joy goswamiসেই কোন ছোটবেলা থেকেই একা একা মনে মনে কথা বলতাম। অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল তেমন। বনে বাদাড়ে, ঝোপ জংলায় ঘুরে বেড়াতাম আর কথা বলতাম। কী রকম কথা? মনে মনে গল্প বানাতাম। গল্প যখন, বলবার তো লোক চাই। ভাইকে শোনাতে যেতাম। আমি হয়ত বললাম এক ছিল রাজা, আর তার ছিল এক রানি। এইটুকু শুনেই ভাই বলত: তুই জানলি কী করে? ব্যাস। অমনি আমি চুপ করে যেতাম। সত্যিই তো! আমি জানলাম কী করে? এর তো কোনও উত্তর দিতে পারব না। কখনও হয়ত বলতে যেতাম, জানিস, একটা ছেলে ছিল, যে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত, আর খেয়া নৌকা করে নদীর ওপারে চলে গিয়ে এলোমেলো হাঁটতো। আবার ভাই বলত, তুই জানলি কী করে অমন একটা ছেলে ছিল? ছেলেটা কোথায় ছিল? তোর চেনা? আমি আবার চুপ। কারণ ছেলেটা তো আমিই। কিন্তু সে কথা তো আর ভাইকে বলা যায় না। তাই নিজের তৈরি গল্প নিজের মানের মধ্যেই থেকে যেত। তবু মনে মনে কথা বলার স্রোতকে থামাতে পারতাম না। কবে একদিন অঙ্ক খাতা নিয়ে তার পিছনের দিকের সাদা পাতায় সে সব কথার কিছু কিছু লিখে রাখতে আরম্ভ করলাম। ডায়েরির মতো করে লেখা। কখন কী মনে হচ্ছে সেটুকু লিখে রাখা শুধু। সব লেখাই এক পৃষ্ঠা দেড় পৃষ্ঠা মতো। সব লেখাই অসমাপ্ত। এই ভাবে লিখতে লিখতে একসময় লেখাগুলো কবিতার আকার পেতে শুরু করল। সে সব পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগের কথা। এখন আমার একক কবিতার বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। কিন্তু আজ যদি কেউ আমাকে আমার কবিতার যে কোনও একটা বিষয়ে প্রশ্ন করে, কী করে জানলি? আমি এখনও উত্তর দিতে পারব না। যদি আমার কোনও কবিতার বই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে এই বইতে কী বলা হয়েছে এবং যা বলা হয়েছে তা তোমার অধিগত হল কী উপায়ে– তখনও আমি চুপ করেই থাকব। ভাইয়ের সেই অমোঘ প্রশ্ন: কী করে জানলি; আজও আমাকে তাড়া করে। কারণ একটি কবিতা বা একখানি কবিতার বই আমি লিখলাম বটে কিন্তু কী উপায়ে লিখলাম এবং সে বই কী বলতে চায়, সবই আমার অজানা।    

অজানা। এই একটি শব্দ পর্যন্ত শুধু আমি পৌঁছতে পারি। আমার কাছে কোনও কবিতা হঠাৎ আরম্ভ হয়। কয়েকটি লাইন পরপর মাথায় চলে এল। কখনও বা মাত্র একটাই লাইন তিন দিন চার দিন ধরে মানের মধ্যে ঘুরে চলেছে। পরে লাইন আর আসছে না। অকস্মাৎ পরে দু’টি তিনটি লাইন চলে এল। অবাক হয়ে দেখলাম চার লাইনের একটি স্তবক তৈরি হয়ে গেছে! তখনও কিন্তু খাতা কলম নিইনি। এই যে চার লাইনের একটি স্তবক মনের মধ্যে তৈরি হয়ে উঠল, তা কী উপায়ে হল? সত্যি আমি জানি না। তারপর হয়ত কলম হাতে বসে কবিতার ওই স্তবকটি নিয়ে লেগে পড়লাম। স্তবকটি স্বয়ংক্রিয় ভাবেই আরও একটি স্তবককে নিয়ে এল সঙ্গে। তারপর আরও একটি স্তবক। পরপর চলতে লাগল। ‘মা নিষাদ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম এই ভাবে। আবার ‘পাগলি, তোমার সঙ্গে’ কবিতাটি লেখার সময় খাতা কলম নিতে হয়নি। পুরো লেখাটাই মাথায় মাথায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ডালহৌসি থেকে একটি মিনিবাসে বাড়ি আসছিলাম। বসার জায়গা পাইনি। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আসছি। আর মাথায় আসছে কবিতার লাইন। লাইনগুলি মাথায় ধরে রাখছি। এক এক স্টপে বাস যাত্রী ওঠানামার জন্য থামে আর বাসের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যে তরঙ্গ ওঠে। ঠেলাঠেলি শুরু হয়। আমি ভিড় বাসে যাতায়াতের সময় কখনওই বসার জায়গা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতাম না। মাথার ওপরের হ্যান্ডেল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন গন্তব্য আসে। সেদিনও তেমনই দাঁড়িয়ে আছি। আর বাস এক-একবার থামছে, সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলির তরঙ্গ উঠছে। 

ঠিক যে সময়টায় ঠেলাঠেলির তরঙ্গ উঠছে, সে সময়টায় আমার মাথায় কবিতার লাইন এসে পড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাস ছাড়ছে। ভিড়ে দাঁড়ানো যাত্রীরা যে যার মতো একটা স্থিতাবস্থা খুঁজে নিচ্ছে। কোনও সিট ফাঁকা হলে নিকটস্থ ব্যক্তি বসে পড়ছে। আবার কেউ ভালো করে দাঁড়িয়ে থাকার মতো জায়গা পাচ্ছে। বাস চলছে। আর ওই ঠেলাঠেলি থেমে গেলেই আবার মাথায় আসছে কবিতার লাইন। ডালহৌসি থেকে ঢাকুরিয়া– এই পুরো রাস্তাটা আমি দাঁড়িয়েছিলাম আর মনে মনে তৈরি হয়ে উঠছিল ‘পাগলি, তোমার সঙ্গে’ নামক কবিতাটি। বাড়ি এসে, স্নান করে, কাগজ কলম নিয়ে বসে আমি টুকে নিচ্ছিলাম কবিতাটি। ‘কী করে জানলি’-র বদলে ভাই যদি আমাকে প্রশ্ন করত ‘কী করে লিখলি’ তাহলে আবারও আমার কোনও জবাব থাকত না। 

‘উন্মাদের পাঠক্রম’ নামে আমার একটি কবিতার বই আছে, যে বইটি আমি পুরোটাই ‘মানস লিখন পদ্ধতি’ অনুসরণ করে লিখেছিলাম। ‘মানস লিখন পদ্ধতি’ নামটা আমার নয়। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ও আমার জীবন’ প্রবন্ধে এই শব্দটির ব্যবহার পেয়েছি। সেই প্রবন্ধ থেকে কথাটা আমার জীবনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বইটা লেখার সময় আমি ও আমার ভাই খুবই আর্থিক অনটনের মধ্যে বাস করছিলাম। আমার স্কুলশিক্ষিকা মা হঠাৎ মারা গেলেন একদিন। তার দু’মাসের মধ্যে আমরা ঘোরতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়লাম। আমাদের তখন দু’তিনটি গোরু ছিল। সেই গোরুর দুধ বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতে হত আমাকে। ঝোলার মধ্যে ঘুঁটে ভরেও পড়শিদের ঘরে পৌঁছে দিতাম। বিচালি কিনে আনতে হত ভ্যান রিকশায় বসে। গোরুদের জাবনা দিতে হত। সময় কোথায়, যে বসে একটু লিখব? তখন মাথায় মাথায় তৈরি হত কবিতা। একটা কবিতা সম্পূর্ণ হয়ে গেলেই তৎক্ষণাৎ সে-লেখা কাগজে লিপিবদ্ধ করব, সে অবকাশ ছিল না। হয়তো চার-পাঁচটি কবিতা মনের মধ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি এক সপ্তাহ। মনে মনেই শব্দ অদল বদল করছি। তারপর হঠাৎ একদিন কিছুটা সময় পেয়ে, হয়তো একটি দুপুরে একসঙ্গে চার পাঁচটি কবিতা লিপিবদ্ধ করলাম। এ ভাবেই ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বইটি লেখা।

ভাইয়ের সেই প্রশ্নের উত্তর আমি এখনও দিতে পারব না যে, কী করে জানলি? সত্যিই তো, একটি কবিতা কী ভাবে লেখা হয়, সে কথা তো আমি এতদিন কবিতালেখার চর্চা  করেও জেনে উঠতে পারলাম না। কবিতা শুরু হওয়ার আগে তো বুঝতেই পারি না! এখন একটি কবিতা যখন লিখে চলেছি, তখনও আমি জানি না কবিতাটি কোথায় গিয়ে থামবে। নিজের কবিতা বিষয়েই যখন আমি বুঝতে পারি না কী ভাবে লেখাটা আসছে, কী ভাবে লিখছি, বা কেমন সেই প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় লেখা আমার উচিত কাজ হবে, তখন আমি অন্য কারও লেখা কী উপায়ে লেখা উচিত, সে কথা বলব কী করে? তবে বিভিন্ন কবির কবিতাবিষয়ক গদ্য লেখায় দেখেছি কী ভাবে এখন কবিতা লেখা দরকার, সে কথা তাঁরা অনায়াসে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে দিচ্ছেন। যাঁরা জানেন তাঁরা বলতে পারেন। আমি তো জানি না। তাই ‘কী করে জানলি?’ এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমার জানা নেই। যে-আমি নিজের মনের ভিতরে প্রবেশ করেই জেনে উঠতে পারলাম না কী ভাবে একটি কবিতা লেখা হয়, সেই আমি কী করে অন্য আর একজন বা আরও পাঁচ-দশজন কবির মনের ভেতর ঢুকে জানতে পারব তাঁর অবচেতনের ভেতরে কী খেলা চলেছে? 

তাই কবিতা বিষয়টাই আজও আমার অজানা। কবিতা, আমার কাছে, এখনও, একটা অজানা বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে। পথ চলে একরকম অজানার মধ্য দিয়ে। এবার এক অজানায় পৌঁছে সম্পূর্ণ করে নিজেকে। কবিতা সম্পূর্ণ হবার আগের লাইনে অথবা তার আগের লাইনে আমি আন্দাজ পাই কবিতাটি এবার থামতে চলেছে। এই অজানার সঙ্গে বসবাস করেই পার করে এলাম এতগুলো বছর।       

Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *