মেলায় এসেও টুনুর বারবার মনে পড়ছিল দিদার কথা। তার দুইপাশে বিশ্বমামা আর রীণামামিমা, যার কোলে গুবলু নেই, রেখে আসা হয়েছে দিদার কাছে। মেলাটি একটি খোলা প্রান্তরে হচ্ছে, যার পাশে বিরাট পুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তা চলে গিয়েছে গ্রামের ভেতর, আর গোটা অঞ্চলটাকে ঘিরে আছে ভুতুড়ে জঙ্গল। পুকুরের শেষপ্রান্তে মন্দির, যার মুঠো ছাড়িয়ে মেলার চৌহদ্দি ছড়িয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। অনেক লোক, একদিকে নাগরদোলা, ঘুর্ণি, তাদের ঘিরে ফুচকা ঘুগনি এগরোলের স্টল। অন্যদিকে ম্যাজিক ঘর। লোকজন লাইন দিয়ে ঢুকছে। সার সার দোকান, কোথাও স্তূপীকৃত মণ্ডা মিঠাই গাঁটিয়া বাদামভাজাদের তেল চকচকে গায়ে টিউবের আলো পিছলে যাচ্ছে, তার পাশেই বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটাচ্ছে কচিকাঁচার দল, একটু দূরে স্টেজ বাঁধা হয়েছে, কলকাতা থেকে শানুকণ্ঠী এসে গান গাইবে। কিন্তু টুনুর বারবার মনে পড়ছে, দিদা বাড়িতে একলা, জানালা ধরে দাঁড়িয়ে, তবু তার জন্য নয়।
‘কী গো, বন্দুক ফাটাবে নাকি?’ জিজ্ঞাসা করল বিশ্বমামা।
‘না, আমার ভাল লাগে না।’
‘তাহলে কী ভাল লাগে তোমার?’
‘উম–জানি না।’
‘চলো, আমরা ম্যাজিক দেখি। তারপর চাউমিন খাওয়াব তোমাকে।’
হঠাৎ চমকে উঠল টুনু, কারণ পথ আগলে দাঁড়িয়েছে একটা পাগল। নোংরা, সারা গায়ে ঘা, জটাভর্তি, উরুর কাছ থেকে একটা পা নেই, আর তীব্র চোখের দৃষ্টি। যেন আগুন জ্বলছে। টুনুর দিকে তাকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে এল।
‘ভয় পেও না, কিছু করবে না।’ বিড়বিড়িয়ে বলল বিশ্বমামা, তার চোখের দৃষ্টি স্থির।
রীণামামিমা টুনুকে নিজের কোলের কাছে জাপটে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তাড়াও না! আগেও একদিন বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল। গুবলুকে দেখছিল! কেমন করছিল গায়ের মধ্যে।’
অদ্ভুত হাসি দিল পাগলটা, সামনের দুটো দাঁত ভাঙা, টুনু মুখ গুঁজে দিল রীণামামিমার কোমরের কাছে, সেটা শুধুমাত্র যে ভয়ে তা নয়, ভয় তেমন করছিল না, আসানসোলের স্কুল যাবার রাস্তায় এরকম পাগল সে অনেক দেখেছে, কিন্তু রীণামামিমার সস্তা সিল্কের শাড়ি থেকে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ ভেসে আসছিল, যাতে মনে হচ্ছিল এভাবেই যদি কাটিয়ে দিতে পারে গোটা সন্ধে।
পাগলটা এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসছিল, বিশ্বমামা রাস্তা আটকে দাঁড়াল, ‘বাড়ি যা।’
পাগল থমকে বিড়বিড় করল কিছু, বিশ্বমামার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ যেন ক্রোধ ফুটে উঠল দুই চোখে, এবং জান্তব একটা গর্জন দিল। বিশ্বমামার দুই হাতের মুঠি শক্ত হয়ে যাচ্ছিল, তখন পাগলটার কাঁধ চেপে ধরল আরেকজন, বিশ্বরই বয়সী, মাঝারি উচ্চতা, শ্যামলা রং, দাড়িগোঁফ কামানো মুখ, ভাসা ভাসা চোখ। আলতো করে জড়িয়ে ধরল, আর অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেল পাগলটা। লোকটা পাগলটাকে ধরে ধরে রাস্তার অন্যপ্রান্তে নিয়ে গেল। টুনু দেখল, বিশ্বমামার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, চোখ যেন হালকা লাল, তখনো মুঠি খোলেনি। লোকটা ফিরে এল আবার তাদের কাছে, বিশ্বর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চিন্তা করিস না। মাঝে মাঝে প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে ওর। তখন লোক দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’
‘আমার ঘরেও চলে এসেছিল একদিন। সামলা, না হলে কিন্তু মারধোর খাবে।’
টুনুর দিকে চোখ পড়তে লোকটা থমকে গেল, ‘মাম্পিদিদির ছেলে? শুনেছিলাম, এসেছে এখানে।’
‘হ্যাঁ।’
হাসি মুখে লোকটা ঝুঁকল টুনুর দিকে, ‘আমি তোমার আরেকটা মামা, বুঝলে? আমার নাম পরেশ। তোমার নাম কী? ‘
‘সৌভিক সিনহা’, লোকটাকে টুনুর ভাল লাগল।
পাঁচু ঠাকুরের পিঠ দিয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে একটা তালগাছ, টুনু দেখতে পাচ্ছিল জ্বরাসুর আর পাঁচু ঠাকুর মিলে সেই তালগাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে, ওপরে, ওপরে, আরো অনেক ওপরে, যেখানে একলা উড়ে বেড়াচ্ছে একটা শকুন, আর গোটা গাছটার শরীরে চাপ চাপ রক্ত, টপটপ করে সেই রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে জ্বরাসুরের পা বেয়ে, ধেয়ে আসছে টুনু যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই মাটিতে
‘চলো চলো, এখানে দাঁড়িয়ে আর কত সময় নষ্ট করবে!’ দুম করেই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল বিশ্বমামা, এদিকে এতক্ষণ কত আয়েসি ভাবে ঘুরছিল, ‘ম্যাজিক দেখতে হবে না? আসি রে, পরে দেখা হবে’।
পরেশ নামের লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিশ্বমামার দিকে তাকিয়ে, কিছু বলবে বলে ভাবছে হয়ত, কিন্তু শুধু ঘাড় নাড়ল হাল্কা করে, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে, যেমনভাবে এসেছিল তেমন করেই আচমকা।
‘এ কে গো? দেখিনি তো আগে! বন্ধু তোমার?’ প্রশ্ন করল রীণামামিমা।
‘নাহ, চেনা হলেই কি বন্ধু হয়! দেখোনি কারণ এ গ্রামের না, মুচিবেড়েতে থাকে। যাক গে, চলো এবার।’
‘ও মা, চলো বললেই হল? তার আগে মন্দিরে যাব না একবার? ঠাকুরের মুখই তো দর্শন করলাম না এখনো।’
তিনটে ঘর নিয়ে মাটির মন্দির, যার মধ্যিখানের ঘরে মূল দেবতা। একপাশের ঘরে বসে নাপিত চুল কাটছে বাচ্চাদের, অপর ঘরটি বিশ্রামকক্ষ। ঢোল বাজাচ্ছে একজন, তাকে ঘিরে ভিড়। দুর্বল, শীর্ণ শিশুদের নিয়ে আসা হয়েছে, যাদের অনেকেরই পোলিও বা রিকেট, পা দুটো সরু কাঠি, কাঁদছে অবিশ্রান্ত, মাথা ন্যাড়া। পেছনের বেলগাছটিতে মানতের অসংখ্য ঢিল বাঁধা হয়েছে। গাছের ডালে ফুলের মালা জড়ানো, নীচে রাখা সিন্নির বাটি। ধুনোর গন্ধে জায়গাটা সমাচ্ছন্ন। দণ্ডি দিচ্ছেন দুই মহিলা। মন্দিরের রোয়াকে সারি সারি থালা, স্তূপীকৃত লাড্ডু, বাতাসা, চিনির সন্দেশ ও পাটালি। দু’জন পুরুত চেহারার লোক বসে আছে সেখানে। এক এক করে ভক্তরা ভেতরে ঢুকছে, ঠাকুরের মূর্তির সামনে। বিশ্বমামা টুনুর দিকে ঝুঁকে পড়ে কানে ফিসফিস করল, ‘ওই যে বাঁদিকের লোকটাকে দেখছ, ফর্সা সুন্দর চেহারা, মিষ্টির থালা পাহারা দিচ্ছে, ও আগে ডাকাত ছিল। নাম মধু। ওর এক বিঘত লম্বা লেজ আছে। ওর বাবারও লেজ ছিল।’
টুনু অবাক হয়ে তাকাল। লেজটাকে দেখা যাচ্ছে না যদিও। মধু ডাকাত টুনুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল, তারপর হাত জড়ো করে নিচু হয়ে প্রণাম করল তাকে। হাসি পেল টুনুর, কেউ তাকে এর আগে প্রণাম করেনি এমন।
রীণামামিমা যখন বলল, ‘চলো, ভেতরে ঢুকি, পাঁচুঠাকুরকে একবার দর্শন করে যাই,’ টুনুর ইচ্ছে করছিল না, কারণ লাইন দিতে হবে। সে ভাবছিল ম্যাজিক দেখবে, অথবা ফিরে যাবে বাড়ি, যেখানে অন্ধকার ঘরে দিদা, কিন্তু রীণামামিমা তার হাত শক্ত করে ধরে আছে , ফলে আরো পনেরো মিনিট কেটে গেল শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, অবশেষে মন্দিরের অভ্যন্তর।
‘নমো করো বাবা ! ভারী জাগ্রত দেবতা।’ দুই হাত কপালে ঠেকাল রীণা। কিন্তু টুনুর সেই অবকাশ আর মিলল না।
কালো রঙের মূর্তি, বাঘছাল পরিহিত, ভয়ঙ্কর দুটো চোখ, দুই কষ থেকে দুটো দাঁত বেরিয়ে আছে, মাথায় জটা চূড়া আকারে বাঁধা, হাতে বালা, গলায় ও হাতে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা, কান অবধি বিস্তৃত গোঁফ, ত্রিশূল, পাশে গাঁজার কলকে, চোখ দেখে মনে হয় আগুন জ্বলছে। পাঁচু ঠাকুরের পাশেই পাঁচি ঠাকরাণি, মহার্ঘ্য শাড়ী, গলায় ফুলের মালা, কষ থেকে দাঁত বেরিয়ে। পাঁচু ঠাকুরের পাশে আরেক ভয়াল, বিশ্বমামা কানে কানে বলল, ‘জ্বরাসুর’, যার তিনটে মাথা, নয়টা চোখ, ছয়টি হাত ও তিনটি পা, গায়ের রং ঘন নীল, ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ, বড় বড় দাঁত, মূর্তির পাশে ঘোড়া ও বাঘ। জ্বরাসুরের পায়ের কাছটায় টকটকে লাল রঙের মাটি, রক্ত।
বাইরে ঢাক বাজছিল, মানুষের চিৎকার, নাগরদোলার আওয়াজ, মাইকের ঘোষণা, কিন্তু টুনুর কান ভোঁ ভোঁ করছিল, কিছুই ঢুকছিল না, সে আচ্ছন্নের মতো তাকিয়েছিল পাঁচু ঠাকুর আর জ্বরাসুরের দিকে। কখনো দুটো মূর্তি মিলে গিয়ে একটা মূর্তি হয়ে যাচ্ছে, তার পরেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে ছিটকে গিয়ে। পাঁচু ঠাকুরের পিঠ দিয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে একটা তালগাছ, টুনু দেখতে পাচ্ছিল জ্বরাসুর আর পাঁচু ঠাকুর মিলে সেই তালগাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে, ওপরে, ওপরে, আরো অনেক ওপরে, যেখানে একলা উড়ে বেড়াচ্ছে একটা শকুন, আর গোটা গাছটার শরীরে চাপ চাপ রক্ত, টপটপ করে সেই রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে জ্বরাসুরের পা বেয়ে, ধেয়ে আসছে টুনু যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই মাটিতে, রীণামামিমা নেই, দিদা নেই, চেনা কেউ নেই কোথাও, ঘন রাত্রি নেমে আসছে দেবমূর্তির মাথায়, নোংরা থকথকে কালো মেঘের দল টুনুকে ঘিরে ধরছে, পাঁচু ঠাকুরের গলার ঝকমকে হারের পেছনেই লুকিয়ে আছে নিষ্ঠুর কোনও উন্মাদের রাক্ষুসে অন্ধকার, যার মাথায় জটা ও চোখে পোষা কুকুরের মতো প্রহরারত বিদ্যুৎ এবং কাঁধের ঝুলিতে রক্তাক্ত কান যাদের স্পর্শ দেওয়ালের ছোপটার মতো তলতলে ও পচা।
আর্ত চিৎকার তার চারপাশে চৌচির হয়ে ফেটে পড়ছিল, জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে টুনু অবাক হয়ে সে আর্তনাদের উৎসকে খুঁজেওছিল।
পরবর্তী পর্ব : ২২ ডিসেম্বর ২০২০, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
অনবদ্য অভিব্যক্তি।