কলকাতা থেকে সাঁওতাল পরগনার রিখিয়া, রিখিয়া থেকে শান্তিনিকেতন, আবার কলকাতা হয়ে জার্মানির হাইডেলবার্গ— দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে অবশেষে থেমে গেলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন, সেরে উঠেছিলেন, আবার অসুস্থ হয়েছেন সে খবরও পেয়েছিলাম। তবু আশা করেছিলাম এই শীতে কলকাতায় বন্ধু ও সাহিত্যানুরাগীরা আবার তাঁর সান্নিধ্য পাবেন। সে সুযোগ আর থাকল না। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক বিরল মেধা ও অন্য বৌদ্ধিক দ্রাঘিমার কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও আন্তর্জাতিক চেতনা-সমৃদ্ধ অলোকরঞ্জনের ৮৭ বছরের এক বৈচিত্রময় জীবন শেষ হল।

অলোকরঞ্জনের জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর। শৈশব কেটেছে সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায়। বিদ্যালয়ের পড়াশুনা বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তাঁর পিএইচডি-র বিষয় ছিল বাংলা কবিতা। ১৯৫৭ সালে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। এখানেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক কবি শঙ্খ ঘোষকে। বৈদগ্ধ্য, জ্ঞানান্বেষণ, সাহিত্য বিশ্লেষণ ও অন্বেষা অলোকরঞ্জনকে অধ্যাপনাতেও খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এরপর জার্মানির হামবোল্ট ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে জার্মানিতে গবেষণার কাজ করতে যান। ১৯৭২ সালে যোগ দেন হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভারততত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক রূপে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রেই গত পাঁচ দশক ধরে হাইডেলবার্গের বাসিন্দা ছিলেন অলোকরঞ্জন। কিন্তু কখনও কলকাতা ও কলকাতার সাহিত্যজগৎ থেকে দূরে যাননি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিটি বিষয়ে ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। আর সেই টানেই প্রতি বছর অন্তত একবার তাঁকে আসতে দেখেছি কলকাতায়। এখানকার সাহিত্যের পত্রপত্রিকার সূচিপত্রে ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।

অলোকরঞ্জনের কাব্যজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে তখনকার উল্লেখযোগ্য কবিতাপত্র আলোক সরকার সম্পাদিত ‘শতভিষা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’-এ। দু’টি পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অলোকরঞ্জনের কবিতা প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই প্রসঙ্গে তিনি পরে বলেছেন— “কৃত্তিবাস’-এর ব্যাপারটাই ছিল চারপাশের প্রথাময়তাকে আঘাত করা, আর ‘শতভিষা’র ব্যাপার ছিল, প্রথার মধ্যে যা কিছু সংরক্ষণযোগ্য, তাকে তুলে আনা… আমার ওপর ‘কৃত্তিবাস’ বা ‘শতভিষা’ কোনো দিক থেকেই সেন্সর ছিল না। দুটো কবিতাপত্রের কোথাও এতটুকু শিবিরপনা ছিল না।” সূচনাপর্ব থেকেই তাঁর কবিতায়, এমনকী, ব্যক্তিগত কথোপকথনেও, স্বাতন্ত্র্য ছিল। তাঁর ছন্দনৈপুণ্য ও ভাষার কারুকার্য তাঁর কবিতাকে দিয়েছে স্বকীয়তা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবনবাউল’ ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কবি হিসেবে অলোকরঞ্জনের এই স্বাতন্ত্র্য তাঁকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি।
১৯৭০- এর দশকে আমরা যখন কবিতার পাঠক, তখনও ‘যৌবনবাউল’ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আমাদের। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বিভাব’ কবিতাটি থেকেই তাঁর পৃথক বাচনভঙ্গি স্পষ্ট –-
পটভূমিকা অন্ধকার আপন স্বত্ব অধিকার
রাখুক, আমি শরীর নোয়াবো না,
একটি মাত্র রাখাল যাক, এ মাঠ একলা পড়ে থাক
নীরবে, আমি এ মাঠ ছাড়বো না।
“ছন্দে, আমি কবিতা ছাড়বো না”, এই অঙ্গীকার কণ্ঠে নিয়ে যাঁর কবিজীবন শুরু, তাঁকে নতুন শব্দের সন্ধান, নতুন শব্দ নির্মাণ ও বাক্যের বিন্যাস ও ছন্দভাবনার বৈচিত্র নিয়ে ভাবতেই হয়। যে অক্ষরবৃত্ত বাংলা কবিতার প্রাণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে উপেক্ষা করে মাত্রাবৃত্তের ওপরে ঝোঁক কবির স্বাতন্ত্র্য সন্ধানের পরিক্রমা বলে ধরে নিতে পারি। এর সঙ্গে মেধা ও মনন যুক্ত হয়ে এক-একটি কবিতা হয়ে উঠেছে হীরকখণ্ডের মতো।
***
পঞ্চাশের অন্য কবিদের সঙ্গে অলোকরঞ্জনের আর একটি পার্থক্য তাঁর আস্তিক্যবোধে। হয়তো রবীন্দ্রনাথ-দর্শনের অসচেতন প্রভাব কিংবা আত্মবোধজাত এই ঈশ্বরচেতনায় মিশেছিল মানস-অস্তিত্বের সংযোগ। মানুষ ছাড়া ঈশ্বরের অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ এ ভাবনা রবীন্দ্রনাথের। অলোকরঞ্জন বলেন—
এখনো তোমাকে যদি বাহুডোরে বুকের ভিতরে
না পাই, আমাকে যদি অবিশ্বাসে দুপায়ে দলে
চলে যাও, তাহলে ঈশ্বর
বন্ধুরা তোমায় যেন ব্যঙ্গ করে নিরীশ্বর বলে।
সব দিক থেকেই ‘যৌবনবাউল’ কাব্যগ্রন্থ এক নতুন কবিতার সূচনা করেছিল। এই গ্রন্থ থেকে ‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’ (১৯৬৭) হয়ে ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’ (১৯৬৯) পর্যন্ত যেন একটি পর্যায়। পরের পর্যায়ে আছে ‘ছৌকাবুকির মুখোশ’ (১৯৭৩), ‘গিলোটিনে আলপনা’ (১৯৭৭), ‘দেবীকে স্নানের ঘরে নগ্ন দেখে’ (১৯৮৬)। তবু কোথাও টান পড়েনি স্বকীয়তায়। কবিতার পরিপ্রেক্ষিত বদলেছে— জীবনের প্রেম-বিবাহ যেমন পরিপ্রেক্ষিত হয়েছে কবিতার, তেমনি বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের আবহ, এবং তার ফল হিসেবে উদ্বাস্তু সমস্যার মতো অনেক সামাজিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় ধরা পড়েছে তাঁর কবিতায়। এই প্রবণতা লক্ষ করা যায় সদ্যতন কাব্যগ্রন্থ ‘শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি’-তেও। নির্বাসন নামের কবিতায় দেখি—
আমি যত গ্রাম দেখি
মনে হয়
মায়ের শৈশব।…
পাহাড়ের হৃদয়ে যত নীলচে হলুদ ঝর্না দেখি
মনে হয় দেশগাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ।
শুধু দেশ-গাঁয়ের মানুষ নয়, বিশ্বজুড়ে যেখানেই উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমেছে, সে আফগানিস্তান হোক কিংবা সিরিয়া, কবিতার পংক্তিতে ধরা পড়েছে। সমসাময়িক বিষয় অবলম্বন করে কবিতা রচনার বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না তিনি, এমন নয়। তাঁকে বলতে শুনেছি— “এটা ঠিকই topicality কবিতার পক্ষে আকর্ষণীয় অন্তরায়। কিন্তু কবিতা কি তাই নয়, যা পায়ের তলা থেকে মাটি কেড়ে নিয়ে যায়? মানুষ তার একতা অবস্থানভূমি খোঁজে? তা না হলে সেটা কবিতা কী করে হল? নকশাল আন্দোলন, গালফ যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, নিকারাগুয়া, শ্রীলঙ্কা ঘিরে আমার ভাবনাকে অনেকে অরণ্যে রোদন ভেবেছেন। ‘গিলোটিনে আলপনা’ বা ‘তিলকতর্পণ’-এ তাঁদের সহানুভূতি পেয়েছি। কিন্তু এঁরা সহরোদক হয়ে ওঠেননি।”

অলোকরঞ্জন স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি যে, তাঁর আন্তর্জাতিক ভাবনা শান্তিনিকেতনে পড়াশুনার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন— “যখন বিশ্বভারতীতে পড়তাম, তখন যে বিশ্বটা আমার মধ্যে ছিল, সে-বিশ্বের কোনো জাতীয়তার বিভাজন ছিল না। যখন জার্মানিতে গিয়ে পড়লাম, তখন মনে হল মনের ভিতরের ‘বিশ্বকিশোর কমপ্লেক্স’-এর অভিক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি বাইরে। ব্রেশট অনুবাদ করি বা রিলকে বা সুরদাস, তাঁরা আমার ভেতরের চৈতন্যকে সম্প্রসারিত করেছেন। কোনো সংকীর্ণ দেশ বা জাতি নয়, আমাদের স্বদেশ সংস্কৃতির মূল কাঠামোর সঙ্গে বিশ্বপ্রতিমার কীভাবে যোগসাধন করা যায়, সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।”
***
হয়তো বিদেশের সঙ্গে দেশের বন্ধন ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি এত অনুবাদ কর্মে হাত দিয়েছিলেন। কলকাতায় থাকতেই, ১৯৫৭ সালে, তিনি বন্ধু আলোক সরকারের সঙ্গে যুগ্মভাবে ‘ভিনদেশী ফুল’ নামে ফরাসি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’ নামে নানা দেশের কবিতার বাংলা অনুবাদ। অনেক পরে জার্মান ভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন ‘প্রেমে পরবাসে’ (১৯৯০) নামে। অনুবাদ করেছেন হাইনের কবিতাও। আবার বাংলা কবিতাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন জার্মান পাঠকদের কাছে। এ সবেরই প্রণোদনা এসেছিল দেশ-বিদেশকে মেলানোর ভাবনা থেকে। এর জন্য জার্মান সরকার ১৯৮৫ সালে অলোকরঞ্জনকে সে দেশের শ্রেষ্ঠ গ্যোয়েটে পুরস্কারে সম্মানিত করেছিল।

এ দেশের পুরস্কারও কম পাননি অলোকরঞ্জন। কবি হিসেবে তাঁর স্বকীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সাহিত্য অকাদেমি, তাঁর ‘মরমী করাত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য (১৯৯২)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছে সুধা বসু পুরস্কারে (১৯৮৩)। এছাড়া পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৫) ও রবীন্দ্র পুরস্কার ((১৯৮৭)। তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা যেমন তাঁকে স্বকীয়তা দিয়েছে ও বাড়িয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্য, তেমনই বৈদগ্ধ্য ও বিশ্বমনস্কতা তাঁর কাব্যজগৎকে দিয়েছে ব্যাপ্তি।
তাঁর ‘শিল্পিত স্বভাব’, ‘দ্বিতীয় ভুবন’ ,’ঘূর্ণিস্রোতে সৃজনী সংরাগে’, ‘শেষ কথা কে বলবে’ ইত্যাদি প্রবন্ধগ্রন্থে তাঁর অসীম বৈদগ্ধ্য ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে মিশেছে সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা। বাঙালি মনীষা ও মননচর্চার ক্ষেত্রে অলোকরঞ্জনের এই অবদান কোনওদিন বিস্মৃত হওয়ার নয়। এমন উদার সুভাষিক ও সুরসিক আন্তর্জাতিক বাঙালির প্রস্থান আমাদের নিঃস্ব করে রেখে গেল। তরুণ কবিরা হারালেন তাঁদের প্রিয় অভিভাবককে।
সৈয়দ কওসর জামাল বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক। দীর্ঘদিন প্রসার ভারতীতে রেডিও ব্রডকাস্টারের দায়িত্ব সামলেছেন সাফল্যের সঙ্গে। সিজেএমসি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেছেন বহুদিন।
খুব ভালো লাগল….
পড়লাম, বেশ ভালো লেখা। সবার পড়া উচিৎ।
কবি অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত সম্পর্কে একটা বিশদ তথ্য জানতে পারলাম সমৃদ্ধ এবং তথ্যবহুল এই লেখাটায়।
খুব প্রয়োজনীয় তথ্যবহুল, বিশ্লেষণাত্মক লেখা ৷ অলোকরঞ্জন বিষয়ক গবেষণায় কাজে লাগবে ৷ ধন্যবাদ জামালদা ৷
ভালো লাগলো। বেশ কিছু তথ্য জানা ছিল না।