অন্ধকার ঘরে জ্যোৎস্না লুটোপুটি খাচ্ছে, ভাঙা আলোতে দেখা যাচ্ছে জানালার একটা পাল্লা ভেজানো, শুধু খাটে কে যেন বসে, কে যেন, তার মুখ ছায়ায় ঢাকা, খুব চেনা লাগছে তবুও, গোটা গড়নটাই–
টুনু এগিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে।
কেউ নেই। শূন্য খাট।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সেখানেই, মাথাটা খালি লাগছে, ঠিকমত চিন্তা করবার ক্ষমতা থাকলে টুনু খতিয়ে ভাবার সুযোগ পেত–তার পেটের কাছ থেকে যে কম্পন উঠে আসছে সেটা কতটা ভয় থেকে আর কতটাই বা শীতের কামড়। কিন্তু টুনুর দৃষ্টি ছিল দেওয়ালের দিকে, যাকে সে অন্ধকারের ভেতরে নিঃশব্দে খুঁড়ে যাচ্ছিল।
দেওয়ালের গায়ের ছোপটা, অন্ধকার আর জ্যোৎস্নার মাখামাখি জাফরি দিয়ে যে টুকরো দেখাটুকু তার নিজস্ব, ছোপটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, তার চোখের সামনেই, গোটা দেওয়াল অধিকার করতে চলেছে, সেখান থেকে এরপর মাটিতে নামবে, ধেয়ে আসবে তার দিকে।
টুনু আলো জ্বালাল।
ছোপ সেই আগের মতোই, কমা-বাড়ার ঊর্ধে নিথর। ঘরও পরিপাটি। মেঝে তকতক করছে, ধুলো বা পায়ের ছাপ, কিছুই নেই, আক্রামের পোস্টার, টেবিল, চেয়ার যথাযথ, টেবিলের বইগুলোও আগের দিনের মতোই গোছানো।
এবং আগের দিনের মতো গোছানো নয়।
আগের দিন টুনু এসে বইগুলো এলোমেলো করে আবার অন্যভাবে সাজিয়ে রেখেছিল। তার মনে আছে হাউ টু রাইট লেটারস রেখেছিল ভূগোল বইয়ের ওপর। সেই সাজানোটা এখন আর নেই। আবার ফিরে গেছে এলোমেলো হবার আগের অবস্থানে।
টুনু এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে কেউ তাকে দেখে যাচ্ছে একমনে। একাগ্র লক্ষ্য করে যাচ্ছে তার প্রতিটা চলাফেরা, তবুও টুনু পেছন ফিরবে না। সে খাতাটা টেনে নিল, নিজের নাম লিখেছিল যার ওপর। মলাট ওলটাল। তার নাম, যেখানে ছিল, নীচে পেনের ঘষায় ঢাকা পড়ে যাওয়া শুভদীপের নামটি সহ।
শুধু তফাত হল, তার নামের ওপর একটা ছবি। খুব কাঁচা হাতের আঁকা হলেও বোঝা যায়, গভীর জঙ্গল, তার মধ্যে দিয়ে উঁকি মারছে একটা বাড়ি। বাড়ি নয়, গম্বুজ, স্বপ্নে যাকে টুনু দেখে আসছে। পেন্সিলে আঁকা হলেও চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। গম্বুজটির মাথার ওপর একটা উড়ন্ত পাখির অবয়ব, শকুন?
টুনু মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকল–এই গম্বুজ, এই জঙ্গল কত চেনা, বহুদিন ধরে যেন দেখে আসছে! যে এঁকেছে, সে কি কিছু জানাতে চায়? কী আছে ওই গম্বুজে? কে আছে? ছোটমামা? লুকিয়ে আছে এতদিন?
নিজের ঘরে সে আসল কী করে, কাল কী হয়েছিল শেষমেশ, কিছুই মনে পড়ছে না। টুনু অনুভব করল, তার গলা হাল্কা ব্যথা করছে, মাথা ধরা, টেম্পারেচারও কি একটু বেশি? কাল ঠাণ্ডায় ঠকঠক কেঁপেছিল, মনে থাকার মধ্যে এটুকুই তলানি হিসেবে, আর স্মৃতিতে ইমপ্রিন্ট হয় আছে গম্বুজের রেখাচিত্র, কিন্তু পরবর্তী সময়টুকু ধূসর অজগরের মতো নিথর ও রহস্যময়, যার পেটের ভেতর লুকিয়ে আছে নিষিদ্ধ ঘরটির এক রাক্ষুসে অজানা, এবং টুনু বাথরুমে যাবার সময়ে দেখল ঘরটি তালাবন্ধ, যেরকম থাকে।
খাটের ওপর বসে স্থিরচোখে লক্ষ্য করে যাচ্ছে, সে হাসল। টুনু স্পষ্ট বুঝতে পারল, নোংরা হলুদ দাঁতগুলো ঢাকা ছিল যে মোটা ঠোঁটের আস্তরণে, তার মাংসপেশি প্রসারিত হচ্ছে ধীরে ধীরে, ছড়িয়ে যাচ্ছে দুই কান পর্যন্ত। খুশি হয়েছে, কারণ টুনু চিনতে পেরেছে এই গম্বুজ, ছুঁড়ে দেওয়া সংকেতগুলোকে কুড়িয়ে নিচ্ছে অভ্রান্ত। তবুও, টুনু পিছু ফিরবে না, তাহলেই নেই হয়ে যাবে।
এবং সে পিছু ফিরল, কারণ এই আকর্ষণ সাঙ্ঘাতিক। কেউ নেই।
শুধু বিছানার মাঝে একটা গর্ত।
টুনু বিছানায় এসে বসল। একটু যেন গরম। কেউ বসেছিল, এখন উঠে গেছে। জানালার ধারে নারকেল গাছের পাতাটি ঝিরঝিরে কাঁপছে, দূরের তালগাছ একলা। ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে স্তব্ধ জঙ্গল অন্ধকার পাহারায়, যার অভ্যন্তরে একটি গম্বুজ, সেখানে ফাঁসি দেওয়া হত। টুনুর চোখ বুজে আসল। এই ঘরে থাকে, সে টুনুকে নিয়ে যেতে চায়, ফাঁসুড়ে উপত্যকার বুকের ভেতর, যেখানে কুচকুচে কালো, তার দিদার সমস্ত ভুলে যাওয়া ও ঔদাসীন্য যেখানে একটি জমাট পাথুরে আকার নিয়েছে যাকে কেটে সুন্দর কোনও মূর্তি কোনওদিনই টুনু বানাতে পারবে না, যতদিন না ছোটমামা আবার ফিরে আসে।
‘টুনু? টুনু? ওঠ বাবা ! দেখ কে এসেছে তোকে দেখতে।’
কেউ তাকে ধাক্কা মারছে। টুনু ধড়মড় করে উঠে বসল। নরম রোদ পায়ের ওপর, মাথা কাজ করছে না ভাল মতো, তবু নিজের ঘরের বিছানাটিকে চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ঘুমজলে ডোবা অর্ধেক শরীর হিঁচড়ে বিছানার বাইরে বার করতে করতে টুনু দাদুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে এসেছে?’
‘তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে বাগানে আয়। তোর এক মামা এসেছে’।
নিজের ঘরে সে আসল কী করে, কাল কী হয়েছিল শেষমেশ, কিছুই মনে পড়ছে না। টুনু অনুভব করল, তার গলা হাল্কা ব্যথা করছে, মাথা ধরা, টেম্পারেচারও কি একটু বেশি? কাল ঠাণ্ডায় ঠকঠক কেঁপেছিল, মনে থাকার মধ্যে এটুকুই তলানি হিসেবে, আর স্মৃতিতে ইমপ্রিন্ট হয় আছে গম্বুজের রেখাচিত্র, কিন্তু পরবর্তী সময়টুকু ধূসর অজগরের মতো নিথর ও রহস্যময়, যার পেটের ভেতর লুকিয়ে আছে নিষিদ্ধ ঘরটির এক রাক্ষুসে অজানা, এবং টুনু বাথরুমে যাবার সময়ে দেখল ঘরটি তালাবন্ধ, যেরকম থাকে। সবকিছুই নিখুঁত ও একঘেয়ে, এমনকি গত রাত পুরোটাই স্বপ্ন ছিল কী না সেটুকুই বা কে বলবে!
বাগানে বেরতে যাচ্ছিল, দেখল বসার ঘরে দাঁড়িয়ে দিদা সেই একইরকমভাবে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। টুনুকে দেখে অস্ফুটে বলল, ‘গুবলু, শীত পড়ছে, মাথার টুপি ভুলো না’।
‘আমি গুবলু নই, টুনু’, বিবর্ণমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। পায়ের পাতা দিয়ে মাটি খামচে ধরতে গিয়ে দেখল অকরুণ ঠাণ্ডা পাথর।
দিদা চমকে উঠল যেন, ‘ওহ, টুনু! টুপি নিয়ে যা বাবা!’
টুনু আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু দিদা আবার অতলে, যেখানে প্রবেশ নিষেধ। মাথাটা অকারণে ঝিমঝিম করছে, খালি লাগছে ভেতরটা। একটু পর ধীরে ধীরে বাইরে আসল, এবং থমকে দাঁড়াল বাগানে এসে।
বাড়ির পেছনে আমগাছের তলায় চেয়ার পেতে বসে আছে সেদিনকার মেলায় দেখা পরেশ নামের লোকটা। চা খাচ্ছিল, টুনুকে দেখে উঠে দাঁড়াল, এবং হাসিটা চোখ অবধি এভাবে ছড়িয়ে ফেলতে তার ছোট্ট জীবনে সে খুব বেশি লোককে দেখেনি, সুতনু সরকার বাদে, যে টুনুকে দেখলেই গত বছর পর্যন্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে এমন একটা মিষ্টি হাসি দিত যে পাবলো বা শিবাজীর যখন তখন গাট্টা মারা অথবা টুনুর টিফিন বক্স ছত্রখান করে ছড়িয়ে দেওয়া সমস্ত চাউমিন, বেঞ্চে মেঝেতে ব্যাগের ওপর, ফিকে হয়ে যেত সে নির্ভার নিষ্ঠুরতা। পরেশ নামের লোকটার শান্ত ভাসাভাসা চোখ, ময়লা গায়ের রং এবং দাঁড়ানোর মধ্যে একটা কিছু ছিল, যা টুনুকে স্বস্তি দিল খানিক, এবং সেও হাসল।
‘সেদিন তোমাকে যখন ওরা মেলা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল, আমিও এসেছিলাম। আজ ভাবলাম, একবার খোঁজ নিয়ে যাই। যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে!’
টুনু এগিয়ে গিয়ে উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। হাওয়ায় মিঠে আরাম সত্বেও মাঝেমাঝেই যে শীত ও গা ব্যথা, সেটুকু অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। আর কেউ নেই বাগানে। এই লোকটা অচেনা হলেও তার খোঁজ নিতে এসেছে, মনখারাপগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো সরে যাচ্ছিল, ‘আমি তো ভাল হয়ে গেছি।’
‘আসলে পাঁচু ঠাকুর আমাদের খুব চালু দেবতা। দেখতে অমন বলে বাচ্চাকাচ্চারা ভয় পায়। কিন্তু তাদের রোগ সারিয়ে দেওয়া, বাঁচিয়ে তোলা, সুস্থ করা, সবই ওই একজন। এ অঞ্চলে পাঁচু ঠাকুরের খুব প্রতাপ।’
‘কেন? এখানে কি বাচ্চাদের খুব অসুখ হয়?’
পরেশমামা হাসল আবার, ‘চলো আমরা মাঠ থেকে ঘুরে আসি একটু’।
মাঠে এখান ওখান দিয়ে দুই একজন যাতায়াত করছে, দূরে ঘাস খাচ্ছে দুটো গরু, জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটা লোক মাথায় কাঠের পাঁজা নিয়ে বেরিয়ে এল, তালগাছকেও কি নিরীহ লাগছে এখন! হালকা রোদ্দুর মাখামাখি হয়ে এখন সবুজের ওপর, ফলত এ চরাচরে বিভীষিকার লেশমাত্র উপাদান থাকল না। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিল তারা, এটা ওটা টুকটাক কথা বলছিল। টুনুর মনে হল একে বলা যায়। ‘একটা কথা বলব?’
‘হ্যাঁ, বলো না !’
‘তুমি ছোটমামাকে চিনতে?’
পরেশ টুনুর দিকে একবার তাকাল। ভুরুটা কুঁচকে গেল কি? মাথা নাড়াল, ‘হুঁ’।
‘আমি ছোটমামার ঘরে ঢুকেছিলাম। ওখানে কেউ থাকে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে আমাকে দেখে যাচ্ছে।’
ভয় ছিল যে উড়িয়ে দেবে, অথবা বলবে টুনুর কল্পনা। কিন্তু পরেশ দাঁড়িয়ে পড়ে টুনুর কাঁধে হাত রাখল। ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘দেখেছ কি কিছু? কবে দেখলে?’
খাটের ওপর বসে স্থিরচোখে লক্ষ্য করে যাচ্ছে, সে হাসল। টুনু স্পষ্ট বুঝতে পারল, নোংরা হলুদ দাঁতগুলো ঢাকা ছিল যে মোটা ঠোঁটের আস্তরণে, তার মাংসপেশি প্রসারিত হচ্ছে ধীরে ধীরে, ছড়িয়ে যাচ্ছে দুই কান পর্যন্ত। খুশি হয়েছে, কারণ টুনু চিনতে পেরেছে এই গম্বুজ, ছুঁড়ে দেওয়া সংকেতগুলোকে কুড়িয়ে নিচ্ছে অভ্রান্ত। তবুও, টুনু পিছু ফিরবে না, তাহলেই নেই হয়ে যাবে।
এক এক করে সমস্ত বলে গেল টুনু, ততক্ষণ পরেশ একটাও কথা বলেনি। সব শুনে অনেকটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা, ‘টুনু, তুমি কেন এসেছ এখানে?’
‘আমি, মানে, আমি তো মা-কে ছেড়ে আসতে চাইনি… ‘
‘তুমি চলে যাও টুনু। এখানে থাকলে তোমারই বিপদ হবে।’
‘কী বিপদ?’ গলা কেঁপে গেল টুনুর।
‘আমি ঠিক বোঝাতে পারব না সবটা। হয়ত তোমাকে বলা উচিতও হচ্ছে না। কিন্তু আমার নিজের মনে হয়, বাচ্চাদের সবসময় বাস্তবটা থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখলে তার ফল ভাল হয় না। মাঝে মাঝে বড়দের মতো ভেবে নেওয়াই ভাল। অবশ্য খুব বেশি বুঝি না,’ হালকা হাসল পরেশ, ‘আমি গোরুর ডাক্তার, জানো তো? গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গোরু ছাগলদের ইনজেকশন দিয়ে বেড়াই।’
‘ওই গোরুগুলোকেও দিয়েছ?’ হাত তুলে নির্দেশ করল টুনু।
পরেশ হেসে ফেলল, ‘হয়ত দিয়েছি। ওদের তো মানুষের মতো নাম থাকে না! আর আমি সরকারি হেলথ সেনটারে বসি। সেখানে রোজ কত কত পশুপাখি আনা হয়, ভাবতেও পারবে না।’
পরবর্তী পর্ব : ১৯ জানুয়ারি, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
এবার একটু রহস্যের ছোঁয়া লেগেছে।
বাংলাভাষায় এরকম লেখা এর আগে পড়িনি। চিরাচরিত পাল্প-ফিকশনকে কাব্যিক আখ্যানের জ্যাকেটে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। অনবদ্য!