আমার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের দিনগুলোয় আবিষ্কার করা দুই মনীষীর রচনা আমার সঙ্গী হয়েছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের দিনগুলোতেও। তাঁদের একজন টমাস আ কেম্পিস, তাঁর বই ‘দ্য ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’ বড় প্রিয় ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। স্বামীজি পড়তে পড়তেই ওঁকে খুঁজে পাই এবং ওঁর রচনায় থেকে থেকেই মনে হয় যেন স্বামীজিরই কথা শুনছি। যেমন কেম্পিস যেখানে লিখেছেন…
“প্রতিদিন সকালে খেয়াল করো যে তুমি সন্ধে অবধি নাও বাঁচতে পারো। সন্ধেকালেও ভেবে নিও না তুমি সকাল অবধি থাকছ। তাই সারাক্ষণ তৈরি থেক যাতে মৃত্যু এসে তোমাকে অপ্রস্তুত না দেখে।”
দ্বিতীয় মনীষী সেন্ট অগাস্টিন, যাঁকে চিনিয়েছিলেন আমার আর এক চিরসঙ্গী লেখক আলব্যের কামু। ইস্কুলে নানাজনের লেখায় এই সন্তের নামটা আসতই, ওঁর বিখ্যাত বই ‘কনফেশনজ়’-এর (স্বীকারোক্তি) একটা কপিও দেখেছিলাম মিশনের লাইব্রেরিতে। তবে আসল পরিচয়টা ঘটালেন কামু পারতপক্ষে একটি বাক্যে, সেটি তিনি উদ্ধৃত করেছেন সেন্ট অগাস্টিনের আত্মজীবনী ‘কনফেশনজ়’ থেকেই। যেখানে অগাস্টিন প্রার্থনা করছেন ঈশ্বরের কাছে,
“হে প্রভু, আমাকে শুদ্ধসত্ব, নিষ্পাপ করো, কিন্তু এখনই না।”
খুব চমকেছিলাম কথাটায়। অগাস্টিন বিশুদ্ধ হতে চাইছেন, কিন্তু আর একটু সময় পার করে! কেন? জীবনের আরও কিছু ভোগ, পিপাসা মিটিয়েই। তাহলে জীবনটা কেমন ছিল সন্তের? সেই কৌতূহল থেকেই সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদারদের নিজস্ব যে অসাধারণ লাইব্রেরি (যেখান থেকে কামু’র ‘লিরিকাল অ্যান্ড ক্রিটিকাল এসেজ়’ বইটিও নিয়েছিলাম) তারই শরণাপন্ন হলাম। এবং পাওয়ার পর এমন পড়া শুরু হল যে বিকেলে বাড়ি না ফিরে সন্ধে ছ’টায় কলেজ থেকেই পার্ক স্ট্রিটের আর এক মোড়ে আলিয়ঁস ফ্রঁস্যাজে ফ্রেঞ্চ ক্লাস করতে চলে গেলাম।

গিয়েছি যখন, তখনও ক্লাস শুরু হতে একঘণ্টা; আমি ফরাসি পড়া নয়, পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম ‘কনফেশনজ়’-এর যা একটা অপরূপ উপন্যাসের মতো আমায় ভর করেছে। গোটা বইটাই ঈশ্বরের কাছে সন্তের অকপট স্বীকারোক্তি, জীবনের সমস্ত পাপ ও পতন বলে বলে, মেনে নিয়ে। আলেয়ঁসের একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে একা-একা বসে পড়ছি…
“সে সময় আমি একটা মেয়ের সঙ্গে থাকতাম, যে আমার বিবাহ করা স্ত্রী ছিল না, নিতান্ত যৌন তাড়না সঞ্চার করত বলে যাকে আমার রক্ষিতা করেছিলাম। তবে ওরকম সম্পর্ক শুধু ওর সঙ্গেই ছিল এবং আমি ওর প্রতি বিশ্বস্তও ছিলাম। ওর সঙ্গে সহবাস করেই বুঝেছি যথার্থ বৈবাহিক সম্পর্কের সংযম কীরকম, যেখানে শরীরের মিলন হয় সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়। আর রতিতৃপ্তির কারণে সহবাসে জন্মানো সন্তান বস্তুত বিড়ম্বনা, যদিও তারা এসে পড়লে ক্রমে ক্রমে ভালবাসায় জড়িয়ে ফেলে।”
‘কনফেশনজ়’-এর একটা পেপারব্যাক সংস্করণ আমার হাতে ঘুরত যখন ইংরেজিতে এমএ পড়ছি। মূল বই লাতিনে লেখা, তাই তা আমার পাঠ্যসূচির অঙ্গ নয়। এমএ-র পাঠ্য ছিল সেন্ট জেমসের ইংরেজি বাইবেলের ‘বুক অফ জোব’ অধ্যায়। অধ্যাপক সারদাপ্রসাদ দে, সংক্ষেপে এসপিডি, বড় আনন্দ আর আবেগের সঙ্গে অধ্যায়টি পড়াতেন। শুরুর দিনই বলেছিলেন,
“একটা কথা জেনো তোমরা, শুদ্ধ ইংরেজির এক সেরা নমুনা জেমস বাইবেল। ‘বুক অফ জোব’ তারই এক মর্মবিদায়ী পর্ব, জোবের দুঃখকষ্ট ও সহনশীলতার নিপুণ বৃত্তান্ত। আমার বড় ভাল লাগবে এটা তোমাদের সঙ্গে পড়তে।”
বলেই স্যার অকাতরে মন থেকে আবৃত্তি করে যেতেন ‘বুক অফ জোব’ থেকে অপূর্ব সব বাক্য …
“Can’t thou by searching find out God?”
কিংবা
“The price of wisdom is above rubies”
বা
“Great men are not always wise.”
অথবা
“For I am full of matter, the spirit within me constraineth me”
ক্লাসে যখন ‘জোব’ পড়ছি, বাড়ি গিয়ে পাতা ওল্টাতাম দুটি আত্মজীবনীর। দুটোরই শিরোনাম ‘কনফেশনজ়’। প্রথমটা, বলা হয়েই গেছে, সেন্ট অগাস্টিনের। দ্বিতীয়টা ফরাসি মনীষী জ্যঁ জাক রুসো-র। কপালজোরে ওয়েলিংটনের পুরনো বইয়ের দোকানে নামমাত্র দামে পেয়ে গিয়েছিলাম এক কপি। তাতে ফল দাঁড়াল এই, যে সিলেবাসের বই ফেলে উথালপাথাল হচ্ছি দুই আশ্চর্য স্বীকারোক্তিতে। পড়ছি আত্মজীবনী আর মনে হচ্ছে যেন দুই জীবন, জগৎ ও সময়ের মধ্যে আন্দোলিত হচ্ছি। আর এই রুসোর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জুড়ে গেল কলেজ স্ট্রিট আর কলেজজীবন। কলেজ স্ট্রিট, কারণ গোটা এলাকা জুড়ে তখন বিপ্লবের হাওয়া, ’৬৮-র ফরাসি ছাত্রবিপ্লবের প্রবল আঁচ সবার গায়ে। দেদার বিকোচ্ছে দোকানে দোকানে চে গেভারা সংক্রান্ত লেখাপত্তর, আর ‘আর্বান গেরিলা’ নামের একটা পেপারব্যাক বই, দেখি কারও কারও হাতে বা বগলে। এক কপি আমার হাতেও চলে এসেছিল কখন জানি।

বিএ-তে আমার পাস সাবজেক্ট ছিল ইতিহাস। আর আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসের শুরুই তো ফরাসি বিপ্লবে, যার সূত্র আবার ভলত্যার, রুসো আর ফরাসি বিশ্বকোষ রূপকার দিদেরা, দালম্ব্যারি-দের চিন্তায়। এই অগাস্টিনের মতো রুসোর স্বীকারোক্তিরও সম্পর্ক নেই আমার ইংরেজি সিলেবাসের সঙ্গে, অথচ এরাই আমার মন জুড়ে বসছে। যেখানে কামু সাহেব তো আছেনই। যাঁর ‘দ্য আউটসাইডার’ উপন্যাস এক অদ্ভুত স্বীকারোক্তি হিসেবে তখন নতুন চোখে পড়ছি। উপন্যাসের শুরুতে অপূর্ব তিনটি বাক্য এক মায়াবী গোলাপের কাঁটার মতো হয়েছে মনের ভিতরে। নায়ক ম্যরসো’র কণ্ঠস্বর যখন ভেসে ওঠে: “আজ মা মারা গেছে। হয়তো গতকালই। জানি না।” এরকমই এক বৈপ্লবিক শুরুই মনে হল রুসো’র ‘কনফেশনজ়’-এর। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঁথা হয়ে গেলাম। এই বইও হাতে নিয়ে ঘোরা শুরু হল। শুধু প্রথম পরিচ্ছদটাই বার পাঁচেক পড়ে দীর্ঘ বইটায় ডোকার রাস্তা করেছিলাম। সেই শুরু এমনই …
“I have resolved on an enterprise which has no precedent, and which, once complete, will have no imitator. My purpose is to display to my kind a portrait in every way true to nature, and the man I shall portray will be myself.
Simply myself, I know my own heart and understand my fellow man. But I am made unlike anyone I have even met; I will even venture to say that I am like no one in the whole world. I may be no better, but at least I am different. Whether Nature did well or ill in breaking the mould in which she formed me, is a question which can only be resolved after the reading of my book.”

