যদিও আমার এই বিশেষ কলামের নাম ‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’, তবুও আজকে আর কবিতা নিয়ে তেমন কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না আমার। কারণ আশ্বিন মাস এসে পড়েছে। মাঝে মাঝে দু এক পশলা বৃষ্টি হলেও আকাশ থেকে মেঘ সরে গেলেই ফুটে উঠছে ঘন এক নীল রং। সেই নীল রঙের সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে দুধসাদা মেঘের স্তূপ। মনে পড়িয়ে দিচ্ছে পুজো প্রায় দরজায় এসে পৌঁছে গেল। মা দুর্গা, সিংহবাহিনী, আবার তাঁর আগমনবার্তা ঘোষণা করে দিচ্ছেন আকাশ বাতাস মেঘ আর কাশফুলের মধ্যে দিয়ে। আমার খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। 

ছোটবেলায় নতুন জামাজুতো পাওয়ার আনন্দ তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল পূজাবার্ষিকী পাওয়ার খুশি!
আমাদের বাল্যকালে দেব সাহিত্য কুটির থেকে পুজোর আগে-আগে ছোটদের পড়ার উপযোগী লেখার বিপুল সম্ভার নিয়ে প্রকাশ পেত একটি পূজাবার্ষিকী। প্রত্যেক বছরে সেই পূজাবার্ষিকীর নাম বদলে বদলে যেত।
আমাদের বাড়িতে নেওয়া হত শুকতারা পত্রিকা।
তখনও পত্রিকার রূপ ধরে আনন্দমেলার প্রকাশ শুরু হয়নি। প্রত্যেক রবিবার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার চার পৃষ্ঠার রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রটির শেষ পাতায় ‘আনন্দমেলা’ নামক একটি বিভাগ-এ ছোটদের জন্য বড়দের লেখা ছাপা হত। কোনও আলাদা পত্রিকার রূপ তখনও সেই আনন্দমেলা পরিগ্রহ করেনি। 

নীল রঙের সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে দুধসাদা মেঘের স্তূপ। মনে পড়িয়ে দিচ্ছে পুজো প্রায় দরজায় এসে পৌঁছে গেল। মা দুর্গা, সিংহবাহিনী, আবার তাঁর আগমনবার্তা ঘোষণা করে দিচ্ছেন আকাশ বাতাস মেঘ আর কাশফুলের মধ্যে দিয়ে। আমার খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। 

পুজো এলেই প্রকৃতির মধ্যে পুজো আসবার সঙ্কেত আসতে থাকে। আমরা যেখানে থাকতাম, কলকাতা থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট টাউনে, সেখানে অনেক গাছপালা আর জংলা ঝোপ ছিল। পুকুর ছিল অনেক। আর ছিল চূর্ণী নামের এক নদী। সেই নদীর ধারে ধারে ফুটে উঠত ঝাঁক ঝাঁক কাশফুল। আমরা যে-বাড়িটিতে থাকতাম তার পূর্বদিকে দশ মিনিট হাঁটলেই পাওয়া যেত রেললাইন আর পশ্চিমদিকে দশ মিনিট হাঁটলেই চূর্ণী নদী। খেয়া পারাপার হত সে-নদীতে। ভাড়া ছিল তিন পয়সা। চূর্ণী নদীর ধারে যেমন শ্বেতশুভ্র কাশফুলের জঙ্গল হয়ে থাকত, তেমনই রেললাইনের দু পাশেও ফুটে থাকত কাশের গুচ্ছ। আকাশে ভেসে বেড়াত প্রায় ততদূর শুভ্র মেঘের স্তূপ। 

দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত ছোটদের পূজাবার্ষিকীর বিজ্ঞাপন আমরা প্রথমে দেখতাম শুকতারা পত্রিকার সাধারণ সংখ্যায়। ওই যে বললাম, প্রত্যেক বছর বার্ষিকীর নাম বদলে যেত, সেই নামগুলির কিছু কিছু এখনও মনে থেকে গেছে। মণিহার, পূরবী, উদ্বোধন, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অপরূপা, নীহারিকা এই রকম সব নাম নিয়ে প্রায় চারশো পাতার বোর্ড বাঁধাই করা একটি পত্রিকা মহালয়ার পরে পরেই এসে পৌঁছত আমাদের বাড়ি। সেখানে বিখ্যাত সব লেখকদের লেখা থাকত, যা তাঁরা ছোটদের জন্য লিখতেন। থাকত ছবিতে গল্প।  অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি, শিকারের গল্প। রহস্য উপন্যাস। কবিতাও থাকত। কিন্তু সে-বয়সে কবিতার দিকে তত মন ছিল না আমার। 

পুজো এলেই প্রকৃতির মধ্যে পুজো আসবার সঙ্কেত আসতে থাকে। আমরা যেখানে থাকতাম, কলকাতা থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট টাউনে, সেখানে অনেক গাছপালা আর জংলা ঝোপ ছিল। পুকুর ছিল অনেক। আর ছিল চূর্ণী নামের এক নদী। সেই নদীর ধারে ধারে ফুটে উঠত ঝাঁক ঝাঁক কাশফুল।

ধীরে ধীরে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, কবিতার প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ওদিকে ছোটদের জন্য প্রকাশিত শারদ সংখ্যা থেকে মন সরে এল বড়দের পূজাসংখ্যার দিকে। শারদীয়া ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, শারদীয় ‘যুগান্তর’, শারদীয় ‘অমৃত’ পত্রিকার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম পুজোর সময়। তখনও ‘আনন্দলোক’ পত্রিকাটি বেরতে শুরু করেনি। বদলে বেরত মাসিক সব সিনেমা পত্রিকার মোটা মোটা শারদসংখ্যা। সেসব পত্রিকার নাম, ‘সিনেমাজগৎ’, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’, ‘ঘরোয়া’ — এখন এইসব পত্রিকার নাম বললে নতুন ছেলেমেয়েরা চিনতে পারবে না। কিন্তু সে সময় এইসব পত্রিকা যথেষ্ট ভালো ভালো লেখা নিয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিত। ‘প্রসাদ’ নামক পত্রিকাটিও ছিল চলচ্চিত্র বিষয়ক কাগজ। তখনও বলিউড বা টলিউড এসব নামের প্রচলন হয়নি। টালিগঞ্জ আর বোম্বে, এই শব্দ দু’টিই ব্যবহার করা হত কলকাতা ও মুম্বই চলচ্চিত্রজগৎ সম্পর্কে। সিনেমা সংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ সংবাদ ও ফিচার থাকত সেই সব কাগজে। সেইসঙ্গে শোভা পেত তখনকার নায়ক-নায়িকাদের বর্ণাঢ্য ছবি। 

কিন্তু পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত উপন্যাসগুলির গুরুত্ব কতদূর উচ্চমানের ছিল, তার দু’ একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি এবার। ‘প্রসাদ’ পত্রিকার একটি শারদ সংখ্যায় পড়েছিলাম মহশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’, যে-উপন্যাস এখনও মহাশ্বেতা দেবীর প্রধান একটি সাহিত্যকীর্তি বলে পরিগণিত হয়। আরও একটি সিনেমা পত্রিকা ছিল যার নাম ‘ঘরোয়া।’ সেই ঘরোয়া পত্রিকার এক শারদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাস। যে-উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পরে, এক স্মৃতিচারণামূলক রচনায় এই অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাস কী কারণে তিনি লিখেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর কবি-বন্ধুরা ‘কৃত্তিবাস’ নামক একটি কবিতা পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে-কাব্যপত্র আজও নিয়মিত প্রকাশ পায় এবং এখন যা একটি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। সে সময়, কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনও চাকরি ছিল না। কিন্তু কাব্যপত্র কৃত্তিবাস বেরবে না, অর্থাভাবে? এ কথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভাবতেও পারতেন না। ফলে, পত্রিকা বেরিয়ে যেত, কিন্তু টাকা বাকি থাকত প্রেসে। 

মণিহার, পূরবী, উদ্বোধন, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অপরূপা, নিহারীকা এই রকম সব নাম নিয়ে প্রায় চারশো পাতার বোর্ড বাঁধাই করা একটি পত্রিকা মহালয়ার পরে পরেই এসে পৌঁছত আমাদের বাড়ি। সেখানে বিখ্যাত সব লেখকদের লেখা থাকত, যা তাঁরা ছোটদের জন্য লিখতেন।

সেই প্রেস-মালিকই ঘরোয়া নামক সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সুনীল তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, যখন বেশ কিছু টাকা বাকি পড়ে গেছে ওই প্রেসে, অথচ সেই অর্থ হাতে আসার কোনও উপায় নেই কৃত্তিবাস সম্পাদকের, তখন ওই প্রেস-মালিক একটি অবাক করা প্রস্তাব দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তিনি বললেন, আপনাকে বাকি টাকা আর দিতে হবে না। বদলে আপনি ঘরোয়া পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য একটি উপন্যাস লিখে দিন। সে কথায় সম্মত হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অরণ্যের দিনরাত্রি নামক উপন্যাসটি লিখে কৃত্তিবাস কবিতা পত্রিকার সূত্রে জমা হওয়া ঋণ পরিশোধ করেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও ওই রকম সিনেমা পত্রিকার পুজোসংখ্যার জন্য কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। শারদীয় ‘সিনেমাজগৎ’  পত্রিকায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি অনবদ্য উপন্যাস প্রকাশিত হয় যার নাম ‘ফেরা।’ ‘শ্যাওলা’ নামেও শীর্ষেন্দুর একটি শক্তিশালী উপন্যাস আছে যা কোনও সিনেমাপত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশ পায়। 

ফলে, পুজো যে আমার জীবনে আসত, তা কেবল নতুন জামাজুতো পরে ঠাকুর দেখার উৎসাহ জাগিয়ে দেওয়ার জন্য, তা নয়। বরং যখন কৈশোর পার হয়ে প্রথম যৌবনে পা রাখলাম, তখন ঠাকুর দেখা বা অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহ প্রায় চলেই গেল। এসে পড়ল পূজাসংখ্যা পড়ার অদম্য আকর্ষণ। 

আরও একটি সিনেমা পত্রিকা ছিল যার নাম ‘ঘরোয়া।’ সেই ঘরোয়া পত্রিকার এক শারদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাস। যে-উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। 

তারপর অনেকগুলো বছর পার হয়ে এলাম। এখন বালক বয়সের মতো ঠাকুর দেখার উদ্দীপনা বহুদিন ধরেই আর নেই। পরিবর্তে এসে পড়েছে পূজাসংখ্যার বিশেষ বিশেষ লেখা খুঁটিয়ে পড়ার আগ্রহ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আট বছর হল প্রয়াত হয়েছেন। আমাদের মধ্যে আর নেই মহাশ্বেতা দেবীও। তবু নতুন নতুন কবি ও লেখক উঠে আসছেন। তাঁদের রচনা এখন স্থান পাচ্ছে বিভিন্ন শারদসংখ্যায়। এখন সেইসব নতুনদের লেখাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। পূজাসংখ্যাগুলি এখন প্রকাশ পেতে শুরু করে পুজো আসার অনেকদিন আগে থেকেই। আমার পড়াও শুরু হয়ে যায় পুকোর আগেই। শারদসংখ্যা পড়তে পড়তেই কখন এসে পড়ে পুজো। চারদিন পার করে চলেও যান মা। তখনও আমার সবগুলো পুজোসংখ্যা পড়া শেষ হয় না। পড়েই চলি। এই ভাবেই এখন পুজো উদযাপন হয় আমার। 

Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *