– তাহলে আজ দুপুরে ক’জন লোক খাচ্ছে, কৃষ্ণা?

বারান্দায় মায়ের আর্ম-চেয়ারে বসে, ছোট্ট একটা বেতের মোড়ায় মায়ের মতোই পা দু’টো তুলে দিয়েছেন সুজাত। সামনে দাঁড়িয়ে বসন্ত আর কৃষ্ণা। দৃশ্যতই বেশ মজা পাচ্ছে তারা। কৃষ্ণা উত্তর দেওয়া শুরু করল কড় গুনে গুনে। “দিদিরা তিনজন, কলকাতা থেকে দিদির বন্ধুরা আসছে তিনজন, আর ও-বাড়ির দাদু …”

কে? হ্যাঁ, অলোকশদা। উনি একটু পরেই আসবেন। তখন আবার চা দিও আমাদের। কিন্তু ক’জন হল তাহলে মোট?

সাতজন।

তার সঙ্গে আমরা তিনজন আর আর তোমার ছেলে-মেয়ে। স্কুল থেকে ফিরলে আজ ওদের সুন্দর করে সাজিয়ে দিও, কেমন?

কৃষ্ণা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাতেই সুজাত জিজ্ঞেস করলেন, “কী খাওয়াচ্ছ আজ তুমি?”

“আপনিই বলুন না,” বলল কৃষ্ণা। মেনু ঠিক করার ব্যাপারে সুজাত এবার যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, তার সঙ্গে আগে কোনও পরিচয়ই ছিল না তার।

সুজাত একটু ভেবে বললেন, “আজ শিম-পোস্তটা কোরও। বলছিলে না, কুর্চি ভালোবাসে? তার সঙ্গে মটর ডাল আর ঢেঁড়স ভাজা। তারক একটু পরে গলদা চিংড়ি দিয়ে যাবে। চিংড়ি কিন্তু সবাই নাও খেতে পারে। আর একটা মাছ লাগবে। বসন্ত দেখ, বাজারে যদি পাবদা পাও আজ। তাহলে পাবদার তেল-ঝাল। পাবদা না-পেলে একটা ফোন করে জানিও ট্যাংরা, ভেটকি কোনটা পাওয়া যাচ্ছে। মৌরলা পেলেও নিয়ে নিও, তাহলে ঢেঁড়সের বদলে মৌরলা ভাজা। বারো জন খাচ্ছি আমরা, সেই বুঝে মাছ নেবে। পাবে তো?”

এখানে না পেলে বোলপুর হাটতলায় চলে যাব। মাছ যা বললেন, পাবদা-মৌরলা, সব পাওয়া যাবে।

বেশ, তাহলে বেরিয়ে পড়ো। ফেরার পথে সর্বমঙ্গলা থেকে দু’কিলো মিছরি মালাই আর কুড়িটা কাঁচাগোল্লা তুলে নিও। ওই তো অলোকেশদা এসে গেছেন। ঘড়ি দেখ, ঠিক আটটা বাজে।

অলোকেশের পরনে আজ তাঁতের পাটভাঙা ধুতি, খদ্দরের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। একটা চেয়ার টেনে সুজাতর পাশে গুছিয়ে বসে বললেন, “কুর্চিকে বাগানে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। বেশ খুশি খুশি লাগল।”

– তাকে তো আজ সকাল থেকে বাগানেই দেখছি। ঘুম ভেঙেই দেখি কৃষ্ণার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গান গাইছে! বলে সুর করে গেয়ে উঠলেন সুজাত —

“আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন॥”

অলোকেশ অবাক হয়ে সুজাতর গান শুনছিলেন আর ভাবছিলেন, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল আনন্দ পাঠশালা আর পাঠভবনে ছোটবেলা কাটানো এই সুজাত গুপ্ত! গান আর এগোবে না বুঝে জিজ্ঞেস করলেন, “কুর্চি কি আজই ফিরল?” কিন্তু সুজাতকে তখন গানে পেয়েছে। সোজা উত্তর না দিয়ে হাসতে হাসতে আবার গান ধরলেন, “মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে, ফিরেছ কি ফের নাই, বুঝিব কেমনে!”

হেঁয়ালি দিলে পারব না। বুঝিয়ে বলো।

বলব বলেই তো আপনাকে জোর করে শান্তিনিকেতনে টেনে আনলাম অলোকেশদা।  কুর্চি ফিরেছে, কিন্তু ফেরেনি। প্রজ্ঞানকাকুর বাড়িতে যেমন আছে, তেমনি থাকবে সে এখন। এ বাড়িতে থাকবে ফুটবলার বন্ধু আর তার মা। দেবদীপ নিজে গাড়ি চালিয়ে আজই কলকাতা থেকে আনছে তাদের। আপনি সত্যিই কিচ্ছু জানতেন না?

উত্তর না দিয়ে অলোকেশ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। সুজাতর জরুরি তলব পেয়ে কালই এসেছেন কলকাতা থেকে। এসব কিছুই জানতেন না। কারণ কুর্চির ওপর খবরদারি এক্কেবারে মন থেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন অলোকেশ। সে কথা আরও একবার বলে লাভ কী! সুজাতও কিছু বললেন না। কী যেন একটা সুর ভাঁজতে থাকলেন গুনগুন করে। কৃষ্ণা এসে চা রেখে গেল টেবিলে। দু’জনে চুপ করে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। অলোকেশই মুখ খুললেন আগে, বললেন, “একটাই প্রশ্ন আমার।”

“আমি কী করে মেনে নিলাম, তাই তো?” অলোকেশকে একরকম থামিয়ে দিয়েই বলে উঠলেন সুজাত। “সুখে-দুঃখে অনেক দিন আপনি আমার সঙ্গে আছেন, অলোকেশদা। মতের অমিল হয়েছে, তবু আমার কথাই বারবার মেনে নিয়েছেন আপনি, প্রবল আপত্তির পরেও। তাই এই প্রশ্নটা করার অধিকার আপনার আছে, শুধু আপনারই আছে। উত্তর দেওয়ার দায়টাও মেনে নিচ্ছি আমি। আপনাকে না বললে আর কারও কাছেই এই কথাগুলো কোনওদিন বলা হবে না।”

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার কথার খেই ধরলেন সুজাত। “অ্যানাস্থেটিস্ট ডক্টর কুশল মল্লিকের ঝকঝকে মেয়ে প্রেরণা। কুশল আমারই কলেজের, এক বছরের জুনিয়র। খুব বন্ধুপ্রিয় ছেলে, ডাক্তার মহলে সব্বাই ওকে খুব ভালোবাসে। বহুদিন একসঙ্গে কাজ করছি, ওরা আমাকে  পরিবারের একজন করে নিয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সেলিং করে ওর স্ত্রী প্রণোদিতা। মা-বাবা যেমন মার্জিত আর উচ্চশিক্ষিত, মেয়েও তেমনি। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে করতে একটা প্রজেক্টের কাজ নিয়ে প্রেরণা এক বছরের জন্যে এসেছিল জামিয়া মিলিয়াতে। দিল্লি পুলিশ যে রাতে জামিয়ার লাইব্রেরিতে ঢুকে লাঠি চালাল, সেদিন নিজে কোনওরকমে বেঁচেছে প্রেরণা। কিন্তু ওর বন্ধুদের অনেক রক্ত ঝরেছে পুলিশের ভয়ানক মারে। আর, সেদিন থেকে ওই মেয়ের প্রত্যেকটা রাত কেটেছে দিল্লির রাস্তায়। কখনও জামিয়ার ৭ নম্বর গেটের সামনে, কখনও শাহিনবাগে। ওর মা-বাবার অবস্থাটা কল্পনা করতে পারছেন? দুশ্চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুমোতে পারে না। তারপর শুরু হল দিল্লির দাঙ্গা। মেয়ে তখনও রাস্তায়। আর পারল না কুশল আর প্রণোদিতা। ছুটল দিল্লিতে। কিন্তু গিয়ে আটকে পড়ল। মেয়ে শাহিনবাগ ছেড়ে ফিরে আসতে রাজি নয়। আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেরণা তো শান্তশিষ্ট মেয়ে। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে চলে আসতে পারছ না? কুশল হেসে বলল, “গান্ধীও তো শান্তশিষ্ট মানুষই ছিলেন! আশ্চর্য এদের মনের জোর, বিশ্বাসের জোর। নিজের বিশ্বাস থেকে কেউ এদের টলাতে পারবে না, কিচ্ছু করতে পারবে না!” অলোকেশদা, বিশ্বাস করুন, আমার ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল কুশলের কথায়। মনে হল, কুশল তো চিনেছে, কিন্তু আমার বাড়ির গান্ধীকে চিনতে আমার এত দেরি হল কেন? তারপর এখানে চলে না এসে আমার সামনে আর কী উপায় ছিল বলুন তো?”

কোনও উত্তর নেই অলোকেশের কাছে। আবার চুপ করে বসে রইলেন দু’জনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বসন্ত দুই থলে ভর্তি বাজার নিয়ে টোটো থেকে নামল গেটের সামনে। কৃষ্ণা এগিয়ে গেল তার হাত থেকে বাজার নিতে। তখনই একটা ছোট্ট ফুলদানির মধ্যে দুটো গোলাপি লিলি গুঁজতে গুঁজতে বারান্দায় এসে হাজির হল সবুজ শাড়ি আর মেরুন ব্লাউজ পরা কুর্চি। চুলে গোঁজা একটা রক্তকরবী। বলল, “বাবা, ওপরে তোমার ঘর আর ঠাম্মার ঘর একটু ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দিলাম। অরিত্র থাকুক একতলায়, আর ওর মা-র ব্যবস্থা করলাম ওপরে, আমার ঘরে। ঠিক আছে?”

সুজাত দু’টো হাত বাড়িয়ে বললেন, “আয় তো আমার কাছে, কত দিন তোকে আদর করিনি!” বলে কুর্চির মাথাটা টেনে নিলেন তাঁর নিজের বুকে। আদর শেষ হলে বাবার গালে একটা চুমু খেয়ে কুর্চি বলল, “তুমি যদি একবার ওপরটা দেখে বল সব ঠিক আছে কিনা, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হই।” মেয়ের একটা হাত ধরে সুজাত বললেন, “কিচ্ছু দেখতে হবে না সোনা। তোমার যেমন ইচ্ছে, যেমন পছন্দ, তেমনি করে সাজাও। আমি তো আর বেশিক্ষণ নেই। দুপুরের খাবারটা সবাই মিলে একসঙ্গে খাব, তারপরেই আমি কলকাতা রওনা হব।”

সে কী! কেন?

কেন মানে? আমি তো এখনও রিটায়ার করিনি। আমার কাজকর্ম নেই? আজ থেকে আবার তুমি এ বাড়ি সামলানোর দায়িত্ব নিলে। এবার আমি ফিরে গিয়ে আমার পেশেন্টদের দায়িত্ব সামলাই।

চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন অলোকেশ। বললেন, “তোমরা বাবা-মেয়েতে কথা বলো, আমি বরং উঠি। একটু পরেই তো আবার খেতে আসতে হবে।” সুজাত হাসতে হাসতে বললেন, “কোথায় যাবেন? ওদিকে তাকিয়ে দেখুন, দেবদীপের গাড়ি গেটের সামনে পৌঁছে গেছে। আমি হয়ত আজ সুযোগ পাব না, আপনিই ওকে জানিয়ে দেবেন, দক্ষিণীর স্পনসর হয়েই থাকবে নিউভি ফার্মা। কি রে কুর্চি, দেখতে হবে না আই-লিগে কেমন খেলে তোর গোলকিপার!”

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *