সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। আজ থেকে এক পক্ষকাল বাংলালাইভে চলবে সত্যজিত উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ, তাঁর প্রচ্ছদশিল্প নিয়ে লিখছেন বিশিষ্ট শিল্পী, কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেব। সঙ্গে থাকল সত্যজিতের ডিজাইন করা কিছু প্রচ্ছদ, দেবাশীষ দেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।
বিশ্বের দরবারে চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের অবদানের কথা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মৃত্যুর সাতাশ বছর পরেও তাঁর সিনেমা মহৎ শিল্পসৃষ্টির নিদর্শন হিসেবে গোটা পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত এবং অবিচ্ছিন্ন ভাবে যাবতীয় তাত্ত্বিক আলাপ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। ফলে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, যে সাধারণ মানুষ চিরকাল একমাত্র সিনেমার মধ্যে দিয়েই সত্যজিতের প্রতিভার সার্বিক মূল্যায়ন করতে চেয়েছেন, এবং শতবর্ষে পৌঁছেও এর অন্যথা হবে বলে তো মনে হয় না। অথচ সত্যজিতের মতো বহুমুখী সৃজনশীল মানুষ সিনেমার পাশাপাশি শিল্পী হিসেবেও সারা জীবন ধরে কত যে উচ্চমানের কাজ করে গিয়েছেন, ক’জনই বা তার সঠিক খবর রাখেন! সিনেমাকে ঘিরে যাবতীয় কর্মকাণ্ড কী ভাবে তাঁর রং-তুলির আশ্চর্য বর্ণময় জগতকে দিনের পর দিন আড়ালে ঠেলে দিয়েছে, এটা তলিয়ে বুঝতে হয়তো আরও কিছুটা সচেতনতার দরকার ছিল।
ভুললে চলবে না যে, একজন সম্পূর্ণ পেশাদার কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবেই কিন্তু কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সত্যজিৎ। এবং সিনেমায় আসার আগে দীর্ঘ বারো বছর ডি.জে.কিমার-এর মতো সাহেবি বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে চাকরি করা ছাড়াও নিয়মিত ভাবে প্রচ্ছদ আঁকার দায়িত্বে ছিলেন নামীদামি বই প্রকাশনা সংস্থা ‘সিগনেট প্রেস’-এ। শুধু তাই নয়, এর আগে শান্তিনিকেতন কলাভবনে গিয়ে আড়াই বছর ধরে হাতে কলমে ছবি আঁকার তালিমও নিয়েছিলেন নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট শিল্পীদের কাছে। ড্রয়িং কিংবা ক্যালিগ্রাফিতে হাত পাকানোর পাশাপাশি ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্যকে ভালো ভাবে জেনে এসে পরে কাজে লাগাবেন এমনটাই ইচ্ছে ছিল সত্যজিতের। এ ব্যাপারে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন সিগনেট পর্বের কাজগুলি তার সব থেকে বড় প্রমাণ।
ঘটনাচক্রে সত্যজিতের জীবনে প্রথম ছাপা হওয়া ডিজাইনটাই ছিল তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের লেখা ‘পাগলা দাশু’ বইয়ের প্রচ্ছদ, যেটা প্রকাশিত হয় ‘এম.সি.সরকার’ থেকে ১৯৪০ সালে। সদ্য কলাভবনে যাওয়া সত্যজিৎ এখানে ধড়িবাজ ছেলে দাশুর মুখের ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিটা এঁকেছিলেন দারুণ দক্ষতার সঙ্গে, যাতে বোঝা যায় ড্রয়িংয়ের একটা নিয়মিত চর্চা তাঁর আগে থেকেই ছিল। এরপর ১৯৪৩ সালে ‘সঙ্কেত ভবন’-এর জন্য ছোটদের সরস গল্পের সঙ্কলন ‘ছাতুবাবুর ছাতা’র প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ। এ কাজটিও বেশ মজাদার। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় হেঁটে চলেছেন ছাতুবাবু আর ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা আর হলুদ রঙের সারি সারি ছাতা তেরছা ভাবে একদিকে পজিটিভ অন্যদিকে নেগেটিভের মতো সাজানো। মনে হবে ছাতাগুলো ঠিক যেন এক একটা বৃষ্টির ফোঁটা! এই অভিনব পরিকল্পনাটি হল্যান্ডের বিখ্যাত শিল্পী এম.সি.এশার-এর ‘সিমেট্রি’ সিরিজের কাজগুলোকে ভীষনভাবে মনে পড়িয়ে দেয়।
বাইশ বছর বয়সের তুলনায় সত্যজিতের ভাবনা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পরিণত, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। সাধারণত শিল্পীরা প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে বইয়ের মূল বিষয়টাকে মানানসই কোনও ভিস্যুয়ালের মধ্যে দিয়ে যথাসম্ভব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। এইখানেই সত্যজিৎ হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমি। ব্যাক্তিসত্ত্বায় মিশে থাকা বিশেষ শিক্ষা, রুচি আর অনুভূতির সাহায্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশনের সম্পূর্ণ এক নিজস্ব ধারা।
একদম গোড়ায় সিগনেটের জন্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ, যার মধ্যে ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘ক্ষীরের পুতুল’-এ দেখা যায় আগাগোড়া একটা লৌকিক মেজাজ। টোপর মাথায় সেজেগুজে বর বসে আছে, পাশের গোড়েমালা অনেকটা ফুলের আকৃতি নিয়েছে। তুলির টানে আঁকা ছবিতে সুন্দর একটা ছন্দ আছে, যা বাংলার পরিবেশটাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডের লাল আর হলুদ রং দুটোও যেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আভাস দিচ্ছে। দেখা যায় নিচে বই আর লেখকের নামগুলোও লেখা হয়েছে কিছুটা আলপনার মতো করে।
ওই সময়ে বাবা সুকুমারের পরপর কয়েকটি বই ছাপে সিগনেট, যার মধ্যে ছিল ‘পাগলা দাশু’র একটি নতুন সংস্করণ (১৯৪৬)। এই বইয়ের প্রচ্ছদে শুধু দাশুর খ্যাপাটে মুখখানা আঁকলেন সত্যজিৎ তুলির ড্রয়িং-এ একটা বাড়তি দক্ষতা নিয়ে। এর আগে ‘ঝালাপালা’(১৯৪৪)বইতেও পাখোয়াজ বাজিয়ের চেহারার মধ্যে বেশ একটা কৌতুকী ভাব এনেছিলেন। সেই সঙ্গে নামটাও লেখা তাল মিলিয়ে। তবে বাপ-ছেলের সেরা যুগলবন্দি ঘটেছিল ১৯৫০-এ প্রকাশিত ছড়া সংকলন ‘খাই খাই’-তে।
প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে নেমন্তন্ন বাড়িতে পাত পেড়ে খাচ্ছে কয়েক সারি গ্রাম্য লোক। সামনে পরিবেশনকারী হাঁকডাঁক করছে এবং সবার আলাদা আলাদা ভাবভঙ্গি, চূড়ান্ত হ্যাংলাপনা! মাত্র তিনটে রংয়ের প্রচ্ছদে গোটা পরিবেশের বিশৃঙ্খল ভাবটাকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ। এমন ভিস্যুয়াল বাংলা বইতে এর আগে তেমন ভাবাই যেত না। ১৯৫৩ সালে লীলা মজুমদারের ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’-র প্রচ্ছদে শুধুমাত্র মেটে লাল রং দিয়ে এঁকেছিলেন একখানা প্যাঁচালো ড্রাগন। ডিজাইনটাও বাক্সের ঢাকনার মতো। এক নজরে চোখ না-টানলেও পাঠকের মনে অবশ্যই একটা বিশেষ অনুভুতি জাগিয়ে তোলে এই প্রচ্ছদ।
নিছক বাহারি না করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিজাইনে চিন্তার অভিনবত্বকে যে কতখানি কাজে লাগাতে চাইতেন সত্যজিৎ, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’ বইটির পিঠোপিঠি আঁকা প্রচ্ছদে। করবেটের বাঘ শিকার, জঙ্গল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই বইতে ইচ্ছে করলেই অ্যাকশন রাখা যেত। কিন্তু সত্যজিৎ বুদ্ধি খাটিয়ে আনলেন এক দারুন চমক। সামনে আর পিছন দু’দিক মিলিয়ে দেখালেন বাঘের গায়ে গুলি লাগার দাগ। দু’পিঠেই হলুদের ওপর কালো ডোরা ডোরা আঁকা আর একটু অফ সেন্টারে সাদা গোল কাট আউট করা। অর্থাৎ যেখান দিয়ে গুলিটা ঢুকেছে আর বেরিয়েছে! সাদা অংশগুলিতে দেওয়া রয়েছে বইয়ের নাম আর বই নিয়ে কিছু কথা। এইখানে সত্যজিৎ নজর রেখেছিলেন খুব জরুরি একটা ডিটেলস-এর দিকে। যেহেতু গুলি বেরবার গর্তটা তুলনায় একটু বড় হয়, সেই হিসেবে পিছনের সাদাটাও কিন্তু বড় করে দেখানো! ১৯৪৮ সালে সিগনেট-এর বাইরে ‘হাতে খড়ি’ বইটির প্রচ্ছদ অবশ্যই সত্যজিতের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। দীপঙ্কর ভবন থেকে প্রকাশিত বিমলচন্দ্র ঘোষের লেখা ছোটদের অ-আ-ক-খ শেখানোর এই ছড়ার বইটিকে দেখতে করা হয়েছিল লম্বায়-চওড়ায় ঠিক একটা স্লেটের মতো। হলুদ ফ্রেমের মাঝখানের কালো অংশে বইয়ের নাম-সমেত কিছু ছবি আঁকা, ঠিক বাচ্চাদের ঢংয়ে। পুরো জিনিসটা এত ভেবে করা, যে বাচ্চারা হাতে নিয়ে অবিকল একটা স্লেট ধরার মজা পেতে বাধ্য।
অতি উচ্চমানের বাংলা বই প্রকাশনায় ‘সিগনেট প্রেস’ একসময় যে সুনাম অর্জন করেছিল তা এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরকাল। এর পিছনে একদিকে যেমন ছিল সংস্থার কর্ণধার দিলীপ কুমার গুপ্ত ওরফে ‘ডি.কে’-র মতো সংস্কৃতিবান মানুষের নিষ্ঠা আর নিরলস পরিশ্রম, অন্য দিকে শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা।
ছোটদের ছেড়ে এ বার আসা যাক বড়দের বইয়ের প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে। সেখানে স্পষ্ট বোঝা যায় গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কী অফুরন্ত রিসোর্স ছিল সত্যজিতের, যার ফলে ভিস্যুয়ালের নীরস, গতানুগতিক চেহারাটা আমূল পালটে দিতে পেরেছিলেন খুব সহজেই। প্রথমেই বলা যাক নরেশ গুহ-র কাব্য সঙ্কলন ‘দুরন্ত দুপুর’-এর কথা (১৯৫২)। প্রচ্ছদটি পরিকল্পনা করা হয়েছে ওই নামের কবিতাটিকে নিয়েই। জায়গা জোড়া কাঁচা হলুদ রংয়ের ওপর সরু লাইনে আঁকা ঘুমন্ত এক নারী।
খোলামেলা শরীরী ভঙ্গিমায় একটা চাপা যৌন আবেদন যেন প্রকট। এখানে সত্যজিৎ যেন ফরাসি শিল্পী আঁরি মাতিসের ড্রয়িংয়ের সাবলীল ছন্দময়তাকে ধরতে চেয়েছেন সার্থক ভাবে। ফিমেল ফিগার রীতিমত স্টাডি করা না থাকলে এ ধরনের আইডিয়াকে রূপায়িত করা সম্ভব নয়। প্রায় একই সময় প্রকাশিত জীবনান্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ বইয়ের প্রচ্ছদে সত্যজিৎ আঁকলেন ঘন লতাপাতার মধ্যে বেরিয়ে থাকা চিরন্তন বাঙালি নারীর কোমল, সেন্সিটিভ একখানা মুখ, সরু সরু লাইনের প্যাটার্ন দিয়ে ভরাট করা। কবির রোম্যান্টিকতার সঙ্গে যেন মিশে গেল অদ্ভুত সারিয়ালিস্টিক মেজাজ। ১৯৫৩ সালে নারীমুখ আঁকা সত্যজিতের আরও একটি মনে রাখার মতো প্রচ্ছদ অচিন্ত্য সেনগুপ্তর ‘অমাবস্যা’। কালো জমির ওপর সাদা প্যাস্টেল দিয়ে সামান্য অমসৃন লাইনের ডিম্বাকৃতি গড়ন। নাক, চোখ, ঠোঁট সব কিছু নিয়ে ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীর সেই রহস্যময়তাকে তুলে এনেছিলেন সত্যজিৎ। একই বছর বিষ্ণু দে-র ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’-এ সেই কালোর ওপর সাদা ড্রইং-এই এসেছে অন্য এক নারী। তবে এখানে সরু স্পষ্ট লাইনে হাঁটু মুড়ে বসা বীণাবাদিনী। উনিশ শতকের রঙিন কালিঘাট পটের অনুসরণে থিমটা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। তারপর ফর্মটা পালটে দিলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে। লোকশিল্পের মেজাজের সঙ্গে মিশে গেল আধুনিকতা।
নারীমুখ দিয়ে আরও দু’টি বইয়ের কাব্যধর্মী প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। যেমন ১৯৫৪ সালে ‘নবনীতা’ যেখানে কাগজের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে কালোর ওপর সাদায় ফুটে উঠেছে নববধূর সালঙ্কারা চেহারা। এরপর ‘জোনাকি’ (১৯৫৫), যেখানে গাঢ় নীলের ওপর হাল্কা রঙে দেখা যায় একরাশ ছটফটে ‘জোনাকি’র মধ্যে মিশে রয়েছে তুলির দ্রুত আঁচড়ে আঁকা মায়াবি একটি মেয়ের মুখ। সে যেন নিজেও এক প্রচ্ছন্ন জোনাকি।
সিগনেটের অন্যান্য বইতে শুধুমাত্র ক্যালিগ্রাফি অথবা লেটারিং দিয়েও অসামান্য কিছু প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ। যেমন জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি, ‘রূপসী বাংলা’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘ইন্দ্রানী’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’। ‘অর্কেস্ট্রা’য় নামের তিনখানা অক্ষর লেখা হয়েছে সরু লাইনকে একটু অমসৃন করে, যেন ছোট ছোট ঢেউ এসে ওদের সামান্য দুলিয়ে দিচ্ছে আর ওরা সুরের ছন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই সময় রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছিল ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ বইটির জন্য সত্যজিতের প্রচ্ছদভাবনা। পুরোটা জুড়ে বৈষ্ণব নামাবলির নকশা ব্যবহার করে মাঝখানে নামটা লিখছিলেন পুঁথির আদলে, যেন চিরন্তন আধ্যাত্মিক পরম্পরা আর বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন কাল অতিক্রম করে যাওয়া দার্শনিক। বলাই বাহুল্য লেখায় এই পুঁথির চেহারাটা হুবহু আনার জন্য সত্যজিতকে কলম চালানোর বিশেষ কায়দাটা রপ্ত করতে হয়েছিল অনেক পরিশ্রমে।
সিগনেটের বাইরে ক্যালকাটা পাবলিশার্সের জন্য ‘স্মৃতির রেখা’র (১৯৫৫) প্রচ্ছদে বই আর লেখকের নামটা লিখতে গিয়ে নিব চালিয়েছেন ইচ্ছে করে একটু কাঁপা কাঁপা ভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে। অথচ কী সুন্দর ছন্দ বজায় রেখে। সব মিলিয়ে প্রচ্ছদ জুড়ে কোথাও যেন একটা ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার ভাব তৈরি হয়। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত অর্থবহ কাজ। আসলে অক্ষরশিল্প বা ক্যালিগ্রাফির প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল বলে তার যাবতীয় প্রয়োগকৌশল নিয়ে আজীবন মেতে ছিলেন সত্যজিত, পর্যায়ক্রমে যা তাঁর প্রচ্ছদ ভাবনাগুলিতে যোগ করেছিল আরও অনেক নতুন মাত্রা। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালি’র খ্যাতি সত্যজিৎকে পাকাপাকি ভাবে জড়িয়ে ফেলে সিনেমার সঙ্গে। বিজ্ঞাপন কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন। ব্যস্ততার জেরে সাময়িক ভাবে ছেদ পড়ে প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজকর্মেও। এরপর ১৯৬১ সালে বহু বছর বন্ধ হয়ে থাকা সত্যজিতের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের হাতে তৈরি ছোটদের মাসিকপত্র ‘সন্দেশ’ নতুন ভাবে বের করতে শুরু করেন সত্যজিৎ। আর সেই সঙ্গে ফিরে আসে তাঁর ছবি আঁকার উদ্যম।
গোড়া থেকেই সম্পাদনা ছাড়াও প্রতি সংখ্যার জন্য নিয়ম করে ছোটদের উপযোগী মজার মজার প্রচ্ছদ আঁকতে থাকেন তিনি। বাদ যায়নি বইপত্রের ডিজাইনও। এই সময়ে লেটারিং-এর সাহায্যে নানা ধরনের পিকটোগ্রাফ জাতীয় আঁকা বহু ক্ষেত্রে তাঁর প্রচ্ছদের একটা বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠতে থাকে। যেমন লীলা মজুমদারের ‘টংলিং’(১৯৬৩) আর ‘মাকু’(১৯৬৭)- বইদু’টির নামগুলি দেখা যায় অদ্ভুত কায়দায় মানুষের মুখের অংশ হয়ে গিয়েছে। আবার সন্দেশের প্রচ্ছদেও পত্রিকার নামের তিনটে অক্ষর দিয়ে কখনও ঘোড়া, আবার কখনও হাতি বানিয়ে চমক লাগিয়েছেন সহজেই। পুরোপুরি সিনেমায় চলে আসার পর আর পেশাদার শিল্পী না থাকলেও এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সুনাম তাঁকে ছবি আঁকার জগৎ থেকে ছুটি দেয়নি কোনওদিন। প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও ফাঁক পেলেই রং তুলি নিয়ে বসে পড়তে হয়েছে প্রকাশক আর পাঠকের চাহিদা মেটাতে।
ইতিমধ্যে লেখক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা তাঁকে সাহিত্য জগতে পাকা জায়গা করে দেওয়ায় নিজের লেখা অন্যান্য বই ছাড়াও দুই জনপ্রিয় চরিত্র ‘ফেলুদা’ আর ‘প্রোফেসর শঙ্কু’কে নিয়ে প্রচ্ছদ এঁকে যেতে হয়েছিল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত।
তাঁর যাবতীয় প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিল ‘আনন্দ পাবলিশার্স’। কিশোর পাঠ্য বইয়ের এই দুই সিরিজের জন্য দু’টো আলাদা স্বাদের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন সত্যজিৎ। ফেলুদার গোয়েন্দা গল্পে পরিবেশ আর ঘটনার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি শঙ্কুর প্রচ্ছদগুলোতে আন্তর্জাতিক স্তরের এই বৈজ্ঞানিকটিকে করে তোলা হয় একাই একশো। ‘স্বয়ং প্রফেসর শঙ্কু’তে(১৯৮৩) দেখা যায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞান জার্নালের পাতার টুকরো দিয়ে বানানো হয়েছে তাঁর চুল, দাড়ি, গোঁফ! কিংবা নিজের তৈরি রোবোটের কাঁধে হাত রেখে নিজস্ব গবেষণাগারে তিনি একা দাঁড়িয়ে (প্রোফেসর শঙ্কুর কান্ডকারখানা, ১৯৭০)। ফেলুদার প্রচ্ছদে তার দুই সাগরেদ তোপসে আর জটায়ু নিয়মিত হাজিরা দিলেও ধীরে ধীরে এরা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং একদম শেষে এদের দেখাই যায়না। এখানেও চৌখস গোয়েন্দা যেন হয়ে ওঠেন অনেকখানি লার্জার দ্যান লাইফ। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বিচ্ছিন্নতাবোধ কি দানা বাঁধছিল সত্যজিতের মধ্যে? এর ফলেই কি লেখকের অল্টার ইগো হিসেবে এই দু’জন কিছুটা পরোক্ষ ভাবে তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন?
সত্যজিতের প্রচ্ছদ প্রসঙ্গে এ সব প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবে উঠে আসে বৈকি। একেবারে কাছের মানুষ সৌমিত্র চট্যোপাধ্যায়ের লেখা অন্তত দু’টো কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলাদা করে বলতে হয়… যার প্রথমটা ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’-য় (১৯৮৩) হলুদের ওপর ছাই রঙে বইয়ের নামটা এমন ভাবে লেখা, মনে হচ্ছে ঠিক যেন কয়েকটা চন্দন কাঠের টুকরো ছড়ানো। পরেরটা ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’ (১৯৭৫)। এখানে তুলির সরু-মোটা লাইনকে সামান্য কাঁপিয়ে জলের এলোমেলো নেমে আসাটা প্রচ্ছন্ন ভাবে বোঝানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট্ট ইঙ্গিত রয়েছে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো একজন মানুষের।
১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান’ বইয়ের প্রচ্ছদে ড্রাই ব্রাশের লেখাটি সত্যজিতের ক্যালিগ্রাফির একটি অনন্য ঘরানার কাজ, যা মনে করিয়ে দেয় তাঁর কলাভবনের শিক্ষা। তবে তুলির প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের ‘দেশ’ বিনোদন সংখ্যার প্রচ্ছদের কথা অবশ্যই বলা দরকার। কাগজকে জলে ভিজিয়ে ‘ড্যাম্প’ করে কালো কালি দিয়ে ‘দেশ ৮১’ কথাটা লেখা। তুলির মোটা লাইন ভিজে কাগজের ওপর পড়ে কম বেশি ছড়িয়ে গিয়ে দুর্দান্ত একটা এফেক্ট তৈরি করে। একাধারে কালির নিয়ন্ত্রণ ও ভিজে থাকা কাগজের মধ্যে সঠিক রসায়ন সম্পর্কে কতদূর স্পষ্ট ধারণা থাকলে, তবে এ কাজ করা সম্ভব, ক্যালিগ্রাফার মাত্রই সেটা অনুমান করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায় এটি সত্যজিতের অন্যতম সেরা প্রচ্ছদ।
এ বিষয়ে আরও কথা বলে লেখাটাকে অহেতুক দীর্ঘ না করাই ভালো। তবে একদম শেষে ‘এক্ষণ’ প্রসঙ্গ বাদ দিলে বর্তমান আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য। ১৯৬১ সাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকা মূলত সাহিত্যবিষয়ক এই পত্রিকাটির প্রস্তুতিপর্ব থেকেই এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন সত্যজিৎ। সেই সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে কমপক্ষে ত্রিশটির মতো প্রচ্ছদ এঁকেছেন। নামের শুধু তিনটে অক্ষর- এ, ক্ষ আর ণ-এর ফর্ম আর বিন্যাসের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র এনে সম্পূর্ণ বাহুল্যবর্জিত এমন এক নান্দনিকতার ধারা তিনি গড়ে তুলেছেন, যা এক কথায় অভাবনীয়! অক্ষরগুলোর নিজস্ব সৌন্দর্য খুঁজে বার করে সত্যজিৎ যেন প্রতিটিকে আলাদা বাদ্যযন্ত্রের মতো কাজে লাগিয়েছেন! সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক সুরের নিখুঁত হার্মনি। ভারতবর্ষের গ্রাফিক ডিজাইন সত্যজিতের হাত ধরে এক সময়ে কোন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছিল অন্তত ‘এক্ষণ’-এর এই প্রচ্ছদগুলি তার সাক্ষী থাকবে চিরকাল।
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
Really who can describe so lively the aspects of Artist satyajit without debasish deb.. Great piece of writing sir…. Congratulations.
Osadharon ekta lekha..
Onek onek dhonyobaad erokom ekta lekha ajker dine prokash korar jonyo