বইমেলা শব্দটির সঙ্গে বইপ্রেমী বাঙালির সখ্য চিরন্তন। কলকাতা ও ঢাকায় যে বইমেলা উদযাপিত হয়, তা শুধুমাত্র পাঠক লেখক আর প্রকাশকের সম্মেলনে সীমাবদ্ধ নেই, হয়ে উঠেছে এক বাৎসরিক পার্বণ। বাঙালির হুজুগ সর্বজনবিদিত, এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয় না। কলকাতা বা ঢাকা বইমেলা জুড়ে থাকা এক বিশাল পরিমাণ ভীড়, সেই হুজুগের পরিণাম।
ঢাকার বইমেলায় আর একটি দিক সংযোজিত, সেটা হল দেশাত্মবোধ। ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এই মেলা ‘অমর একুশে‘ নামাঙ্কিত। যে কারণে, এই বইমেলা ঘিরে মানুষের আবেগ এক অন্য স্তরে উন্নীত হয়। সুবেশ সুবেশা মানুষেরা উৎসবের আবহে মেলা প্রাঙ্গনে আসেন। তাদের গালে শহিদ মিনারের উল্কি আঁকা, মহিলাদের মাথায় ফুলের মুকুট। মূলত বাংলা একাডেমি ও তৎসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে এই মেলার বিস্তার। প্রায় সাতশোর ওপর স্টল আর প্যাভিলিয়ন। আছে লিটিল ম্যাগাজিনের স্টল, খাবারের স্টল, আড্ডা দেওয়ার স্থান, মুক্তমঞ্চ, অনুষ্ঠান মঞ্চ, লেখকদের জন্য আলাদা আলোচনার পরিসর। এ ছাড়া বহু প্রকাশনা সংস্থা নিজেদের স্টলের ভেতরেও লেখক সমাবেশের ব্যবস্থা করেন।
ফেব্রুয়ারি জুড়ে মেলা হলেও, একুশ তারিখ এই আনন্দ শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে। মধ্য রাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাছে জমায়েত হয় ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে। দিন বাড়তে বাড়তে সেই সংখ্যা লাখে পৌঁছে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর আর মেলা প্রাঙ্গণ মিলে তৈরি হয় মহামিলন ভূমি। ভাষা শহিদদের নামাঙ্কিত সুদৃশ্য তোরণ নির্মিত হয়েছে। স্টল আর প্যাভিলিয়ন নির্মাণেও নানা চমৎকার সৃজনশীলতা লক্ষ্য করা যায়।
ভীড়ের চাপে হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য ঘোষণা চলে অবিরাম। বিশেষ করে শিশুদের হারিয়ে যাওয়ার খবর শুনে উদ্বেগ হয়। তবে, ভীড় দেখে প্রকাশকরা খুব উচ্ছ্বসিত হতে পারে না, তাদের অনেকের মতে, এই ভীড় বাণিজ্য বৃদ্ধির সহায়তা করে না। সমাজের অন্য সমস্ত বিভাগের মতো, বইমেলাও যেন প্রভাবশালী মানুষের ক্ষমতা বিস্তারের একটি ক্ষেত্র। এমন বহু মানুষ তাদের ‘বই‘ প্রকাশ ও জনসংযোগের জন্য বইমেলার সময়কে বেছে নেন। তাঁদের বইএর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নেবার জন্য ‘পাঠক‘কে আকর্ষণ করতে, খাবারের প্যাকেট, বইএর নামাঙ্কিত টিশার্ট সহ নানা উপঢৌকন বিনা মূল্যে বিলি করা হয়। উপহারের থলি হাতে তারা বইটিকে একটি বাহুল্যরূপে গ্রহণ করে। বইটি যে কোনোদিন পড়াই হবে না, বোঝা যায়। কেউ কেউ খাওয়ার জন্য অর্থ খরচ করে ফেলায়, বই কিনে উঠতে পারেনা। আবার কেউ কেউ ঝুঁকিহীন কেনাকাটায় মন দেন। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে হুমায়ূন আহমেদ, নজরুল ইসলাম অথবা রবীন্দ্রনাথের বাইরে বেরতে পারে না। এতে প্রতিবেশীর কাছে নিজের রুচিবোধের উৎকর্ষের পরিচয় দিতে অসুবিধা হয় না আবার সময় করে বইগুলো পড়ে দেখার কষ্ট করতে হয় না। বসার ঘরে সজ্জিত এই প্রণম্য লেখকের বইগুলো থেকে এক গৌরবের আলো বিচ্ছুরিত হয়। হঠাৎ করে কোন তরুণ শিল্পীর সিগারেট ধরানোতে পুলিশি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মিছিলে শ্লোগানে ভরে ওঠে মেলার মাঠ, চড়ে যায় প্রতিবাদের পারদ।
এত কিছুর পরও বইমেলা ঘিরে নতুন কবি স্বপ্ন দেখে, প্রকাশক লগ্নি করে। নতুন বসন্ত উদযাপনে তরুণ পাঠক সেল্ফি তুলতে তুলতে হয়তো বই আর বউ দুইই খুঁজে পায়। পায়ে পায়ে ওড়া ধুলোয় সারা শরীর ঢেকে গেলেও মনে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত সুগন্ধ, যার রেশ নিয়ে তারা অনায়াসে যানজট পার হয়। নানান নির্মাণ কার্যে আটকানো রাজপথ ডিঙোতে ডিঙোতে শাহবাগ চলে আসে বাড়ি ফেরার গাড়ি ধরতে। শহিদ মিনারের শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুল, আলপনার ফুল তখন মূর্ছা গেছে। দৈনন্দিন ব্যবহারিক সমস্যা সঙ্কুল জীবনের ভেতর থেকে যায় সেই মথিত ফুলের ঘ্রাণ, যা মানুষের বৌদ্ধিক সত্তাকে প্রাণিত করে। বাংলা শুধুমাত্র ভাষা নয়, হয়ে ওঠে একটি আবেগের প্রতিশব্দ।
এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।
ভালো লাগলো। একুশের বইমেলার আবেগ মনকে ছুঁয়ে গেল।
খুব ভালো লাগলো, আরো বড় করে লেখা চাই
Pore khub bhalo laglo. Tumi bhalo lekhok eta r notun kore bolar opekhya rakhe na. Erokom ro lekha upohar dao sobai ke
খুব ভালো লাগল। উপস্থিত না থেকেও লেখাটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করলাম বাংলাভাষীর আবেগ।
Sourav Howladarer lekhay amodito haoyar bipul protisruti.kalamti druto dharalo hochchhe.Sobai porun.