আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২]

জন্তুরা একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল৷ সকলেই জানে স্নোবল ওদের হাওয়াকল ধ্বংস করেছিল, কিন্তু এবারে তার বদমায়েশি যেন আগের সব ঘটনাকেই ছাপিয়ে গেছে৷ তবুও স্কুইলারের কথাগুলোকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে নেওয়ার আগে তারা থমকে কয়েক-মুহূর্ত ভাবল৷ স্মৃতি এখনও পুরোপুরি ধোঁয়াটে হয়ে যায়নি৷ তারা দিব্যি মনে করতে পারল গোয়ালঘরের যুদ্ধে স্নোবল কেমন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, কীভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের উজ্জীবিত করেছিল৷ এমনকী জোন্সের গুলি পিঠে লাগার পরেও এক মুহূর্তের জন্য থামেনি সে৷ সুতরাং প্রাথমিকভাবে কারও মাথায় ঢুকল না যে এত কিছুর পরেও স্নোবল জোন্সের পক্ষ নিলটা কেমন করে! যে বক্সার কখনও কোনও বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তোলে না, সে-ও পর্যন্ত ঘাবড়ে গেল৷ সামনের হাঁটু দুটো মুড়ে বসে, চোখ বন্ধ করে সে প্রচণ্ড চেষ্টা করতে লাগল নিজের ভাবনাচিন্তাগুলোকে এক সুতোয় গাঁথার৷ তারপর একসময় বলে উঠল,
– উঁহু, আমার কিন্তু এ কথা বিশ্বাস হচ্ছে না৷ স্নোবল গোয়ালঘরের যুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছিল, আমি তা নিজের চোখে দেখেছি৷ আমরা তো তো এজন্য তাকে ‘প্রথম শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’ খেতাবও দিয়েছিলাম৷ দিইনি?
– আমাদের ভুল হয়েছিল, কমরেড। স্নোবলের যে গোপন নথিপত্রগুলো আমরা খুঁজে পেয়েছি তার থেকে সব জানা গেছে৷ সে আসলে আমাদের বরবাদ করারই চেষ্টায় ছিল৷
– কিন্তু স্লোবলের তো সত্যি সত্যিই আঘাত লেগেছিল৷ আমরা সবাই তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছি৷
– এ সবই সাজানো ঘটনা, কমরেড।
স্কুইলার বলল।
– জোন্সের গুলি তাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে কেবল৷ এসব সে নিজেই লিখেছে, তোমরা যদি পড়তে পারতে তা হলে দেখিয়ে দিতাম। স্নোবলের আসল ধান্দা ছিল অন্য৷ সে ঠিক করেছিল জটিল পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের ডাক দেবে এবং শত্রুর মুখে সব্বাইকে ফেলে ময়দান ছেড়ে চম্পট দেবে৷ তার উদ্দেশ্য প্রায় সফল হয়েও যাচ্ছিল, কমরেডস৷ বলা যেতে পারে সফল হয়েই যেত— যদি না আমাদের বীর নেতা কমরেড নেপোলিয়ন থাকতেন৷ তোমাদের কি মনে নেই, জোন্স তার দলবল নিয়ে খামারের উঠোনে ঢুকতেই স্নোবল কেমন উল্টো দিক ফিরে পিঠটান দিয়েছিল? অনেক জন্তুও তো ওর পিছুপিছু তখন পালিয়ে গিয়েছিল৷ আমরা সবাই ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিল এই বুঝি হেরে যাব— তখন কমরেড নেপোলিয়ন ‘মানবজাতি মুর্দাবাদ’ বলে হুংকার ছেড়ে লাফিয়ে গিয়ে জোন্সের পায়ে কেমন ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিলেন৷ তোমাদের নিশ্চয়ই এসবই মনে আছে কমরেডস? কি? মনে নেই?

স্কুইলার উত্তেজিত হয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে এমন ছবির মতো পুরো ব্যাপারটাকে সবার সামনে তুলে ধরল যে, জন্তুদের মনে হতে লাগল যেন এসব ঘটনা সত্যিই একসময় ঘটেছিল৷ যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত জন্তুরা মনে করতে পারল যে স্নোবল সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও বক্সারের মন থেকে খুঁতখুঁতে ভাবটা গেল না৷ সে বলে উঠল,
– আমি কিন্তু মনে করি না যে স্নোবল একদম শুরু থেকেই বিশ্বাসঘাতক ছিল৷ পরে সে যা করেছে তার কথা আলাদা, কিন্তু গোয়ালঘরের যুদ্ধের সময় সে একজন সাচ্চা কমরেড ছিল বলেই আমার বিশ্বাস৷
খুব কেটে কেটে দৃঢ় গলায় ঘোষণা করল স্কুইলার,
– আমাদের নেতা, কমরেড নেপোলিয়ন স্পষ্টভাবে… আবার বলছি খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, স্নোবল একদম প্রথম থেকেই জোন্সের চর ছিল৷ হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ কমরেডস, যখন কেউ বিপ্লবের কথা কল্পনাও করেনি তখন থেকেই সে জোন্সের হয়ে কাজ করছে।
বক্সার বলল,
– তা হলে সেটা আলাদা ব্যাপার৷ কমরেড নেপোলিয়ান যদি বলে থাকেন তবে তা নিশ্চয় ঠিকই হবে৷
– বাহ্‌! বাহ্‌! এই তো চাই, কমরেড!
স্কুইলার মুখে একথা বলল বটে, কিন্তু দেখা গেল সে কুঁতকুঁতে চোখে খুব বিশ্রীভাবে তাকিয়ে রয়েছে বক্সারের দিকে৷ স্কুইলার ফিরে যাবার জন্য ঘুরে গিয়েও আবার থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ গলায় কিছুটা আবেগ এনে বলল,
– এই খামারের প্রত্যেক জন্তুকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি— সব্বাই কিন্তু চোখ কান খোলা রেখে চলবে। আমরা বেশ বুঝতে পারছি স্নোবলের কিছু চর এখনও আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে৷
চারদিন পরের কথা, তখন বিকেল প্রায় ফুরিয়ে আসার পথে, এমন সময় নেপোলিয়ন হুকুম জারি করল যে, সব জন্তুকে খামারের উঠোনে এসে জড়ো হতে হবে৷ সেইমতো জন্তুরা সবাই একজোট হওয়ার পর খামারবাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল নেপোলিয়ান। সম্প্রতি সে নিজেই নিজেকে ‘প্রথম শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’ আর ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর জানোয়ার বাহাদুর’— এই খেতাব দুটো দিয়েছে৷ সেই দুটো পদকই সে এখন পরে আছে৷ তার চারপাশে ঘুরছে ন’টা কুকুর৷ তাদের গর্জনে বাকি জন্তুদের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে। প্রত্যেকে নিজের-নিজের জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ কারও যেন বুঝতে আর বাকি নেই যে খুব খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে এবার৷ 

Animal Farm 2
কুকুরগুলো আচমকাই যেন ক্ষেপে উঠল

নেপোলিয়ন সমবেত জন্তুদের উপর কঠিন দৃষ্টি হেনে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল। অমনি কুকুরগুলো লাফিয়ে গিয়ে চারটে বাচ্চা শুয়োরের কান কামড়ে ধরল৷ তারপরে তাদের ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলল নেপোলিয়নের পায়ের তলায়৷ শুয়োরগুলো ব্যথায় ভয়ে রীতিমতো আর্তনাদ করছে, কান থেকে রক্তও গড়াচ্ছে ওদের৷ কুকুরগুলো রক্তের স্বাদ পেয়ে আচমকাই যেন ক্ষেপে উঠল৷ সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনটে কুকুর ছুটে গেল বক্সারের দিকে৷ বক্সার ওদের আসতে দেখেই তার বিশাল খুর বাগিয়ে তৈরিই ছিল৷ একটা কুকুর ওর দিকে লাফ দিতেই বক্সার প্রায় শূন্য থেকে কুকুরটাকে লুফে নিয়ে এক ঝটকায় মাটিতে পেড়ে ফেলল, তারপর ঠেসে ধরে রইল পা দিয়ে৷ সঙ্গীর এই দুর্দশা দেখে অন্য কুকুরগুলো আর এগোবার সাহস করল না৷ নিমেষের মধ্যে লেজ গুটিয়ে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল৷ ওদিকে বক্সারের বিশাল খুরের তলায় ধরাশায়ী কুকুরটা সমানে কুঁইকুঁই করে তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য কাকুতিমিনতি করে চলেছে৷ বক্সার নেপোলিয়নের দিকে তাকাল। ভাবখানা এই— কী করব? একে পিষে গুঁড়িয়ে দেব? না ছেড়ে দেব? 

নেপোলিয়নের মুখের রঙ ততক্ষণে বদলে গেছে৷ সে তীক্ষ্ণ গলায় বক্সারকে হুকুম দিল কুকুরটাকে ছেড়ে দিতে৷ বক্সার পা তুলে নিতেই কুকুরটা কেঁউ-কেঁউ করতে করতে চোরের মতো পালিয়ে বাঁচল৷ তার শরীরময় চোট-আঘাতের দাগ৷ সাময়িকভাবে গন্ডগোল থামল৷ শুয়োরের বাচ্চা চারটে বাঁশপাতার মতো ঠকঠক করে কাঁপছে, তাদের চোখেমুখে অপরাধবোধের ছাপ। নেপোলিয়ন তাদের সব দোষ স্বীকার করার হুকুম দিল৷ এই শুয়োরগুলো হচ্ছে সেই শুয়োর, যারা নেপোলিয়ন রবিবারের সভা বাতিল করার সময় প্রচুর হইহল্লা করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷ যা-ই হোক, দ্বিতীয়বার বলতে হল না, শুয়োরগুলো নিজে থেকেই স্বীকার করল যে, স্নোবলকে তাড়িয়ে দেয়ার পর থেকেই ওরা গোপনে তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং হাওয়াকল ধ্বংস করার কাজেও তারা স্নোবলের সঙ্গ দিয়েছে৷ এমনকি মিস্টার ফ্রেডরিকের হাতে অ্যানিম্যাল ফার্ম তুলে দেয়ার ব্যাপারে স্লোবলের সঙ্গে তাদের চুক্তিও হয়েছিল। শুয়োর চারটে শেষমেষ এ-ও বলল, স্নোবল নাকি তাদের কাছে একান্তে এ কথা স্বীকার করেছিল যে, সে অতীতে বহু বছর ধরেই জোন্সের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছে৷ চার শুয়োরের স্বীকারোক্তি শেষ হয়েছে-কি-হয়নি, কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে ওদের টুঁটি ছিঁড়ে দিল৷ রক্তজল করা গলায় নেপোলিয়ান জানতে চাইল আর কারও কিছু স্বীকার করার আছে কিনা৷

এবার তিনটে মুরগি এগিয়ে এল৷ মুরগিরা ডিম পাড়বে না বলে মাঝে যে একটা বিদ্রোহের চেষ্টা করেছিল, এই মুরগি তিনটে ছিল সেই বিদ্রোহের নেতা৷ মুরগিগুলো জানাল যে, স্নোবল ওদের স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে নেপোলিয়নের আদেশ অমান্য করার জন্য উসকেছিল। এদেরও সঙ্গে সঙ্গে কোতল করা হল৷ এরপর এল একটা রাজহাঁস৷ সে স্বীকারোক্তি করল যে, সে নাকি গত বছরের ফসল থেকে শস্যের ছ’টা শিস চুরি করে রাত্তিরবেলা লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়েছিল৷ এরপর একটা ভেড়া এসে স্বীকার করল— সে খাবার জলের পুকুরে পেচ্ছাব করেছে৷ জানা গেল, এর পেছনেও রয়েছে স্নোবল৷ আরও দুটো ভেড়া এসে স্বীকারোক্তি দিল, তারা একটা বুড়ো ভেড়াকে খুন করেছে৷ সেই বুড়ো ভেড়াটা নাকি নেপোলিয়নের অন্ধ ভক্ত ছিল৷ বুড়োটার সর্দি হয়েছিল, সেই অবস্থায় তাকে আবর্জনার স্তূপের আগুনের চারপাশে গোল গোল ছুটিয়ে ছুটিয়ে মেরেছে ওরা৷ এদেরকেও মুহূর্তের মধ্যে জবাই করা হল৷ এইভাবে স্বীকারোক্তি আর সাজা দেওয়ার পালা চলতে লাগল একের পর এক৷ দেখতে দেখতে নেপোলিয়নের পায়ের সামনে লাশের পাহাড় জমে গেল, রক্তের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল৷ জোন্সকে তাড়ানোর পরেও যে এমন একটা পরিস্থিতি কখনও তৈরি হতে পারে তা জন্তুরা স্বপ্নেও ভাবেনি৷ 

বিচার আর নিধনের এই পর্ব মিটলে পরে শুয়োর আর কুকুর বাদে প্রায় সব জন্তুরাই নিঃশব্দে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল৷ ওদের মনের অবস্থা খুবই খারাপ৷ অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠেছে সবার৷ কোন ঘটনাটা যে বেশি ঘা দিয়েছে, তা ওরা নিজেরাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না— স্নোবলের সঙ্গে দল বেঁধে জন্তুগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা করা, না কি তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলা— যা একটু আগেই তাদের চোখের সামনে ঘটল৷ আগেকার জমানায় এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ড এই খামারে যে হয়নি তা নয়৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় সেসব এখন তাদের নিজেদের মধ্যেই ঘটছে৷ সেজন্যই বোধ হয় সবার এটা মেনে নিতে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে৷ জোন্স চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই খামারে কখনও কোনও জন্তু অন্য জন্তুকে হত্যা করেনি৷ একটা ইঁদুর পর্যন্ত মারা হয়নি৷ ধীর পায়ে হেঁটে ওরা সেই ছোট ঢিবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ অর্ধসমাপ্ত হাওয়া কলটা এখনও সেখানে খাড়া রয়েছে৷ ওরা একে অপরের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে সেখানে বসে পড়ল— ক্লোভার, মুরিয়েল, বেঞ্জামিন, গরুভেড়ার পাল, হাঁস-মুরগিরা সব্বাই৷ ওরা একে অপরের উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিতে চায়৷ বেড়ালটা যথারীতি এই দলে নেই৷ নেপোলিয়ান সকলকে জমায়েত হওয়ার হুকুম দেয়ামাত্র সে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল৷

Animal Farm 3
সব জন্তুরাই নিঃশব্দে নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। বক্সারই কেবল বসেনি৷ সে অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর নিজের লম্বা কালো লেজটাকে সপাং সপাং করে দু’পাশে চালাচ্ছে৷ মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক শব্দও করছে৷ এরকম কিছুক্ষণ চলার পর শেষমেষ সে বলে উঠল,
– আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না৷ সত্যি বলছি, আমার এখনও যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমাদের খামারে এমন কাণ্ড কখনও ঘটতে পারে! আমাদেরই হয়তো কিছু ভুলচুক হয়েছিল৷ আমার মতে এর সমাধান একটাই— আরও বেশি পরিশ্রম করা৷ এখন থেকে আমি প্রতিদিন সকালে পুরো এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ব৷
এই বলে সে দুলকি চালে পাথরের খাদের দিকে হাঁটা দিল৷ সেখানে পৌঁছে প্রথমে পাথর সংগ্রহ করল এবং পরপর দু’বোঝা পাথর টেনে এনে হওয়াকলের কাছে রেখে তবে সেদিনের মতো কাজ থেকে ছুটি নিল। জন্তরা সবাই ক্লোভারের গা-ঘেঁষে বসে রয়েছে৷ কারও মুখে কোনও কথা নেই৷ যে ঢিবিটায় তারা বসে আছে সেখান থেকে আশপাশের গ্রামের বিস্তৃত দৃশ্য দেখা যায়৷ বড়ো রাস্তা পর্যন্ত প্রসারিত দীর্ঘ তৃণভূমি, খোড়ো মাঠ, ছোট বন, পুকুর, চাষের জমিতে সুপুষ্ট কচি কচি গমের চারা এবং খামারের লাল টালি বসানো বাড়ির ছাদের চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া— খামারের সিংহভাগ অঞ্চল এখন তাদের চোখের সামনে৷

বসন্তকালের এক মেঘমুক্ত নির্মল সন্ধ্যা৷ মাঠের ঘাস, ঝোপঝাড়— সবই বেলাশেষের সোনালি আলোয় মাখামাখি হয়ে রয়েছে৷ বহুদিন পরে তাদের আবার মনে পড়ল, এই খামার ওদের নিজেদের৷ এর প্রতিটি ইঞ্চি ওদের নিজস্ব সম্পত্তি৷ চারপাশে বিস্মিত চোখ মেলে ওরা যেন নতুন করে খামারটাকে আবার ভালোবেসে ফেলল৷ এত ভালো আগে কখনও বাসেনি৷ পাহাড় ছাড়িয়ে নীচের দিকে দৃষ্টি মেলতেই ক্লোভারের চোখ জলে ভরে গেল৷ সে যদি নিজের ভাবনাচিন্তাগুলো ঠিক ঠিক ভাবে কথায় প্রকাশ করতে পারত তা হলে সে বলত, মানুষদের উৎখাত করার সময় যে লক্ষ্য নিয়ে তারা এগিয়েছিল তার সঙ্গে আজকের দিনটার বিস্তর ফারাক৷ বুড়ো মেজর যে রাতে ওদের ভেতর প্রথমবারের মতো বিপ্লবচেতনা জাগিয়ে তুলেছিল, তখন তো ওরা এমন একটা হাড়কাঁপানো কসাইখানার ছবি কল্পনাও করেনি৷ ক্লোভার নিজের মনের গভীরে যে ভবিষ্যতের ছবি লালন করত, সেই সমাজে খিদের জ্বালা নেই, চাবুকের শাসন নেই৷ সেখানে সবাই সমান৷ প্রত্যেকে নিজের সাধ্যমতো পরিশ্রম করবে৷ সবলেরা দুর্বলদের রক্ষা করবে— যেমনভাবে সে নিজে বুড়ো মেজরের বক্তৃতার রাতে ছোট্ট-ছোট্ট হাঁসের ছানাগুলোকে নিজের সামনের দু’পায়ের ঘেরাটোপে আগলে রেখেছিল৷

Animal Farm 1
কমরেড, এই গানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে

কিন্তু তার বদলে, কেন কে জানে— এমন এক সময় এসেছে যখন কেউ নিজের মনের কথাটা প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছে না৷ হিংস্র কুকুরের দল তর্জনগর্জন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র৷ তোমার চোখের সামনে তোমার কমরেডরা ভয়ানক সব অপরাধের স্বীকারোক্তি করছে তারপর কুকুরের কামড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা যাচ্ছে৷ ক্লোভারের মনে কিন্তু অবাধ্যতা বা বিদ্রোহী চিন্তাভাবনার লেশমাত্র নেই৷ সে জানে, এখন অবস্থা যেমনই হোক না কেন, জোন্সের আমলের চেয়ে তা ঢের ভাল৷ এবং এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ বলতে একটাই— মানুষের ফিরে আসা আটকাতে হবে৷ ক্লোভার জানে, যা-ই হয়ে যাক, তাকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে৷ তাকে যে যে নির্দেশ দেয়া হবে সব অক্ষরে অক্ষরে পালনও করতে হবে, এবং সর্বোপরি নেপোলিয়নের নেতৃত্ব মেনে চলতে হবে৷ তবুও একটা কথা স্বীকার করতেই হয় যে এভাবে বাঁচার আশায় সে বা অন্যান্য জন্তুরা এত খাটাখাটনি করেনি৷ এভাবে বাঁচবে বলে তারা হাওয়াকল বানায়নি বা জোন্সের গুলি খায়নি৷ এরকম অজস্র ভাবনার স্রোত বয়ে যেতে লাগল ক্লোভারের মনের মধ্যে— সেগুলোকে ঠিকঠাক প্রকাশ করার মতো শব্দের যোগানই পাওয়া যাচ্ছে না৷ ক্লোভার শেষ পর্যন্ত শব্দের খোঁজ মুলতুবি রেখে তার বদলে ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গেয়ে উঠল৷ তাকে ঘিরে বসে থাকা জন্তুরাও তার সঙ্গে গলা মেলাল৷ পরপর তিনবার গানটা গেয়ে ফেলল তারা— খুব ধীরলয়ে, শোকাকুল সুরে৷ এভাবে আগে কখনও তারা গানটা গায়নি৷ তৃতীয়বারের গান শেষ হয়েছে-কি-হয়নি দুটো কুকুর সমেত স্কুইলার এসে হাজির। তারা তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে এসেছে৷ সে ঘোষণা করল, কমরেড নেপোলিয়নের বিশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানটার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷ এখন থেকে এই গান গাওয়া চলবে না৷

