আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০]

জুড়ান আমাকে  খবর দিল, চঞ্চলচন্দ্র এবার  এই ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র যাবেন। তাকে  ফ্ল্যাট খুঁজে দিচ্ছে জুড়ান। নোংরা নীলমাধবের প্রতিবেশী  হয়ে থাকবেন না তিনি।  আবদাল্লাকে এমন ভয় দেখিয়েছে  থানার কনস্টেবল  যে সে পালিয়েছে। তাকে খুঁজছেন চঞ্চলচন্দ্র।   

জুড়ান বসল সোফায় পা তুলে। ঢলঢলে প্যান্ট আর আধ ময়লা হাওয়াই শার্ট। দাড়ি খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। আমাকে বলল, অনুতোষ, গুণেন বলল, তুমি নাকি বলেছ ওদের চেন?

মসলন্দপুরের বসন্ত মল্লিক?

 ইয়েস অনুতোষ, বাট নট মসলন্দপুর, হাবড়া।

বসন্ত  যে আমাকে  বলল। আমি অবাক হয়ে বললাম।

বসন্ত নয় বসির, লুকিয়ে আছে তো, ঠিকানা বদলায়, এরপর বলবে বাদুড়িয়া কিংবা গাইঘাটা।  জুড়ানের কন্ঠস্বরে  গভীর  প্রত্যয়। 

আমি বললাম,  তুমি ভুল করছ জুড়ান, লোকটা নিরূপায়, মেয়েটাকে শিল্পী বানাতে চায়, নীলমাধবের ফাঁদে পড়েছে, হি ইজ বসন্ত, নট বসির। 

জুড়ান বলল, কিন্তু পার্ক স্ট্রিটে একটা মাস্টার ধরা পড়েছে তো সত্যি, শেখ মুজিবের হত্যাকারী, আমি তোমাকে ইউটিউব ভিডিও দেখাতে পারি।

তার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ? জিজ্ঞেস করলাম একটু ক্ষুব্ধ গলায়। 

সম্পর্ক আছেই, জুড়ান  সিগারেট ধরিয়ে বলল, নীলমাধব যোগ, ধরা ওরা পড়বেই, একটু ওয়েট করো। 

আমি বললাম, একই  কথা  গত  পঞ্চাশ বছর ধরে শুনছি জুড়ান।

এতদিন অপেক্ষা করেছ যখন আরও কিছুদিন অপেক্ষা করও, জুড়ান বলল, তোমার কাছে ক’টা টাকা হবে অনুতোষ।

কত? আমি যেন এই অপেক্ষায় ছিলাম। জুড়ান গুণেনের কাছ থেকে দুশো টাকা নিয়ে পঞ্চাশ করে  তিনবারে দেড়শ শোধ করেছে। বাকি পঞ্চাশ দেবে কিংবা দেবে না। হয়ত দেবে দশ দশ করে। অভাবী মানুষের যা হয়। 

আমরা ক্লাস ফ্রেন্ড অনুতোষ, দাও হাজার পাঁচেক, আমার কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেছে এই মাসে, পঁয়ষট্টির  পর আর রি অ্যাপয়েন্টমেন্ট  হয় না, আমি বারাসত মোটর ভেহিকেলে কাজ করছি, মানে কাজ ধরে করিয়ে নিচ্ছি, সবে আরম্ভ,  দালালি তো। 

তোমার ছেলে কী করে ?  

আমার তো ছেলে নেই। জুড়ান বলল, আসলে কেউ নেই, এক ভাই নেই, অন্য দুই ভাই  যোগাযোগ রাখে না, বোন ভাইফোটায় বাঁকুড়ায় ডাকে, খরচ করে অতদূর  যেতে পারি না। 

মেয়ে তো শপিং মলে কাজ করে?

মাথা নাড়ে জুড়ান, বলে, “আমার নয়, ভাইয়ের মেয়েকে নিজের মেয়ে করেছি, ও আমারই মেয়ে হয়ে আছে, সেই ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে, হকারি করত হাতিবাগানে, বাবা মারা যাওয়ার পর মেয়ে তার মায়ের কাছে ফিরে গেছে বাগমারি বস্তিতে।”  বলল জুড়ান, মোটর ভেহিকেলের দালালির কাজ আমাকে করতেই হবে, না করলে আমি সব নজরে রাখতে পারব না।

আমি বললাম, নজরে রেখে কী হবে?

বাহ, নজরে রেখেছি বলে এতটা জানতে পেরেছি, তুমি কি হাজি আনোয়ারের কথা জানো অনুতোষ ?

না, তিনি কে?  অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। 

বাংলাদেশের শিল্পপতি, জমি মাফিয়া,  ফেঁসে গেছে  ব্যাঙ্ক  কেলেঙ্কারিতে, এখন ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসবে, পালোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে । 

এ তো আমাদের দেশে আকছার হয়, দেশ থেকে কতজন পালিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা জালিয়াতি করে, তাতে তোমার কী, তুমি কী করবে? আমি বললাম,  তুমি আমি কতটুকু  মানুষ জুড়ান।  

নজরে রাখব, বসির মল্লিক কিংবা নীলমাধব মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা, তারা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে, এইটা ফাঁস করে দিতে পারলেই  কেল্লা ফতে। 

আমার মনে হলো জুড়ান রায় স্বাভাবিক নয়, বললাম, নজর দিতে কে বলেছে?

আমি জানি সবটা তাই নজরে রেখেছি, তুমি আমাকে পাঁচ হাজার দাও, আমি তোমাকে শোধ দিয়ে দেব মাস পড়লেই। পেনশন তো পাই।

 চুপ করে থাকলাম। অভাবি মানুষকে ধার দিলে কি ফেরত পাওয়া যায়, কিন্তু  কী যে মনে হলো,  বললাম, দিতে পারি এক শর্তে ?

কী শর্ত ? ভ্রূ কুঁচকে জুড়ান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। 

তুমি বসন্ত মল্লিককে বসির মল্লিক বলতে পারবে না, এসব রটাতে পারবে না। 

তাতে তোমার কী, আমি সিওর  বসির হয়ে গেছে বসন্ত। জুড়ান বলল, লুকিয়ে আছে। 

অনুমান করে এসব বলা ঠিক নয়, তোমার সবই অনুমান। আমি বললাম,  কোনও প্রমাণ নেই।

কিন্তু তাতে তোমার কী হবে   তা বলো।  জুড়ান বলল, নীলমাধবের লীলা তুমি সমর্থন করও?    

কী  করি না করি,  তা আমি বলব না, কিন্তু তোমাকে এটা করতে হবে।

অথচ  নীলমাধব ? জুড়ান ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, নীলমাধব যে যায় বসির মল্লিকের বাড়ি।

বসন্তর বাড়ি যায়, বসির মল্লিক কোথায় পেলে?  

কেন যায় বলও? জুড়ান সহজে দমবার মানুষ নয়।  

তা নিয়ে আমার কোনও কৌতুহল নেই, মেয়ের বাবা আর মেয়ের  ক্ষমতা আছে নিজেকে রক্ষা করার,  তুমি বসন্ত মল্লিকের উপর নজরদারি করবে না। আমি স্পষ্ট  করে বললাম।   

মেয়েটার নাম শামিমা জাহান শ্যামলী। জুড়ান তার গোঁ ছাড়ে না।

কে বলল? আমি অবাক, কী অদ্ভুত জুড়ানের কল্পনা।  

খবর পেয়েছি, বাংলাদেশে অমন নাম হয়, আগের অংশ বাদ দিয়ে  হয়ে গেছে শ্যামলী।

আমরা ক্লাস ফ্রেন্ড অনুতোষ, দাও হাজার পাঁচেক, আমার কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেছে এই মাসে, পঁয়ষট্টির  পর আর রি অ্যাপয়েন্টমেন্ট  হয় না, আমি বারাসত মোটর ভেহিকেলে কাজ করছি, মানে কাজ ধরে করিয়ে নিচ্ছি, সবে আরম্ভ,  দালালি তো। 



তুমি এসব অনুমান, কল্পনা ত্যাগ করবে? আমি একটু চাপা গলায় ধমক দিলাম, নিরীহ মানুষ বসন্ত, তাকে তুমি অতিষ্ঠ করে তুলছ নিরীহ মানুষ জগদীশ,  কেন এমন কর ? 

পাঁচ হাজারই   দেবে তাহলে ?

দেব কিন্তু শর্ত ওই। আমি দৃঢ় গলায় বললাম।  

জুড়ান রায় ভাবতে লাগল। দুহাতে মাথা টিপে ধরল। চোখ বন্ধ করল।  ভাবতে লাগল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমার বউ লিপিকা, তার মাথার ভিতরে খুব যন্ত্রণা হয়, মনে হয় আমার কথার ঝাঁঝ ওর মাথার ভিতরে ঢুকেছে অনুতোষ, কিন্তু কথা তো মিথ্যে মনে হয় না, ইন্টারনেট দেখলেই সব জানা যাবে, রাজাকার, নরহত্যা,  শেখ মুজিব হত্যা, তিরিশ লক্ষ মানুষ হত্যা, আমাদের উদ্বাস্তু  হয়ে চলে আসা, এখন তা অন্যদেশ হলেও আমাদের দেশ ছিল, আমি ওদেশের সব খবর রাখি, কিন্তু আমার বউ  শুনতে চাইত না, বলত যে দেশ তার নেই, সে দেশ নিয়ে কথা শুনবে না, ঝিনাইদহর মেয়ে, এখন  তার মাথায় খুব যন্ত্রণা…,  চিকিৎসা করাতে হবে। 

তাহলে লিখে দাও। আমি বললাম। 

কী লিখব?

বসন্ত যে বসির নয় তা লেখ, তুমি এসব রটাবে না লেখ। আমি ধমক দিলাম।

জুড়ান বলল,  ঠিক আছে আমার বউ মরে যাক,  সকলেই তো মরবে একদিন, কিন্তু  নীলমাধবের  ভালো হয়, তেমন কিছু আমি লিখব না।

নীলমাধবের তুমি কিছু করতে পারবে না, পারনি, তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি এতকাল, সত্যি হলেও বিশ্বাস করেনি, মিথ্যে হলেও বিশ্বাস করেনি, কেন এসব করও? 

জুড়ান চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আমার বোন রাখিকে ও একবার টিউশন ফেরার সময় ধরেছিল, তুমি জান?

না জানি না।  আমি বললাম, নীলমাধব আমার বন্ধু ছিল না।  

জুড়ান ম্লান মুখে  বলল, তুমি জান, ভুলে গেছ ভুলবে বলে,  আমি তো  চা ওয়ালা বিপিনের ছেলে তোমার বন্ধু ছিলাম, আমার বাবাকে ও তুই তোকারি করত, অ্যাই বিপিন, দুটো চা দে দেখি, কুইক। 

আমি এসব জানি না। বললাম যেন নতজানু হয়ে। 

জানতে অনুতোষ, কিন্তু মনে রাখতে চাওনি, তখন তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়, নভেম্বর মাস, মনে নেই  অনুতোষ, তোমাকে তখন বলিনি? তুমি জেনেও ভুলে গেছ অনুতোষ, আর একটু  হলেই পার্কে শুইয়েই  ফেলত রাখিকে, ওর সঙ্গে বংশী, ছোটন, ননী ছিল, চা-উলির ফ্রক ছিঁড়ে দিয়েছিল সে,  কোনো রকমে পালিয়ে এসেছিল আমার বোন। 

আমি সত্যিই  জানি না এই ঘটনা। বললাম  মুখ অন্ধকার করে, কিন্তু আমি জানি, শুনেছিলাম, বংশী হ্যা হ্যা করে বলেছিল, মাধব পেড়ে ফেলেছিল প্রায়, বংশী ছিল যুব পার্টির মাথা, মাধব তাকে মাল খাওয়াত, পয়সা জোগাত, ১৯৭৩ সাল, পুলিশ নক্সাল মারছে। যুব পার্টি  সকলকে চোখ রাঙিয়ে বেড়াচ্ছে। ত্রস্ত  হয়ে আছে  চারপাশ। 

জানো অনুতোষ, ভুলে গেছ, সব কথা মনে রাখতে নেই তাই ভুলতে পারলে, কিন্তু আমি ভুলিনি এখনও, আমি  এর শোধ  নিচ্ছি,  তুমি বলছ কেউ বিশ্বাস করে না, করে অনুতোষ, করে, গুণেন করে, আরো কতজন  করে তা কি তুমি জানো? জুড়ান আমার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলছিল, আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। চা দোকান করে সংসার চালাতেন জুড়ানের বাবা, বিপিন রায় লুঙ্গি আর শার্ট পরে এনামেলের থালায় চায়ের কাপ সাজিয়ে বাজারের পশারিদের কাছে ঘুরতেন, চা বিস্কুট, কোয়ার্টার পাউন্ড রুটির হাফ।  সেই লোকের মেয়ের যদি অপমান হয়, কীভাবে  তার প্রতিকার হবে?  মেয়েরই দোষ দিয়ে  পালোধীদের পক্ষে দাঁড়াবে পাড়া!  থানা  কি  পালোধীদের  বিপক্ষে যাবে? সংসার অভিজ্ঞ বিপিন রায়  জুড়ানকে থামিয়েছিল। 

জুড়ান বলল, এত বছর ধরে কিছু   লোকে  বিশ্বাস করেছে,  তুমি কি ভাব যা বলে আসছি আমি তার সবই  ভুয়ো, কিছুই সত্যি না, না হলে ওরা  এই নিয়ে চুপ করে থাকল কেন? 

কিন্তু বসন্ত মল্লিক কী দোষ করল? 

জুড়ান বলল,  বসির নাম, তুমি বসন্ত বলছ, আচ্ছা তাই,, নীলমাধব  মেয়েটাকে নষ্ট করবে, ও লোভে পড়ে মেয়েটাকে…,  আমাকে হেল্প করবে  অনুতোষ, তুমি ইচ্ছে মতো ভুলে গেছ অনেক কথা।

শর্ত মানলে  টাকা দেব। আবার বললাম। 

কাগজ কলম দাও, তবে পালোধীদের  বিপিনের বেটা ক্ষমা করবে না। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল জুড়ান।       

জুড়ান খসখস করে সাদা কাগজে লিখতে আরম্ভ  করবে  এবার। কলম হাতে নিয়ে ভাবল  কী লিখবে। হয়ত ভাবছে, লিখলে তার সমস্ত জীবনের অনুমান মিথ্যে।  একটা মিথ্যে হলে অন্যটাও  মিথ্যে হয়ে যাবে। অথচ সারাজীবন  ধরে  একটা  সত্য  প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠার পিছনে তার বোন রাখির অসম্মান  জড়িয়ে আছে।  জুড়ানের ঘাড় ঝুলে পড়েছে কাগজ কলম  নিয়ে। সে লিখতে আরম্ভ করল। গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে জুড়ান। 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *