আমার জন্ম ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায়। তবে আমার ছেলেবেলা বলতে ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ ― এই দশ বছর ধরে যেতে পারে। আমাদের পরিবারও দেশভাগের বলি এবং আমাদের শেষ দেশ ছিল উত্তরবঙ্গের রংপুর শহর, যা এখন বাংলাদেশে। ছেলেবেলায় বারংবার কলকাতা থেকে রংপুরে গিয়ে থেকেছি। সেখানকার দুর্গাপুজোর স্মৃতি আমার মনে স্পষ্ট আছে। কলকাতায় তখনও এরকম বারোয়ারি পুজোর মোচ্ছব লাগেনি। প্রতি পাড়াতেই তখন এরকম বহুল সংখ্যক পুজো হত না। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতায় কয়েকটি হাতে গোনা বারোয়ারি পুজো হত। আর হত কয়েকটি বিত্তবান, রাজা-রাজড়াদের বাড়িতে। সেখানে ছেলেমানুষের পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই, রংপুরের স্মৃতিই স্পষ্ট আছে।
রংপুর শহরের একটি প্রান্তে আমাদের বাড়ি ছিল। সেই পাড়াটির নাম ছিল ‘ধাপ’। যে লালমাটির পথটি সোজা চলে গিয়েছিল বাঁশবন এবং গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে, সেই পথের ওপরেই ছিল আমাদের বাড়ি। শরৎকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে শেষ বিকেলের রক্তিমাভায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত। আমাদের বাড়ি ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে। সামনে গোলাপবাগান। পেছনে আলুক্ষেত, পুকুর, এবং পাশে নানারকম গাছ যেমন আম, কাঁঠাল, লিচু, জলপাই, চালতা, এবং আনারসের বিস্তীর্ণ বাগান ছিল। সেই বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল ঘোঘটের ক্যানাল। শুনতাম, এই ক্যানাল এসেছে তিস্তা নদ থেকে। ক্যানালটি বানানো হয়েছিল সেচের জন্য। বাড়ির পেছনের বাগান, বাঁশবন এবং নানা গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছিল হরিসভার দিকে। সেই হরিসভার পাশেই ছিল একটি মস্ত কদম গাছ। আর তার পাশে ছিল একটি বেশ বড় পুকুর। পুকুরের এক পাশে ছিল ধোপার পাট, যাতে দুপুরের নিস্তব্ধতা ধপাধপ শব্দে ছিদ্রিত করে ধোপা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সেই পাটে আছড়ে আছড়ে কাপড় কাচত। তার পাশে ছিল মধুচুষির বন, যে বনের মধু খেতে দলে দলে মৌমাছিরা উড়ে উড়ে বেড়াত। সেই পুকুরে গত বছরের বিসর্জন দেওয়া কাঠামো কলা গাছের ভেলার উপরে জেগে থাকত, আর সেই কাঠামো জড়িয়ে রোদ পোয়াত মস্ত বড় চিত্রল জলঢোঁড়া সাপ। কলকাতার ছেলে আমি। আমার চোখে উত্তর বাংলার এই নিসর্গ এখনও আঁকা হয়ে আছে।

হরিসভাতেই প্রতিমা গড়া হত বেশ অনেকদিন ধরে। তার সামনে ম্যারাপ বেঁধে যাত্রার মঞ্চ হত। পুজোর পরে সেখানে হত নানা যাত্রাপালা। আর দিনের বেলা সেই মাঠে বকবাহন গোরুরা পটাপট শব্দে মুথা ঘাস ছিঁড়ে খেত।
মহালয়ার পর থেকেই ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের সঙ্গে নীল আকাশে শরতের রোদ ঝলমল করত। কদমফুলের গন্ধে, শিউলির গন্ধে চারিদিক ম ম করত। চারিধারের মাঠে কাশ ফুটত অজস্র। সকালবেলায় শরতের শিশিরভেজা সেই কাশবন রোদে ঝলমল করে উঠত। মহালয়ার পর থেকেই ঢাকিরা এসে জমায়েত হত হরিসভাতে। ঢাকের শব্দে চতুর্দিক এবং দীঘির জল প্রাণিত হত। বড় বড় হ্যাজাক ঝোলানো হত হরিসভাতে এবং হরিসভার সামনের মাঠে সন্ধ্যের পর চতুর্দিক আলোকিত হয়ে উঠত। পুকুরপাড়ের গাছগাছালির ডালে বসে থাকা বাদামি-সাদা গো বকেরা আর ধবধবে সাদা বকেরা পুকুরের দিকে চেয়ে বসে থাকত, ঢাকের শব্দে তারা চমকে চমকে উঠত। সন্ধ্যের আগে আগে বাদুড়ের ঝাঁক তাদের বড় বড় ডানায় সপাসপ শব্দ তুলে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যেত।
পুকুরের এক পাশে ছিল ধোপার পাট, যাতে দুপুরের নিস্তব্ধতা ধপাধপ শব্দে ছিদ্রিত করে ধোপা হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সেই পাটে আছড়ে আছড়ে কাপড় কাচত। তার পাশে ছিল মধুচুষির বন, যে বনের মধু খেতে দলে দলে মৌমাছিরা উড়ে উড়ে বেড়াত। সেই পুকুরে গত বছরের বিসর্জন দেওয়া কাঠামো কলা গাছের ভেলার উপরে জেগে থাকত, আর সেই কাঠামো জড়িয়ে রোদ পোয়াত মস্ত বড় চিত্রল জলঢোঁড়া সাপ।
হরিসভার অদূরেই উঁচু, লাল পাঁচিল ঘেরা ডিমলার রাজবাড়ির ভেতর থেকে পেটা ঘড়িতে প্রতি প্রহর ঘোষিত হত। ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ভেসে আসত। কখনও কখনও কোচোয়ান আর পাগড়ি পরা দেহরক্ষীশোভিত ফিটনগাড়িতে চড়ে আমাদেরই সমবয়সী গোলাপিরঙা রাজকন্যে শহরের দিকে যেতেন ফিটনের ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে। রাজবাড়ির উল্টো দিকেই ছিল আমাদের পাঠশালা। একটি বড় চালাঘর। তার কাছেই ছিল একটি বড় ইঁদারা। পাঠশালার মাঠে দুপুরের রোদে কিছু গোরু, আর ছাগল-পাঁঠা ঘুরে ঘুরে ঘাস খেত। পুজোর কিছুদিন আগে থেকেই পাঠশালা বন্ধ থাকত। পাঠশালার একজনই মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনি পণ্ডিতমশাই। তাঁর মাথায় ছিল লম্বা টিকি, হাতে বেত। তিনি আমাদের শুভঙ্করীর আর্যা মুখস্থ করাতেন।
হরিসভার পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গিয়েছিল নীলফামারির দিকে। সেই পথে একটু গিয়েই ডানদিকে পড়ত জমিদারবাড়ি। তারা কোথাকার জমিদার, আমার জানা ছিল না। কিন্তু পুজোর সময় সে বাড়িতে খুব প্রজাসমাগম হত। অষ্টমীর দিন ১০৮ পাঁঠাবলি এবং একটি মোষ বলি হত। আমরা ছোটরা ভয়ে জড়সড় হয়ে সেই মোষবলি দেখতাম। ডাকাতের মতো একজন কাপালিক মস্ত বড় খড়্গ হাতে বড় সিঁদুরের টিপে কপাল শোভিত করে সেই খাঁড়ার এক কোপে মোষের শরীর থেকে মাথাটি আলাদা করে দিতেন। রক্ত উঠত ফিনকি দিয়ে। চতুর্দিক থেকে অসংখ্য ঢাকের এবং কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ জায়গাটি মথিত করে দিত। আমরা ছোটরা কোরা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে সেই মোষবলি দেখতাম।

রাজবাড়ির উল্টোদিকেই ছিল আমার বন্ধু পুঁটুদের বাড়ি। পুঁটুর ছোটকাকা ছিলেন পাগল। বাড়ির বাইরে বড় বড় গরাদ দেওয়া আলাদা ঘরে তার ছোটকাকাকে রাখা হত। সে ঘরের দরজা খোলা হলেই নাকি ছোটকাকা যাকে সামনে পেতেন, তাকেই কামড়ে দিতেন। ঘরের মধ্যেই তাঁকে খাবার, জল দিয়ে আসা হত। তিনি ঘরের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরতেন, আর বলতেন, “কাছে আয়, তোকে ঘ্যাঁচাং করে দেব।” আমরা তাঁকে দূর থেকে দেখতাম। খাঁচার কাছে যেতাম না। মহালয়া আসত, আগমনীর গান বাজত, পুজো আসত, তারপর বিজয়া, ঠাকুর ভাসান, সবই হত, কিন্তু ছোটকাকার ঘরের দৃশ্যের কোনও পরিবর্তন হত না। সকলেই নতুন জামাকাপড় পরতেন, আমরা তো পরতামই, কিন্তু ছোটকাকা যে পোশাক পরতেন, তাই পরে থাকতেন। বাইরের কোনও কিছুরই আঁচ সেই কুঠুরির মধ্যে পৌঁছত না। শুনতাম, ছোটকাকা নাকি একজনকে ভালোবেসে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তা হবে হয়তো।
বিজয়া দশমীর দিনে হরিসভার চারপাশে চেয়ার বেঞ্চি সমস্ত সাজিয়ে রাখা হত প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে। অনেকগুলি কলার ভেলার হ্যাজাক নিয়ে বড়রা উঠতেন। ঢাকিরাও উঠত। আর একটি বড় ভেলার উপরে মা দুর্গাকে তোলা হত। ঢাক আর কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজে পুকুরের জল চলকে চলকে উঠত আর অনেক হ্যাজাকের আলোতে ঝলমল করত। ভেলাগুলো বারবার হরিসভার পুকুর প্রদক্ষিণ করত। সেজেগুজে, গয়না পরে মেয়েরা এবং কচিকাঁচার দল পুকুরের চারপাশে বসে সেই প্রতিমা বিসর্জন দেখত। পুজো মিটতেই কাঁধে বাঁশের বাঁক ঝুলিয়ে তাতে বড় বড় মাটির হাঁড়িতে বাড়িতে বানানো রসগোল্লা, চমচম নিয়ে ধাপের ময়রা হরিসভার সামনের মাঠে বিক্রি করতে বসত। আমরা ছোটরা যার যেমন সামর্থ্য তেমনটা কিনে কলাপাতায় করে খেতাম। পরদিন সকালে সেই পুকুর পাড়ে গেলে আমাদের মন বড় খারাপ হয়ে যেত। কত মজা, কত আনন্দ, এই কটি দিন পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া।
ডাকাতের মতো একজন কাপালিক মস্ত বড় খড়্গ হাতে বড় সিঁদুরের টিপে কপাল শোভিত করে সেই খাঁড়ার এক কোপে মোষের শরীর থেকে মাথাটি আলাদা করে দিতেন। রক্ত উঠত ফিনকি দিয়ে। চতুর্দিক থেকে অসংখ্য ঢাকের এবং কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ জায়গাটি মথিত করে দিত। আমরা ছোটরা কোরা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে সেই মোষবলি দেখতাম।
পুজো শেষ হয়ে গেলে কয়েকদিন যাত্রাপালা হত। আমার মনে আছে একটি যাত্রাতে একজন একটি পিস্তল হাতে করে উত্তরবঙ্গীয় রাজবংশী ভাষাতে তার প্রতিপক্ষকে বলত, “এই দ্যাখ, মোর হাতে পিস্তলো চকোচকো করিতেছে, ড্যামো বসায়া।” মানে হল, “এই দ্যাখ, আমার হাতে পিস্তল চকচক করছে, দেব বসিয়ে।” পিস্তল যে ছুরির মতো বুকে বসাতে হয় না, গুলি ছুঁড়তে হয়, তা সেই যাত্রাপালার নায়ক জানতেন না।
এই সব রূপ, রস, গন্ধ, সব মিলেমিশে আমাদের রংপুরের ধাপের পুজো আসত আর চারদিনের শেষে আমাদের সকলকে বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিয়ে চলে যেত।
বুদ্ধদেব গুহ এই সময়ের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্ম হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশে। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেও সাহিত্যই তাঁর আদত বিচরণক্ষেত্র। রবীন্দ্রসংগীত, পুরাতনী ও টপ্পার আঙিনাতেও তাঁর সাবলীল যাতায়াত। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'জঙ্গলমহল।' তাঁর রচিত 'হলুদ বসন্ত', 'মাধুকরী', 'কোয়েলের কাছে', 'কোজাগর', 'একটু উষ্ণতার জন্য' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। পেয়েছেন আনন্দ ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার। তাঁর চোখে সব বনই সুন্দর, সুন্দর বন।
প্রিয় লেখককে পড়লাম। অসম্ভব ভালো লাগা।
তারপর? সে সব ছেড়ে চলে এলেন কেন?
আমি ভ্রমণের ওপর লেখা দিতে চাই। কিভাবে দেব যদি একটু জানিয়ে দিতেন তাহলে উপকৃত হতাম।