জোন্স চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই খামারে কখনও কোনও জন্তু অন্য জন্তুকে হত্যা করেনি৷ একটা ইঁদুর পর্যন্ত মারা হয়নি৷ ধীর পায়ে হেঁটে ওরা সেই ছোট ঢিবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷ অর্ধসমাপ্ত হাওয়া কলটা এখনও সেখানে খাড়া রয়েছে৷ ওরা একে অপরের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে সেখানে বসে পড়ল— ক্লোভার, মুরিয়েল, বেঞ্জামিন, গরুভেড়ার পাল, হাঁস-মুরগিরা সব্বাই৷ ওরা একে অপরের উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিতে চায়৷ বেড়ালটা যথারীতি এই দলে নেই৷

জন্তুরা একেবারে হতচকিত হয়ে গেল৷ মুরিয়েল বলল,
– কেন?
স্কুইলার বলল,
– কমরেড, এই গানের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ হল বিপ্লবের গান৷ কিন্তু বিপ্লব তো কবেই সফল হয়েছে৷ আজ বিকেলে বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যেটুকু বাকি ছিল সেটুকুও সারা হয়ে গেল৷ ঘরেই বল কিংবা বাইরে— সর্বক্ষেত্রেই আমরা আমাদের শত্রুদের হারিয়ে দিয়েছি৷ ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানে একটা উন্নতমানের সমাজ চেয়েছিলাম আমরা৷ কিন্তু সেই উন্নত সমাজ তো আমরা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি৷ তা হলে এই গানের আর দরকারটাই বা কী?
যদিও সবাই খুবই ভয় পেয়ে রয়েছে তবুও হয়তো দু-একটা জন্তু প্রতিবাদ করলেও করতে পারত৷ কিন্তু সে সুযোগ মিলল না৷ ভেড়াগুলো তারস্বরে ‘চারপেয়েরা ভালো, দু’পেয়েরা খারাপ’ বলে চিৎকার জুড়ে দিল৷ বেশ কয়েক মিনিট ধরে এই চিৎকার চলল, আর কোনওরকম আলোচনার জায়গাই রইল না৷ এরপর ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’ গানটা আর কখনও শোনা যায়নি৷ তার জায়গায় মিনিমাস নামের কবি শুয়োরটি নতুন একটা গান তৈরি করল৷ সেই গানের শুরুটা এ-রকম—

পশুখামার, পশুখামার
তোমার ক্ষতি করব না কভু
তুমি যে প্রিয় আমার৷

ফি রবিবার পতাকা তোলার সময় এই গানটাই গাওয়া হতে লাগল৷ কিন্তু এই গানের কথা, সুর কোনওটাই যেন ‘ইংল্যান্ডের পশুরা’-র মতো জন্তুদের নাড়া দিয়ে যায় না৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৩০ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Englishclasses, Movie Nation, Pinterest

Arka Paitandi

অর্ক পৈতণ্ডীর জন্ম ১৯৮৫-তে বীরভূমের সিউড়িতে। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। বিজ্ঞানের স্নাতক। পেশাদার শিল্পী। 'মায়াকানন' পত্রিকা ও প্রকাশনার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। অবসরে লেখালিখি করেন। অলঙ্করণ শুরু ষোলো বছর বয়সে শুকতারা পত্রিকায়। পরবর্তীকালে আনন্দমেলা, সন্দেশ, এবেলা, এই সময়, উনিশ-কুড়ির মতো একাধিক পত্রপত্রিকার জন্য ছবি এঁকেছেন। কমিক্স আঁকার জন্য ২০১৪ সালে নারায়ণ দেবনাথ পুরস্কার পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *