সব মরণ নয় সমান। বুলবুল নামক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ প্রান্তে যে মানুষগুলির প্রাণ গেল, তাঁদের মৃত্যুসংবাদ জেনে শ্রোতারা অনেকেই একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, তার পর খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন। ওই মানুষেরা কেউ বিখ্যাত ছিলেন না, তাঁদের চলে যাওয়াকে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ বলার কথা ভাববেনও না কেউ, নিতান্ত আপনজনেরা ছাড়া। তাঁদের মৃত্যুতে কোনও চমকপ্রদ ঘটনা নেই, কোনও রহস্য নেই, যা মানুষের কৌতূহল আকর্ষণ করতে পারে। ঝড় আসার আগে অবধি ওঁরা ছিলেন, ঝড় চলে গেল, ওঁরাও নেই হয়ে গেলেন, বেবাক, বেমালুম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ রকম বহু প্রাণ নিয়ে যায়। এ আমাদের অতি পরিচিত ঘটনা। আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘প্রকৃতির মার’। আগে বলতাম ‘ভগবানের মার’, এখন অনেকেই অন্তত ভাষাটা পাল্টেছি, হাল-ছেড়ে-দেওয়া মানসিকতা পাল্টাইনি। প্রকৃতির মার তো বটেই, কিন্তু তার কতটা অনিবার্য? কোন মৃত্যু অমোঘ ছিল, কোনটি নয়? সব দুর্যোগ সমান নয়। ভূমিকম্প বা সুনামির ক্ষেত্রে প্রস্তুতির সময় থাকে না, বা— সুনামির বেলায়— যে সময়টুকু থাকে তা প্রস্তুতির পক্ষে যথেষ্ট নয়। ঝড়ের ব্যাপারটা সব সময় তা নয়, অনেক সময়েই তার পূর্বাভাস থাকে। এ বারেও ছিল। পূর্বাভাসের প্রযুক্তি এখন অনেকটা উন্নত হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় এসে আছড়ে পড়ার অনেক আগে থেকেই তাকে শ্যেনদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা চলে, তার গতিপথ অনুমান করা চলে, এমনকি মাঝপথে সে বাঁক নিলেও সেই পরিবর্তনের চেহারা চরিত্র সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা স্থলভূমিতে কোথায় তার কতটা আক্রমণ হবে, তা বুঝে নেওয়া যায়। তার পরেও এতগুলো প্রাণ চলে যায় কেন?

না, সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে অন্যায় হবে। ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত এলাকায় মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রশাসন কিছু করেনি, এমনটা বলা যাবে না একেবারেই। বরং আগের আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার বেশ কয়েক দিন ধরে উদ্যোগ করা হয়েছিল বলেই বহু মানুষকে সময় থাকতে সরিয়ে নেওয়া গেছে নিরাপদ জায়গায়, তা না হলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারত।

দোষারোপের পরিচিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আর একটু পরিষ্কার করে সমস্যাটা নিয়ে ভাবা দরকার। কাজে লাগানো দরকার স্থানীয় সমাজকে। দেখা দরকার, এ ধরনের বিপর্যয়ের পূর্বাভাস পেলে কী ভাবে নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, স্থানীয় মানুষ নিজেরা যাতে সে বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকেন এবং তার পাশাপাশি সরকারি প্রশাসনের স্থানীয় স্তরে তাঁদের সাহায্য করার সমস্ত ব্যবস্থা মজুত থাকে। এখানেই আমাদের দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার গোটা পরিকাঠামোয় একটা বড় রকমের ঘাটতি থেকে যায়। দুর্যোগ হঠাৎই আসে, কিন্তু তার মোকাবিলার প্রস্তুতি হঠাৎ তৈরি করা যায় না, সেটা একেবারে রোজকার জীবনের অঙ্গ করে নিতে হয়। বিশেষ করে যে সব জায়গায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বাভাবিক ঘটনা, প্রতি বছরই একাধিক বার সেই দুর্যোগ ঘটতে পারে। 

আসলে সেই ধরনের প্রস্তুতি ঠিক ভাবে নেওয়ার জন্য সমাজের মনে একটা ধারণা তৈরি করা দরকার। সেটা এই যে, কোনও একটি প্রাণও যেতে দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশের মানুষের মনে এই ‘জিরো টলারেন্স’ এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আমরা মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকলেই সন্তুষ্ট থাকি। এই মন পাল্টাতে হবে। বলতে হবে, ‘সব মরণ সমান’।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *