পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসাই শ্রেয়, বেরিয়ে যাওয়া উচিত। টুনু ঢোক গিলল। চারপাশে চোখ চালাল আবার। হা হা ঘর তার দিকে অপলকে– আর তখন জানালার কাছ থেকে একটা টিকটিকি টিক টিক করে উঠল, এবং টুনুর চোখ চলে গেল জানালা পেরিয়ে মাঠের দিকে।
দিদা, মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। হাতে ধরা থালাটির ওজন বেশ ভারীই, যা মনে হচ্ছে দূর থেকে। কোথায় যাচ্ছে? টুনু এগিয়ে এসে জানালার গরাদে মুখ চেপে ধরল। ফাঁকা মাঠের মধ্যে একমাত্র দিদা এইটুকখানি হয়ে দূরে চলে যাচ্ছে, নিস্তব্ধ হয়ে যেন তাকে দেখে যাচ্ছে ঝোপঝাড় গাছপালা। বস্তুত, তার মামাবাড়ি কেন এরকম বিরাট মাঠের মধ্যে একলা, পাশের বাড়িতেও যেতে হলে হেঁটে তিন চার মিনিটের রাস্তা, টুনুর অবাকই লেগেছিল, কারণ আসানসোলের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এতটা একাকীত্ব তার কল্পনাতীত। দাদু দিদাও কারোর সঙ্গে মেশে না তেমন, এ বাড়িতে বাইরের মানুষের পদার্পণ নেই বিশেষ। দিদা কি কোনও প্রতিবেশীর বাড়ি যাচ্ছে? কিন্তু ওইদিকে তো কেউ থাকে না! যুগীপাড়া বলে একটা জায়গা আছে বটে, দাদু বলেছিল একবার, মাঠের অন্যপ্রান্তে, কিন্তু সেটা উল্টোদিকে। থালা হাতে টুনু বয়স্ক মহিলাদের আগে হাঁটতে দেখেছে, সেটা পুজোর সময়ে। থালায় থাকে মিষ্টি, নৈবেদ্য, ফুল। এই হাঁটা অন্যরকম।
হাঁটতে হাঁটতে দিদা তালগাছের গোড়ায় এসে থামল। মনে মনে রেগে উঠল টুনু–তাকে মানা করে নিজে এখন–দিদা ঝুঁকে হাতের থালাটা রাখল গাছের গোড়ায়। জঙ্গল একটি আদিম রোদছবি হয়ে তিরতির কাঁপছে। এখান থেকে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে থালায় ভাত, আরো দুটো বাটি আছে। বাটিতে কী আছে দেখা যায় না। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ, ওপরদিকে তাকাল যেন। ফেরবার পথে হাঁটা লাগাল তারপর।
টুনু পিছিয়ে এল জানালা থেকে। ওখানে কে আছে, যাকে দিদা খাওয়াচ্ছে? কিন্তু কেউ তো খেতে এল না? থালা বাটি যেমন কে সেই পড়ে আছে। আশেপাশে এমন কেউ নেইও যে খেতে আসতে পারে। কুকুর বেড়ালের জন্য থালায় করে এত ভাত নিয়ে যায় না কেউ! তা ছাড়া, এই বাড়িতেই কয়েকটা বেড়াল আছে, রোজ দাদু দুপুরবেলা তাদের জন্য মাছের কাঁটা, ছিবড়ে, কখনো মহার্ঘ্য একটু পেটির জায়গা, ভাত, দুটো রুটি এসব মেখে একটা মণ্ড বানায় বেশ বড়, এবং ভাগ ভাগ করে দেয় বেড়ালদের দলের মধ্যে। টুনু এর আগেও দুপুরবেলা দিদাকে বাড়ি থেকে বেরতে দেখেছে, তখন অত কিছু খেয়াল করেনি, আজই প্রথমবার পুরোটা চোখে পড়ল। টুনু দেওয়ালের দিকে তাকাল। ছোপটা নির্বাক তাকিয়ে আছে, বিছানা পরিপাটি, টেবিলে এককণাও ধুলো লেগে ছিল না, শুধুই শুকনো হাওয়া অবসাদের মতো আটকে আছে ঘরটার বুকে, ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে তবু বেরতে পারছে না।
ঘর থেকে বেরোবার আগে আরো একবার চোখ চালাল চারপাশে–সব শান্ত, নিঝুম। সাবধানে দরজা বন্ধ করে টুনু নীচে নেমে এল। দিদা এখন বাড়ি ঢুকবে। তাই সামনের গেটের কাছে যাওয়া চলবে না, সে ঘুমোয়নি দেখলেই বকতে শুরু করবে আবার। কিন্তু অদ্ভুত ধাঁধা লাগছে দিদাকে নিয়ে, যার উত্তর না পেলে স্বস্তি পাচ্ছে না সে কিছুতেই।
বিশ্বমামার ঘরটি বাগানের যে দিকে, সেখান থেকে ঢোকবার গেট দেখা যায় না। বিশ্বমামা পেছনের বাগান থেকে আসছিল, হাতে প্রচুর ডিমের খোলা, এগুলো পুড়িয়ে মশা মারা হয়, দেখেছে টুনু। দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘কী গো, ঘুমোওনি?’
টুনু হাত তুলল, ‘দিদা, তালগাছের নীচে। ওখানে ভাত রাখল। কেন?’
বিশ্বমামা থমকে গেল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুমি কী করে দেখলে?’
‘জানালা দিয়ে। দিদা কী করতে গেছিল ওখানে?’
একটু চুপ করে থেকে বড় নিশ্বাস ফেলল বিশ্বমামা, তারপর বাড়ির রোয়াকে গিয়ে বসল। টুনুকেও হাতছানি দিয়ে বসার ইশারা করল।
ছোটমামার জন্য সবাই কেমন মনখারাপ করে, কত দামি একটা লোক ছিল যেন! এই যেমন টুনুকে ভুলেই গেছে এখন। আর একটুও কি কথা বলবেই না? তাহলে খবরটা দিতেই হয়, হয়ত বকবে, কিন্তু তবুও, এই চুপচাপ থাকাটা যেন অসহ্য! ‘বিশ্বমামা, আজ আমি ছোটমামার ঘরে ঢুকেছিলাম।’
‘টুনুবাবু, তুমি বড় হলে সব বুঝবে। তোমার দিদা ভাবে যে তোমার মামা ওই তালগাছেই আটকে আছে। কেন ভাবে, কী হয়েছিল, সেসব বুঝতে পারবে না এখন! তুমি তো ছোট! কিন্তু ভাবে বলেই রোজ গিয়ে খাবার রেখে আসে, যাতে তোমার মামার খিদে না পায়।’
‘কিন্তু মামা কি ওখানে আছে?’
‘থাকতেও পারে। কে যে কখন কোথায় লুকিয়ে থাকে, বলা তো যায় না!’
‘তার মানে,’ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল টুনু, ‘একানড়ে মামাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তালগাছে আটকে রেখেছে?’
‘মাম্পিদিদির কি কোনও আক্কেল নেই, ভাইয়ের গল্প করতে গেছে! এত ছোট বাচ্চাকে এসব কেউ বলে?’ কিছুটা যেন বিরক্ত হয়েই আপনমনে বলল বিশ্ব, তারপর সামলে নিল নিজেকে, ‘হ্যাঁ, তা বলতে পারো। একানড়ে ওখানে ধরে রেখেছে। তোমার দিদা বিশ্বাস করে যে ছেলে ফিরে আসবে। তাই ছেলের ঘর পরিপাটি করে সাজায়, হপ্তায় হপ্তায় ধুলো ঝাড়ে, বই খাতায় কাউকে হাত লাগাতে দেয় না, আর রোজ গিয়ে খাবার দিয়ে আসে। বুঝলে?’
‘তাহলে ছোটমামা ফিরছে না কেন? ছোটমামা ফিরলেই তো দিদা ভাল হয়ে যাবে! আর আনমনা থাকবে না। আমি দুপুরবেলা ভাত না খেলেও ভুলে যাবে না, বরং জোর করে খাওয়াবে। মা বলেছিল, দিদা কী সুন্দর কইমাছ রান্না করে! আমি গেলে রান্না করবে। ছোটমামা যদি ফিরে আসে, তাহলে কি দিদা কইমাছ রাঁধবে?’
হাসল বিশ্বমামা, ‘তোমার মামা যেখানে গেছে, সেখান থেকে তো ফেরা যায় না বাবা!’
না বুঝতে পেরে টুনু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বিশ্বমামার চোখ কেমন বিষণ্ণ, আবার সুতনু সরকারকে মনে করিয়ে দেয়, সুতনুর চোখ দেখলে মনে হত জলে টুপটুপে। বিশ্বমামা নিঝুম হয়ে বসে আছে নিজের চিন্তায়। তার কালো ধারালো মুখ, খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি, ময়লা পাজামা গুটিয়ে পরা–ছোটমামার জন্য সবাই কেমন মনখারাপ করে, কত দামি একটা লোক ছিল যেন! এই যেমন টুনুকে ভুলেই গেছে এখন। আর একটুও কি কথা বলবেই না? তাহলে খবরটা দিতেই হয়, হয়ত বকবে, কিন্তু তবুও, এই চুপচাপ থাকাটা যেন অসহ্য! ‘বিশ্বমামা, আজ আমি ছোটমামার ঘরে ঢুকেছিলাম।’
বিশ্ব চমকাল না। ভুরুটা কুঁচকে গেল সামান্য। ওটুকুই–‘কী করে বুঝলে কোনটা ছোটমামার ঘর?’
‘খাতায় নাম ছিল তো, লেখা। মা বলেছে, ছোটমামার নাম শুভদীপ।’
বিশ্ব আবার চুপ। যেন ভাবনার অথৈ ঢেউ অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। টুনু মরীয়া হয়ে বলল, ‘ঘরটায় কেউ থাকে মনে হল। আমার ভয় করছিল।’
এবার অবাক হয়ে ঘাড় ফেরাল বিশ্ব, ‘কী সব বলছ ! কে থাকবে? ওই ঘর তো তালাবন্ধ।’
‘না’, টুনু বুঝতে পারছিল না কীভাবে বলবে, ‘আমার মনে হচ্ছিল, ঘরটায় এখনো কেউ থাকে। আমাকে দেখছিল, আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিল।’ গলাটা সামান্য কেঁপে গেল তার, ‘ছোটমামা?’
‘টুনু’, বিশ্ব তার দিকে ঝুঁকে চোখে চোখ রাখল, ‘তুমি আর ছোটমামার ঘরে ঢুকো না। তোমার দিদা জানলে খুব রাগ করবে। ওই ঘরে কারোর ঢোকা বারণ।’
‘কিন্তু কেউ তো থাকে–‘
‘কেউ থাকে না বাবা !’ বিশ্ব স্নেহভরে টুনুর কাঁধে হাত রাখল। ‘ওগুলো তোমার মনের ভুল। কিন্তু তুমি ভয় পেয়ে গেছ, আবার গেলে আবারো ভয় পাবে। তাই বলছি, আর যেও না ওখানে।’ একটু থেমে হাসল, ‘মামার বাড়ি এসেছ, এখন তো তোমার আনন্দ করার সময়! আজ সন্ধেবেলাই মেলায় যাব আমরা। এখন একটু ঘুমিয়ে নাও গে।’
পরবর্তী পর্ব : ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, সন্ধে ছটা।
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
টানটান গদ্য। কোনদিকে মোড় নেয় কে জানে!
বেশ এগোচ্ছে। কোনদিকে মোড় নেয় কে জানে!