সম্প্রতি যাঁরা কবিতা লিখছেন, সেইসব নবীন কবিদের লেখার প্রতি আমি সর্বদা আগ্রহী থাকি। ‘সম্প্রতি’, এই কথাটি দ্বারা আমি বোঝাতে চাইছি একবিংশ শতকের প্রথম দশকে যাঁরা কবিতার বই প্রকাশ করতে শুরু করেছেন, তাঁদের কথা। সেই সঙ্গে প্রথম দশকের ঠিক আগে, অর্থাৎ শূন্য দশকে যাঁরা লিখতে শুরু করেছেন, তাঁদের লেখার সন্ধানেও আমি থাকি। নব্বই দশকের কবিরা এখন ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের লেখা তো আমি অবশ্যই পড়ি।
সাম্প্রতিক কবিদের বই সন্ধানের জন্য আমি আশ্রয় করেছি কলেজ স্ট্রিটের ‘ধ্যানবিন্দু’ নামক পুস্তক-বিপণিটিকে। এই বিপণির কর্ণধার নব্বই দশকের একজন শক্তিমান কবি, যাঁর নাম অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুন্দর দু’টি কবিতার বই আছে তাঁর। তিনি নবীনতর কবিদের গ্রন্থগুলিকে বই বিপণির ভেতর সাদরে স্থান দেন। আমি লোক পাঠিয়ে সেই বিপণি থেকে বই আনিয়ে নিই। প্রসঙ্গত বলা ভালো, এই ‘ধ্যানবিন্দু’ শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে বাংলা ভাষার এক চিরস্মরণীয় কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর একটি কবিতার শিরোনাম থেকে। এখানেও ওই পুস্তক-বিপণির প্রতিষ্ঠাতার শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
আজকে আমি যাঁর কবিতা নিয়ে দু’চারটি কথা বলতে চলেছি, তাঁর নাম শাশ্বতী সান্যাল। তাঁর প্রথম বই ‘ব্রেইলে লিখিত বিভ্রান্তিসমূহ’ ধ্যানবিন্দু থেকে যে কেউ সংগ্রহ করতে পারেন। আমি সেই বই নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া কিছুদিন আগে ব্যক্ত করেছিলাম একটি রচনায়। আজ আমি কথা বলব শাশ্বতীর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। আগে পাঠককে জানাই বইয়ের নামকরণটি। সে-বইয়ের নাম ‘কেয়ার অফ শ্যামতরু লেন।’ এই নামের মধ্যে তিন-তিনটি ইংরাজি শব্দ বসানো হয়েছে। অথচ বইটি হাতে নিয়ে তার নাম দেখেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কেন? এ-রহস্যের কারণ জানি না। বড়ো মাধুর্য্যসম্পন্ন এই শব্দগুচ্ছ। হয়তো তিনটি ইংরিজি শব্দের মধ্যে ঢুকে ‘শ্যামতরু’ কথাটিই এই ম্যাজিক ঘটিয়েছে।
কোনও কবির কবিতা পড়তে গেলে আমার কাছে সবসময় অগ্রাধিকার পায় সেই কবির ভাষা ও কবিতার মন। হ্যাঁ, কবিতারও একটি পৃথক মন থাকতে পারে। যে-মনের সৃষ্টি করে কবির নিজস্ব মন। শাশ্বতী সান্যালের এই ‘কেয়ার অফ শ্যামতরু লেন’ বইটির মনের কেন্দ্রে আছে প্রেমার্তি। এখানে একটি জরুরি কথা বলা দরকার। কবিতার মধ্যে অবস্থিত সেই প্রেমার্তি বিশেষ একজন কোনও পুরুষের দিকে ছুটে যাচ্ছে না, সে কথা এ-বইয়ের কবিতার পর কবিতা পাঠ করে চললেই বোঝা যায়। এইসব কবিতার মন কোনও বিশেষ একটি পুরুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি। বিভিন্ন কবিতা বিভিন্ন পুরুষের প্রতি ধাবিত হয়েছে। আমাদের সামাজিক জীবনে, পুরুষ বা নারীর ক্ষেত্রে, উভয়তঃই, কোনও একটি বিশেষ নারী বা পুরুষের সংলগ্ন হয়ে থাকাই শ্রেয় বলে প্রতীয়মান হয়।
কিন্তু মন কি কারও কথা শোনে? লেখা কি কারও কথা শোনে? মন তো কবিতা রচনার সময়ে সামাজিক বন্ধনকে ছিন্ন করে স্বাধীন হতে চায়। শাশ্বতী সান্যালের কবিতাও স্বাধীন হতে চেয়েছে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, স্বাধীন হতে পেরেছে। আমি বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি কারণ, শাশ্বতী সান্যাল কবিতা লিখতে গিয়ে কখনও পরাধীন বোধ করেননি। তাঁর ভাষা খুব শক্তিশালী, স্তবকগঠন পরিমিতি বোধের পরিচয় বহনকারী। শব্দপ্রয়োগ, বাক্য ও চিত্রকল্প নির্মাণে নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ।
শাশ্বতী সান্যালের প্রেমার্তির মধ্যে কোনও অভিযোগ নেই, অভিমান আছে। পুরুষের প্রতি ঘৃণা নেই। কোনও প্রতিশোধস্পৃহা নেই। গোপন দুঃখের আলো আছে। শাশ্বতী সান্যালের কবিতার মন যে বিভিন্ন পুরুষের দ্বারা আলোড়িত হয়েছে, এমনকি কখনও কখনও প্রশ্নাতীত ভাবে মুগ্ধ হয়েছে, সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। তবে সত্যি যদি তাঁর কবিতা কোথাও কোথাও দুঃখ বা আঘাত দ্বারা উৎসাহিত হয়ে থাকে, তাহলেও সেসব কবিতা কোনও প্রত্যাঘাত করাকে নিজের বিষয়বস্তু করেনি।
আমি আবার একটা কথা পাঠকের কাছে একটু স্পষ্ট করি। কবিতার মন বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, হ্যাঁ, বিশেষ বিশেষ কবিতার মনকেই। মানুষ যেমন আলাদা আলাদা হয়, পৃথক পৃথক কবিতার মনও পৃথক ভাবেই গঠিত হয়। শাশ্বতী সান্যালের কবিতা প্রায়শই এক একাকিনীকে দেখিয়ে দিয়েছে, যে রয়েছে বইয়ের সকল কবিতার কেন্দ্রে। এই একাকিনী, অনুমান করি, একমাত্র কবিতার মধ্যে দিয়েই তার আত্মপ্রকাশ সম্পূর্ণ করে। শাশ্বতী সান্যালের ব্যক্তিজীবন কী রকম, আমি তার কিছুই জানি না। কেবল কবিতার মধ্যে এক সঙ্গীহীনা নারী অবস্থান করছে, এ-ধারণার প্রমাণ পাই।
যদি কোনও কবির বাস্তবজীবনে একজন নির্দিষ্ট নারীসঙ্গী অথবা পুরুষসঙ্গী থাকেও, তবু সেই কবি দুর্মর নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করতে পারেন— কারণ মাত্র একজন ব্যক্তির প্রেমের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েই যে অপর কোনও ব্যক্তি নিঃসঙ্গতাকে চিরতরে জীবন থেকে দূর করে দেবেন, তা কমই ঘটে। স্নিগ্ধ দোষারোপ শাশ্বতী সান্যালের কবিতায় একেবারে নেই, তা বলব না, কিন্তু তা স্নিগ্ধ-ই। কখনওই ক্রোধযুক্ত নয়।
‘কেয়ার অফ শ্যামতরু লেন’ কাব্যগ্রন্থটি আমি অন্তত দু’বার পাঠ করেছি। পাঠান্তে বুঝেছি, স্বচ্ছ পুষ্করিণীর ন্যায় এই কবির হৃদয়। জলের একেবারে তলায় পড়ে থাকা নুড়িকেও রৌদ্র দ্বারা আলোকিত করে তার স্থানাংক নির্ণয়ে সহায়তা করছে। এতটাই মালিন্যহীন এই কবির মন।
ওই যে একটু আগে বললাম, ‘গোপন দুঃখের আলো’ কথাটি- এক একাকিনী হৃদয়ের দুঃখের আলো জ্বলে আছে শাশ্বতী সান্যালের এই কবিতার বইয়ে। এবং সেইসব কবিতার মন বিভিন্ন পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কথা কখনও গোপন করতে চায়নি। ‘তুমি’ বা ‘তার’ অথবা ‘সে’ শব্দগুলি দিয়ে এক সুন্দর অন্তরাল রচনা করেছে মাত্র। কষ্ট পাওয়ার অন্তরাল। মুগ্ধতাবোধের যে বেদনা, তাকে ঢাকা দেওয়ার অন্তরাল। কিন্তু কী ভাবে বুঝিয়েছে সেই গোপন করতে না-চাওয়া? মর্মস্পর্শী সঙ্কেতে সঙ্কেতে বুঝিয়েছে।
শাশ্বতী সান্যালের কবিতা এক রকম নিরূপায় হয়ে লিখিত কবিতা। কবিতা না-লিখলে তিনি অসহায়, এই সত্য তাঁর কাব্যে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিতার প্রেমবোধ এমন যে, ধারণা হয়, কোনও অপ্রাপণীয়ের উদ্দেশে উপায়হারা মুগ্ধতা ও আকর্ষণের প্রকাশ। অপ্রাপণীয় মানে কী? মানে, আমি যাকে কখনও পাব না, পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, এবং সেটা আমি জানি- অথচ তারই দিকে আমার কবিতা অগ্রসর হয়ে চলেছে।
আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি আগে জার্মান কবি হ্যেল্ডারলিন, তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি লিখেছিলেন এক অপ্রাপণীয়াকে লক্ষ্য করেই। নিম্নবিত্ত হ্যেল্ডারলিন এক ধনী ব্যক্তির বাড়ি গৃহশিক্ষক রূপে নিযুক্ত হন সেই ব্যক্তির সন্তানদের পড়ানোর কাজে। অথচ কিছুদিনের মধ্যেই গৃহকর্ত্রীর প্রণয়ে হ্যেল্ডারলিনের হৃদয় গভীর ভাবে আবদ্ধ হয়। একের পর এক অবিস্মরণীয় কবিতা লিখে চলেন তিনি। কিন্তু পরিণতিহারা এই প্রণয় অচিরাৎ ভেঙে যায়। সেই গৃহ ত্যাগ করে চলে আসতে হয় হ্যেল্ডারলিনকে।
তারপর যা যা ঘটে, সে-বিবরণ বিশদ ভাবে পাওয়া যাবে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতাসমগ্র’-এর পঞ্চম খণ্ডে। এই অপ্রাপণীয়ার উদ্দেশে লিখিত কবিতার দৃষ্টান্ত দেশবিদেশের সাহিত্যে ছড়িয়ে রয়েছে। পেত্রার্কের ক্ষেত্রে যেমন লরা, দান্তের ক্ষেত্রে, যা সবাই জানেন, বিয়াত্রিচে। হ্যেল্ডারলিন তাঁর প্রণয়িণীকে কবিতায় সম্বোধন করেছেন ‘দিওতিমা’ নামে।
আপাতত আবার আমরা শাশ্বতী সান্যালের কবিতার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
এ কথা ঠিক, শাশ্বতী সান্যালের কবিতার ছন্দ প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। অল্প কয়েকটি ছন্দোমুক্ত, অর্থাৎ গদ্যরূপে আশ্রয় পাওয়া কবিতাও এ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবু শাশ্বতীর কবিতার মূল অবলম্বন নির্ভুল অক্ষরবৃত্তই। তাঁর ছন্দের শ্রুতি সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন। কিন্তু তাঁর এই অক্ষরবৃত্ত-নির্ভরতার দিকে যদি কোনও সমালোচক আঙুল তোলেন, তাহলে বলব, মাত্রাবৃত্তে বা স্বরবৃত্তে লিখে সকলকেই প্রমাণ দিতে হবে কেন, যে তিনি সেইসব ছন্দ জানেন? যে-কোনও সত্যিকারের কবি তো তাঁর পাঠককে কেবল ছন্দটুকুই, ছন্দের বৈচিত্র্যটুকুই উপহার দিতে চান না- কবি কেবল একটি কবিতাই লিখতে চান- তা সে-কবিতা যে-ছন্দই আশ্রয় করুক না কেন! আমি অন্তত পাঠক হিসেবে প্রথমেই দেখব, আবার বলছি, কবির ভাষা ও মন কী বলছে। বিনয় মজুমদারের মতো অতবড়ো কবি ‘ফিরে এসো, চাকা’ বই থেকে সারাজীবন কেবল অক্ষরবৃত্ত ছন্দেই কবিতা লিখে গেছেন। তার ফলে বিনয় মজুমদারের লেখার কাব্যগুণ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। শাশ্বতী সান্যাল যদি অক্ষরবৃত্তকেই তাঁর কবিতার প্রধান বাহন করেন, তাতেও তাঁর কবিতার ভাষা ও মন একটুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এ-বিশ্বাস আমার আছে।
‘কেয়ার অফ শ্যামতরু লেন’ কাব্যগ্রন্থটি পড়লে আমার মন শান্ত, নির্মল হয়ে আসে। সমাজসংসারে নানারকম দ্বন্দ্বযুদ্ধের হাত থেকে আমি মুক্তি পাই। সাময়িক ভাবে হলেও এই বইয়ের কবিতাগুলি আমার চারপাশে ঘটে চলা সামাজিক ঘটনাক্রমের অভিঘাত থেকে আমাকে একটি নিঃসঙ্গ বৃক্ষের নিচে বসে সামনে প্রসারিত স্থির জলের দিকে তাকিয়ে থাকার বিশ্রাম দেয়। এই কবির আগামী কবিতাগুলির জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।
আমার ধারণা, শাশ্বতী সান্যালের কবিতা আমার মতো প্রবীণ পাঠককে যখন অভিভূত করেছে, সে-কবিতা নিশ্চয়ই আরও অনেক নবীন ও আমার চেয়েও সক্রিয় পাঠককে নিজের দিকে আকর্ষণ করে নেবে। পাঠকদের জন্যে শাশ্বতী সান্যালের একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি।
না-প্রেমের কবিতা
লিখেছি সাহস ক’রে
কবিতা পড়ো না তাই জেনে…
দেখাশোনা নেই। কোনও গন্ধ নেই। ডেটলের শিশি
উপুড় করেছি ড্রেনে। বীজাণু মরুক কিছুদিন
এ শহরে সুস্থ হোক সকালের রোদ
প্রেম বলতে এখনও কি ধ্যানবিন্দু? সূর্য সেন স্ট্রিট?
ট্রাম মিস হলে আর তেমন সমস্যা হয় না, জানো
শুধু সাদা অ্যাপ্রনের কিছু দেখলে- বিবমিষা জাগে
এও তো অসুখ, খালি মাথা ঘোরা, বমি পাওয়া। তুমি
ওষুধ জানো না। একটা পাতিলেবু রেখেছ পকেটে
এখনও তালুতে, হাতে সাইট্রিক অ্যাসিডের স্বাদ
এসব কি লেখা যায়? এসব কি ধুয়ে ফেলা যায়?
যতটা অবলীলায় ধুয়ে যেতে দিয়েছি তোমাকে
ঝাপসা মফসসলে, অচেনা গ্রামীণ হাসপাতালে
চিঠি লেখালেখি নেই। ওসব কঠিন কাজ। আমি
নীরবতা ভালোবাসি। ভালোবাসি পূর্ণচ্ছেদ। দাঁড়ি।
কবিতা পড়ো না, তাই এখনও সহজে লিখতে পারি…
জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
বইটির কোন পিডিএফ পাওয়া যেতে পারে?
Shri Joy goswami-r ei darodiyaa bishleshon amar montake ek oporiseem bhalo lagaye bhore dilo….dhonyobad