প্রেসিডেন্সির বান্ধবী একটু অবাকই হত আমার এই সব বইয়ের প্রতি দুর্বলতা দেখে। ও-ও কিছুদিন ফ্রেঞ্চ পড়েছিল এবং কামু’র ‘দ্য আউটসাইডার’ উপন্যাসের ফরাসি নাম যে ‘লেত্রঁজে’ তাও জানত। তবে দুর্বলতা বলতে যা বোঝায় তা ওর ছিল ইংলিশ মেটাফিজ়িকাল পোয়েটসদের প্রতি। আর ওর নতুন দুর্বলতা হয়েছিলাম আমি। কফি হাউজ় হোক কি ইংলিশ সেমিনার রুম, একবার থিতু হয়ে বসলে কত কী যে বকে যেতাম অনর্গল, তা আমি নিজেও এখন ভাবলে অবাক হই। ১৯৭৩ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার প্রথম উপন্যাস ‘এই আমি একা অন্য’র জন্মও বোধহয় এই একতরফা বকে যাওয়া থেকে। ওই ক্রমান্বয়ে কথা বলার মধ্যে যে সঙ্গ, নির্জনতা ও অনুরাগ আছে, সেই চলনটাই তুলে এনেছিলাম উপন্যাসে। কারও জন্য লিখছি না, কোনও কোনও মানুষকে শুনিয়ে কথা কয়ে যাচ্ছি যেন। যার প্রথমজন কফি হাউজ ও ইংলিশ সেমিনার রুমে মুখোমুখি সেই বান্ধবী। যাকে উদ্দেশ করে উপন্যাসের প্রথম তিন বাক্য— “পায়ের ওপর পা। পরমেশ্বরী। এই ছিল রূপা।”
প্রথম চুম্বনে পৌঁছতে যে কত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত হয়েছি ঈশ্বরই জানেন। সেন্ট অগাস্টিনের ‘কনফেশনজ়’ যেন তেমনই এক মধুর সংলাপ জারি করেছেন আমার ভেতর সে সময়। ভেতরে ভেতরে কথা কয়ে যাচ্ছি নিজের সঙ্গে। কফি হাউজ়ে বসলে সেও এক বৈদ্যুতিক পরিবেশ। চেনাশোনা মুখরা সব বিপ্লবে যোগ দিচ্ছে। আর আমরা প্রসিডেন্সির দলবল আখের গোছাব বলে নিশ্চিন্তে বই ঘাঁটছি, প্রেমে পড়ছি, বড় বড় মানুষের ক্লাস করে যাচ্ছি। এক এক সময় আমি অগাস্টিন ও রুসো’র ‘কনফেশনজ়’ কি টমাস আ কেম্পিসের ‘দ্য ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট’-এর প্রশ্নের মুখে পড়ছি। আগুন, বই আর গোলাপে মুড়ছে আমার কলেজ স্ট্রিট, কলেজজীবন। এরকমই একদিন কফি হাউজে বসেছি দু’জনে আমরা, যখন খবর এল অসীম চট্টোপাধ্যায়, থুড়ি, কাকা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। সহসা কফিটা বড় তিক্ত ঠেকল, কোনও কথা সরল না কারও মুখে। বুকের কোথায় যেন একটু চিনচিন করল।

সেদিন রাতে বই সাজিয়ে পড়তে বসেছি। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে নিজের কাছেই কিছু স্বীকারোক্তির প্রয়োজন। রুসোর স্বীকারোক্তি পৃথিবীর কাছে, অগাস্টিনের স্বীকারোক্তি ঈশ্বরের কাছে, আর আমার? মনে পড়ল দার্জিলিংয়ের জনমানবশূন্য সূর্যাস্তকালে ম্যাল, ১৯৫৫ সালের জুন মাস। রক্তিম আকাশের প্রেক্ষাপটে সুটেড-বুটেড দীর্ঘাঙ্গ বাবা ওঁর সাহেবি উচ্চারণে আট বছরের আমাকে আর মা’কে আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা ‘Kali the Mother’…
The Stars are blotted out,
The clouds are covering clouds
It is darkness vibrant, sonant
In the roaring, whirling wind
Are the souls of a million lunatics
Just loose from the prison house,
Wrenching trees by the roots,
Sweeping all from the path…
Dance in destruction’s dance
Come O Mother come.
Who doth misery love
And hug the form of death,
Dance in destruction’s dance,
To him the Mother comes.
মনে হল আমার ভয়-ভাবনা-দুঃখ-বেদনা জানানোর দেবী তো আছেনই বুকের মধ্যে। কালী। আমি তাঁর কাছেই ফিরে আসি। (চলবে)
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, India Today, CareElite
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।
স্যার, অনেক কিছু জানছি আপনার লেখা থেকে। যেগুলো র সন্ধান কেউ আজ পর্যন্ত দেয়নি। আমাদের শেখানো হয়েছে যা, তাতো কাজে লাগেনি। লেগেছে চাকরি পেতে, বড়জোর মানুষ কে বলতে যে “আমি বি এ , এম এ । কিন্তু জানলাম কি ? লিখলাম কি? তাই, জীবনের সায়াহ্নে এসে ( ৬৮ বছর বয়স আমার) আবার জানতে চাই, বুঝতে চাই। সেই কাজটি আপনি করে দিচ্ছেন , স্যার। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।