joy goswami

১৯৭৩ সালে আমার কবিতা প্রথম প্রকাশ পায় এক শারদ উৎসবের সময়, একইসঙ্গে তিনটি লিটল ম্যাগাজিনে। তখন আমার বয়স ১৯। এর পরের ষোলো বছর ধরে কলকাতা ও মফসসলের অজস্র লিটল ম্যাগাজিনে আমার কবিতা বেরতে থাকে। আমার ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত একটানা আমি লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লিখে চলি। সেই সব পত্রিকার সম্পাদকরা চিঠি লিখে আমার কাছে কবিতা ও কবিতাগুচ্ছ চাইতেন। লিটল ম্যাগাজিন আমার সাহিত্যজীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। 

এই লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হল কী ভাবে? কী ভাবে আমি জানতে পারলাম লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্বের কথা? সে এক আশ্চর্য কাহিনি, যে-কাহিনির কেন্দ্রে আছেন একজন আশ্চর্য মানুষ। তাঁর কথা আজ জানাব। 

তাঁর নাম ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মোটেই কোনও লেখক বা কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট কোচ। আমি আমার বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবন যে-টাউনে অতিবাহিত করেছি, তার নাম রানাঘাট। সেখানে ক্রিকেট-লিগ খেলা হত। ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নবাঙ্কুর নামে একটি ক্রিকেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু এ কথা বলা দরকার, তিনি যে শুধু রানাঘাট ক্রিকেট লিগেই খেলতেন, তা নয়। কলকাতার প্রথম ডিভিশন ক্রিকেট লিগে তিনি খেলেছেন যথাক্রমে হোয়াইট বর্ডার ও স্পোর্টিং ইউনিয়ন নামক ক্লাবে। আমি যখন ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখি, তখন তাঁর মধ্যযৌবন। ছ’ফুটের বেশি লম্বা। খাড়া নাক, চোখে তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। ছিপছিপে তলোয়ারের মতো চেহারা। আমার তেরো বছর বয়সে আমি নবাঙ্কুর ক্লাবে ভর্তি হই ক্রিকেট খেলা শিখব বলে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে ভারী ক্রিকেট ব্যাট আমি হাতে তুলতেই পারতাম না। আমার ক্রিকেট খেলা শেখা আর হল না। তবু আমি নবাঙ্কুর ক্লাবে রয়ে গেলাম একজন দর্শক হিসেবে। ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রখর ব্যক্তিত্ব আমাকে এতটাই আকর্ষণ করে রেখেছিল যে কথাবার্তা বলার সময় আমি তাঁকে নকল করতাম। 

লিটল ম্যাগাজিনের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় ও ক্রিকেট কোচের কথা এতক্ষণ বলছি কেন? কারণ আছে তার। বছরে তিন মাস রানাঘাটে ক্রিকেট খেলা হত। অন্য সময়ও ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় নানা রকমের সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকতেন। রানাঘাটে, ওই প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি এমন একটি কাজ প্রতি বছর নিয়মিত করে যেতেন, যে কথা ভাবলে এখনও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমার। 

প্রত্যেক বছর ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজোর চারদিন একটি প্রদর্শনী করতেন এক বালিকা বিদ্যালয়ের চারটি বড়ো বড়ো ঘর নিয়ে। বিদ্যালয় পুজোর ছুটিতে বন্ধ থাকত। ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যালয়ের চারটির মধ্যে দু’টি ঘরে চিত্রকরদের ছবি টাঙাতেন। পুরো পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন নবীন চিত্রকরদের আঁকা ছবি তিনি সংগ্রহ করে আনতেন। দু’টি ঘরে ছবি রইল। আর বাকি দু’টি ঘরে কী রাখতেন? রাখতেন অজস্র লিটল ম্যাগাজিন। এক্ষেত্রেও পুরো পশ্চিমবঙ্গে যত ছোটবড়ো লিটল ম্যাগাজিন বেরত তখন, সে সব সংগ্রহ করে সাজিয়ে দিতেন ঘরের বড়ো বড়ো টেবিল জুড়ে। লিটল ম্যাগাজিন কথাটি আমি জীবনে প্রথম ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেই শুনতে পাই। তিনি আমার মতো কিশোর বয়সী ছেলেদের ভলান্টিয়ার করে দাঁড় করিয়ে দিতেন ওই লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনীতে। আমাদের কাজ পাহারা দেওয়া। চারদিন পর প্রদর্শনী শেষ হত। তখন আমরা, ক্লাবের ছেলেরা সেইসব লিটল ম্যাগাজিন দড়ি দিয়ে বেঁধে ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতাম। 

কত পত্রিকাই না থাকত সেই প্রদর্শনীতে! ক্ষুধার্ত, আর্তনাদ, কৃত্তিবাস, কবিপত্র, গল্পকবিতা, নিষাদ, নতুন সাহিত্য, উলুখড়, জিগীষা ইত্যাদি অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্ভার ছিল ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পোস্টকার্ড সাইজের একটি পত্রিকা তখন বেরত, যার নাম পত্রাণু। প্রয়াত বেতার-ঘোষক ও আবৃত্তিকার অমিয় চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই পত্রাণুর সম্পাদক। 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভলান্টিয়ারের কাজ করবার সময় হাতে নিয়ে উল্টে দেখতাম সেইসব পত্রিকার কবিতা ও গল্প। ‘অনুক্ত’ নামে একটি পত্রিকায় প্রথম পড়ি জীবনানন্দ দাশের গল্প। তখনও জানি না জীবনানন্দ মূলতঃ কবি। 

প্রদর্শনী হয়ে যাবার পর আমি ভয়ে ভয়ে ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে যেতাম। তাঁর কাছে কয়েকটি পত্রিকা পড়ার জন্য ধার চাইতাম। প্রথমবার তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন, মনে আছে। কারণ, ওই নবাঙ্কুর ক্লাবের আর কোনও ছেলে তো এসে লিটল ম্যাগাজিন পড়ার জন্য চাইত না তাঁর কাছে। পত্রিকাগুলি আমার পড়া হয়ে গেলে আমি তাঁর বাড়ি গিয়ে ফেরত দিতাম কয়েকদিন পর। ফেরত দিয়েই আবারও কিছু লিটল ম্যাগাজিন চাইতাম। ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটি ছিল বড়ো। সেখানে একটি ঘরে লিটল ম্যাগাজিন ঠাসা। প্রত্যেক বছর প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে আসা লিটল ম্যাগাজিন জমা হচ্ছে তো সেই ঘরে। পরের দিকে, আমার অত আগ্রহ দেখে, ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, “ওই ঘরে গিয়ে নিজে বেছে নিয়ে যাও।” আমি আবারও চার-পাঁচটি করে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আসতাম পড়ব বলে। 

এ কথা স্বীকার করতে আজ কোনও কুণ্ঠা নেই আমার যে, ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই আমি আধুনিক কবিতার সংস্পর্শে আসতে পারি। আমি ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যাই আর কয়েকটি করে পত্রিকা নিয়ে আসি। এইসব পত্রিকা পড়তে পড়তেই একদিন গোপনে কবিতা লেখার চর্চা শুরু হয়ে যায় আমার। এ কথাও স্বীকার করতে বাধা নেই, সেই ৫০ বছরেরও বেশি আগে ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী আরম্ভ না করলে কবিতা লেখার নেশায় আমাকে ধরত না। 

আপনারা একবার ভেবে দেখুন, ৫০ বছর আগে, কলকাতা থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের একটি ছোট টাউনে একজন ক্রিকেট খেলোয়াড় কতখানি মনোযোগী ছিলেন কাব্য-সাহিত্যের প্রতি, যে প্রত্যেক বছর লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী করতেন একেবারে একক চেষ্টায়। সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হবার কত আগের কথা বললাম আমি, এ কথাও ভাববার মতো। 

ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় এইসব লিটল ম্যাগাজিন কিনে আনতেন কলেজ স্ট্রিটের পাতিরাম নামক লিটল ম্যাগাজিনের স্টল থেকে। তাঁর মুখে সে কথা জানতে পেরে আমিও একদিন খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেলাম কলেজ স্ট্রিটের মোড়ের কাছে সেই পাতিরামের স্টলে। ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাওয়া পত্রপত্রিকার মধ্যে আঠারোটি ছিল ‘কবিতা’ পত্রিকার সংখ্যা, যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকা তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। কিন্তু ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন তার আঠারোটি সংখ্যা। তাঁর কাছে পেলাম পরিচয় পত্রিকা, পূর্বাশা পত্রিকা। পূর্বাশাও তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকা পড়ে প্রথম জানতে পারলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখা কী রকম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার বই ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’ পড়ার সুযোগও পেয়েছিলাম ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রেই। 

মূল কথা হল, এই যে আমাকে আজ আপনারা একজন কবিতালেখক হিসেবে চেনেন, তার সূত্রপাত হয়েছিল ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরেই। রানাঘাটের মতো দূর মফসসলে ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সিনেক্লাব’ নামে একটি ফিল্ম ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে আমি বার্গম্যান, ফেলিনি, কুরোসাওয়া, গদার এইসব বিশ্ববিখ্যাত পরিচালকদের ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি। সে সব ছবি আমার কবিতার মর্মবস্তুর সঙ্গে এসে মিশে গিয়েছে। পরিণত বয়সে ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায় রানাঘাটে একটি নিয়মিত বইমেলাও শুরু করেছিলেন। 

আজ থেকে মাত্র একমাস হল অকস্মাৎ প্রয়াত হয়েছেন ভৃগু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মাধ্যমেই আমার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ। আজ তাঁকে গুরুপ্রণাম জানাই। 

Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

5 Responses

  1. ভালো লাগল।
    শহরতলিতে এমন বেশকিছু মানুষকে দেখতে পেতাম, যাঁরা তাঁদের গন্ডি পেরিয়ে যাওয়ার সাহস করতেন এবং অনেককে তাঁর সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতেন।

  2. এই আন্তরিক গুরুবন্দনা বড় মধুর লাগল । জয় গোস্বামী অমিয় চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রাণুর কথা লিখেছেন , সেই পত্রিকার একটি সংখ্যা এখনও আমার কাছে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে । সত্তর দশকের শুরুতে মিনি পত্রিকার ধুম লেগে গিয়েছিল । অনেক বড় বড় লেখক সেখানে লিখতেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *