২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাংলালাইভের সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন গোসাঁইকবি। কলামের নাম ‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’। কেমন সেই কাব্যময় অভিযাত্রা? কবি নিজেই লিখেছিলেন প্রথম পর্বটিতে– ‘কবিতা বিষয়টাই আজও আমার অজানা। কবিতা, আমার কাছে, এখনও, একটা অজানা বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে। পথ চলে একরকম অজানার মধ্য দিয়ে। এবার এক অজানায় পৌঁছে সম্পূর্ণ করে নিজেকে। কবিতা সম্পূর্ণ হবার আগের লাইনে অথবা তার আগের লাইনে আমি আন্দাজ পাই কবিতাটি এবার থামতে চলেছে। এই অজানার সঙ্গে বসবাস করেই পার করে এলাম এতগুলো বছর।’ সেই অজানাকে আবিষ্কার আজও কবিমানসে নিরন্তর বয়ে চলেছে। ভাবছেন, পড়ছেন, আবার ভাবছেন, কখনও লিখছেন, কখনও অস্ফূটে বলছেন। চলেছে অন্তর্যাত্রা। নবীন কবিদের কবিতাকে আশ্রয় করে কবিভাবনের সূক্ষ্ম পথরেখা উন্মোচিত হচ্ছে পরতে পরতে। বাংলালাইভ উঁকি দিচ্ছে সেই গোপন অন্তর্লীন কাব্যবিশ্বের এক কোণ দিয়ে…। শুরু হল ‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’-এর দ্বিতীয় পর্যায়। এবার সঙ্গে থাকবে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, যা শুনতে পাবেন পডকাস্ট হিসেবেও।
কবিতার সঙ্গে বসবাস: অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতা: শেষ পর্ব
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় একটি টিভি চ্যানেলে নবীন প্রজন্মের একজন কবির সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন নব্বই দশকের লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি শিবাশিস মুখোপাধ্যায়। শিবাশিস এই চ্যানেলে নিয়মিত কবি ও লেখকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর নির্বাচনে নতুন যুগের লেখক ও কবিরাই প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। এরফলে আমার ব্যক্তিগতভাবে একটি উপকার সাধিত হয়। যে-কবিরা এই চ্যানেলে আসেন, তাঁদের সকলের বই-ই আমার কাছে আছে, ঠিক কথা, কিন্তু কবিতা রচনা সম্পর্কে তাঁদের ভাবনাকেন্দ্রের নানা বিচ্ছুরণ জানতে পারি, এমন কোনও গদ্যগ্রন্থ আমি সংগ্রহ করে উঠতে পারিনি এখনও। সে কারণে, শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নগুলির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা যে প্রতিক্রিয়া জানান, সেইসব উত্তরমালা থেকে তাঁদের চিন্তাপদ্ধতি আমার খানিকটা অধিগত হয়।
যে-সন্ধ্যার কথা বলেছি প্রথমে, সেই সন্ধ্যার অতিথি ছিলেন অমৃতা ভট্টাচার্য। এই কবির প্রথম বই প্রকাশ পায় ২০১৮ সালে– অর্থাৎ অমৃতা ভট্টাচার্যকে আমরা বলতে পারি একবিংশ শতকের প্রথম দশকের কবি। সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্নের উত্তরে অমৃতার কাছে জানতে পারি তাঁর জীবনের দুটি তথ্য– যা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হল, নিজের গবেষণার কাজে শিলং গিয়েছিলেন অমৃতা, গিয়ে দেখেন সেখানে তখন কার্ফ্যু চলছে। পূর্বভারতের এই অস্থিরতা দেখে অমৃতার মনে হয়, কেবল পূর্বভারত-ই নয়, আমাদের সমস্ত দেশেই এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে এখন।
দ্বিতীয় যে-অভিজ্ঞতার কথা অমৃতা জানান, সেই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে ঘটে যখন তিনি স্কুলছাত্রী। এই সময়, অমৃতার বাবা, হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়। পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো খেতে পারেন না, ঘুমোতে পারেন না। পার হয়ে যায় এক সপ্তাহ। হঠাৎ অমৃতার বাবাকে কারা যেন বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। দেখা গেল, অমৃতার বাবার মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। তখন বামফ্রন্টের শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে। অমৃতার বাবা শিক্ষকতা করেন তখন। কিন্তু সিপিএমের অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ তিনি জানাচ্ছিলেন জেলাস্তরে। আরামবাগে বাড়ি অমৃতার। সেখানেই ঘটে এই ঘটনা। সিপিএমের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল অমৃতার বাবাকে।
এই দুটি ঘটনা কীভাবে অমৃতার কবিতায় ঢুকে এল, তা বুঝতে পারি, যখন শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি তাঁর দুটি কবিতা পাঠ করেন। অমৃতার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি আগে পাঠ করেন তিনি। উক্ত কবিতার বইটি আমার সংগ্রহে থাকায় পাঠকদের সামনে কবিতাটি তুলে দিতে পারছি এখন:
আমাদের পাড়ায়
কোনও মাও-সে-তুং ছিল না কোনওদিন
কোনও চে-গেভারা বা হো-চি-মিনও নয়!
আত্মীয়দের মধ্যে কেউ নকশাল ছিল না কোনওদিন
কোনও মাওবাদীকে সামনে থেকে চিনিনি কখনও
আমার বাড়ি পাহাড় থেকে অনেক দূরে
নাগা, অসম, মণিপুর, দিল্লি, গুজরাট
সবার লড়াই– আমার বইয়ের পাতায় আর টিভির স্ক্রিনে!
শুধু বিপ্লবের সঙ্গে মুক্তির লড়াইয়ে
আমার নির্বিবাদী বাবার মাথায় চোদ্দোটা সেলাই দেখেছিলাম একবার—
আজও বাবার হাতে
চিরুনি ধাক্কা খায়
সেলাইয়ের স্ফিত দেয়ালে;
চিরুনির সঙ্গে
ওই প্রত্যেকটা দেয়ালে ধাক্কা খায়
আমার চুপ করে থাকার বিলাসিতা।
এইজন্যই কবিদের একান্ত সাক্ষাৎকার জরুরি। অন্ততঃ আমার মতো সন্ধিৎসু পাঠকের জন্য, জরুরি। এই কবিতায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কথা উঠে এসেছে। যেসব অঞ্চল অশান্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে– যেমন নাগাল্যান্ড, অসম, মণিপুর…। উঠে এসেছে নিজের একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। বাবা নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে যখন ফিরে এলেন, বোঝা গেল বাবার মাথায় চোদ্দোটা সেলাই রয়েছে। ওই চোদ্দোটা সেলাইয়ের দাগ চিরদিনের জন্য স্ফিত হয়ে রইল অমৃতার বাবার মাথায়। চুল আঁচড়াতে গেলে চিরুনি সেখানে আটকে আটকে যায়। এই হল বাইরের ঘটনাটুকু।
ভিতরের প্রক্রিয়াটি কী? সে হল কবির আত্মসমালোচনা। পরিচালক কিসলোভস্কি তাঁর একটি চলচ্চিত্র ‘ক্যামেরা বাফ’ তৈরি করেছিলেন একজন ফোটোগ্রাফারের জীবন নিয়ে। সেই ফোটোগ্রাফার চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায় এবং যা দেখে তারই ছবি তোলে। এইভাবে চলতে চলতে সেই ফোটোগ্রাফারের জীবন নানারকম ঘূর্ণিপাকের মধ্যে এসে পড়ে। ফিল্মের একদম শেষে কিসলোভস্কি দেখিয়েছেন, ওই ফোটোগ্রাফার আর বাইরের দিকে তার ক্যামেরা তুলে ধরছে না– বাইরের কোনও বিষয়বস্তু আর তার উপজীব্য নেই তখন, সেই ফোটোগ্রাফার ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে। নিজেকে এবার দেখতে শুরু করে সেই ফোটোগ্রাফার।

আমাদের এই কবি, অমৃতা ভট্টাচার্যের পূর্বোক্ত কবিতাটিও সেই ধর্ম পালন করেছে। কবিতাটির শেষ লাইনে এসে দেশ জোড়া অরাজকতার সামনে নিজের নীরব থাকাকে দায়ী করে কবিতাটি সম্পূর্ণ করেছেন কবি। নিজেকে একপ্রকার ধিক্কারই দিয়েছেন। নিজেই নিজেকে এমন বিরুদ্ধ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করা, সাধারণত এখনকার কবিতায় দেখা যায় না। নিজেকে সমর্থন করেই এখন প্রধানত লেখা হয় কবিতা। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় পাওয়া যেত এরকম আত্মসমালোচনার স্বর। কবিতাটি শোনার সময় একবারও আমি বুঝতে পারিনি, শেষে পৌঁছে এভাবে ক্যামেরার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেবেন অমৃতা। অমৃতার দ্বিতীয় কাব্য়গ্রন্থের প্রবেশক কবিতাটি বললাম। এবার বলি এই বইয়ের একেবারে প্রথম কবিতাটির আরম্ভে পাচ্ছি কোন তিনটি লাইন:
চিৎকার করতে না-পারার ক্ষমা চাইছি আমি!
মাটি কামড়ে থাকার ঔদ্ধত্যে
ক্ষমা চাইছি আবার–
এইভাবে নিজের কথা বলতে বলতে সমস্ত মধ্যবিত্ত সমাজের কথাও বলা হয়ে গেল কবিতায়, যে মধ্যবিত্ত নিজেকে একটা নিরাপদ নিরপেক্ষতায় ঘিরে রাখতে চায়। এ-কবিতাও অবশ্যই একরকম প্রতিবাদ। তবে সরাসরি প্রতিবাদ এসে পড়ে কবিতায় যখন অমৃতা লেখেন:
…. মণিপুর, এসো, আঁচল তুলে ধরো
বিবস্ত্রা হও, লজ্জা সরিয়ে রাখো
একবার শুধু আয়নায় দেখি আজ
আমার চড়াই, আমার উৎরাই
আমার স্রোত, আমার খাদ–
আমি ভারতবর্ষ!
মণিপুরের রাস্তায় অসম রাইফেলস-এর সশস্ত্র বাহিনীর সামনে মণিপুরের বয়স্কা মহিলারা যে নগ্ন হয়ে কোমরের কাছে সকলে একসঙ্গে একটি বড় ফেস্টুন ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন একদিন, আর সেই অস্ত্রধারী উর্দিপরিহিত বাহিনী ক্রমশ পিছু হটে যাচ্ছিল ভয়ে– সে-কাহিনি আমাদের সকলের জানা। সেই কাহিনিই এ-কবিতার উৎস। কিন্তু ‘আরশিকথা’ নামক এই কবিতাটি উৎসেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। যেহেতু এই কবি একজন নারী, তাই কবিতাটি খোলা নারীশরীরকে মেলে ধরছে আয়নার সামনে– বলছে: ‘একবার শুধু আয়নায় দেখি আজ / আমার চড়াই, আমার উৎরাই / আমার স্রোত, আমার খাদ…।’ এই পর্যন্ত একটি নারী শরীরকেই যেন দেখতে পাই আমরা। এ কথাও মনে হয় যে, অনেক যুবতী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার না একবার নিজের শরীর পর্যবেক্ষণ করেছে তার জীবনে, পোশাকহীন অবস্থায়। এখানে আবারও মনে রাখতে হবে যে, কবিতাটির নাম ‘আরশিকথা’ এবং আয়না এ কবিতায় স্পষ্টভাবেই উপস্থিত।
আমি কবিতাটির শেষাংশটুকুই ব্যবহার করেছি। কিন্তু সেখানে কবিতার প্রথমে প্রয়োগ করা ‘মণিপুর’ শব্দটি ভুলে যাব কী করে? সেখানেও তো বলা আছে, ‘মণিপুর, এসো, আঁচল তুলে ধরো’। মণিপুর এক পার্বত্য অঞ্চল– তাই, ‘আমার চড়াই আমার উৎরাই আমার খাদ’, এই সবই যেমন নারীদেহের বর্ণনা, তেমনই এক পার্বত্য অঞ্চলেরও বর্ণনা। তবে একেবারে শেষে এসে, এ কবিতা এক অভাবনীয়ের মুখোমুখি দাঁড় করায় পাঠককে, যখন কবিতার স্বর বলে: ‘আমি ভারতবর্ষ!’ অর্থাৎ নিজের নগ্ন শরীর পরিবর্তিত হয়ে ভারতবর্ষ নামক এক বিরাট দেশ হয়ে উঠল।
অমৃতার বাবার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার বৃত্তান্ত আরও বিশদভাবে ধরা পড়েছে তাঁর ‘বিপ্লবের নমিনিরা’ কবিতায়:
… হ্যারিকেনের কাচটা ঘোলাটে
মা আজও মোছেনি
রোজকার মতো ঘুঁটের ছাই দিয়ে মুছে
মুখে হাওয়া ভরে
জ্বালিয়ে রাখা পরিষ্কার কাচ
আজ ঘোলাটে, কালিমাখা–
দোরগোড়ায় বসে আছে মা
বাবা ফেরেনি–
আজ সাতদিন
কালিমাখা কাচ ঘিরে
শান্ত হয়ে আছে বিপ্লবের হাওয়া–
আজ নিয়ে সাতদিন।
পরপর চারটে বাইক
শ্বাপদের জ্বলন্ত চোখ হয়ে
দাঁড়াল রাস্তায়।
অন্ধকার ঠেলে ছায়ামূর্তিরা সিঁড়ি বেয়ে
উঠে এল উঠোনে।
চৌকাঠ থেকে ধড়মড় ছুটে গেল মা–
কালো কাচের মধ্যে দপদপ করছে বিপ্লব।
পিছনে দাঁড়ানো বাবা, ভিড়ের মধ্যে–
সারামাথায় ব্যান্ডেজ– সাদা কাপড়ে
চাপচাপ রক্ত, ছোপ ধরে আছে
জামার আস্তিনে, পিঠে, গালের পাশে–
ঝড়ের আগে থেমে থাকা হাওয়ায়
দেয়ালে টাঙানো ছবির মতো উঠোনে
হ্যারিকেনের কালো কাচ পেরিয়ে
বিপ্লব ধাক্কা খেল বাবার চোখে।
অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণের পর
ব্যান্ডেজ বাঁধা ফোলা মুখে
বাবার ওই দুটো চোখ–
ক্লাস সিক্স-এর ইতিহাস বইয়ে বিপ্লবের প্রথম মশাল।
বাংলা কবিতায় দুটি প্রধান ধারা দেখা যায়। একটি হল বিবরণধর্মী কবিতার ধারা, অন্যটি সঙ্কেতধর্মী কবিতার পথ। কখনও কখনও একই কবি দুটি ভিন্ন সময়ে এই দু’ধরনের কবিতাই লিখেছেন, এমন আমরা দেখতে পাই বাংলা কবিতার অনতিঅতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে। অমৃতার যে-কবিতাটির কথা এক্ষুণি বললাম, তার চলন বিবরণধর্মী, কিন্তু শেষে গিয়ে তাঁর পূর্বোক্ত তিনটি কবিতাই এক আচমকা মোচড়ে অন্য উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে। বিবরণ, কেবল বিবরণ হয়েই থাকছে না। এক উত্তরণ লাভ করছে।
এবার বলব অমৃতার এমন কবিতার কথা, যা সঙ্কেতধর্মী। যা অন্তর্মুখী। হ্যাঁ, আগের কবিতাগুলির মধ্যে ছিল বাইরের পৃথিবী এবং নিজের জীবনকে বাইরের দিক থেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক আকস্মিক ঝাঁকুনি দিয়ে বিস্তারের দিকে নিয়ে যাওয়া। এবার অমৃতার অন্যরকম কবিতার কথা বলব, যেসব কবিতার মূল কোথাও কোথাও মনস্তত্বের জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে। যেখানে কবিতার ভাষা সহজ ও সাবলীল হলেও কবিতার অন্তর্বস্তু কবির চেতনার গভীরে চেপে রাখা কোনও স্তরের উন্মোচন সম্ভব করে। যেমন এই কবিতাটি:
সংলাপ
মন: তেলের ঘনত্ব সরিয়ে একলাবাজি করে এক লহমায় পারি জঙ্গলে বান ডাকতে… মথের ডানায় গরল তুলে কপালে টিপ করে অভিসার সাজাতে, রক্তশিব গড়তে পারি, একদমে তাকে নিয়ে মাটি ফুঁড়ে উড়ে যেতে পারি সময়গর্ভ ছাড়িয়ে…
শরীর: আগুনে বুদ্বুদ তুলতে পারো? পারো কি স্বপ্ন ফিরিয়ে দিতে সেই কিশোরকে, যে তার কৌমার্য ভাঙতে প্রস্তুত?
এই কবিতার গঠনের মধ্যে এমন এক নতুনত্ব সঞ্চারিত হয়েছে, যা সচরাচর কোনও নবীন কবির হাতে দেখতে পাই না। কেননা, নবীন কবিরা, সাধারণত, তাঁদের অব্যবহিত আগে যাঁরা লিখতে এসে খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেইসব একদশক-দু’দশক পূর্ববর্তীদের কাব্যরচনার পন্থাই অনুসরণ করে চলেন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে। অনেকসময়ই নবীন কবিদের লেখা পড়তে গিয়ে খুঁজে পেয়েছি, ঠিক তাঁদের আগের কোনও কোনও কবির রচনারীতির সাদৃশ্য। এমন সব কবি যাঁরা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন।
এইমাত্র অমৃতার যে-কবিতা তুলে দিলাম, সেই ফর্ম বা গঠনটি কিন্তু অমৃতার সমসাময়িক কবিরা কেউ ব্যবহার করেননি। সামান্য পূর্বজরাও নয়। কারণ এখানে নাটকের আঙ্গিক প্রয়োগ করেছেন অমৃতা। অথচ কাব্যনাট্য লিখতে যাননি। কাব্যনাট্য অনেক বড় পরিসর নিয়ে রচিত হয়, একটি কাহিনিসূত্র ধরা থাকে তার মধ্যে, শেষে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যও অপেক্ষা করে কাব্যনাটকের পরিণতির মুখে। কিন্তু এই কবিতার লক্ষ্য তেমন নয়। স্বল্প কয়েকটি লাইনে দেখা যাচ্ছে, কথা বলছে মন ও শরীর। কবিতাটি খুব নিশ্চিত করে কোনও পরিণতিও দেখাচ্ছে না। পাঠকের মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, পাঠকের কল্পনার জন্মকে উস্কে দিচ্ছে, কবিতাটির সমাপ্তিটুকু ঘিরে টেনে আনছে বহু স্মৃতি। কখনও জীবনস্মৃতি, কখনও পাঠস্মৃতি।

আমার যেমন মনে পড়ছে অস্ট্রিয়ার লেখিকা এলফ্রিদে ইয়েলিনেক-এর (Elfriede Jelinek) কথা। ২০০৪ সালে ইয়েলিনেক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এবং বিস্ময়ের কথা, ইয়েলিনেক নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে জাঁকজমকপূর্ণ পুরস্কার প্রদান সমারোহে উপস্থিত হতে স্টকহোমে যাননি। তিনি বলেছিলেন একটি টেলিফোন সংলাপে, ‘I cannot stand public attention.’ ইয়েলিনেক-এর অনুরোধে অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত সুইডিশ দূতাবাসে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে সে-দেশের রাষ্ট্রদূত তাঁর হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেন পরে। ইয়েলিনেক মনে করেন, একলা ঘরে বসে লেখাটুকুই তাঁর মঞ্চ। লেখা পাঠকের সামনে আসুক। লেখক হিসেবে তিনি জনসমক্ষে আসতে নারাজ।
এই একই কথা আমরা বলতে পারি এলফ্রিদে ইয়েলিনেক-এর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ইতালির লেখিকা এলেনা ফেরান্তে বিষয়েও। এলেনা ফেরান্তে এখনও পর্যন্ত চারটি উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেকটি উপন্যাস নিজের দেশে তো বটেই, সেইসঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে এলেনা ফেরান্তের খ্যাতি। কিন্তু এই লেখিকাকে তাঁর প্রকাশকরাও কোনওদিন দেখেননি। কোনও বইয়ের প্রোমোশনে এলেনা উপস্থিত হন না। কোনও জার্নালে সাক্ষাৎকারও দেন না। টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তাঁর বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পায়নি আজও। এমনকী এলেনা ফেরান্তে তাঁর প্রকৃত নাম কিনা, জানা যায় না সেই তথ্যও। তবে তাঁর উপন্যাসগুলির রিভিউতে লেখিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়েছে, নারীমনের একান্ত আলো-অন্ধকার স্তরগুলি প্রকাশ পায় তাঁর সাহিত্যকর্মে। আগ্রহী পাঠকদের জানিয়ে রাখি, এলেনা ফেরান্তের কয়েকটি উপন্যাসের নাম। বইগুলি হল: My Brilliant Friend, Lying Lives of Adults, The Lost Daughter, Those who Leave and Those who Stay। পাঠক পড়ে দেখতে পারেন বইগুলি। আজকের এই প্রবল প্রচার ও ফেসবুকের আধিপত্য়ের যুগেও একজন নারী এসব থেকে পুরোপুরি দূরে থেকে, শুধু রচনাশক্তির দ্বারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন নিজের সৃষ্টিকে।

ইয়েলিনেক-এর কথায় ফিরে আসি। এই লেখিকার দুটিমাত্র বই আমি পড়েছি। একটি বইয়ের কাহিনি আবর্তিত হচ্ছে ৩৬ বছর বয়সী এক নারী, যিনি পিয়ানো শিক্ষিকা এবং তাঁর কিশোরবয়সী ছাত্রকে ঘিরে। একসময় ওই ৩৬ বছরের পিয়ানো শিক্ষিকা সেই মাতৃহীন একাকী কিশোরটিকে তার কৌমার্য কী করে ভাঙতে হয়, সেই শিক্ষাও দেন। নোবেল কমিটিতে এই বইয়ের লেখিকাকে নোবেল পুরস্কার অর্পণ করা হবে কিনা, সে-বিষয়ে দীর্ঘসময় বিতর্ক চলেছিল বলে শোনা যায়। এমনকী, এ কথাও সংবাদপত্রে জেনেছি, যে-সদস্য ইয়েলিনেক-কে নোবেল পুরস্কার দেবার প্রস্তাব উত্থাপন করেন ও ইয়েলিনেক-এর সাহিত্যের উৎকর্ষ ও সততার পক্ষে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ সওয়াল চালিয়ে যান, এবং নোবেল পুরস্কার শেষপর্যন্ত ইয়েলিনেক-কে দিতে বাধ্যই করেন নিজের অকাট্য সাহিত্যিক যুক্তিজাল প্রয়োগের দ্বারা– পরের বছর সেই সদস্যকে নোবেল কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে হয়। আমি ওই বিতর্কিত উপন্যাসটি পড়েছি। ওই উপন্যাসে একরকম অবধারিত জীবনসত্যের উন্মোচন আছে, আছে একধরনের গোপন অভিজ্ঞতার সযত্ন ও সাহসী প্রকাশ। ইয়েলিনেকের অন্য যে বইটি আমি পড়েছি তার নাম ‘Lust’। সেখানেও রয়েছে জীবনের দমিত কিন্তু নিরুপায় বাসনাবৃত্তান্তের তীব্রতা।
আবার অমৃতার কবিতাটির কাছে যাওয়া যাক। মন ও শরীর যখন পরস্পর সংলাপ বিনিময় করে, তখন আশ্চর্য গোপন এবং সুনিশ্চিত সত্য উদ্ঘাটিত হয়। কিশোরের কৌমার্য ভাঙার প্রসঙ্গে এসে কবিতাটি নিজেকে ছেড়ে দেয়– এখানেই এই রচনার সার্থকতা। এবার কবিতাটির ভাগ্য পাঠকের হাতে চলে যায়– পাঠকই স্থির করুন এই কবিতার গন্তব্য কোনদিকে! সবই কবি বলে দেবেন কেন? এই কম বলা, বা না-বলে ছেড়ে দেওয়া একরকম কাব্যপরীক্ষার পরিচয়। সাহস লাগে এ কাজে। এই যে ‘কিশোর’ শব্দটির উপস্থিতি পেলাম আমরা অমৃতার কবিতায়, সেই ‘কিশোর’ শব্দটিকে অমৃতার অন্য একটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যেও খুঁজে পাব আমরা, সে-কবিতার মধ্যেও আছে প্রণয়প্রসঙ্গ, সে-কবিতাও অন্তর্মুখী, একাকী, ডায়রিতে লেখা রাত্রিলিপির মতোই নির্জন উচ্চারণ দেখা দেয় সেই কবিতায়। কবিতাটি এইরকম:
প্রেম
আমি তার কষ্টকল্প পাখি।
সে আমার অনুগত স্বস্তিক বেদনা।
অসাড় উষ্ণীষ নিয়ে,
দীর্ঘ পথ পার হয়ে
ক্রীড়াক্ষেত্রে– অনন্ত কোলাজে–
স্বাভিমানী–
সে
যুদ্ধে স্থির–
জাতিস্মর, কিশোর উন্মাদনা।
প্রথমেই কবিতাটির নামকরণে আমরা পাচ্ছি ‘প্রেম’ কথাটি। একেবারে সরাসরি। অথচ পুরো কবিতাটি এক সঙ্কেতময় ভাষা আশ্রয় করে অগ্রসর হয়ে চলেছে। বাবার নিখোঁজ হওয়া, মণিপুর এবং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যেসব কবিতা আমরা এক্ষুণি পড়ে এলাম– সেসব কবিতার ভাষার চেয়ে এ-কবিতার ভাষা একদম পৃথক হয়ে গেছে। ওইসব কবিতার ভাষা ছিল বিবরণের ধারায় চালিত– এ-কবিতার ভাষায় সঙ্কেতধর্মের রূপায়ণ দেখা যাচ্ছে। ‘আমি তার কষ্টকল্প পাখি।’ এই লাইনটি অপূর্ব! একইসঙ্গে আমি তাকে কষ্ট দিই বা সে আমাকে নিয়ে কষ্ট পায়– এই ইঙ্গিত আসার পরমুহূর্তেই ‘পাখি’ শব্দটির আগমন এক উড়ালকে এনে উপহার দেয় প্রথম লাইনটিতে। ‘পাখি’ শব্দে যে উড়ান যুক্ত আছে– তা আসলে এক আনন্দ। অর্থাৎ আমি তার কষ্টের কারণ– পাশাপাশি আমার অস্তিত্ব তার কাছে আনন্দও বহন করে আনে।
একটি বইয়ের কাহিনি আবর্তিত হচ্ছে ৩৬ বছর বয়সী এক নারী, যিনি পিয়ানো শিক্ষিকা এবং তাঁর কিশোরবয়সী ছাত্রকে ঘিরে। একসময় ওই ৩৬ বছরের পিয়ানো শিক্ষিকা সেই মাতৃহীন একাকী কিশোরটিকে তার কৌমার্য কী করে ভাঙতে হয়, সেই শিক্ষাও দেন। নোবেল কমিটিতে এই বইয়ের লেখিকাকে নোবেল পুরস্কার অর্পণ করা হবে কিনা, সে-বিষয়ে দীর্ঘসময় বিতর্ক চলেছিল বলে শোনা যায়।
দ্বিতীয় লাইন: ‘সে আমার অনুগত স্বস্তিক বেদনা।’ অনুগত কেন? কবিতাটি পুরো একবার পাঠ করার পর আমরা এক কিশোরের উপস্থিতি শেষ লাইনে দেখতে পাই। কোনও কিশোর যদি তার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড় কোনও নারীর প্রতি অনুরক্ত হয়, তাহলে তার মধ্যে সেই নারীর প্রতি একটা অনুগত থাকার ভাব কাজ করে। তাই ‘অনুগত’। এটা শুধু দ্বিতীয় পাঠেই ধরা দেয়। ‘স্বস্তিক’ শব্দটি আমাদের ঠেলে নিয়ে যায় স্বস্তিকাচিহ্নের ছায়ার অনুসরণে। স্বস্তিকাচিহ্ন অঙ্কিত হয় গৃহের দেওয়ালে, যে-গৃহে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আবার, ‘স্বস্তি’ বা নির্ভার মন-কেও ছুঁয়ে আছে এই শব্দসঙ্কেত। কিন্তু ‘স্বস্তিক’ কথাটির পরেই রয়েছে ‘বেদনা’ শব্দটিও। ঠিক ওই ‘কষ্টকল্প পাখি’ শব্দদুটির মতোই এক শরীরে দুই বিপরীতের অবস্থান। যন্ত্রণা ও আনন্দ। যার জন্য যন্ত্রণা পাচ্ছি আমি, সে-ই আমার আনন্দেরও উৎস।

তাহলে কী দাঁড়াল? দু’জনেই দু’জনের কাছে যুগপৎ রোমাঞ্চের উড়াল ও প্রণয়বহনের কষ্ট নিয়ে আসছে। প্রথম দু’টি লাইনের পর স্পেস আছে। অর্থাৎ কবিতার মূল সূত্র প্রথম দুটি লাইনে উল্লেখিত হয়ে একটু অবকাশ গ্রহণ করল। পরে, কবিতাটিতে আর স্পেস ব্যবহার করা হয়নি। যদিও ‘সে’ শব্দটি একটিমাত্র লাইনে একাকী দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় স্পেস-এর কাজই যেন করিয়ে নেয় কবিতাটিকে দিয়ে। স্পেস প্রয়োগের উদ্দেশ্য, বিরতি নেওয়া। কবিতাটির শেষ লাইন থেকে যদি উপরের দিকে উঠে যাই আমরা, তাহলে তৃতীয় লাইনটিতে দেখা যাবে ‘সে’ কথাটি একলা-একা দণ্ডায়মান। ‘আমি’ এবং ‘সে’ এই দুটি চরিত্র সংক্ষিপ্ত এ-কবিতাটির মূল আধার। সেই ‘সে’ একাকী একটি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কেন? এলফ্রিদে ইয়েলিনেকের উপন্যাসের মতো এখানেও কিশোরটি কি পরে একা হয়ে যায়?– যাবেই, কারণ এমন সম্পর্ক কি সমাজ মেনে নেবে?
মন ও শরীর যখন পরস্পর সংলাপ বিনিময় করে, তখন আশ্চর্য গোপন এবং সুনিশ্চিত সত্য উদ্ঘাটিত হয়। কিশোরের কৌমার্য ভাঙার প্রসঙ্গে এসে কবিতাটি নিজেকে ছেড়ে দেয়– এখানেই এই রচনার সার্থকতা। এবার কবিতাটির ভাগ্য পাঠকের হাতে চলে যায়– পাঠকই স্থির করুন এই কবিতার গন্তব্য কোনদিকে! সবই কবি বলে দেবেন কেন? এই কম বলা, বা না-বলে ছেড়ে দেওয়া একরকম কাব্যপরীক্ষার পরিচয়। সাহস লাগে এ কাজে।
শেষ লাইনের আগের লাইন বলে: ‘যুদ্ধে স্থির–’ অর্থাৎ ‘সে’ একা হলেও তার মনের মধ্যে প্রেমের যে টানাপোড়েন, কষ্ট ও আনন্দের যে সংঘর্ষ, সেই যুদ্ধ মেনে নিয়ে ‘সে’ স্থির। এইবার আসে এক আশ্চর্যের আবির্ভাব, শেষতম লাইনে– ‘জাতিস্মর, কিশোর উন্মাদনা।’ এই প্রণয় যেন এ-জন্মেই ঘটছে তা নয়, এর পূর্বসূত্র আগের কোনও জন্ম থেকেই যেন যুক্ত হয়ে আছে কবিতাটিতে বর্ণিত এই দুটি চরিত্রের জীবনে! তাই ‘জাতিস্মর’ শব্দটি এল– কবিতা সম্পূর্ণ করছে দুটি আকুল করা শব্দের সহাবস্থান: ‘কিশোর উন্মাদনা।’
কিশোরবয়সী কেউ প্রেমে পড়লে তার মনে উন্মাদনা আসা স্বাভাবিক। কারণ শরীর চিনতে সদ্যই শিখেছে সে। জেনেছে, প্রেমে পড়লে মন কীভাবে অন্য শরীরকে প্রাণপণ পেতে চায়। তাই ‘কিশোর উন্মাদনা’ এই শব্দদুটির প্রয়োগ। এইসঙ্গে লক্ষণীয় যে, স্পষ্ট অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আরম্ভ হয়ে এ-কবিতা ‘সে’ কথাটিকে অকস্মাৎ একটি লাইনে একা স্থাপন করে অক্ষরবৃত্তের চলনটিকে একটু ভেঙে দেয়, স্বেচ্ছাকৃতভাবে। যেহেতু একাকিত্ব বোঝানো হচ্ছে, অথচ কবিতার সূচনার দুটি লাইনে পরপর ‘সে’ ও ‘আমি’ পাশাপাশি অবস্থান করছিল, তাই এরমধ্যে দিয়ে একটি যুগ্মক তৈরি হয়ে উঠেছিল তখন– সঙ্কেতধর্ম দ্বারা। কবিতাটির পরিণতি যখন আসে, তখন যুগ্মকটি যেন ভেঙে যায়। কারণ আমরা একা এক ‘কিশোর উন্মাদনা’-কেই দেখতে পাই। আর যুগ্মকটি ভেঙে যায় বলেই শেষ লাইনের সামান্য আগের একটি লাইনে ‘সে’ শব্দটিকে লাইনের একমাত্র শব্দ হিসেবে প্রয়োগ করে অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেও একটু ভেঙে পড়তে দেওয়া হয়। ছন্দের নিয়ম অনুযায়ী, এখানে অন্তত দু’মাত্রা থাকার কথা। কিন্তু রইল এক মাত্রা। পরিপূরক অন্য মাত্রাটি রইল না। কেননা, যুগ্মকটিও যে থাকবে না কবিতার শেষে পৌঁছলে— তারই অগ্রিম ইঙ্গিতরূপে ওই প্রত্যাশিত এক মাত্রা প্রত্যাহার করা হল এখানে।

এখানে প্রণিধানযোগ্য একটি বিষয়, যা ছন্দপ্রয়োগের নৈপুণ্যে ধরা পড়ছে। ‘কিশোর উন্মাদনা’ উচ্চারণ করতে গেলে কিশোর কথাটির শেষ বর্ণ ‘র’-এর মধ্যে ‘উন্মাদনা’ কথাটির প্রথম বর্ণ ‘উ’ প্রবিষ্ট হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই– অর্থাৎ আমাদের উচ্চারণে জিনিসটা আসছে এইভাবে: কিশোরুন্মান্দনা। ফলে ‘জাতিস্মর, কিশোর উন্মাদনা’ যদি পড়ি– তবে অক্ষরবৃত্তের কাঠামো একটুও ভাঙছে না, দশমাত্রা অটুট থাকছে আমাদের উচ্চারণে। অন্য়দিকে, আরও একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটছে এইখানে, একটি বর্ণ অন্য বর্ণের মধ্যে প্রবেশ করার ফলে। এই যে কবিতার প্রধান দুটি চরিত্র ‘সে’ ও ‘আমি’– আমরা কেন একে অন্যের ‘কষ্টকল্প পাখি’? কেনই বা ‘স্বস্তিক বেদনা’? কারণ আমরা মিলিত হতে পারছি না পরস্পরের সঙ্গে। সমাজের বাধায়, বয়সের বাধায়। তাই ‘পাখি’-র আগে ‘কষ্টকল্প’ শব্দটি আসছে, একই কারণে ‘বেদনা’ কথাটি বসছে ‘স্বস্তিক’ কথাটির পর। এই প্রস্তাবনা দিয়ে কবিতার আরম্ভ। কবিতার কোথাও বলা নেই, আমরা দু’জনে মিলিত হতে পেরেছি। কোথাও এ কথা নেই। কিন্তু ধ্বনিগতভাবে কবিতার শেষ দুটি শব্দ– ছন্দের কারণে– একে অপরের মধ্যে প্রবেশ করল, মিলিত হল– যেভাবে প্রণয়ব্যাকুল পুরুষ ও নারী শরীরমিলনে সম্পূর্ণ করে নিজেদের বাসনা। অর্থাৎ জীবনে যা ঘটেনি, ছন্দপ্রয়োগের নৈপুণ্যে কবিতায় সেই মিলন সঙ্ঘটিত হল। একটি বর্ণ ঢুকে গেল অপর বর্ণের মধ্যে।
মন ও শরীর যখন পরস্পর সংলাপ বিনিময় করে, তখন আশ্চর্য গোপন এবং সুনিশ্চিত সত্য উদ্ঘাটিত হয়। কিশোরের কৌমার্য ভাঙার প্রসঙ্গে এসে কবিতাটি নিজেকে ছেড়ে দেয়– এখানেই এই রচনার সার্থকতা। এবার কবিতাটির ভাগ্য পাঠকের হাতে চলে যায়– পাঠকই স্থির করুন এই কবিতার গন্তব্য কোনদিকে! সবই কবি বলে দেবেন কেন? এই কম বলা, বা না-বলে ছেড়ে দেওয়া একরকম কাব্যপরীক্ষার পরিচয়। সাহস লাগে এ কাজে।
কবিতালেখকের পক্ষে ছন্দ জানা এইজন্য জরুরি যে, কবিতা রচনার সময় যদি কেউ ছন্দের ক্রীতদাস না হয়ে ছন্দকে তার অন্তর্গত শ্রুতি থেকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে, তবে এমন অকল্পনীয় প্রয়োগমিলন সম্ভব করে তুলতে পারে সেই কবি, নিজের কবিতায়। এই প্রসঙ্গে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এক লেখিকার মনে যে বিষয়টি একটি উপন্যাসের রূপ ধরে প্রকাশ পেয়েছে, সেই একই চিন্তা বীজরূপে জেগে উঠেছে অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতায়। আমি নিশ্চিত, ইয়েলফ্রেড ইয়েলনেকের এই উপন্য়াসের কথা অমৃতা জানেন না। তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন মাত্র। এই প্রকাশের সাহস ও সঙ্কেত, দুইই আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব: ৩১ জানুয়ারি সোমবার প্রকাশিত হবে।
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Millenium Post, Early Bird Books এবং অমৃতা ভট্টাচার্যের ফেসবুক পেজ থেকে
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।