joy goswamiনিজে কী কবিতা লিখি নিজে ভাল বুঝতেও পারি না ভালো হল? আদৌ হল কিছু? সেই বোধ ধারণায় আসে না তবে নতুন লিখতে আসা কবিদের কারও কারও লেখা পড়ে চমকে উঠি মুগ্ধ হয়ে যাই সম্প্রতি এমনই এক কবির কবিতা পড়ছি কিছুদিন ধরে, যিনি আমার সম্পূর্ণ অচেনা নাম কস্তুরী সেন আবহমান, বৃষ্টিদিন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় পরপর কস্তুরী সেনের কবিতা পড়ার পর আমি এই কবির কাব্যগ্রন্থ পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম আবহমান এবং বৃষ্টিদিন পত্রিকায় কেবল নবীন নবীনাদের লেখাই ছাপা হয় কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমার মতো প্রবীণ যাঁরা, তাঁদের লেখাও জায়গা পায় কৃত্তিবাস কবিতাপত্রের দরজা সব বয়সের কবিতা লেখকদের জন্য খোলা থাকে তবে আমার নিজের আগ্রহ নবীনদের কবিতা পড়ার দিকে ঝুঁকে আছে সবসময়

আমি এই কস্তুরী সেনের যে বইটি পেয়েছি সেবইটি হলনাম নিচ্ছি মাস্টারমশাই বইটি একবার সম্পূর্ণ পড়ার পর আবার একটু একটু করে সারাদিন ধরে পড়ছি আমার মনে পড়ছে বুদ্ধদেব বসুর একটি চিঠির অংশ, যা তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৩ সালে, কবি নরেশ গুহকে, মহীশূর থেকে বুদ্ধদেব লিখছেন, ‘কিছুদিন আগে বোদলেয়ারের গদ্যকবিতা একখণ্ড আমার হাতে এলছোট বই, পড়ে উঠতে একঘণ্টার বেশি লাগে না কিন্তু পড়ে ফেলতে সারা জীবন কেটে যায় তোমাকে বলব কীঘুমের আগে বইখানা খুলে যে কোনও পাতায় দুটি চারটি লাইন যদি পড়ি, তহলেই সমস্ত মন এক বেদনামধুর শান্তিতে ভরে যায় ওই একটুকুর বেশি দরকারই হয় না…’

আমি, ব্যক্তিগত জীবনে, বোদলেয়ারের ওই রকম গদ্যকবিতার কোনও বই পড়িনি আমি পড়েছি জোনা রিচার্ডসনের ইংরেজি অনুবাদ সত্তর দশক থেকে বইটি আমার সঙ্গে ছিল, বারবার বাড়ি বদল করায় এখন হারিয়ে গিয়েছে সে বই 

কস্তুরী সেনের কবিতার সঙ্গে বোদলেয়ারের বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই কিন্তু, বুদ্ধদেবের চিঠির লাইনগুলি বললাম এই কারণে যে, বুদ্ধদেবের পড়ার ধরনের সঙ্গে আমার পড়ার সাদৃশ্য আছে খুব বেশি রকম আমি কস্তুরী সেনের বই খুলে একসঙ্গে দুটি, বড়জোর তিনটি কবিতা পড়ে উঠতে পারছি তারপর বই বন্ধ করে বসে থাকছি অনেকক্ষণ কবিতাগুলির কোনওটিতেই কোনও উচ্চস্বর নেই মৃদু প্রেমার্তি আছেদুঃস্বপ্ন নেইসংসারযাপনের মধ্যেকার শান্তিঅশান্তির কথা নম্র ভাবে বলা আছে ভাষা এতই সুন্দর যে মনকে দীর্ঘক্ষণ এক মাধুর্যে ভরিয়ে রাখে এই কবি অত্যন্ত ভালো ছন্দ জানেন, কিন্তু কোথাও ছন্দদক্ষতা কবিতা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠে আলাদা ভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে না অন্তঃমিল প্রয়োগ করা হয়েছে অনেক কবিতায়, কিন্তু মিলগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন সুন্দর ভাবে দূরে দূরে স্থাপন করা আছে যে কবিতাটির দ্বিতীয় পাঠেই কেবল তা চোখে ধরা দেয় সবচেয়ে আমাকে যা মোহিত করেছে তা হল, এইসব কবিতার মন যেমনের মধ্যে এক কণা বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা কিংবা ক্রোধ উদযাপন নেই কোথাও আছে কোমল দুঃখের স্বর, কোথাও স্নিগ্ধ বিষাদএমনকি, আজকের কবিতায় যা দুর্লভ, সেই শুদ্ধ আনন্দের উপস্থিতিও আছে কারও প্রতি কোনও দোষারোপ নেই 

এখানে জায়গা কম, তাই কবিতা তুলে তুলে আমি বিশ্লেষণ করতে পারছি না কিন্তু লেখা যাঁরা পড়বেন, তাঁদের কাছে প্রথমে একটি কবিতা উপহার দিচ্ছি

তারা

সন্ধ্যেবেলা দেরি করে ফেরা

অশান্তির বাড়তি টিউশন

দোষ দেওয়া, দোষ নেওয়া ভেসে যাচ্ছে সংসার ডোঙায়

নারীটি করিৎকর্মা, পুরুষ অর্ধেক বাতে

                 সন্তানের মুখে অপলক

শখের রেওয়াজ গেছে!

আমারও তো লেখালেখি সব

নব্বই সালের পাড়া, জেদ করে ভিন্ন হাঁড়ি

রক্তচক্ষু যৌথ পরিবার;

পড়োশিনি ক্ষুণ্ণমুখ, বউটির তবু নিচু স্বরে

উনি না হলে কি আর এত কিছু একা পারতাম!’

 

অন্ধকারে, লেবুফুলে, মাঝে মাঝে দীর্ঘ রাস্তায়

বাড়িতে ফেরার পথে মনে পড়ে অনটন

অসমাপ্ত ন্যাড়া ছাদে

বাবা, মাকে তারা চেনাচ্ছেন

এই কবিতা এমন সৌন্দর্যভরা লাইন আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সম্পূর্ণ করবে নিজেকে, সে কথা ভাবা যায়নি

 এই কবির আরও একটি বই আছে যার নামধীরে বলো অকস্মাৎ বইটি মাত্র একদিনের জন্য হাতে পেয়েছিলামবইয়ে ডুবে গিয়ে পড়া হয়নি এই কবির দুটো কাব্যগ্রন্থই প্রকাশ করেছেনধানসিঁড়িপ্রকাশন, যে প্রকাশন সংস্থা তরুণ শক্তিমান কবিদের বই প্রকাশ করতে সতত উন্মুখ 

এই কবির জন্ম ১৯৮৫ সালে তখন আমিউন্মাদের পাঠক্রমলেখার পরভূতুমভগবানবইটির কবিতা লেখা শুরু করেছি অর্থাৎ এই কবি বয়সে আমার সন্তানতুল্য কিন্তু বয়স কম হলেই কাউকে শ্রদ্ধা করা যাবে না, এমন বিশ্বাস আমার নেই আমি এই কবির লেখার দরজায় বারবার গিয়ে দাঁড়াব আজকের লেখা থামানোর আগে এই কবির আরও দু’টি কবিতা পাঠকদের পড়তে দিচ্ছি। 

kasturi sen
কস্তুরী সেন-এর কাব্যগ্রন্থ। ছবি সৌজন্য – জয় গোস্বামী

ত্যাগ

ত্যাগ করবে 

পুনরায় মৃত্যুর দুরত্বে গিয়ে

সমস্ত রাত্রি দেবে ভরে ভরে

গানের অধিক গান

গোপনের অধিকে গোপন

 

আমারও অনন্ত পাঠ বুঝে নেওয়া

 

হাজার বছর ধরে পুরনো বাংলা ভাষায়

আমার অনন্ত কূল, আমারও অনন্ত ঘর ভেঙে

লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়া

 

লুকিয়ে বাঁচিয়ে নেওয়া

নতুন লেখার মতো মন

 

জীবন

অথচ বুকেও নিইনি

সারাদিনে একবার তাকিয়ে দেখিনি যত পক্ষীরাজ ধুলো

বন্ধুদের গল্প কিংবা নতুন চাহিদা

সারাদিনে একবারও আঙুলে কামড় নয়, টিফিনে সুগন্ধ নয়

               পছন্দের প্রবল আদর

সমস্ত দিনের শেষে

যুদ্ধ শেষে, জয় শেষে, পরাজয় শেষে

শ্রাবণের রাত্রি নামে অমল গহন

 

আমার উপান্ত ঘরে একা বিশ্ব হয়ে আছে ঘুম

 

ছেলের মুঠোর গন্ধে ধুয়ে যায়

জীবনের সব সব বাইশে শ্রাবণ!

Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

6 Responses

  1. বাহ্! বাহ্! বাহ্! অভিনন্দন আপনাকে। আমার মনে হয় আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এর চেয়ে আর বেশি কিছু হতে পারে না। আপনার কবিতা পড়ার সুযোগ তেমন হয় নি। ফেসবুকে কিছু পড়েছি। বেশ ভালো লেগেছে। একটু ভিন্ন ধর্মী লেখা। এখানে উল্লেখিত তিনটি কবিতা খুবই ভালো লিখেছেন। তার মধ্যে “তারা” কবিতার মধ্যে আমি যেন নিজেকে ও খুঁজে পাই। কবিতা
    লেখার আপনার নিজস্ব একটা মৌলিকতা আছে। তাই এই বয়সে এত যশ, খ্যাতি। কালে আপনি অনেক বড় লেখক হবেন, সেটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আপনার আগামী দিনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা, শুভকামনা আর ভালোবাসা রইল। ভালো থাকবেন।

  2. নাম নিচ্ছি মাস্টারমশাই অর্থাৎ নামকবিতাটি এতটাই ভাল লেগেছিল, পড়িয়েছিলাম কয়েকজনকে। ছন্দের জন্য নয়, শব্দপ্রয়োগের কৌশল ও তাকে এক্সপ্রেশনে বিদ্ধ করার মুন্সিয়ানায় বেশ মেধার ছাপ পেয়েছিলাম, ইদানীংকার খুব বিরল ঘটনা যেটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *