‘নে এবার বল’, আলুপোড়ায় নুন মাখাতে মাখাতে বাপ্পা বলল।
জঙ্গলে আলো ফুটছে আস্তে আস্তে। গাছের মাথায় ডাকাডাকি করছে কয়েকটা কাক। ছোটন আর বিষ্ণু আলু চুরি করে পুড়িয়ে এনেছে। ছোটন মুখে গরম আলু পুরে হা হা করতে করতে একদলা ফেলে দিল কোলের ওপর। তারপর জিভে হাওয়া খেলাতে খেলাতে বাবানের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল, ‘তুমি ভয় পেয়ে যাবে!’
‘ধুস ! ব-বল তুই।’
কয়েক বছর আগে ছোটনের বাবা বৈদ্যনাথ গুণ্ডা মদ খেয়ে ছোটনের কানে গরম ইস্তিরি চেপে ধরেছিল। কানটা গলে পুড়ে গিয়ে একদলা মাংসপিণ্ড, ছোটন যাকে ঢেকে রাখে একটা গামছায়। এত কিছুর পরেও ছোটন বাবা অন্ত প্রাণ, এবং যতই স্কুল থেকে নাম কাটা যাক এবং বড়রা ছেলেপুলেদের বারণ করুক তার সঙ্গে মিশতে কেননা সে নাকি বাবার মতোই গুণ্ডাদলে নাম লিখিয়েছে বলে জনশ্রুতি, তবুও দুরন্ত প্রকৃতির ছেলেটি নুয়ে যায় বাবার সামনে, মুখে ফুটে ওঠে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। গামছাটা মাথায় শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে ছোটন বলল, ‘সেটা এই গরমকালে, এপ্রিল মাস। আমি গেছি বাবার দোকানের জন্য কয়লা আনতে, তিনটে গ্রাম পেরিয়ে। তো, ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাচ্ছে, আর ঝাঁ ঝাঁ রোদ। আমারও ভেতরটা কেমন আনচান করছে, বুঝলি! তো, আমি তো খুঁজছি কোনও পুকুর ফুকুর আছে কী না, দুটো ডুব মারব, তারপর, বাবা পয়সা দিয়েছে, সিধ্বেশ্বরী হোটেলে কষিয়ে ভাত আর ঝাল ঝাল মুরগির মেটে, হেভি বানায়। তো, একটা লোককে জিজ্ঞাসা করতে সে দেখিয়ে দিল রাস্তা, সেখানে নাকি পুকুর আছে, পরিষ্কার জল, সবাই স্নান করে। ও বাবা, গিয়ে দেখি ভিড়ে ভিড়াক্কার। অনেক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে, আর মেয়েছেলেরা কান্নাকাটি করছে। উঁকি দিয়ে দেখি, ভিড়ের মধ্যে বসে একটা বাচ্চা, পাঁচ- ছয় বছর বয়েস হবে, সে কাঁপছে, মুখ থেকে লালা ঝরছে, চোখ ঘুরছে, যাচ্ছেতাই ব্যাপার। এর ওর কাছ থেকে তারপর পুরোটা জানলাম।
‘পুকুরটা একটা নির্জন পাড়ার মধ্যে, বুঝলি, বেশ বড়, প্রায় দিঘি বলা যায়। আর চারপাশ ঘিরে আছে সুপুরিগাছের সারি। খুব গভীর নাকি, কুচকুচে কালো জল। তো, বাচ্চাটার নাকি খেলনা পড়ে গেছিল বলে কুড়োতে নেমেছিল। ওমনি পুকুরের নীচ থেকে হাত বাড়িয়ে ওকে টেনে নামিয়ে নিয়ে গেছে একটা জোয়ান লোক, এই চেহারা, সাতফুট লম্বা, পাথরের মতো বুক! তাকে অতলে নামাতে নামাতে নামাতে নামাতে একদম সোজা একটা অন্য দেশ। সেখানে নাকি গ্রাম আছে, গাছপালা, নদী, সেই নদীতে নৌকা ভাসছে। সেখানে আরো লোকজন ছিল। তাদের কাছে নিয়ে এসেছে বাচ্চাটাকে। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল এবার একে নিয়ে নৌকা করে সোজা অন্ধকারে পাড়ি দেবে, আর ফিরবে না। এদিকে এই বাচ্চাটা তখন হাউ হাউ করে কাঁদছে, কাকুতি মিনতি করছে তাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দাও। শেষটায় একটা মেয়েছেলে, লালপাড় শাড়ি আর মাথায় সিঁদুর, সে নাকি চুপিচুপি হাত ধরে বাচ্চাটাকে নিয়ে আবার উঠে গিয়েছে ওপরে। সোজা গিয়ে পুকুরের ঘাটে বসিয়ে দিয়ে বলেছে ‘আর কখনো দুপুরবেলা একা একা নেমো না।’ বলে ভুশ করে ডুবে গেছে।’
দেবু অস্ফুটে বলল, ‘যখ’।
‘ঢ-ঢপ’।
‘তোমার শোনাও চাই, আবার এসব বলতেও হবে, না?’
ছোটন মিচকি হাসল, ‘ছেড়ে দে দেবু। বাবানবাউয়ু ভদদরলোকের ছেলে, ও যা বলবে সেটাই ঠিক। আমরা বেশি বেগড়বাঁই করলে হয়ত বিকেলবেলা টিমেই নেবে না।’
‘তু-তুই এমন বা-বাজে বলিস কেন রে? ক-কবে টিমে নিই নি?’
‘তবে যখ কিন্তু আমাদের গ্রামেও আছে, ঘোষেদের পুকুরে।’ বিষ্ণু বলল।
‘হ্যাঁ, তোকে বলেছে !’ অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকাল বাপ্পা।
‘তুই কখনো ঘোর অমাবস্যার রাতে পুকুরপাড়ে যা। দেখবি ছায়ার মতো কারা যেন বসে থাকে। তাদের মুখ দেখা যায় না, শুধু চোখ জ্বলে অন্ধকারে। একটা বুড়ি বলেছে। সে তাদের মুখ দেখবার চেষ্টা করেছিল কাছে গিয়ে। যা দেখেছে, তাতে পাগল হয়ে গেছে। সারাদিন এখন ঘুরে বেড়ায় মাঠে ঘাটে আর আপনমনে বিড়বিড় করে।’
‘কী দেখেছিল?’
‘তার আমি কী জানি! তবে ঘোর অন্ধকারে কারা পুকুরপাড়ে চাপা গলায় কথা বলে, ফিসফিস করে, হাসে, সেসব অনেকেই শুনেছে।’
হঠাৎ একটা সাদা ঘুঘু উড়ে এসে বসল তেঁতুলডালে। একটু এদিক ওদিক করল, তখন ছোটন একটা আধভাঙা আলু তার দিকে ছুড়ে মারতে ভয় পেয়ে পাখা ঝাপটিয়ে পালিয়ে গেল।
‘ফালতু ফালতু মারলি ! অবোলা পশু–‘ রাগ করল দেবু।
‘ঘুঘুর মাংস হেভি টেস্ট হয় মাইরি !’ ছোটন ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে খ্যা খ্যা হাসল।
‘তো-তোর মায়াদ-দয়া নেই, ন্না?’
‘কেন ! পাখি তো ! আর লাগেও নি গায়ে–‘
‘অত সু-সুন্দর পাখিটাকে দে-দেখে তো-তোর খেতে ইছ-ছে করল?’
‘কে জানে ! গরিব মানুষ তো, তোমার মতো বড়লোক বাবা নেই। তাই যা দেখি তাই খেতে ইচ্ছে হয়’। হাই তুলল ছোটন।
‘বাব-বাবা তুলবি না শালা ! তো-তোর বাবা কী? গু-গুণ-গুণ্ডা !’
ছোটনের মুখ শক্ত হয়ে গেল। দাঁত চিপে হাতের মুঠোয় একটা আলু তুলে পিষতে লাগল। একটু পরে বলল, ‘আমার বাবা গুণ্ডা, দেবুর বাবা তোমাদের চাকর, বাপ্পার বাবা–এই তোর বাবা কী রে?’
‘ছাড় না, ঝামেলা ভাল লাগে না !’ বিরক্তমুখে বাপ্পা বলল।
‘তাহলে ও আসে কেন আমাদের সাথে মিশতে?’ ছোটন মাথার গামছায় পাক দিল।
‘তুইই বা কেন ওকে সারাক্ষণ এভাবে বলিস?’ দেবু বলল এবার, ‘ওকে পছন্দ না হয় তো মিশিস না !’
ছোটন আর কিছু না বলে হিংস্রমুখে আলু চটকাতে লাগল।
‘আস-আসলে ওর গল্পকে ঢপ বল-লেছি বল-লে ওর গায়ে লেগেছে।’ নির্বোধের মতো হাসল বাবান, যেন কিছু হয়নি, কিছুই আসে যায় না ওর।
আমি সেদিন দেখেছিলাম, লোমগুলোও খুব শক্ত, যেন নারকোলের দড়ি। গাছের গায়ে কড়কড় করে ঘষে যাচ্ছিল। তবে ওকে নাকি অনেকেই দেখেছে। খুব ভোরবেলা, বা গভীর রাতে, বা ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, গাছ থেকে নেমে এসে এক পায়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। মানুষজন এড়িয়ে চলে, দেখা দেয় না চট করে।
কেউ উত্তর দিল না। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসল বনভূমিতে। শুধু একঘেয়ে পোকার ডাক, জল পড়বার শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠছে বুড়ো গাছেদের দল, মাটি শুকিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাবান দেখল, দূরে নিচু ডালে বসে একটা কালো বক তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। একটু কেঁপে উঠল কোনও কারণ ছাড়াই, ‘একানড়ের পা-পায়ে বাঁকা নখ কে-কেন বললি?’
দেবুও যেন চমকে উঠল, ‘কে? ওহ–তা, জানি না কেন। আমি সেদিন দেখেছিলাম, লোমগুলোও খুব শক্ত, যেন নারকোলের দড়ি। গাছের গায়ে কড়কড় করে ঘষে যাচ্ছিল। তবে ওকে নাকি অনেকেই দেখেছে। খুব ভোরবেলা, বা গভীর রাতে, বা ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে, গাছ থেকে নেমে এসে এক পায়ে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। মানুষজন এড়িয়ে চলে, দেখা দেয় না চট করে। যদি তাল পাড়ার সিজন আসে তাহলে নাকি রাত থাকতেই গাছ থেকে নেমে জঙ্গলে কাপাসগাছের তলায় গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকে সারাদিন। অনেকে দেখেছে, জ্যোৎস্না রাত্রে যখন অল্প অল্প হাওয়া আসে সাগরের দিক থেকে, তখন কে একজন ছায়ার মতো শুয়ে থাকে এখানে তেলাকুচো ঝোপের পাশে। তার ধারেপাশে ভয়ে যায় না মানুষ। আবার দিনের আলো ফুটলেই তার চিহ্নমাত্র থাকে না। উবে যায়।’
আলু মুখে নিয়ে জিভের টাকরায় ঝাল নুনের স্বাদ চাখতে চাখতে বাপ্পা বলল, ‘আমাদের পাড়ার ফটিকও দেখেছিল একবার। একানড়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল, গাছের মাথায় বসে। মুখ দেখা যাচ্ছিল না, পাতায় ঢাকা, শুধু বোঝা যাচ্ছিল ওকে দেখছে। তখন নিশুত রাত। ওদের বেড়ালটা মরে গিয়েছিল, কুকুরে খুবলে ওর পেট খেয়ে ফেলেছিল, তাকে এখানে ফেলতে এসেছিল। ফটিক ভয় পেয়ে বেড়াল ফেলে দৌড়। পরদিন গিয়ে আর বেড়ালটাকে খুঁজে পায়নি। একানড়ে নাকি মাছ- মাংস খেতে খুব ভালবাসে।’
হঠাৎ একটা কর্কশ করুণ কান্নার সুর শোনা গেল। পরপর দুইবার। নির্জন জঙ্গলকে চিরে কান্নাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
বাবান কেঁপে উঠল, ‘ও ক্ক-ক্কী?’
‘বক। ‘ শান্তস্বরে উত্তর দিল দেবু। ‘এই সময় ওরা ডাকে’।
‘কিন্তু কাল একটা আওয়াজ শুনেছিলাম রাত্রিবেলা, সেটা বকের ডাক ছিল না।’ বিষ্ণু ধীরে ধীরে বলল।
কেউ কথা বাড়াল না আর। বাবান চোখ তুলে দেখল, কালো বক তার দিকেই তাকিয়ে। এই বকটা ডাকেনি। সকাল হচ্ছে, সকলে উঠে দাঁড়াল। দেবু বলল, ‘পা চালা, তাড়াতাড়ি না গেলে ভাল দর মিলবে না।’
সকলেই যেন থম মেরে আছে। কেউ কথা বলছিল না। সবার পেছনে বাপ্পা, তার বুকের ধুকপুকুনি অন্যেরা শুনতে পাবে এই ভয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছিল। বকের ডাকটা অবিকল তার দাদার গলার মতো। এভাবেই কি চিৎকার করেছিল, যখন চাকাটা দাদার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল?
পরবর্তী পর্ব : ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
Odvut sundor ei uponyas. Bhasha je eto magical hote pare, eto abhijatyo thakte pare tar nirmane, bhaba jay na.
ভালোই এগোচ্ছে। চলতে থাকুক।