথার মধ্যে কোনও ওঠাপড়া নেই। প্রথম দুটো উপদেশ মামুলি। কিন্তু তিন নম্বরটা ভাববার। রঞ্জন বলল,
– ব্রেন হ্যাক করা যায় নাকি?
– ক’দিন আগে আমিও এমনটাই ভাবতাম, কিন্তু কয়েকটা অদ্ভুত কেস দেখবার পর এখন মনে হয় কেউ বা কারা ব্রেন হ্যাক করছে–
– কেসগুলো কীরকম?
– প্রায় আপনারই মতো… কানের কাছে হঠা কেউ যেন ফিসফিস করে বলল বাঁ-দিকে নয় ডাইনে, আপনি ডানদিকে চলতে শুরু করলেন। ব্রেন হ্যাকিং মানে হচ্ছে টেকনোলজির হেল্প নিয়ে আপনার মস্তিষ্কের কন্ট্রোল নিয়ে নেওয়া…
রঞ্জন অবাক!
– এইরকম হয় নাকি!

– দেখুন, স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো কতটা সম্ভব আমার ঠিক জানা নেই। মাথার ভেতর আলফা বিটা গামা ডেল্টা এইসব নানান রশ্মির তরঙ্গ পাঠানো যায়, এগুলো দিয়ে আমাদের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এমনকী কোনও গন্ধ দিয়েও ঘুমন্ত মানুষের মগজের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন ইস্রায়েলের এক মহিলা বিজ্ঞানী। এখন এই যে এতরকম রশ্মি মাথায় ঢুকছে, তাকে যদি বাইরে থেকে মনিটর করবার পদ্ধতি এসে যায়, তাহলে তো আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হয়তো সেই পদ্ধতি এসে গেছে, আমরা কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তা বুঝতে পারছি না–
– তাহলে আপনি বলছেন এটা ডিপ্রেশন বা ওই জাতীয় কিছু নয়?
– একেবারেই নয়। আপনার মতো পজিটিভ মানুষের ডিপ্রেশন?
মাথা নাড়লেন তলাপাত্র সাহেব।
– হয় না যে বলছি না, কিন্তু এটা অন্য ব্যাপার। বললাম না, এমন কেস আমি আরও দেখেছি, নয় নয় করে কুড়ি বাইশটা তো হয়ে গেল… 
তলাপাত্র সাহেব চুপ করে গেলেন। রঞ্জনও কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঘরটাও নিস্তব্ধ। দরজায় সবুজ পর্দা। আজকাল দরজায় পর্দা প্রায় দেখাই যায় না। টেবিলে যে গেলাসে জল রাখা, অমন মোটা কাচের গ্লাসও আজকাল বাজারে মেলে না।

 

আরও পড়ুন: রতন সিদ্দিকীর কলমে: এস এম সোলায়মানের নাটক: রাজনীতির খতিয়ান

 

– দেখুন যে কেসগুলো আমার কাছে এসেছে তার সত্যি-মিথ্যে জানি না, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে ভিকটিমের মস্তিষ্কের ওয়েভলেন্থকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে হ্যাক করে কন্ট্রোল করা হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে বলেই মনে হয়। কারণ কে হ্যাক করছে তার খোঁজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব…
– বুঝলাম। কিন্তু আমার ভীষণ মুড সুইং হচ্ছে… হাসতে-হাসতে হঠা কান্না পেল, কোনও কারণ নেই তবুও। আবার, এই গাড়ি চালাচ্ছি হঠা একটা কুকুরকে চাপা দিয়ে দিলাম, ইচ্ছে করেই…
তলাপাত্র সাহেব মৃদু হাসলেন।
– শুধু হাসিকান্নার ব্যাপারটা বললে ভাবা যেত। নন্দিনীর সঙ্গে থাকেন না এখন, হয়তো ওর কথা মনে পড়ায়। কিন্তু, কুকুর… আসলে ব্রেন হ্যাকিং মানে আমাদের স্নায়ুর ওপরও দখল পাওয়া। সেইজন্যই মাথা ঘুলিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে সেই মুহূর্তের জন্য–
– তাহলে তো এমনভাবে কাউকে দিয়ে অপরাধও করানো যেতে পারে?
– এক্সজ্যাক্টলি…! তখন যার মস্তিষ্ক অন্যের দখলে, সে রোবট। একে টেকনিক্যাল সম্মোহনও বলতে পারেন। তাকে দিয়ে নানান ক্রাইম করানো যায়। সুবিধা হল, যে হ্যাক করছে সে ধরা পড়ছে না…
– তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায়?… কীভাবে নিস্তার পাওয়া যাবে? এখন আমাকে দিয়ে যদি কোনও বড় অপরাধ করানো হয়? আপনি তো জানেন আমি… এ তো খুব চক্করে পড়লাম…

ওসি সাইবার সেল ডান হাত তুললেন।
– শান্ত হোন। আমি আপনার কেসটা টপ প্রায়োরিটি লিস্টে রাখছি। চেষ্টা করছি আপনাকে কভারে রাখবার। একজন সাইলেন্টলি আপনাকে ফলো করবে এখন ক’দিন। আর যেই আন্দাজ পাবেন কারা এইসব করছে, ইমিডিয়েটলি জানাবেন…
একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন তলাপাত্র সাহেব।
– এই মোবাইল নম্বরে ফোন করবেন… আর প্যানিক করবেন না, ঠিক কোনও কিছু উপায় বেরবে…

নমস্কার করে ওসি-র ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল রঞ্জন। বাড়ি ফিরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে ছিল। ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে। মানুষের মাথার ভেতরটা বিচিত্র, কত জটিল শিরা-উপশিরা-স্নায়ুতন্ত্র-ঘিলু! সেই জটিল ব্যবস্থাটাকে চালনা করছে বাইরের কেউ! ভাবা যায়! নন্দিনীর কথাও মনে হচ্ছিল। হুট করে খুব তো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলি। বুঝলি না, বুঝতে চাইলিই না ব্যাপারটা কত সিরিয়াস। আমাকে এমন একলা ফেলে কোন সুখে দিন কাটাচ্ছিস। চোখে জল এসে গেল রঞ্জনের।

স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো কতটা সম্ভব আমার ঠিক জানা নেই। মাথার ভেতর আলফা বিটা গামা ডেল্টা এইসব নানান রশ্মির তরঙ্গ পাঠানো যায়, এগুলো দিয়ে আমাদের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এমনকী কোনও গন্ধ দিয়েও ঘুমন্ত মানুষের মগজের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন ইস্রায়েলের এক মহিলা বিজ্ঞানী। এখন এই যে এতরকম রশ্মি মাথায় ঢুকছে, তাকে যদি বাইরে থেকে মনিটর করবার পদ্ধতি এসে যায়, তাহলে তো আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আজও এই শেষ বিকেলের আলোয়, তিনটে ঝুরি নামা বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে, সামনের গাড়ি-প্রবাহ দেখতে-দেখতে যেই নন্দিনীর কথা মনে এল, সে দিনের মতো আজও নিঃশব্দ অশ্রুপাত। শীতের হাওয়া বয়ে গেল বুকের মধ্যে। বুক ভেসে গেল চোখের জলে। সে একা-একা নৌকা বেয়ে চলেছে, কোথাও কোনও কূলকিনারা নেই…। খারাপ লাগছে, অসহায় লাগছে সব ঠিক, কিন্তু হারবে কেন? যদি একবার হারো, বারবার লড়ো, বারবার লড়ো, বারবার… লড়তে হবে। নো পাসারন। এক ইঞ্চি এগোতে দেওয়া নয় মনখারাপকে। একবার নাক টেনে, দু’বার গলা খাঁকারি দেবার পর একটু সুস্থ লাগল।

সুনীল তলাপাত্রের কথা শুনে প্রথমটায় খানিক মুষড়ে পড়লেও ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে রঞ্জন নিজেই খোঁজখবর শুরু করে দিয়েছিল। যত পড়ছে তত অবাক। নিউরোটেকনলজি কত এগিয়ে গেছে! ফিলিপ লো একটা অদ্ভুত যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, আই ব্রেন! এর সাহায্যে পক্ষাঘাতের রোগী, যারা কথা বলতে পারে না, তাদের মনের কথা জানা যায়। ক’দিন আগেই টরোন্টো ইউনিভার্সিটির ড্যান নেমরোডভ ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফিকে কাজে লাগিয়ে মনের কথা জানবার ব্যবস্থা করেছেন। কেউ একজনের মুখ গভীরভাবে কল্পনা করছে, তার শরীরে লাগান নানান তার, ইসিজি করবার সময় শরীরে যেমন লাগানো হয়, কতকটা সেই রকম। নেমরোডভ বলছেন, ভাবুন, ভাবুন, আরও গভীরভাবে ভাবুন তার মুখ,চোখ, কানের গড়ন, নাকের খাড়াই…। বানানো যন্ত্র বিশ্লেষণ করে চলেছে লোকটির ব্রেন ওয়েভ, কম্পিউটরে ফুটে উঠছে যার কথা, কল্পনা করা হচ্ছে তার চেহারা! এইসব তো ঘটছে পৃথিবীতে! এই যন্ত্র লালবাজারে বসানো হলে দারুণ হয়। এতদিন গোয়েন্দা বিভাগের কোনও শিল্পীকে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী, বর্ণনা শুনে-শুনে অপরাধীর ছবি আঁকতে হত, এখন যন্ত্র করে দেবে সেই কাজ। করে দেবে দ্রুত এবং নিখুঁত।

বাড়ি ফিরে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে ছিল। ভালো ঝামেলায় পড়া গেছে। মানুষের মাথার ভেতরটা বিচিত্র, কত জটিল শিরা-উপশিরা-স্নায়ুতন্ত্র-ঘিলু! সেই জটিল ব্যবস্থাটাকে চালনা করছে বাইরের কেউ! ভাবা যায়! নন্দিনীর কথাও মনে হচ্ছিল। হুট করে খুব তো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলি। বুঝলি না, বুঝতে চাইলিই না ব্যাপারটা কত সিরিয়াস।

নিউরোটেকনলজির বাড়বাড়ন্তের বিপদও আছে। বিদেশে মাইন্ড হ্যাকিং আর ব্রেনের তথ্য চুরির বিরুদ্ধে মানবাধিকার কর্মীরা তো সবাইকে বোঝাতে শুরু করেছে। নিউরোটেকনোলজির বিপদ নিয়ে সজাগ করতে নেমে পড়ছে তারা। ওরা বলছে, মনের কথা এমনভাবে জেনে যাবার কল করলে, মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা নিজস্ব গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকবে না। ভালো কাজের উদ্দেশ্যে করা হলেও, বজ্জাতরা তো চিরকালই তাকে বদমাইশির কাজে লাগায়।

আজ রঞ্জনও এই বদমায়েশদের শিকার। প্রথম শিফটের পর প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চলল, এখনও দু’নম্বর শিফটের ডাক আসেনি। ফলে,ঘোর অনেকটাই কেটে গেছে। এই যে ভুট্টা খেতে-খেতে এতটা নিজের মতো চিন্তা করতে পারল, কম কী! অলক্ষ্যে তাকে ঘিরে ধরেছে কিছু বজ্জাত। ধরুক, সে জাল কেটে বেরোবেই। কীভাবে? ভাবতে হবে। ভাবলেই মনের জোর বাড়ে, সমাধানের রাস্তা বেরিয়ে আসে। এই যেমন পড়ন্ত বিকেলে, বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে মাথায় এল, একবার শ্যামবাজারের ডিলারের কাছে যাওয়া খুব জরুরি, কেন সেলস কমে গেল বোঝা দরকার। গাড়ির দিকে এগোতেই লছমনের গলা–
– কঁহা যা রহে হ্যায়, পহলে জুতা তো উতারিয়ে…
লোকটা হাসছে। পেট খোলসা হলেই এমন নিশ্চিন্ত হাসি আসে।

প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *